সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

বেওয়ারিশ : শারমিন সুলতানা রীনা 


প্রকাশিত:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:৩৪

আপডেট:
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ০২:৩৯

ছবিঃ শারমিন সুলতানা রীনা 

 

গাঙে ভাইসা আসা সারা শরীরের মাংস ক্ষইয়া গেছে আপনে সেই লাশ কবর দেওনের লেইগা আপনার পোলা বইলা সনাক্ত করলেন আব্বা? কামডা কি আপনে ঠিক করলেন?আমি এহনও এই ভিটায় পইড়া আছি আপনের পোলার আশায়।আমার বিশ্বাস একদিন সে ফিরা আইবো।জীবনের এতো মূল্যবান সময় আমি পইড়া থাকলাম তার লেইগা তার ফেরত আসনের লেইগা।পাঁচটা বছর বাপ মার বাড়িও গেলামনা আত্বিয়-স্বজনের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওন লাগবো বইলা।কি উত্তর দিতাম মাইনষেরে স্বামি আমারে ফেলাই থুইয়া অঁচিন দেশে আবার বিয়া কইরা ঘর বানছে এইডা কইতাম?এই সকল কথার উত্তর দিতে পারুমনা বইলা আজো আপনার ভিটা পাহাড়া দিতাছি আপনাগো দেখাশোনা করতেছি।নিজের জীবনের সাধ আহলাদ সব বিসর্জন দিলাম আপনার পোলারে ভালোবাইসা বিয়া বসনের দায়ে।আপনিতো ভালো মতোই জানেন আমার বাপ মা কেউ রাজি আছিলনা এই বিয়ায়।তারা অন্যহানে আমার বিয়া ঠিক করছিলো আমি ভালোবাসতাম আপনার পোলারে তাই রাইতের আন্ধারে তার হাত ধইরা সবার চোখ ফাকি দিয়া ঘর ছাড়ছিলাম তার লগে।পরে আপনি কাজি ডাইকা আমাগো দুইজনরে বিয়া দিছিলেন সেই কথাটাকি এহন ভুইলা গেছেন আব্বা।

আমার রঙিন শাড়ি খুইলা সাদা থান আমি পরতে পারুম না।আপনি যারে আপনার পুত্র বানাইছেন সে আমার স্বামী না আমি তারে স্বামী বানাইতে পারুম না।যা করনের আপনে কইরেন আমি এর মধ্যে নাই।

 

খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে আব্বাস শেখ।ছেলে বউয়ের কথার কোন উত্তর দিতে পারছেনা।রাত অনেক হয়েছে খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে আব্বাস শেখ।ভাতের লোকমা তার গলা দিয়ে নামছেনা।কেরোসিনের কুপির আলোও নিভু নিভু।পুত্র শোকে স্ত্রী জমিলা সয্যাশায়ী আজ পাঁচ বছর হলো।একটাই ছেলে তার আর কোন ছেলেমেয়ে হয়নি।অভাবের সংসারে সুখ কাকে বলে জানেনা ছেলেকে সামান্য লেখা পড়া শিখিয়েছিলো।বেশীদূর এগুতে পারেনি।লেখাপড়া ছেড়ে ছেলে তার বাউন্ডুলে হয়ে গিয়েছিলো কাজ কর্মও করতোনা ঠিক মতো।এই নিয়ে পিতাপুত্রের সব সময় ঝগড়াঝাটি লেগে থাকতো।স্ত্রী জমিলা একটা ছেলে বলে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছিলো কারো কথাই সে শুনতোনা।একটা ছেলে বলে কথা আব্বাস শেখ ছেলেকে বকলেও কড়া শাসনে কোনদিন যায়নি।একদিন জানতে পারে গ্রামের মেম্বার হানিফ শেখের মেয়ে কুসুমের সাথে তার সম্পর্কের কথা।এ নিয়ে ছেলেকে শাসন করেছে ভয়ভীতি দেখিয়েছে কিন্তু কেন কাজ হয়নি।ছেলেকে বোঝানো হয়েছে মেম্বারের মেয়েকে তারা কোনদিন আসাদের হাতে তুলে দেবেনা বরং গ্রাম ছাড়া করবে।আসাদও একগুয়ে কোন কথায় সে কর্ণপাত করেনি।

একদিন রাতে ঘুমিয়ে পড়েছে ছেলে তখনও বাড়ি ফিরেনি।এ নিয়েও তাদের চিন্তার অন্ত ছিলনা কখন কার সাথে মারামারি করে খুন হয় কে জানে।

হঠাৎ দরজায় জোরে জোরে কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় আব্বাস শেখের।দরজা খুলতেই চোখ ছানা বড়া হয়ে যায়।অঁচেনা এক মেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে আসাদ।হতভম্ব হয়ে দরজা ধরেই দাঁড়িয়ে থাকে আব্বাস শেখ।বাবাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে কুসুমকে নিয়ে ঘরে ঢোকে।মাঝরাতে স্বামী স্ত্রী বিলাপে মেতে ওঠে।হারামজাদা কােন বাড়ির মেয়ে নিয়ে আসছিস ঘরে?আসাদ মাথা নীচু করে জবাব দেয় মেম্বারের মাইয়া কুসুম।মাথার উপর বজ্রপাত ঘটে।মেম্বারের মাইয়ারে তুই এভাবে আনছোস সকাল হইলে ওরা আমাগো গ্রাম ছাড়া করবো।কিচ্ছু করবোনা তুমি চুপ করো বাজান।চিল্লাইয়া পাড়ার মানুষ জড়ো কইরোনা।চকির এককোণায় কুসুমের হাত ধরে বসে থাকে।আব্বাস শেখ কি করবে তার মাথা কাজ করছেনা বাকি রাত সবাই বসে থাকে।ফজরের আজানের পর আব্বাস শেখ ঘর থেকে বের হয়ে নামাজ পড়ে দ্রুত গতিতে কুসুমদের বাড়ির পথে ছুটতে থাকে।বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলে কুসুমের বাবার কাছে।নির্লিপ্ত ভাবে কুসুমের বাবা বলে কষ্ট পেয়ে আর কি হবে ওকে আমি আর মেয়ে বলে স্বীকার করিনা যা ভালো হয় তুমি করো মিয়া।আমরা আর কিছু বলতে চাইনা। ভাববো আমাদের মেয়ে মরে গেছে।মান সম্মান যা যাবার তা গেছে তুমি বাড়ি যাও তোমাদের বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নাই।

