সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৭ই বৈশাখ ১৪৩১

একা এবং একা : আহসান হাবীব (পর্ব- এক)


প্রকাশিত:
১৫ জুন ২০২০ ২২:২৬

আপডেট:
৪ আগস্ট ২০২০ ২২:০৬

 

সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের সামনে রিকশা থেকে নেমে মারুফ হকচকিয়ে গেল। এটাই তাহলে সরযুবালা বিদ্যানিকেতন? বাইরে কোন সাইনবোর্ড নাই।

- এটা বিদ্যানিকেতন স্কুল?

- হ স্যার এইডাই।

- সাইনবোর্ড নাইযে।

- ছেল ঐ কালবৈশাখী ঝড় হইছিল গেল মাসে, উড়ায়া লইয়া গেছে। এহনতরী হেই সাইনবোর্ড খুঁইজা পায় নাই।

মারুফ তার ব্যাগ নামাল রিক্সা থেকে, ভাড়া মিটাল। তারপর ঢুকলো স্কুল কম্পাউন্ডে। স্কুলের হতদরিদ্র অবস্থা। এক সাইডে পাকা বিল্ডিং আরেক সাইডে টিনসেড ক্লাস রুম। সামনে বেশ খানিকটা খোলা মাঠ আছে। যেটা ভাল লেগেছে সেটা হচ্ছে প্রচুর গাছ স্কুলে। এমনিতে তারকাটা বা দেয়াল দিয়ে স্কুলের সীমানা নেই; কিন্তু সারি সারি গাছ দিয়ে সীমানা হয়ে গেছে যেন। আজ স্কুল বন্ধ।

মারুফ ব্যাগটা বাইরে রেখে হেডস্যারের রুমে  ঢুকলো

- স্যার আমি মারুফ রহমান। রাজশাহী থেকে আসছি।

বৃদ্ধ হেডস্যার চশমার ফাক দিয়ে তাকালেন। তারপর হাসি মুখে উঠে দাড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন

- আমি সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক মানবেন্দ্র দাস, বসেন বসেন আপনার জন্যই বসে আছি। আপনার ব্যাগ কোথায়?

- বাইরে

- বাইরে কেন? তিনি টেবিলের উপর বেল বাজাতে শুরু করলেন। তখনই দরজায় একটা মাথা দেখা গেল

- স্যার বুলাইছেন?

- এই স্যারের ব্যাগ ভিতরে নিয়ে আস।

- জি স্যার

- আর আমাদের নাস্তা দাও।

খুব দ্রুই নাস্তা চলে এল, সম্ভবত নাস্তা আগেই রেডি ছিল।। দু কাপ লাল চা। আর চারটা সিংগারা। সিঙ্গারা ঘুরো ভালই গরম। যেন এই মাত্র ভেজে আনা হয়েছে। খেতে যথেষ্ট সুসাদু। চা খেতে খেতে প্রথম প্রশ্ন করল মারুফ

- স্যার সরযুবালা বিদ্যা নিকেতনের সরযুবালা কে?

- আমার স্ত্রী। ক্যান্সারে মারা গেছে আজ দশ বছর। যে বছর মারা গেল সে বছরই এই স্কুল প্রতিষ্ঠা করি আমি। বলতে পারেন তার স্মৃতিতে এই স্কুল। তাহলে কাজের কথায় আসি

- জি জি

- স্কুলের পিছনে আপনার জন্য একটা রুম ঠিক করা হয়েছে। ওখানেই  থাকতে পারবেন। খাওয়া দাওয়া একটু কষ্ট হতে পারে প্রথম প্রথম। তবে মবিন আপনাকে সাহায্য করবে। সে ভাল রাধে। আর চাইলে আপনি হোটেলেও খেতে পারেন। এখানে ভাল হোটেল আছে। মফস্বল শহরতো সুযোগ সুবিধা কম কিন্তু যা পাবেন একদম ফ্রেশ।

- জি জি

- মারুফ সাহেব ‘স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল’ এই কথাটাকে আমি খুবই গুরুত্ব দেই। আমার বয়স কত হবে বলুনতো?

- এ্যাঁ স্যার ৬০ বা ৬৫ ?

- হা হা ... আমি এই অগ্রাহয়নে পঁচাত্তরে পরব।

- বলেন কি স্যার?

