সিডনী শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

বঙ্গদেশের রুপের জৌলুসে বুঁদ ছিলেন প্রাণের কবি জীবনানন্দ : এ. আই. বাবুন 


প্রকাশিত:
৩০ আগস্ট ২০২০ ০১:০৪

আপডেট:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:৪০

 

রবীন্দ্রউত্তর কালের শ্রেষ্ঠতম স্বরস্বত কবি প্রতিভার অধিকারী কবিবর জীবনানন্দ দাশ। দুঃখের হলেও সত্য, সমকাল তাঁকে তাঁর প্রতিভার স্বীকৃতি দিতে পারেনি। তাঁর কাব্যকলার যতটুকু জয়গান, সবটাই মৃত্যু পরবর্তীকালীন। এখানে একটি বিষয় উপলব্ধি করবার মত, কবিবর জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতার রাজপুত্র। অশ্বমেধের ঘোড়া তিনি, কাজেই কালের থেকে তিনি এগিয়ে ছিলেন অনেকটাই। ফলত, কালগত উপলব্ধি সম্ভবপর না হওয়ায়, সমকাল তাঁর গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেনি। শ্রেষ্ঠ কবি লেখকদের অনেকের সাথেই এই বিষয়টি হয়েছে, অস্বীকার করবার উপায় নেই। যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত প্রবল প্রতিভাসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, তাঁর সমকালে নবীনচন্দ্র, হেমচন্দ্র প্রমুখকে তাঁর দেখে বহুগুণে এগিয়ে রাখা হয়েছিল। আবার, অমর কথাশিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায়ও সমকালীন সময়ে তেমন কোন স্বীকৃতি পাননি। 

যায়হোক, বাংলা কবিতার রাজপুত্র কবি জীবনানন্দ দাশকে সমকাল উপলদ্ধি না করলেও, পরবর্তীতে অর্থাৎ  চলমান সময়ে তিনি সবচেয়ে পঠিত কবি, এ বিষয়ে তেমন সন্দিহান হওয়ার মত জায়গা নেই। জীবনানন্দের কবিতায় নানা প্রসঙ্গ এসেছে তাঁর কাব্যকলাকে পূর্ণ করতে। এই বহুবিধ প্রসঙ্গাদির মধ্যে বাংলার প্রকৃতি এবং নৈসর্গিক বর্ণনার এক মহা আয়োজন আমরা কবিবর জীবনানন্দ সমীপেষুর কাব্যশরীরে প্রবল দীপ্তিময় হতে দেখি। এই জায়গাতে অমর কথাকর প্রিয় বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর প্রবল সদৃশ্য লক্ষ্যগোচর হয়। কথাসাহিত্যের অঙ্গনে মনীষী রবীন্দ্রনাথ অপেক্ষাকৃত উচ্চবিত্ত সম্প্রদায় অমিত, কেটি মিত্রদের আনয়ন করলেন (প্রান্তিক চরিত্রের উপস্থিতি নেই এমনটি বলছি না ), বঙ্কিমচন্দ্র জাতীয়তাবাদ, কোথাও কোথায়ও তার উগ্র মুর্ত্তি ধারণ, আবার শরৎ সাহিত্যে চরিত্ররা এলো কৃষক, গোপালক, সাধারণ চাকুরিজীবির বেশে। এই যে আবেশ এতদিন বাঙালি পাঠককে মোহমুগ্ধ করে রেখেছিল, সেই জায়গা থেকে বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায় বাংলার প্রকৃতি, গাছ গাছালির অপূর্ব বর্ণন সৃজনে সমৃদ্ধ করলেন বাংলা সাহিত্যের অঙ্গন। অরণ্য, নদীনালাও  চরিত্র হয়ে উঠেছিল তাঁর কথনগুণে। বাংলা কাব্যকলার ক্ষেত্রে এই কাজটিই করেছিলেন কবিবর জীবনানন্দ দাশ। 

