সিডনী শনিবার, ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

কবি জীবনানন্দ দাশের জীবন ও কাব্যে নারী : এ. আই. বাবুন


প্রকাশিত:
৩ সেপ্টেম্বর ২০২০ ২১:৪১

আপডেট:
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০০:৪৫

 

জীবনানন্দ দাশ আধুনিক কালের সর্বাধিক নন্দিত কবি ব্যক্তিত্ব। সর্বাধিক পঠিতও। তাঁর সমকালে তিনি সমাদৃত না হলেও, ভাবিকাল অর্থাৎ চলমান সময়ে তিনি রবীন্দ্রউত্তর কালের শ্রেষ্ঠতম কাব্যসাধক হিসাবে খ্যাতি পেয়েছেন। আধুনিক বাংলা কাব্যের পথ পরিক্রমায় এ কবির অনন্য অবদান রয়েছে। তৎকালীন সময়, অর্থাৎ একদিকে রবীন্দ্র নজরুল অন্যদিকে তাঁদের অনুসারী কবিদের জয়জয়াকার। সেই কালপর্বে সাহিত্য অঙ্গনে প্রবেশ করে তিনি যথার্থই এক নব কাব্য স্বাদ পাঠককে প্রদান করলেন। জীবনানন্দ সর্বঅর্থেই নতুনত্বের সঞ্চার করলেন। শব্দ ভাবনা, উপমার অপূর্ব প্রয়োগ, চিত্রকল্পের যথাযথ উপস্থাপন গুণ তাঁকে বিশিষ্টতা দান করলো। 

জীবনানন্দের ভাব ও ভাবনার মধ্যে এক মাধুর্য্যময় আহ্বান ছিল। তাঁর শব্দ এবং উপমা ও চিত্রকল্পের সংযোজনা, সেই প্রবাহকে আরও মধুময় করে তুলেছে। জীবনানন্দের কাব্যের স্বরও বহুমুখী। সমকালীন সমাজিক ও রাষ্ট্রীয় অবক্ষয়, দুর্ভিক্ষ আনহারকে পূর্ণতা দিতে এসেছে মৃত্যুচেতনা ও অন্ধকার প্রসঙ্গ, একই সাথে সময় চেতনা ও ইতিহাস ইতিবৃত্তের সন্ধানও দেন জীবনানন্দ। এসবের মধ্যেই জীবনানন্দকে বিশিষ্টতা দিয়েছে তাঁর প্রেমময় কবিতাগুলি। প্রেম হৃদয়কে প্রশান্তিময় করে তোলে। তাই প্রেমের আহ্বান অস্বীকার করা কোন সাহিত্যের স্বজনের পক্ষে সম্ভব নয়। বিদ্রোহী কবি নজরুল দেশমায়ের শৃঙ্খল মোচনের নিমিত্তে একদিকে লিখছিলেন অগ্নিবীণার জ্বালাময় কবিতা, অন্যদিকে নার্গিস ও ফজিলাতুন্নেসাকে উদ্দেশ্য লিখছেন অমর সব প্রেম কথা। জীবনানন্দও তাই প্রেমকে অস্বীকার করতে পারেননি। ব্যক্তি জীবনের প্রেমহীনতা তিনি যেন পুষিয়ে নিয়েছেন কাব্যকলার পাতায়। একদণ্ড শান্তির জন্য কখনও বনলতা, কখনও সুচরিতা, সুরঞ্জনার কাছে কবি আশ্রয় নেন । 

