সিডনী রবিবার, ১৯শে মে ২০২৪, ৫ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মহাভারতের ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে ভারতীয় সভ্যতা : সৌম্য ঘোষ


প্রকাশিত:
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ২০:৫১

আপডেট:
১৯ মে ২০২৪ ১৩:৩০

ছবিঃ অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ

 

হাজার হাজার বর্ষ পেরিয়ে মহাভারত আজও মর্যাদার আসনে অক্ষুন্ন আছে। তার ইতিহাসই আমাদের মুখ্য বিবেচ্য। এই ভাবনায় ভারতীয় সমাজ ও ধর্ম জীবনের ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারার এক বিশ্বস্ত ইতিহাস--মহাভারত।

 মহাভারত ভারতীয় সমাজের একটি সম্পূর্ণ পরিচয়বাহী সাহিত্য দলিল। প্রাচীন ভারতবর্ষের অভ্রান্ত ইতিহাসের সন্ধানে আমাদের যেতে হবে মহাভারতের কাছে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দর করে বলেছেন, "বহু শতাব্দী মধ্য দিয়া আমাদের শত সহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে।"  তাই রামায়ণ ও মহাভারতকেই রবীন্দ্রনাথ "আমাদের জাতীয় সম্পত্তি" রূপে আখ্যায়িত করেছেন। 

রামায়ণ ও মহাভারতকে কেবলমাত্র মহাকাব্য রূপে না দেখে, তাকে ইতিহাস রূপে দেখাই শ্রেয়। মহাভারত ঘটনাবলীর কোনো ইতিহাস নয়। কারণ সেরূপ ইতিহাস নির্দিষ্ট সময়ে কে অবলম্বন করে থাকে। মহাভারত ভারতবর্ষের চিরকালীন ইতিহাস।  ভারতবর্ষের যা কিছু সাধনা, যা কিছু আরাধনা, সংকল্প, তারই ইতিহাস এই বিপুল কাব্যধর্মের মধ্যে চিরকালের সিংহাসনে বিরাজমান আছে। কবিগুরু তাঁর ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বলেছেন,  "ইহার সরল অনুষ্টুপছন্দে ভারতবর্ষের সহস্র বছরের হৃদপিণ্ড স্পন্দিত হইয়া আসিয়াছে।" 

প্রাচীন গ্রিস ও রোমের ইতিহাসে যেমন আমরা পাই হোমারের "ইলিয়ড" ও  "ওডিসি" র মধ্যে। তেমনি ভারতবর্ষের ইতিহাস আমরা পাই রামায়ণ-মহাভারতের মধ্যে। একটি দেশ বা সমাজের ইতিহাস মহাফেজখানা হেফাজতের আবদ্ধ নয়। ‌ তার প্রকৃত ইতিহাস তার মহাকাব্যের মধ্যেই পাওয়া যায়। যে জাতির মহাকাব্য নেই, তার ইতিহাসও কুহেলিকা আচ্ছন্ন। মানুষের মনের উদার উন্মুক্ত মহাফেজখানাতেই পাওয়া যায় প্রকৃত ইতিহাস। ‌

 

সাহেব ঘেঁষা ইতিহাসবিদরা, দুর্ভাগ্যক্রমে মহাভারত- রামায়ণকে মজার উপন্যাস বলে প্রতিপন্ন করার আগ্রহী। রোম, গ্রিসের ইতিহাসবেত্তা লিবি, হোরোডেটাস প্রভৃতি এবং মুসলিম ইতিহাসবেত্তা ফেরেশতা প্রণীত গ্রন্থাবলী যদি ইতিহাস বলে গৃহীত হতে পারে তবে মহাভারত ঐতিহাসিক মর্যাদা পাবে নিশ্চয়ই। মহাভারত একটি "লোকায়ত গ্রন্থ" (বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়) । সুতরাং এতে কাল্পনিক বৃত্তান্তের বাহুল্যঘটা খুবই স্বাভাবিক। শূন্যে কখনো অতিকথন বা Myth সৃষ্টি হয় না। বাস্তবের মাটিতে অর্থাৎ সমাজের প্রচলিত ধাঁচেই Myth তৈরি হয়। এই Myth সমাজজীবন কে ধারণ করে রাখে। সমাজ বা সভ্যতার ইতিহাসের ধারাকেই Myth বহন করে চলে। মহাভারতের ইংরেজি অনুবাদক রাজা গোপালাচারীর ব্যাখ্যা, 

"Mythology and holy figures necessary for any great culture to rest on its stable spiritual foundation and functions as a life giving inspiration and guide."

 

রাজাগোপালাচারী আরো বলেন, 

"They are the records of the mind and spirit of four fathers who cared for the good, ever so much more than for the pleasant and who saw more of the mystery of life, then we can do our  interminable pursuit for petty and illusory achievements in the material plane."