জীবনানন্দ দাশের কাব্যকলায় অন্ধকার প্রসঙ্গ, মৃত্যুচেতনা, পরিমিত বোধের বিষয় উঠে এলেও, প্রকৃতি বর্ণনায় তিনি বাংলা কাব্যকে এক অনন্য আলোকদ্যুতি প্রদান করেছেন। কাব্যকলার ভাষা, উপমা সংযোজন এবং সর্বপরি প্রকৃতিক নিসর্গের অপরুপ বর্ণনা তাঁকে অন্য কবিদিগের থেকে পৃথক সত্ত্বায় উন্নীত করেছে। এ কবি আইফেল টাওয়ার, কিম্বা  টেমসের জলতরঙ্গে বিমোহিত নন, বাংলার গাছ গাছালি, নদীনালা, পাহাড় পর্বতের প্রতি তাঁর পরম আত্মিক টান। প্রকৃতিক এই অপরুপ বর্ণন সৃজন নিমিত্তেই তিনি লিখলেন 'রূপসী বাংলা' নামক অমর কাব্যগাথা। এই কাব্যটি জীবনানন্দ সমীপেষুর মৃত্যু পরবর্তীকালে প্রকাশিত। কাব্যকলাটির  প্রতিটি কবিতার শব্দগঠনে বাংলার নদীনালা, মাঠ মাঠালির বিরাট জয়গান ধ্বনিত হয়েছে কবিবরের কণ্ঠের পবিত্র উচ্চারণে। কাব্যগ্রন্থটির নিবিড় পাঠে পাঠক উপলব্ধি করবেন, কবি বঙ্গপ্রীতি কতখানি সুউচ্চ এবং মহৎ। তিনি লিখছেন, 

'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রুপ / খুঁজিতে যাই না আর'

কী অপরুপ এবং অনবদ্য উচ্চারণ, পাঠক মাত্রই বিমোহিত হবেন, সেটায় স্বাভাবিক। জীবনানন্দের কবিতা পাঠকের সাথে কথা বলে। প্রতিটি শব্দই ইঙ্গিত করে অনন্য সব ব্যঞ্জনা, উপমার অনন্যতার যে পরিচয় তিনি রাখলেন তা সত্যই অনন্য দৃষ্টান্তের স্মারক চিহ্ন। সমকালীন যুগ যন্ত্রণা, সময়ের প্রসব বেদনার সাথে ব্যক্তিজীবনের গ্লানি তাঁর কবিতাকে দিয়েছে শক্তিশালী আকর। যে সময়টিতে তাঁর জীবনের গল্প অতিবাহিত হয়েছে, তা বড্ড কঠিন সময়। পরাধীন দেশ, বিদেশি শাসকের রক্তচক্ষুর আস্ফালন, দুর্ভিক্ষ আনহার কবিকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিল। ব্যক্তি ও কর্মজীবনেও যেন ঈশ্বর তাঁর ললাটে ব্যর্থতার স্ট্যাম্প মেরে পাঠিয়েছিলেন। ফলত, খুব স্বভাবিকভাবেই, তাঁর কবিতায় এসেছে অন্ধকার প্রসঙ্গ, মৃত্যুচেতনার নানান আঁকিবুকি। তবে, কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু, বঙ্গভূমি প্রকৃতিক দর্শন কাব্যময় শরীরে আঁকতে ভীষণ রকম সফল হয়েছেন। বললে অত্যুক্তি হবে না, তাঁর মত বাংলাদেশের রুপকে এমন জীবন্ত করে তুলতে পারেননি অন্য কোন সাহিত্য স্বজন। তবে বাংলাদেশের রুপ গরিমার কথা বাংলা সাহিত্যে বারে বারে উঠে আসলে, তাঁর মত এত ব্যাপক পরিধি নিয়ে পূর্বে, আর কেউই অঙ্কন করতে সক্ষম হননি। 

'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই পৃথিবীর রুপ / খুঁজিতে যাই না আর' 

এমন অসামান্য কাব্যউক্তি তাঁর পক্ষেই উপস্থাপন করা সম্ভব। কেননা, বঙ্গদেশের রুপের জৌলুসে তিনি বুঁদ হয়েছিলেন আবাল্য মৃত্যুকাল পর্যন্ত। বাংলাদেশের শস্য শ্যামলা রুপ তাঁর হৃদয়কে এতটাই প্রশান্তি করে তুলেছিল, তিনি মৃত্যুকালীন সময়ের চেয়েছেন বঙ্গমায়ের স্নেহময় আঁচলের প্রশ্রয়। 

'যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো - অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে / কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে ...' 

