সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩১


যেভাবে উ.কোরিয়ায় মেয়েদের যৌনদাসী বানানো হয়


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০১৮ ০০:৩৩

আপডেট:
১০ মে ২০২৪ ০৬:২০

যেভাবে উ.কোরিয়ায় মেয়েদের যৌনদাসী বানানো হয়

উত্তর কোরিয়ার নেতাদের মনজয় করতে একজনকে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হতো। অপরজনকে মাত্র ৪ বছর বয়সেই চীনে পাচার করে দেয়া হয়। এরপর নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এখন তারা পৌঁছেছে নিউজিল্যান্ডে। সেখানে তারা স্বপ্ন খুঁজছে। তাদের উত্তর কোরিয়ার ফেলা আসা দিনগুলোকে ‘জাহান্নাম’ বলে দাবি করেছেন এই দুই তরুণী। 



পালিয়ে আসে ওই দুই তরুণী সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রভাবশালী গণমাধ্যম এনজেডহেরাল্ড’কে জানিয়েছে তাদের যৌনদাসী হওয়ার লোমহর্ষক বর্ণনা।



তারা হলেন- ২৪ বছর বয়সী বোরা চো এবং সু পার্ক (২৬)। বর্তমানে তারা নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডের একটি গোপন স্থানে বাস করছেন। সেখানে তারা খ্রিস্টান মিশনারির ‘ইওর নেইবার চ্যারিটি ট্রাস্ট’ অধীনে পাঁচ জন বাস করছেন।



চো’র ইচ্ছা সে বাইবেলের শিক্ষক হবেন আর পার্ক চান নার্স হতে। তারা কিম জন উনের দেশকে ‘জাহান্নাম’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। চো’য়ের বয়স যখন ১৪ তখন তার উচ্চতা ছিল ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি। আন্তঃস্কুল সুন্দরী প্রতিযোগিতায় সুদর্শনী চো’কে উত্তর কোরিয়ার সরকার ‘জাতীয় বধূ’ হিসেবে নির্বাচন করতো।



সম্প্রতি পিয়ংইয়ং চ্যাংয়ে হওয়া শীতকালীন অলিম্পিক প্রতিযোগিতায় চেয়ারলেডার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে মূলত দেশটিতে যাদেরকে যৌন ব্যবসার জন্য বাধ্য করা হয় তেমন ২৩০ জনকে নিয়ে আসা হয়েছিল।  



চো’র জন্ম দেশটির হামগায়োং প্রদেশের চোংজিন শহরে। চো বলেন, ‘একদিন সরকার থেকে আমাদের স্কুলে এসে বললো স্কুলের যে মেয়েরা লম্বা ও সুন্দরী তাদের আমরা বাছাই করবো। ভবিষ্যতে তাদের সরকার থেকে সুন্দর চাকরি দেয়া হবে।’



চো বলেন, ‘সেখানে অনেক মেয়ের মত আমাকেও পছন্দ করা হলো। যেহেতু আমি ছিলাম অল্প বয়সের; খুব খুশি হয়েছিলাম।’ 



কিন্তু, সরকারি লোকজন খোঁজ নিয়ে দেখলো আমার দাদার পূর্বপুরুষের জন্ম চীনে আর আমার মায়ের জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ায়। আর উত্তর কোরিয়ায় এমন বংশের লোকজনকে দেশের শত্রু হিসেবে দেখা হয়।







দেশে ভালো চাকরি বা উন্নত জীবন পেতে হলে কিমের দলের সদস্য হতে হবে। তাছাড়া তাদের অনুগত হতে হবে উল্লেখ করে চো বলেন, ‘কারো পরিবারের সঙ্গে বিদেশিদের কারো সংযোগ থাকলে তারা কিমের দলের সহানুভূতি পাবে না। আর তাদের সহানুভূতি না পেলে চাকরিও পাবে না। সুতরাং, আমার সাথে যারা নির্বাচিত হয়েছে সেই মেয়েরা রাজধানীতে গিয়ে অভিনেত্রী, কণ্ঠশিল্পী বা সেনাবাহিনীতে চাকরি নেয়ার জন্য প্রশিক্ষণ নিলো।’



‘আর যারা ক্যাম্পে গিয়ে পিয়ংইংয়ের টিকিট পেল না। তারা আর বাড়িতে ফিরতে পারবে না। যে ক্যাম্পে আছে সেখানেই পাথর ভাঙা, লেবারি কিংবা রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার কাজে যেতে হবে। এর আড়ালে তাদের মূলত রাজনীতিকদের মনজয় করতে হবে’ 



‘ফলে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম পালিয়ে অন্য দেশে যাবো। সেটাই হলো পরিবারের মাধ্যমে এক দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে দক্ষিণ কোরিয়ায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অধিকাংশ দালালই মাদকাসক্ত, তারপরও ভরসা রাখতে হলো। তাছাড়া আর কোনো পথ ছিল না’ যোগ করেন তিনি।