         

স্বামী বিবেকানন্দও এই দৃষ্টিকোণ থেকেই মহাভারতের ঐতিহাসিকতার বিষয়টি বিচার করেছেন। তিনিও বলেছেন যে, কালে কালে মূল মহাভারতে নানাবিধ আখ্যায়িকা, উপাখ্যান, পুরান, দার্শনিক, নিবন্ধ, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ে সংযোজিত হলেও পরিশেষে তা এক প্রকাণ্ড গ্রন্থের রূপ পরিগ্রহ করেছে। তাঁর বিচারে,  মহাভারত হলো  "প্রাচীন আর্যগণের জীবনচরিত ও জ্ঞান রাশির সুবৃহৎ বিশ্বকোষ।"  সুতরাং ভারতবর্ষের ইতিহাস জানতে হলে এই বিশ্বকোষকে কল্পকথা বলে উপেক্ষা করা যায় না‌।

 

মহাভারত হল সংহিতা। অর্থাৎ পঞ্চমবেদ ধর্মগ্রন্থ। পুরাকালে আখ্যান ছিল খন্ড খন্ড। সেই ঐতিহ্য ও আখ্যান সংগৃহীত হয়ে স্থান পেয়েছে মহাভারতেও। মহাভারত প্রাচীন সমাজ ও নীতিবিষয়ক তত্ত্বের অনন্ত ভান্ডার। ভূগোল, গ্রহ-নক্ষত্র, জীবতত্ত্ব, চিকিৎসাশাস্ত্র, প্রভৃতি সম্বন্ধে মহাভারতে প্রাচীন ধারণা ও বিজ্ঞান বিধৃত।

এই গ্রন্থ তাই কাব্য রসেসিক্ত ধর্মগ্রন্থ হয়েও "ইতিহাস"।  আমরা জানি যে, মহর্ষি ব্যাসদেব বিরচিত “মহাভারত"। কিন্তু প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক এবং শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিকদের রচনা পরে জানা যায়, বাস্তবে মহাভারত কোন ব্যক্তি বিশেষের রচিত ইতিহাস নয়। কবিগুরুর ভাষায়, "একটি জাতির স্বরচিত স্বাভাবিক ইতিহাস।"

 

 সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র এবং অন্যান্যদের বিচার অনুসারে,  প্রাচীন কিংবদন্তি ও রচনা একত্রে সংগ্রহ করে এক একখানি "পুরান" সংকলিত হয়েছিল। বৈদিক সূক্তগুলি সংকলিত হয়ে --- "ঋক", "যজু:", " সাম"  এই তিন সংহিতায় বিভক্ত হয়েছিল। বেদ বিভাগের জন্য বিভাগ কর্তার উপাধি ছিল ----- "ব্যাস" । 'ব্যাস' কোন ব্যক্তির নাম নয়। এটি একটি বিভাগীয় কর্তার উপাধি। মহাভারতের সংকলকের নাম কৃষ্ণ। দ্বীপে তাঁর জন্ম হয়েছিল। তাই তিনি ' 'কৃষ্ণদ্বৈপায়ন'  নামের শ্রদ্ধেয়। যুগ যুগান্তরব্যাপী মহাভারতের যেসব রচয়িতারা তাদের কাহিনী ও বর্ণনা প্রক্ষিপ্ত করে এসেছেন, তাঁরা সকলেই "ব্যাস" নামেই লীন হয়েছেন। জাতির "স্বাভাবিক স্বরচিত ইতিহাস" বহুজনের সম্মিলিত অবদানের ফসল। সুতরাং 'ব্যাসদেব' কোন একজন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বিশেষ নন।  তৎকালে একটি আচার্যের পদ। এই বিচার কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাজা গোপালাচারী, রাজ শেখর বসু সহ বহু শ্রদ্ধেয় ঐতিহাসিকের।  যেমন, আমরা জানি যে,  দেবরাজ "ইন্দ্র" একটি বিশেষ পদ;  কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম নয়। মহাভারতে বর্ণিত ইন্দ্রের কার্যাবলীর মধ্যে নানা সময়ে নানা অসঙ্গতির যে চিহ্ন পাওয়া যায় তারও কারণ ইন্দ্র পদাধিকারী নানা ব্যক্তির নানা নীতি ও কৌশল।

 

মহাভারতের কাহিনীতে আমরা পাই, অসততা, তঞ্চকতা, কপটতা, চৌর্য, নারী লোলুপতা, অর্থগৃধ্নুতা। আবার একই সঙ্গে পাই,  শ্রেয়বোধ, আত্মত্যাগ, সততা, ধৈর্য, সাহস, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, রাজ ধর্ম, কূটনীতি, সদাচার, পতিব্রতা, কর্তব্যবোধ,  এমনকি পরিবেশ ও পশুপক্ষীর প্রতি মানুষের পালনীয় কর্তব্য এবং সর্বোপরি ধর্মীয় জীবনযাপনের শিক্ষা মহাভারতের অজস্র ঘটনায় সন্নিবেশিত হয়েছে। ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ ---- এই চতুর্বর্গ এতে বর্ণিত আছে। তাই, ইতিহাস গ্রন্থ হয়েও মহাভারত সমগ্র ভারতবাসীর কাছে  "মহাধর্মগ্রন্থ " হিসাবে শ্রদ্ধেয়।  নৈমিষারণ্যের দ্বিজগণকে সৌতি ( উগ্ৰশ্রবা) বলেছিলেন, "যা মহাভারতে আছে তা অন্যত্র থাকতে পারে, যা এতে নেই তা আর কোথাও নেই।"