- তাহলেই বুঝেন... ঐ যে বললাম স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল, একসময়তো নিয়মিত ব্যায়াম করতাম, এখন হয়ে উঠে না, ডায়াবেটিসটা কাবু করে ফেলেছে। তো এই কারণেই আমরা ড্রিল টিচার হিসেবে আপনাকে নিলাম। আমি চাই নিয়মিত ড্রিল ক্লাশ থাকবে ছাত্র ছাত্রীদের।  আগে শরীর স্বাস্থ্য ঠিক থাকবে তারপর পড়াশুনা ঠিক কিনা?

- এখানে ছেলে মেয়ে এক সাথে পড়ে?

- হ্যাঁ তবে মেয়ের সংখ্যা একটু বেশী আছে। আরেক কাপ চা খাবেন?

- না না   

- তাহলে চলুন আপনার ঘরটা বুঝিয়ে দেই, স্কুলটাও ঘুরিয়ে দেখাই।

তবে স্কুল সম্পর্কে আসল তথ্য পাওয়া গেল মবিনের কাছে। মবিন এখানকার দপ্তরী, পিয়ন, রাধুনী সব। বয়স ১৮/১৯ হবে, কমও হতে পারে। সে মারুফকে প্রথম প্রশ্ন করল

- স্যার মনে কিছু নিয়েন না, একটা কতা জিগাই?

- বল

- স্যারের বেতন কত ধার্য করছে হেড স্যারে?

প্রশ্নের ভঙ্গিতে হেসে ফেলে মারুফ।

- তোমার বেতন কত আগে বল?

- আমার বেতন? আইজ ছয় মাস বেতন নাই। তারপর সে গলা নামিয়ে ফিস ফিস করল ‘স্যার, এই স্কুল ছাত্র ছাত্রী মোডে ৫০ জন। স্যার আছে তিনজন। আপনেরে লয়া হইল চাইর জন। কেউরে বেতন দিতে পারে না। তো এই স্কুল চলব? ভিতরে ভিতরে চমকাল মারুফ। 

 

মবিন মিয়া আরো কিছু ভয়ঙ্কর তথ্য দিল -

১) এই স্কুলের কোন কোন ক্লাশে রাতে নেশা দ্রব্যের ভাগ বাটয়োরা হয়।

২) এই স্কুলের জমি দখলের পায়তারা করছে প্রভাবশালী একটা মহল।

৩) হেড স্যারের উপর দুইবার হামলা হয়েছে , তাকে কেউ কেউ মেরে ফেলতে চায়।

৪) প্রতি বছর স্কুলের মাঠে মেলা বসে। জোর করে বসায়, তখন মাঠের বারোটা বেজে যায়।

৫)  স্কুলের মহিলা টিচার দুজনের মধ্যে একজন চলে যাবে খুব শিগ্রী...

৬) ...

 

মবিন মিয়া আরো কিছু সমস্যার কথা বলতে চাইল। মারুফ থামিয়ে দিল। থাক আপাতত এই সমস্যাগুলো নিয়ে ভাবা যাক। মবিন মিয়া স্কুলে থাকে না। সে তার দাদিমার সাথে থাকে। সে চাবি বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেল। মারুফ বেরুলো খেতে। প্রথম দিন হোটেলেই খাওয়া যাক। মবিন রাধা বাড়া করতে চেয়েছিল। কিন্তু চাল ডাল কেনাকাটা করতে হবে, তারপর না রান্না। 

স্কুল থেকে আধা ঘন্টার দূরত্বে একটা হোটেল পাওয়া গেল। সব ধরনের ভাজি ভর্তার এক হোটেল। মালিক হিন্দু। এই এলাকা খুব সম্ভব হিন্দু প্রধান এলাকা। খেতে বেশ লাগল। খাওয়া দাওয়া সেরে একটা রিকশা নিল ঘন্টা হিসেবে। এক ঘন্টার জন্য ৫০ টাকা খুব বেশী না। শহরটা ঘুরে দেখাবে রিকাসাওয়ালা

- স্যার কি এই  এলাকায় নতুন?

- তা বলতে পারেন নতুন

- স্যারের হেতায় আগমনের হেতু?

মারুফ এর মনে হল, এরা মানে এই শহরের মানুষেরা কথাবার্তায় মাঝে মধ্যে  বেশ  ভারী ভারী বাংলা শব্দ ব্যবহার করে। যেমন  হেড স্যার বলছিলেন স্বাস্থ্য সকল সুখের মূল...

- হ্যাঁ নতুনই। সরযুবালা বিদ্যা নিকেতনে জয়েন করেছি

- স্যার কি সরযু স্কুলের মাস্টার?

