সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

চিলেকোঠা : দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
২১ জুন ২০১৯ ০৬:২০

আপডেট:
১৮ মে ২০২০ ২২:৪৯

 

মাত্র ইন্টার পাস করেছে শিপলু। বাবার ইচ্ছা ছিলো ওই কলেজেই সে বিএ পড়ুক। কারণ এর চেয়ে বেশি ভাববার সাধ্য বা সাহস যে তার নেই ছেলেকে নিয়ে! কিন্তু গ্রাম-সম্পর্কের এক চাচাতো ভাইয়ের প্ররোচণায় পড়ে শিপলু ঢাকা আসতে আগ্রহী হয়ে উঠলো। বাবা তাকে ভাসমান অবস্থায় ছেড়ে দিতে রাজি নয় বিধায় বাধা-বিপত্তি, অপরগাতার ঝড় তুলেছেন। কিন্তু সিদ্ধি লাভ হলো না বাবার। শিপলু চলেই এলো।

নানান ঘাটের পানি খাওয়া চাচাতো ভাইটি শিপলুর থেকে বেশ ক’বছরের বড়। ঘাত-প্রতিঘাত এখন তার সয়ে যায়। তাহের শিপলুকে সঙ্গে করে যেখানে উঠলো সেটা তার বহুদিনের চেনা রামপুরা এলাকায় এঁদো গলির কাঁদা থিকথিক উঠানোর চেয়ে মাত্র ক’ইঞ্চি উঁচু ভিটের টিনের ছাপড়া। লম্বা সারি বাঁধা ছাপড়া। অসংখ্য তার খুপরি ঘর। একটা সারি থেকে আরেকটার মাঝখানে আড়াই ফুট তিন ফুট করে হিসেবের জায়গা।

খুপরি মধ্যে ছয় ফিট কি সাত ফিট করে যে জায়গা সেখানে প্রায় প্রতিটি রুমে পাঁচজন করে থাকছে। দুটো পায়খানা লাগালাগি অবস্থায়। খোলা জায়গায় একটিমাত্র কল। একসঙ্গে অনেকে গোসল সারে সেখানে। আবার আগে পরে নিয়ে পরস্পরের লাগালাগি। প্রথমে বালতি ছোঁড়া, তারপর বদনা, তারপর গোটা সাবানও। শেষে পরনের ভেজা গামছাও খুলে প্রতিপক্ষকে বেঁধে ঘায়েল করতে চাওয়া কাউকে কাউকে এ-কদিনে চিনে ফেলেছে শিপলু।

তাহেরের খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। সে এক বাড়ির দুটি বাচ্চাকে দু’বেলা করে পড়িয়ে দু’বেলাই খেয়ে আসে। আর যদি কোনো বেলা পড়াতে না যেতে পারে সে বেলা না খেয়েই থাকতে হয়। তবে শিপলুর জন্য একপোয়া চাল দুটো-তিনটে আলু, কখনো একটা ডিম কিনে কাউকে বলে যায় তাদের চালের সঙ্গে ফুটিয়ে দিতে। আর প্রতিদিন ওভাবেই একবেলা ফুটানো ভাত শিপলু খায়, দু’বেলা করে।

প্রায় বস্তির মতো ঘিঞ্জি, ছাপড়ার ওইটুকু জায়গায় এতগুলো মানুষের মধ্যে শিপলুর সেঁদিয়ে থাকা তাহেরকে বিব্রত করে। শিপলু তাদের এভাবে থাকার বর্ণনা গ্রামে গিয়ে ঝাড়লে আর শহরের হম্বিতম্বি ভাবটা বজায় রাখা যাবে না। কদিন তাই লেগে থেকে আর একটু ভালো বাসস্থান খুঁজলো সে। শেষে পেয়ে গেল পাঁচতলার উপরে একটি চিলেকোঠা।

‘চিলেকোঠা’ শব্দটি কানে যেতেই গল্পে পড়া নিঃসঙ্গ দুপুরগুলোয় আকাশ ছুঁ’য়ে কোনো বিষন্ন বালকের ছবি ভেসে ওঠে শিপলুর চোখের পাতায়। বুকখানা তার দুরুদুরু করতে থাকে কৌতূহলে। কিন্তু টিনের বাক্স, হাতপাখাখানা এবং দুজনের দুটো বালিশ, চারটি কাঁথা, শার্ট, গেঞ্জি, লুঙ্গি একত্র করতেই বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে দেখলো তার মতো আর কারো চোখ জলে ডুবছে না। এমনকি এদের এতদিনের সঙ্গী তাহেরও না।

শিপলু বুঝলো এরকম ঠেলাধাক্কা খেতে খেতে সবগুলোর কৈ মাছের প্রাণহয়ে গেছে। ওখানকার সবাই তাকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কাছেই তো যাচ্ছো ভাইডি! ওইতো বাইরে দাঁড়ালে তোমাদের চিলেকোঠা দেখা যায়। আর যেতে আসতে এতবার দেখা হবে-তারপর ভুইলেই যাবে এরকম কবে কার সঙ্গে ছিলা। দুনিয়া বড় কঠিন ভাইডি! মাত্র তো ঘর ছাইড়া আইলা। চোউখখের পানির স্বাদ আর থাকবো না।