দুই বারের চেষ্টায় উত্তর কোরিয়া ও চীনের মাঝের টুমেন নদী পাড়ি দিলাম। সেই নদীতে ছিল বড় বড় ঢেউ এবং খুবই খরস্রোতা। প্রায় নদীই পাড়ি দিয়েছি সাঁতরিয়ে।’



এদিকে, চো’র মা দক্ষিণ কোরিয়ায় একজন দালাল ঠিক করেছে মেয়েকে তার কাছে নেয়ার জন্য। কিন্তু মাঝ পথেই দালাল অন্য এক দালালের কাছে বেঁচে দেয়। ফলে আর তার মায়ের কাছে ফেরা হয়নি।



অপরদিকে, সু পার্ক বয়স যখন তার ১৭ বছর মাকে খোঁজার জন্য চীনে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু সে দালালের দ্বারা প্রতারিত হয়। মাঝপথে তাকে অন্য এক দালালের কাছে বিক্রি করে দেয়। এই শর্তে যে পার্ক ২৪ ঘণ্টায় থাকা ও খাওয়ার বিনিময়ে বাড়ির পরিচারিকার কাজ করবে।



তার মা কয়েক বছর আগে হারিয়ে গেছে তার বিশ্বাস চীনে গেলে মাকে খুঁজে পাবে। সে বলে উত্তর কোরিয়ার প্রতিটি দিন মনে হয়েছে ‘জাহান্নামে বাস করছি’।



পার্ক যেখানে যে শহরে জন্মগ্রহণ করেছে সেই হোইরয়ং শহরে কিম জং উনের দাদিরও জন্ম। পার্কের শখ ছিল সে ফুটবলার হবে। কিন্তু তার মা চীনের বংশধর হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া, সেনাবাহিনীতেও কাজ করার ইচ্ছে ছিল তার।







সে যখন উত্তর কোরিয়া থেকে পালাচ্ছিল তার বাবা ও ভাইকে তখন জানায়নি। ‘যখন দালাল এসে বলল সে মাকে খুঁজতে সহায়তা করবে তখন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে তার সঙ্গে বেরিয়ে পরি। যখন আমি বুঝলাম দালাল মিথ্যা কথা বলেছে, আমাকে বেতন ছাড়াই পরিচারিকা হিসেবে বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে তখন আমি অসহায় হয়েছিলাম, কিছু করার ছিল না’ বলেন পার্ক।



‘দক্ষিণ কোরিয়ার একটি পরিবারে পরিচারিকা হিসেবে চার বছর কাজ করার পর আমাকে কোনো টাকা ছাড়াই বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হলো’



এক পর্যায়ে চো এবং পার্কের দেখা হয়। তারা বলেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়াতে এক মুঠো খাবার জোগার করতে দিয়ে অনেক বাজে কথা শুনতে হয়েছে। যেমন- ‘খাবার না গাছের বাকল খাবে?’ ‘উত্তর কোরিয়ানরা তো খুবই ক্ষুধার্ত, তাদেরকে মাটিও খেতে দেয়া যাবে না।’ ইত্যাদি ইত্যাদি কথা।



এক পর্যায়ে চো বাথরুমের খণ্ডকালীন চাকরি নিলো। এভাবে কয়েকমাস চলে গেলো। এরই মধ্যে খ্রিস্টান মিশনারি নারা লীর সঙ্গে পরিচয় হয় তিনিই তাদের দুইজনকে উন্নত জীবনের সন্ধান দেখিয়ে নিউজিল্যান্ডে নিয়ে আসে।



লি বলেন, ‘বর্তমান পৃথিবীতে চলতে গেলে যে ইংরেজি শেখা খুবই দরকার। এটা কোরিয়া এখনো উপলব্দি করে উঠতে পারেনি।’



চো ও পার্ক দুইজনকেই এক বছরের শিক্ষার্থী ভিসা দিয়ে নিউজিল্যান্ডে নিয়ে আসা হয়েছে। তাদের নিরাপত্তার জন্য অকল্যান্ডের গোপন জায়গায় রাখা হয়েছে।



পার্ক অবশ্য উদ্বিগ্নই ছিল যে নিউজিল্যান্ডে এসে আবার কী ঘটে। তবে এখানে পৌঁছে সে খুবই খুশি। ‘আমি এখানে এসে খুবই ভালো অনুভব করছি। প্রাণ খুলে নিশ্বাস নিতে পারছি।’ 



পার্ক ও চে দুইজনই আর উত্তর কিংবা দক্ষিণ কোরিয়ায় আর ফিরতে চায় না। ‘এখানেই আমরা ধর্ম পালন করতে চাই এবং আমাদের স্বপ্ন পুরণ করতে চাই।’



ডেভিড চো অকল্যান্ড ভিত্তিক খ্রিস্টান মিশনারির একজন পরিচালক। তিনি মূলত উত্তর কোরিয়া থেকে নির্যাতিত হয়ে আসাদের আশ্রয় দিয়ে থাকেন এবং ধর্ম প্রচার করেন।



সূত্র-এনজেডহেরাল্ড।


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top