- হ্যাঁ মাস্টার।

রিকসাওয়ালাও  মবিনের মত কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিল

১) এই এলাকায় হিন্দু বেশী। বিখ্যাত একটা মন্দির আছে এখানে নাম রামজির মন্দির।

২) এখানে হিন্দু বেশী হলেও মাতবরী মুসলমানদের হাতে। রাজনৈতিক নেতা সব মুসলিম। মেয়র কাউন্সিলর মেম্বার বেশীর ভাগই মুসলমান।

৩) এই এলাকায় ফাদার গ্রেগরীর নামে একটা গির্জা আছে। অনেক পুরোনো গীর্জা

৪) এই শহরের পিছনে আছে একটা নদী ( নদীর নামটা রিকাসাওয়ালা উচ্চারনে ঠিক ধরতে পারল না মারুফ) ।

৫) নদীর ওপারে পুরাতন সিলেট শহর। নৌকা দিয়ে নদী পারাপার করা যায়।

৬) এই এলাকা একটা টালি পাড়া আাছে। এখানে টালি তৈরী হয়। এই টালি বিদেশেও রফতানী হয়।

৭) সবচে খারাপ খবরটা হচ্ছে এই এলাকায় এখন নেশা দ্রব্য খুব পাওয়া যাচ্ছে বিশেষ করে হিরোইনের প্যাকেট আর বাবা... এরা অবশ্য বাবা বলে না, বলে আব্বা!

স্কুলে ফিরতে ফিরতে রাত দশটা। নিজের ঘরে গিয়ে কিছুক্ষন শুয়ে থাকল মারুফ। বাড়ীতে মায়ের সঙ্গে কথা হল। মা বড়বোনের সঙ্গে থাকে। বড় বোন একটা কলেজের শিক্ষক। তাদের বাবাও শিক্ষক ছিলেন।

ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে যাবে তখনই একটা হাসির শব্দ এল কানে। খুব কাছ থেকে। মারুফ বের হল। হাসিটা আসছে স্কুলের একদম কোনার ঘরটা থেকে, টিন শেড ঘর। সাবধানে এগুলো মারুফ তার মনে পড়ল মবিনের ১ নম্বর তথ্যটা। এই স্কুলের কোনো কোনো ক্লাশে নেশ্যাদ্রব্য ভাগ বাটোয়ারা হয়।

ঠিক তাই, তিনটা লোক বসে কিছু ভাগাভাগি করছে। ওরা ঢুকেছে জানালা দিয়ে। দুটো মোম জ্বালিয়ে নিয়েছে, পাশে একটা মদের বোতল, বিদেশী। তিনটা গ্লাস। আরেক পাশে একটা বড় ব্যাগ। তাদের কাছে কোনো অস্ত্র আছে কি? কোন একটা কথায় একজন ফ্যা ফ্যা করে মাঝে মাঝেই হাসছে।

- এই চোপ, কাম কর।

- কামতো শেষ ।
মারুফ তার বাম পকেটে হাত দিল। জিনিষটা আছে। দুটো ছোট বিঘত পরিমান চকচকে লাঠি। হাফ ইঞ্চি ডায়ামিটার লাঠি দুটো পাতলা শিকল দিয়ে বাধা। জিনিসটার একটা অফিসিয়াল নাম আছে, নান চাকু। এরা তিনজন জানে না সরযুবালা বিদ্যানিকেতনের ড্রিল টিচার মারুফ রহমান একজন টায়কানোদা ট্রেনার। মারুফ খুব সাবধানে ক্লাশ রুমে ঢুকলো, চাবি তার কাছে ছিল। যাওয়ার সময় সব ক্লাশের চাবি মবিন দিয়ে গেছে। এরা বেঞ্চগুলো এক পাশে সরিয়ে রেখে মিটিং বসিয়েছে। মারুফ খুক খুক করে কাশলো। তিন জন চমকে তাকাল। মারুফ বলল ‘এই তোমরা এখানে কি কর?

 

(চলবে)


একা এবং একা - পর্ব এক
একা এবং একা - পর্ব দুই
একা এবং একা - পর্ব তিন
একা এবং একা - পর্ব চার
একা এবং একা - পর্ব পাঁচ
একা এবং একা - পর্ব ছয়
একা এবং একা - পর্ব সাত
একা এবং একা - পর্ব আট

 

লেখক: আহসান হাবীব
কার্টুনিস্ট/ সম্পাদক
উম্মাদ, স্যাটায়ার কার্টুন পত্রিকা
 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top