'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থটি কবি প্রণয়ন করেছিলেন বাংলাদেশের রুপ সৌন্দর্য বর্ণনার নিমিত্তে। 'এখানে আকাশ নীল', 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের এক শোভাবর্ধক কবিতা। এ কবিতাতেও কাব্যগ্রন্থের অনন্য কবিতার মতই কবি বঙ্গমায়ের রুপ সৌন্দর্য বর্ণনায় মুখর হয়েছেন। সাথে কবিতাটিকে অনন্য করেছেন বাংলাদেশের স্মরণীয় ইতিহাস সংযোজনার মধ্য দিয়ে। প্রয়োজনেই কবিতাটিতে এসেছে, ধনপতি শ্রীমন্ত বেহুলা লহনার প্রসঙ্গ, এসেছে মুকুন্দরাম ও চণ্ডীমঙ্গলের স্বর্ণালী ইতিহাস ইতিবৃত্তের প্রসঙ্গ। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায় জননী বঙ্গভূমির রুপে মুগ্ধ হয়েই লিখেছিলেন 'সকল দেশের সেরা' নামক অমর সঙ্গীতখানি। আসলে, বাংলাদেশের রুপ সৌন্দর্য এত্তটাই মনোমুগ্ধকর যে, বিবশ হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই। কবি সাহিত্য সাধকগণ তো আর পাঁচটা মানুষের সাধারণ গণ মানব তো নন, তাঁদের ভাবনার তন্ত্রীর আকর আর উপলব্ধি করবার হৃদয়ের পরশ অসম্ভব অনুভূতিময় হয়ে থাকে। তাই আমাদের দেখা এবং তাঁদের দেখা অনেকটাই পৃথক মাত্রার হয়। জীবনানন্দ সেই অনুভূতি হৃদয় দিয়ে দেখেন বাংলা মায়ের সৌন্দর্য। বাংলার নীলাকাশ, গাছ গাছালি, হিম সাদা মেঘমালা, আকন্দ ফুলে কালো ভীমরুলের আনাগোনা, রোদের সুচিক্কণ রুপ কবিকে মোহিত করে। 'এখানে আকাশ নীল' কবিতায় সেই ছবি আঁকলেন কবিবর শ্রদ্ধেয় জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু। পড়ুন, 

'এখানে আকাশ নীল - নীলাভ আকাশ জুড়ে সজিনার ফুল / ফুটে থাকে হিমশাদা - রং তার - আশ্বিনের আলোর মতন; / রৌদ্রের দুপুর ভরে, বার বার রোদ তার সুচিক্কণ চুল .... ' 

বাংলার ঐতিহ্য এবং স্বর্ণালী ইতিহাস সম্পর্কে সচেতন কবি। একবিতায় এসেছে সে প্রসঙ্গ। মঙ্গলকাব্য বাংলা সাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ। যা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিশ্বময় আলোকদ্যুতি। এই কাব্য সমূহের চরিত্র ধনপতি, শ্রীমন্ত, বেহুলারা অমর সব চরিত্রের দৃষ্টান্ত। বিশেষ করে বেহুলা। সতী নারী হিসাবে আজও তিনি বন্দিত। সর্পদর্শনে মৃত স্বামী নিয়ে গাঙুরের জলে ভাসেন ভয়ডরহীন ভাবে। তাঁর সতীত্বে বিমুগ্ধ দেবগণ ফিরিয়ে দেন লক্ষীন্দরের জীবন। উক্ত ইতিহাসের কথায় স্মরণ হয় কবির কাব্যউক্তির উচ্চারণে, 