'জীবনানন্দের জীবন ও কাব্যে নারী' এই শিরোনামের এই নিবন্ধটির শুরুতেই আমরা কবির অমর কবিতা 'বনলতা সেন' উল্লেখ করবো।  'বনলতা সেন' কবিতাটি শুধুমাত্র কবি জীবনানন্দ দাশের জনপ্রিয়তম কবিতা, এই আপ্তবাক্যে থেমে থাকা চলে না। 'বনলতা সেন' প্রেমের কবিতা হিসাবে বিশ্বসাহিত্যের ভূমন্ডলে এক অনন্য সংযোজন। স্যার আর্থার কেনান ডয়েলের  'শার্লক হোমস' বিশ্ব গোয়েন্দা সাহিত্যের প্রপিতামহ সদৃশ চরিত্র, অর্থাৎ বিশ্ব সাহিত্যের প্রায় সব গোয়েন্দা চরিত্র গুলোর নির্মাণ রহস্যের নেপথ্যে 'শার্লক হোমস' দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়ার দৃষ্টান্ত সূর্য উদয়ের মত নির্ভেজাল সত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চরিত্রটি এত্তটা ভয়ঙ্কর রকম জীবন্ত, তা নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই, অর্থাৎ শার্লক বাস্তব কোন চরিত্র কীনা তার ঠিকুজি বার করতে এখনও গবেষক পাঠকদের মধ্যে  হিমালয় প্রতীম প্রচেষ্টা লক্ষ্যগোচর হয়। এখনও অনেক পাঠকই বেকার স্ট্রীটে চিঠি পাঠান, যেখানে গল্পের চরিত্র শার্লক এবং ওয়াটসন থাকতেন। পাঠকের ভ্রম হতে পারে, হঠাৎ করেই বিষয় থেকে বেরিয়ে গেলাম কীনা ? পাঠক আশ্বস্ত হন, বোঝানোর ঋজুতা নিয়ে আসবার নিমিত্তে শার্লক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছি মাত্র। জীবনানন্দ দাশের 'বনলতা সেন' চরিত্রটিও অসম্ভব জনপ্রিয় একটি চরিত্র। ফলত, কবিবর জীবনানন্দ কোথায় পেলেন নাটোরের বনলতা সেনকে? তিনি কী কবির পূর্বপরিচিত কোন প্রিয়জন?  এমনতর বিষয় সমূহের উপস্থাপনা আমরা গবেষক মহলে ভীষণ রকম আলোচিত হতে দেখি।

প্রশ্নটি অবান্তর নয় মোটেও, সত্যই কোথায় পেলেন প্রিয় কবি জীবনানন্দ তাঁর অমর সৃষ্টি বনলতা সেনকে? পাঠক বুঝবেন, কবি মানুষগণ তো মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে আসেন না, এই মর্ত্য পৃথিবীর প্রতিভূ হিসাবে তাঁরা সক্রিয় থাকেন। ফলত, সমাজ রাষ্ট্র ও অনন্য পরিআবহিক ঘটনা পরম্পরা থেকে তাঁরা সাহিত্যের মনিমুক্তা সংগ্রহে ব্রতী হন। তাহলে, বললে খুব একটা অযৌক্তিক হয় না, বনলতাও কবির সমাজগত উচ্চারণ, অর্থাৎ তাঁর দেখা কোন সমাজিক চরিত্র, যিনি কবিবরের হৃদয় নির্মাণকে আলোড়িত করেছিল, এমন প্রশ্ন বার বার পাঠকের হৃদয়ে উঁকি দিয়েছে।

আলোচনার বহর প্রসারণ করবার পূর্বে প্রখ্যাত কবিতাখানি আসুন পাঠক পাঠ করি-

“হাজার বছর ধ’রে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিলো নাটোরের বনলতা সেন”।

'বনলতা সেন' কবিতাটি বিশ্বসাহিত্যের সন্দেহাতীত ভাবে এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি। যদিও রচনার পরপরই 'শনিবারের চিঠির' সম্পাদক, সজনীকান্ত দাশের মতো চরিত্রগণ এর বিরুপ সমালোচনা করেছিলেন। পাঠক নিশ্চয় ভোলেননি, এই সজনী বাবুই কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী', কবিতার অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তার পরপরই একাধিক প্যরোডি কবিতা লিখে কাজী কবির মানসিক শান্তির বিঘ্ন ঘটিয়েছিলেন। আসুন সজনী বাবু, কী লিখেছিলেন পড়ি। তিনি লিখলেন, 'এই প্রতিভাবান কবিদের আর একটি কৌশল কবিতা লিখিতে লিখিতে অকস্মাৎ অকারণ এক একজন ভদ্রমহিলার নাম করিয়া আমাদিগকে উৎসুক আর উৎসাহিত করিয়া তোলা'। যায়হোক, সজনী বাবুরা প্রায় সকল যুগউত্তীর্ণ কবিবর্গের সমালোচনা করা একপ্রকার প্রতিদিনকার কর্ম বলে জ্ঞান করেছিলেন, জীবনানন্দ সমালোচনাও তারই পরম্পরা ।