 

যে সময় মহাভারত রচিত হয়েছিল সে যুগে ভারতবর্ষের সীমা ইংরেজ শাসিত ভারত ছিল না। বর্তমান ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সীমাকে বিচার করলেও হবে না। তার ছিল বহুদূর বিস্তৃতি। হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আফগানিস্থান, এমনকি সিরিয়া ইরান প্রভৃতি দেশ মহাভারত বর্ণিত ভারতের অংশ ছিল। তিব্বতের উত্তর-পশ্চিম, মতান্তরে সাইবেরিয়া ছিল মহাভারত বর্ণিত উত্তর কুরু অঞ্চল। কাশ্মীরের উত্তরে ছিল কম্বোজ, আধুনিক কুশী নদী  মহাভারতের কৌশিকী নদী। জব্বলপুর ছিল চেদিদেশ। উত্তর প্রদেশের সীতাপুর জেলা ছিল নৈমিষারণ্য। কামরূপ প্রাগজ্যোতিষ দেশ। পাঞ্জাবের চন্দ্রভাগা ও ইরাবতী নদীর মধ্যবর্তি অঞ্চল ছিল মদ্রদেশ।  দিল্লির পূর্ব দিকে মিরাটের কাছে গঙ্গার ধারে ছিল  হস্তিনাপুর‌। 

             

 বালি খুঁড়লেই যেমন শোন নদীর জল নির্গত হয়,  তেমনি এইসকল আঞ্চলিক Myth বা স্মৃতিমালা অনুসন্ধান করলে ইতিহাস বিমুক্ত হয়ে ধরা দেবে। সাহেব ঘেঁষা আধুনিক যুক্তিবাদী (?!) ইতিহাসবিদরা তার ধার কাছ দিয়ে না গিয়ে, প্রতিপন্ন করতে চান, মহাভারত একটি সুরম্য কাব্যগ্রন্থ মাত্র। ইতিহাস নয়।  বিলাতি পণ্ডিতরা সর্বদা প্রমাণ করতে তৎপর,  ' ভারতীয়রা পরাধীন দুর্বল হিন্দু জাতি, হয়তো কোনো কালে সভ্য ছিল। তবে তা অতি প্রাচীন।' এই সকল পণ্ডিতরা সবাই না হলেও অধিকাংশই প্রাচীন ভারতবর্ষের গৌরব খর্ব করতে নিযুক্ত ছিলেন। সাহেবদের হাত ধরে যারা ভারতবর্ষের ইতিহাস খুঁজতে যান তারা ধানের ক্ষেতে বেগুন খোঁজেন।

 

কোনো কোনো ভারতীয় পন্ডিত  আধুনিক দৃষ্টিও মাপকাঠিতে রামায়ণ ও মহাভারতের অসংগতি বিচার করেন। তাঁরা রাম সীতার দাম্পত্য সম্পর্ক, রামের কর্তব্যবোধ, অর্জুনের একাধিক বিবাহ, যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলা ও দ্রৌপদীকে পণ রাখা প্রভৃতি নানাবিধ ঘটনার বিচার করেন। লক্ষণের চরিত্র ভাল না মন্দ, রামের চরিত্র কতটা নিষ্কলুষ এসব বিচার আধুনিক সাহিত্য ও সমাজের ছাঁচে করে থাকেন।  এ বিষয়ে রাজশেখর বসুর  মতামত প্রণিধানযোগ্য। তিনি তাঁর রচিত "রামায়ণ" এর ভূমিকায় বলেছেন, হাজার হাজার বছর পূর্বে সম্পূর্ণ ভিন্ন সমাজ ভিন্ন ভাবনার চরিত্রদের এই যুগের মাপকাঠিতে আমাদের বিচার করার কোন অধিকার নেই। এদের বিচার করবার আমরা কেউ নই। হাজার হাজার বর্ষ পেরিয়ে যে মহাভারত আজও মর্যাদার আসনে অক্ষুন্ন আছে তার ইতিহাসই আমাদের মুখ্য বিবেচ্য। এই ভাবনায় ভারতীয় সমাজ ও ধর্ম জীবনের ইতিহাসের ক্রমবিবর্তনের ধারার এক বিশ্বস্ত ইতিহাস-  মহাভারত। এক্ষেত্রে ব্যক্তি রাম-সীতা, রাবণ, যুধিষ্ঠির-অর্জুন-ভীম-দূর্যোধন-দূঃশাসন প্রধান নয়। প্রধান হচ্ছে সতত প্রবহমান ইতিহাসের ধারা। তাই মহাভারতকে ভারতীয় সভ্যতার যথার্থ ইতিহাস হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়।

         

অধ্যাপক সৌম্য ঘোষ
হুগলী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারতবর্ষ 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top