'কাঁঠাল জামের বুকে নিঙড়ায়ে - দহে বিলে চঞ্চল আঙুল / বুলায়ে বুলায়ে ফেরে এইখানে জাম লিচু কাঁঠালের বন / ধনপতি, শ্রীমন্তের, বেহুলার লহনার ছুঁয়েছে চরণ;' 

বঙ্গভূমির পবিত্র মাটি, গাছ গাছালি, নদী নালা পাহাড়ের সাথে কবির  চরম আত্মিক যোগ ছিল, ভীষণ রকম মজবুত। কবি বঙ্গমায়ের রুপে এতটাই বিমুগ্ধ ছিলেন যে, বাংলার মুখ দেখেছেন বলেই তিনি পরম তৃপ্ত, পৃথিবীর রুপ তিনি দেখতে চাননি । এই বঙ্গপ্রেমী কবি তাই মৃত্যুর মধ্যে বিলীন হওয়ার মুহূর্তও বঙ্গমায়ের আঁচল জড়িয়ে ধরে রাখতে চান স্বশরীরে। কবি লিখছেন, 

'যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো - অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে 
কাঁঠাল গাছের তলে হয়তো বা ধলেশ্বরী চিলাইয়ের পাশে 
দিনমানে কোনো মুখ হয়তো সে শ্মশানের কাছে নাহি আসে 
তবুও কাঁঠাল জাম বাংলায় - তাহাদের ছায়া যে পড়িছে 
আমার বুকের পরে - আমার মুখের পরে নীরবে ঝরিছে' 

এখানে একটি কথার উপস্থাপনা দিই, জীবনানন্দ দাশের এক অলৌকিকপ্রায় ক্ষমতা আছে, তাঁর কাব্য কথন, ভাবনার গ্রন্থি এবং উপস্থাপন গুণ এতটাই মনোমুগ্ধকর যে, পাঠক সমালোচক সকলকে, তা বিবশ করে ।

'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থে কবিবর শ্রদ্ধেয় জীবনানন্দ দাশ মহাশয় একাধিক নদীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। যেহেতু, অবিভক্ত বাংলা মূলত নদীমাতৃক, ফলত, নদী ব্যতীত বাংলার অপরুপ সৌন্দয্যের পরিপূর্ণ বিকাশ সম্ভবপর নয়। তবে, কবি উল্লেখিত সব নদীর বাস্তবিক উপস্থিতি লক্ষ্যগোচর হয় না। যেমন জলসিড়ি কিম্বা ধানসিড়ি, এই নদী সমূহ মূলত কবিকল্পনার ফসল। যাইহোক, এই কবিতাটিতে বাংলা প্রকৃতির এক অনন্য এবং অপূর্ব সৃজন ঘটিয়েছেন কবি। প্রথম কয়েকটি চরণের উদ্ধৃতি দিয়েই আলোচনার বহরকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায় উত্তম। আসুন পড়ি, 

'একদিন জলসিড়ি নদীটির পারে এই বাংলার মাঠে / বিশীর্ণ বটের নিচে শুয়ে রবো; পশমের মতো লাল ফল / ঝরিবে বিজন ঘাসে, - বাঁকা চাঁদ জেগে রবে -......' 
অন্য একটি কবিতায় জীবনানন্দ দাশ লিখছেন,
'তোমরা যেখানে সাধ চলে যাও - আমি এই বাংলার পারে / রয়ে যাবো .....' (তোমরা যেখানে সাধ - রূপসীবাংলা)। 
অর্থাৎ বঙ্গের এই প্রকৃতি, নদনদী, বট আকন্দের মহা মেলবন্ধন কবিকে শুধু মুগ্ধই করেনি, বিমুগ্ধ আবেশ প্রদান করেছে । তাই তিনি লিখতে পারেন, 
'আবার আসিব ফিরে ধানসিড়ির তীরে এই বাংলায়' (আবার আসিব ফিরে)
নদী বরাবরই সৃজনকর্মে মহা অনুঘটক হিসাবে কাজ করে। ওই যে পূর্বে বললাম, আমাদের বাংলাদেশ (বিভক্ত, অবিভক্ত যায় বলো না কেন) নদীময়। কবিগণের  চোখে নদীর নীল তরঙ্গ অন্যমাত্রা পাবে সেটায় তো স্বাভাবিক। যেমন, স্মৃতিপটে পরম শ্রদ্ধেয় কবি মধুসূদন দত্তের কথা উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি জাহ্নবীর তীরে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। এই নদীটি তাঁর এতটাই প্রিয় ছিল যে, তিনি নদীটিকেই  অমর করে দিলেন। কিম্বা তারাশঙ্করের সেই ছোট নদী   হাঁসুলী বাঁকের কথা স্মরণ করে দেখো। 