পূর্বেই বলেছি 'বনলতা সেন' প্রেমের কবিতা হিসাবে বিশ্বসাহিত্যে ভীষণ রকম সামাদিত। কবি নিজে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেছিলেন, 'Banalota Sen Of Natore' কবিবর জীবনানন্দ দাশ সমীপেষু, কোথায় পেলেন এমন আদরনীয় চরিত্রকে, এই বিষয়টি জানবার কৌতূহল পাঠকের শাশ্বতভাবেই রয়েছে কবিতাটি সৃষ্টিলগ্ন হতেই। সুদূর ইউরোপে ভিঞ্চির মোনালিসা, শেক্সপিয়রের ডার্ক লেডি’কে মানুষ যেভাবে খুঁজে বেরিয়েছে ঠিক সেভাবেই আমাদের বাংলা সাহিত্যের বনলতা সেনকেও খুঁজছে মানুষ।

জীবনানন্দ দাশের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক প্রদ্যুম্ন মিত্র । তিনি  তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘জীবনানন্দের চেতনাজগৎ’ এ বনলতা সেন চরিত্র সৃষ্টির নেপথ্যে তাঁর কোন পূর্ব পরিচিত মহীয়সী নারী থাকতে পারেন বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। আসুন, তিনি কী লিখেছেন পড়ি।  “বনলতা সেন নাটোরের-হয়তো সে কবির প্রিয় পরিচিত নাটোরেরই। প্রিয় পরিচিত অথচ বিস্মৃত; কিন্তু নবীন আবিষ্কারে মহনীয় সত্তায় সে যেন উদ্ভাসিত।” নাটোরের মেয়ে জয়শ্রী সেনের সঙ্গে কবির পূর্ব পরিচিতি ছিল। বিবাহের পর জয়শ্রী কলকাতায় স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। কবিও কলকাতাতে ছিলেন, ফলত জয়শ্রীর সঙ্গে কবির বেশ ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে, অনেক সমালোচক মনে করেন, জয়শ্রীর আদলে কবি বনলতা বিনির্মাণ করতে পারেন ।

জীবনানন্দ দাশের আরও  একটি বিশিষ্ট কবিতা, 'কোনদিন দেখিব না'। কবিতাটি আদ্যপান্ত একটি প্রেমের কবিতা।  কবি তাঁর প্রেয়সীকে  'সখী' বলে সম্বোধন করছেন। উল্লেখিত এই ' সখী' কবিকে ছেড়ে চলে গেছেন দূরে বহু দূরে। এই চলে যাওয়া কবির হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করেছে। এ কবিতার প্রতিটি শব্দ তারই প্রতিধ্বনি করে। কবিতার শুরুতেই কবি লিখছেন, 

'কোনদিন দেখিব না তারে আমি: হেমন্তে পাকিবে ধান , আষাঢ়ের রাতে/ কালো মেঘ নিঙরায়ে সবুজ বাঁশের বন গেয়ে যাবে উচ্ছ্বাসের গান/ সারারাত, - তবু আমি সাপচরা অন্ধপথে - বেনুবনে তাহার সন্ধান/ পাবো নাকো: পুকুর পাড়ে সে যে আসিবে না কোনদিন হাঁসিনীর সাথে/ সে কোন জোৎস্নায় আর আসিবে না - আসিবে না কখনো প্রভাতে'

কবিতার প্রতিটি কাব্যচরণ কবির হৃদয় রসে ভীষণ রকম সিক্ত। প্রেয়সী নারী ছেড়ে গেছে তাঁকে। কবিতার শরীরে কবি লেপন করলেন এক অনন্য বিরহের গান। 

'যখন দুপুরে রোদে অপরাজিতার মুখ হয়ে থাকে ম্লান/ যখন মেঘের রঙে পথহারা দাঁড়কাক পেয়ে গেছে ঘরের সন্ধান/ ধূসর সন্ধ্যায় সেই সেই আসিবে না এখানে;  ....' 