অবশেষে কাজি আর মৌলানা ডেকে বিয়ে পড়ায়।কুসুমদের বাড়ি থেকে কেউ আসেনা।কুসুমেরও বাপের বাড়ি যাওয়া চিরতরে বন্ধ হয়।

ভালোবাসা আবেগ অনুভুতির কাছে পৃথিবীর সব কিছু তুচ্ছ হয়ে যায় কুসুমের বেলায়ও ঠিক তাই ঘটে।তাকে নিয়ে চারজনের সংসার অভাবতো নিত্য সঙ্গী হয়েই আছে।কুসুম মানিয়ে নেয় এ জীবন।

একদিন শশুরকে বুঝিয়ে শেষ সম্বল একটা জমি সেটা বিক্রি করে আসাদ কে বিদেশে পাঠায়।প্রথম প্রথম যোগাযোগ করলেও আজ পাঁচ বছর কারো সাথে আর যোগাযোগ নেই আসাদের।পরিচিত কারো কাছেও আর তার কোন সন্ধান পায়না।কুসুম মানুষের কাপড় সেলাই করে তিনজন মানুষের ভরণপোষণের যেগান দেয়।কখনও কোন অভিমান আক্রোশ ওর মধ্য কাজ করেনা।তার আজো বিশ্বাস আসাদ একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।শাশুড়ি পুত্রশোকে প্যারালাইসড হয়ে আছে।তা নিয়েও কুসুমের মনে কোন খেদ নেই।অতিরিক্ত বেদনায় সে পাথর হয়ে গেছে।কোনদিন ভুলেও অনুশোচনায় একফোঁটা চোখের পানিও ফেলেনি দোস দেয়নি ভাগ্যের।যে ভাবে সে রাতের আঁধারে ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসাদের হাত ধরে পালিয়ে এসেছিলো সে দোসে কাউকে দোসী করতে চায়না স্বয়ং নিজের ভাগ্যেকেও না।তবুও নিজেকে সান্তনা দেয় কাউকে ভালোবাসাতো পাপ নয়।

ভাত মুখে না দিয়া বইসা আছেন কেন?আপনি আমার কথার জবাব দেন সম্বিৎ ফিরে আসে আব্বাস শেখের।সে নিজেও জানেনা এটা তার ছেলের লাশ কিনা

প্রতিদিনের মতো ফজরের নামাজ পড়ে বের হয়ে দেখে মানুষের হট্রগোল।একটা পচা গলা লাশ নিয়ে সকলের উত্তেজনা। গাঙের পাড়ে পইরা আছে সনাক্ত করতে না পারলে লাশের দাফন কাফন হবেনা।তাছাড়া তার ছেলেও আজ অনেকদিন নিরুদ্দেশ। কারো কাছথেকেই কোন খবর পাচ্ছেনা ছেলের।আব্বাস মিয়ার বুকের মধ্য,ছেলের জন্য একটা হাহাকার অস্ফুট চিৎকারে বলে ওঠে ওরে দাফন কাফন দেও ও আমার পোলা আসাদ।তারপর সকলের গুঞ্জন থেমে যায়।লাশের দাফন কাফন শেষ করে বাড়ি আসতে আসতে রাত হয়ে যায়।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় কুসুম চুপ করে থাকে।নিজের মতো রান্না বান্না সেরে শাশুড়ি কে খাইয়ে শশুরকে খেতে দিয়ে লাশের কথাটা তেলে।

ঃহরে মা আমি সবাইরে কইছি আমার পোলা আসাদ এইটা।না কইলে তার আরো পচন লাগতো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে।

ঃআপনে যে কইলেন আপনেতো শিওর না

ঃহরে মা আমিও শিওর না তবু আইজ পাঁচ বছর সে নিখোজ সে যেমন ডানপিটে তার শত্রুরওতো অভাব নাই।এমনওতো হইতে পারে ও বিদেশ থেইকা আসার পর কেউ ওরে মাইরা গাঙে ভাসাই দিছে।আর কোনদিন ও ফেরত আইবো না আমি বুকেত পাথর বানছি তুইও মাইনা নে মা

ঃআমি মানতে পারুম না আব্বা যদি কোনদিন সে ফেরত আসে আমি প্রতিটা মুহুর্ত তার সাধনায় কাটাই।এ আপনি কি করলেন আব্বা এ আপনি কি করলেন। অন্যের লাশরে আপনার একমাত্র পোলার লাশ বানাই দিলেন।কুসুমের এতো দিনের চাপানো কষ্ট বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতে উছলে ওঠে।এতোদিনের আশা আকাঙ্খা অপেক্ষার অবসান ঘটাতে তাদের গাঁয়েই ভেসে উঠলো বেওয়ারিশ এ লাশ?

 

সমাপ্ত

 

শারমিন সুলতানা রীনা
কবি, ছড়াকার ও লেখক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top