এখানেও কবি জীবনানন্দ দাশের নদীপ্রীতির বিচ্ছুরণ ঘটেছে। জলসিড়ি নামক একটি কল্পনদীর তীরে শয়ন করবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, সাথে একটি অনন্য দৃশ্যের উপস্থাপনাও দিয়েছেন। বিশীর্ণ বটের তলে কবি শুয়ে থাকবেন, উপর থেকে লাল পশমের ফুল পড়বে নিচে, অপূর্ব বর্ণনা। আমাদের সকলের তো নদীকূলে জন্মাবার সৌভাগ্য হয় না, তবুও যাঁদের সে সৌভাগ্য ঘটেছে, তাঁরা কবির এই মরমী বর্ণনার সাথে সম্পৃক্ততা স্থাপন করতে পারবেন খুব সহজেই। অন্যরা পারবেন না এমনটি কিন্তু বলছি না। তবে পদ্মানদী কিম্বা তিতাসের কূলে বসবাস কারি মাঝি মাল্লাদের নদী প্রেম নিশ্চয় আমাদের থেকে কিছুটা বেশি হবে। 

বঙ্গমায়ের স্নেহছায়ায় সিক্ত কবি। মায়ের আমোদিত রুপে তিনি বিবশ হবেন সেটায় স্বাভাবিক। তাঁর এই বঙ্গপ্রীতি তুলনারহিত। কত উপমা, কত্ত বিশেষণ, পাঠক ভীষণ রকম নৈকট্য অনুভব করে সে মরমী কাব্যকথনের অপরুপ সৃজন মালায়। 

'দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে; দেখিব খয়েরি ডানা শালিকের সন্ধ্যায় হিম ঘরে আসে / ধবল রোমের নিচে হলুদ ঠ্যাং ঘাসে অন্ধকারে / নেচে চলে - একবার - দুইবার - তারপর হঠাৎ তাহারে / বনের হিজল গাছ ডাক দিয়ে নিয়ে যায় হৃদয়ের পাশে ...' (তোমরা যেখানে সাধ - রুপসী বাংলা)

এইসব বর্ণনা সমূহের বিষয়বস্তু অতীব সাধারণ এবং অত্যন্ত স্বাভাবিক দৃশ্যের উপস্থাপন, তবুও মরমী কবির অপরুপ হৃদয়জাত বর্ণনায়, তা অনুপম আলেখ্য রুপ ধারণ করে। ' জলসিড়ি নদীটির' কবিতার শেষ শব্দচরণ সমূহেও কবি জীবনানন্দ বঙ্গপ্রকৃতির জয়গান গেয়েছেন। আসুন পড়ি- 

'চারিদিকে বাংলার ধানী শাড়ি - শাদা শাঁখা বাংলার ঘাস / আকন্দ বসকলতা ঘেরা এক নীল মাঠ - আপনার মনে ভাঙিতেছে ধীরে ধীরে; - চারিদিকে এইসব আশ্চর্য উচ্ছ্বাস।' 