প্রেম যেন এক মহাসঙ্গীত। আর বিরহ সেই সঙ্গীতের ভগ্নরুপ। দুটি হৃদয়ের মাঝ বরাবর যখন বয়ে যায় বোঝাবুঝির কণ্টক প্রাচীর, তখন হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হবে, সেটায় তো স্বাভাবিক। তবে প্রেমকে প্রেয়সীকে ভোলা কি সম্ভব? কবি লিখছেন, 

'জোনাকি আসিবে শুধু; সারারাত কথা কবে ঘাসে আর ঘাসে/ বাদুড় উড়িবে শুধু পাখনা ভিজায়ে নিয়ে শান্ত হয়ে রাতের বাতাসে/ প্রতিটি নক্ষত্র তার সন্ধান খুঁজে জেগে রবে প্রতিটির পাশে/ নীরব ধূসর কণা লেগে রবে তুচ্ছ অনুকণাটির শ্বাসে/ অন্ধকারে - তুমি সখি চলে গেলে দূরে তবু; / হৃদয়ের গভীর বিশ্বাসে অশ্বথের শাখা ঐ দুলিতেছে ....' 

কবি জীবনানন্দ দাশের  সিংহভাগ সাহিত্য সম্ভারই ছিল অপ্রকাশিত। ডঃ ভূমেন্দ্র গুহ, জীবনানন্দ দাশের পাণ্ডুলিপি আবিষ্কার এবং তা গবেষণার ক্ষেত্রে প্রশংসা করবার মত কাজ করেছেন। ডঃ গুহ কবির 'লিটেরেরি নোটস' গবেষণা করে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, যে কবির জীবনে নিঃসন্দেহে ভাবেই প্রেম এসেছিল। দিনলিপি বা লিটেরেরি নোটস-এ ওয়াই (Y) হিসেবে উল্লিখিত মেয়েটিই কবির কাঙ্ক্ষিত নারী। ভূমেন্দ্র গুহ উল্লেখ করেছেন, মেয়েটির নাম  শোভনা। কবির এক কাকা ছিলেন, নাম অতুলান্ত দাশ। শোভনা, তাঁরই মেয়ে। যার ডাক নাম ছিল  বেবী। ১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে লাবণ্য দাশকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পূর্বে যুবক জীবনানন্দ দাশের সঙ্গে শোভনার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। যদিও তা বিয়ে পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। একটি উপন্যাসে শোভনাকে শচী নামেও উপস্থাপন করেছিলেন কথক জীবনানন্দ।  শোভনার সঙ্গে বিচ্ছেদ কবি বহুদিন ভুলতে পারেন নি।

পরবর্তীতে কবি লাবণ্য দাশ নামক এক মহিলাকে বিবাহ করেন। জীবনানন্দের বিবাহিত জীবন খুব একটা সুখের ছিল না। আমরা, ব্যক্তি জীবনানন্দ সম্পর্কে যতটা ওয়াকিবহাল হয়েছি, তাতে দেখা যায় ব্যক্তি জীবনানন্দ মূলত প্রচার বিমুখ, আত্মমুখী স্বভাবের মানুষ ছিলেন। প্রচার সর্বস্ব পাড়া দিয়েই তিনি হাঁটেননি কখনও। ফলত, কাব্য জীবন এবং ব্যক্তি জীবনে তার বিরুপ প্রভাব পড়েছিল। চাকরি টিকিয়ে রাখা কিম্বা পুরষ্কার বগলদাবা করবার অন্যতম একটি উপায় হল তোষামোদ এবং মোসহেবীপনা  চাটুকার স্বভাবের হওয়া। প্রসঙ্গক্রমেই বঙ্কিম বাবুর মুচিরাম গুড় চরিত্রটির কথা হৃদয়জাত হচ্ছে, অর্ধশিক্ষিত গোঁয়ার মুচিরাম কেবল মাত্র তোষামোদ এবং চাটুকার বৃত্তির বদৌলত কালেক্টর পেস্কারি, এমনকি ডেপুটি পদ জুটিয়ে নিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশের এই গুণটি মোটেও ছিল না। ফলত সমকালে তাঁর কাব্যিক সক্ষমতা অনুযায়ী মূল্যায়ন যেমন হয়নি, তেমনই চাকরিতে তিনি খুব বেশি সফল হননি। তাঁর কর্মজীবন ছিল অনিশ্চয়তার এক মহাগোলক ধাঁধাঁ। অধ্যাপক হিসাবে কর্ম জীবন শুরু এবং শেষ। শিক্ষক হিসাবে কবি জীবনানন্দ ততখানি সফল সে বিষয়ে তেমন আলোকপাত চোখে পড়ে না।

১৯২২ সালে কলকাতার ব্রাহ্মসমাজ পরিচালিত সিটি কলেজে টিউটর হিসাবে যোগ দেন তরুণ জীবনানন্দ। ১৯২৮ সালে স্বরস্বতী পূজাকে কেন্দ্র করে একটি কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ। সে বছর এই কলহ জনিত কারণে ছাত্র ভর্তি তুলনা মূলক ভাবে কম হওয়ায় অন্য কয়েকজনের সাথে কবি জীবনানন্দকেও বরখাস্ত করা হয়। এই কষ্ট কবি আজীবন মনে রেখেছিলেন। 

জীবনানন্দ দাশ তৎকালীন অবিভক্ত ভারতের নানা স্থানে অধ্যাপনা করেছেন। তবে বেশ অবাক করবার মত বিষয়, প্রায় কোথায়ও তিনি খুব বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেননি। কলকাতার সিটি কলেজে ছিলেন ছয় বৎসর, ১৯২২ - ২৮ পর্যন্ত, এরপর কিছুদিন খুলনার  বাগের হাট কলেজে, পরে দিল্লির রামযশ কলেজে ছিলেন এক বছর, ১৯৩০ - ৩১ পর্যন্ত, বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে ছিলেন বেশ অনেকটা সময় ১৩ বছর, ১৯৩৫ - ৪৮ পর্যন্ত, এছাড়াও, খড়গপুর কলেজ, বড়িশা কলেজ, হাওড়া গার্লস কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। চাকরির স্থায়িত্ব না হওয়ার যন্ত্রণা, জীবিকার অভাব তাঁকে আমৃত্যু কষ্ট দিয়েছে। 

একটি চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন রবীন্দ্রউত্তর বাংলা কাব্যের এই মহান সাধক। স্ত্রী লাবণ্য দাশ শিক্ষকতা করে অভাব কিছুটা পুষিয়েছেন। দুই দফায় বেকার ছিলেন দীর্ঘ সময়। বিবাহের পর পর তাঁকে বেকার থাকতে হয়েছে বেশ কয়েক বছর। স্ত্রী কন্যার দায়িত্ব তেমন ভাবে নিতে পারেননি। ইন্সুরেন্স কোম্পানির এজেন্ট রুপে কাজ করেছেন। গৃহ শিক্ষকতা করে কর্ম নির্বাহের চেষ্টা করেছেন। ব্যবসা করতে উদ্যোগী হলেও ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। দরিদ্র অভাব  নিত্য সঙ্গী রূপেই আমৃত্যু তাঁর জীবনের সাথে লেপ্টে ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তর মত।

বৈবাহিক জীবনের শান্তি প্রেম অক্ষুন্ন থাকে অনেক ক্ষেত্রেই অর্থনীতিক সক্ষমতার উপর। বিষয়টি শুনতে খারাপ লাগলেও বিষয়টি নির্ভেজাল সত্য। ব্যক্তি জীবনে ঈশ্বর জীবনানন্দের ললাটে যেন ব্যর্থতার স্ট্যাম্প মেরে পাঠিয়েছিলেন তাঁর সাজানো এই পার্থিব ভূমিতে। ফলত, এই অর্থনীতিক অসফলতা কারণেই তাঁর দাম্পত্য জীবনের গল্পও সফল হতে পারল না। স্ত্রী লাবণ্যের সাথে কবি জীবনানন্দের বনিবনার গল্প তেমন পরিচিত নয়, বরং বিপরীত কাহিনীই বেশি সমাদৃত। 