বঙ্গমায়ের এই অপরুপ রুপেই তো বিবশ কবিবর। এই রুপে মোহিত হয়েই তো তিনি বারে বারে মৃত্যুর পরেও ফিরে আসতে চেয়েছেন বঙ্গভূমির পবিত্র মাটিতে। বাংলার মুখ তিনি দেখেছেন, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষও বাংলার মুখ দেখেছেন, কেননা, অন্ধ তো নয়। তবে কবির দেখবার চোখ এবং অনুভব করবার হৃদয় যে পৃথক। তাই বাংলার ঘাস, আকন্দ, বসকলতাও হয়ে ওঠে তাঁর কাছে অত্যন্ত আদরনীয়। কবিতাটির পুরো শরীর জুড়ে কবির এই বঙ্গপ্রীতির বিচ্ছুরণ পাঠককে বিমুগ্ধ করে। 

কবি জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু বঙ্গপ্রকৃতির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন নিজের জীবন সত্ত্বার সব কিছু আকর। বাংলাদেশের প্রকৃতির মনমোহিনী রুপ তাঁকে ভীষণ রকম মুগ্ধময় করে রেখেছিল। কাব্যময় জীবনের এক বিরাট প্রেক্ষিত এসেছে বঙ্গপ্রকৃতির অপরুপ বন্দনা। ফলত, বিমুগ্ধ কবি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বার পূর্বে জননী জন্মভূমির স্নেহ আঁচল তলে আশ্রয় নেবেন, সেটায় তো স্বাভাবিক। 'একদিন কুয়াশায়' কবিতায় কবি লিখলেন, 

'একদিন কুয়াশায় এই মাঠে আমারে পাবে না কেউ খুঁজে, জানি / হৃদয়ের পথ চলা শেষ হল সেইদিন - গিয়েছে যে শান্ত - হিম ঘরে।' আবার

'মনে হয় একদিন' কবিতায় তিনি লিখলেন-

'মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিব না আর; / দেখিব না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে এক ঝাড় জোনাকী কখন /  নিভে যায়; দেখিব না আর পরিচিত এই বাঁশবন ' 

এই আক্ষেপ পুরো কাব্যময় এক বেদনার সঞ্চার করেছে। 

বাংলাদেশে জন্ম হওয়ার অভিজ্ঞান কবিকে ধন্য করেছে। বঙ্গদেশের প্রকৃতি, রুপ রসের চাক্ষুস কবি হৃদয়কে দিয়েছে পরম তৃপ্তি। তাই মৃত্যু জীবনকে ছিন্ন করলেও দুঃখ নেই কবির। 'যেদিন সরিয়া যাব', কবিতায় কবি লিখলেন, 

'যেদিন সরিয়া যাব তোমাদের কাছ থেকে - দূর কুয়াশায় / চলে যাব, সেদিন মরণ এসে অন্ধকারে আমার শরীর / ভিক্ষা করে লয়ে যাবে; সেদিন দুদন্ড এই বাংলার তীর - /এই নীল বাংলার তীরে শুয়ে একা একা কি ভাবিব, হায়; /সেদিন রবে না কোন ক্ষোভ মনে - এই সোঁদা ঘাসের ধূলায় ...' 

বঙ্গপ্রেমে মুগ্ধ কবি ছেড়ে যেতে চান না জননী জন্মভূমি প্রিয় বাংলাদেশ ছেড়ে। 'তোমরা যেখানে সাধ' কবিতায় কবি লিখলেন, 

'তোমরা যেখানে সাধ চলে যেও - আমি এই বাংলার পারে / রয়ে যাবো;' 

কিন্তু হায়, 'যেতে নাহি দিব',  'যেতে নাহি দিব', তবুও যেতে দিতে হয়, মৃত্যু অপ্রতিরোধ্য তাকে রোধ করবার ক্ষমতা কোথায়। একথা বিলক্ষণ জানেন কবি, তাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বার সময়ও তিনি বঙ্গজননীর শীতল ছায়ায় বিলীন হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করেছেন 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থের একাধিক কবিতায়। 

 

এ. আই. বাবুন
বারাসাত, ভারত

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top