ব্যক্তিজীবনে সত্যকার নারীপ্রেম প্রাপ্তি না ঘটায় জীবনানন্দ তাঁর কাব্যে একাধিক প্রেয়সী নারী মূর্তির উপস্থাপনা দিয়েছেন। ব্যক্তি জীবনের গ্লানি পুষিয়ে নিয়ে কাব্যকলার কল্পলোকে। বনলতা, সুচেতনা, সুরঞ্জনা প্রমুখ নারী মূর্তির বেদির সামনে নতজানু হতে দেখি জীবনানন্দকে। এক দণ্ড শান্তিতে কাতর এ কবি। 

জীবনানন্দ দাশের একটি বিখ্যাত কবিতা  'অশ্বথ বটের দিন', এ কবিতায় কবি এক নারী মূর্তির আদল আনয়ন করেছেন । কবি লিখলেন, 

“সন্ধ্যায় পুকুর থেকে হাঁসটিরে নিয়ে আমি তোমাদের ঘরে/ গিয়েছি, অনেকদিন, - দেখিয়াছি ধূপ জ্বালো, ধরো সন্ধ্যাবাতি/ থোরের মতন শাদা ভিজে হাতে - এখুনি আসিবে কিনা রাতি/ বিনুনি বেঁধেছ তাই - কাঁচপোকাটিপ তুমি কপালের পরে/ পড়িয়াছ ...তারপর ঘুমায়েছ; কল্কাপাড় আঁচলটি ঝরে/ পানের বাটার পরে; নোনার মত নম্র শরীরটি পাতি”। 

অপূর্ব এ নারী মূর্তির আদল উপস্থাপন করেছেন কবি। এই নারীকেও অন্য সকল নারীর মত উপমায় সাজিয়ে তুলেছেন কবিবর জীবনানন্দ দাশ। তবে, এই কবিতার শেষ কয়েকটি চরণ ভীষণ রকম ভাবে পাঠককে আকর্ষিত করে। জীবনানন্দ লিখছেন, 

'আজ আমি ক্লান্ত চোখে ব্যবহৃত জীবনের ধুলোয় কাঁটায় 
চলে গেছি বহুদূরে - দেখোনিকো, বোঝোনিকো, করোনিকো 
মানা/ রূপসী শঙ্খের কৌটা তুমি যে গো প্রাণহীন - পানের বাটায়' 

কবিতার এই কয়েকটি চরণে উক্ত নারীর প্রতি কবির অভিমান ঝরে পড়তে দেখি। সেই নারী কবিকে উপলব্ধি করতে পারেনি, ক্লান্তি থেকে মুক্তি দিতে পারেনি। আমরা, জীবনানন্দ পড়তে পড়তে ভীষণ রকম ভাবে দেখেছি, ব্যক্তি জীবনানন্দের একটা প্রবল ছাপ রয়েছে উক্ত সৃজন কলায়। যেমন, এই মুহূর্ত জীবনানন্দ দাশ প্রণীত অনবদ্য গল্প 'জামরুলতলা' গল্পটির কথা মনে পড়ছে। যেখানে গল্পকার জীবনানন্দ কর্মহীন এক শিক্ষিত বেকার বিবাহিত যুবকের যন্ত্রণার কথা বলেছিলেন, যা পড়তে গিয়ে কবির ব্যক্তি জীবনের অসফলতার ছবি আমাদের হৃদয় গহীনে উঁকি মারে। এই কবিতার শেষ কয়েকটি চরণে নারী প্রেম বঞ্চিত জীবনানন্দের আকুতিই পাঠকের কাছে ধরা পড়েছে, সেটি বলা চলে । 

 

এ. আই. বাবুন
লেখক, বারাসাত, ভারতবর্ষ



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top