দেশী কুকুরের ঘেউ ঘেউ গেটটি পার হয়ে তাহেরের পিছনে ময়লা, জীর্ণ বিছানাপত্র নিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে সিঁড়ি ভেঙে ছাদে পৌঁছাতেই বুঝলো রোদ-বৃষ্টির দাপটে আক্রান্ত কুটিরটি এতটুকুু পরিসর। ঘর বলতে যে নিবিড় আশ্রয় মানুষের চোখের সামনে ভেসে ওঠে, এ সেরকম নয়। তার উপর আবার কাঠ বাঁশে অর্ধেক জায়গা ঠাঁসা। থাকতে হবে এসব কিছুর পাহারাদার হয়ে। তার উপরে আবার ভাড়া একহাজার টাকা। অবশ্য ওখানেই লাগানো আছে একটি গ্যাসের চুলা এবং লাগোয়া একটি বাথরুম।

চারপাশে দু’ফুট উঁচু করে দেয়ালগাঁথা ছাদখানা মোটেও নিরিবিলি নয়। মোট দশটি ফ্ল্যাটের মানুষজন সারাক্ষণ কাপড় শুকোতে আসা-যাওয়া করে। তার ওপর আবার মধ্যদুপুরগুলোয় প্রায়ই দেখা যায় দোকান থেকে একখানা রঙিন ঘুড়ি কিনে রুটি তৈরির বেলুনে শিশুরা তাতে সুতো পেঁচিয়ে ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করছে। তা নিয়েও কত মধুর হাঙ্গামা দলবাধা ছেলেগুলোর হৈ-চৈ মন্দ লাগে না শিপলুর।

আঠারো-উনিশ বছরের সব পিছুটানমুক্ত ছেলেটির কোথায় যেন একটি টান প্রচ- হয়ে ওঠে এখানে এসে। হয়তো ওদের ভেতরে সে তার শৈশবেও পৌঁছে যায়। যেখানে থেকে জানতে শুরু করেছিলো অস্থিত্বহীনতার ভয়াল আভাস। সবাইকে ছেড়ে, এমনকি ওই এঁদো গলির খেটে খাওয়া, ঘামের উৎকট গন্ধে ভুরভুর মানুষগুলোও যদি তাকে ওখানে জড়িয়ে ফেলতো তাহলে এই অনন্ত বিষাদ তার কাছে স্বাদহীন থেকে যেত। সে জীবনেরও কোনো মাহাত্ম্য ছিলো না। এখনও যেমন নেই। তবু এই গোলকধাঁধাঁ মন্দ লাগছে না। জর্জরিত বুকে সুখের পিপাসা।

তাহের ঘরে এসে দেখে, সে যে জিনিস যেখানে রেখে গেছে সেভাবেই আছে। তাহের চালের ঠোঙা থেকে না-ধোয়া পাতিলটির মধ্যে চাল ঢেলে আলুগুলোও তাতে তুলতে তুলতে বলে, তোকে গ্রাম থেকে আনলাম, তুই শহরের কলেজে পড়বি। দুচারটে টিউশনি জোগাড় করে নিবি। কিন্তু এ রকম কবি কবি ভাব ধরে থাকলে মাঠে মারা পড়বি বলে দিলাম।

আসলে আমি আগে কিছু করিনি তো! ঘরে কোনো কাজই খুঁজে পাই না। বলো কী করবো, তাহের ভাই! শুধু দেখিয়ে দিলে আমি চেষ্টা করবো সব কাজ গুছিয়ে রাখতে।
-কিছুই করতে হবে না তোকে এখন! মোটে একটা ডিম দু’টো আলু সিদ্ধ হলে সব একত্রে মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে ভর্তা মাখাবো। তারপর দু’জনে খাবো। এখনি বেরিয়ে যেতে হবে আবার।
-টিউশনি কীভাবে যোগাড় করবো?
-বের হয়ে খুঁজতে হবে! এভাবে চিলোকোঠায় এসে কেউ তোমাকে খোঁজ দিয়ে যাবে না। আমাকে দেখে শেখো! হাঁটতে হাঁটতে কুকুর হয়ে যাই, তবেই না চারটে ভাত জোটে! 
-তুমি খুঁজে দাও না! 
-খুঁজছি তো। সে তোকে বলে দিতে হবে? তবে তুইও চেষ্টা কর।
তাহের এসএসসি পাস করেনি, অথচ বলে বিএ পাস। মিথ্যে কথা না বললে টিউশানি পাবে না। ‘রিকশা চালানোরও  যোগ্যতা নেই শেষে খাবো কী?’ এ তাহেরের নিজের অভিমত। তাই শুনেই শিপলু বললো, ‘তাহের ভাই এ চিলোকোঠা তোমার বিএ পাশের মতোই কী বল?’ দু’জন একসঙ্গে হাসে। অনেকক্ষণ ধরে হাসে।

এ বাড়ির বাড়িওয়ালি রোজ বিকেলে একবার ছাদে আসেন তার একমাত্র প্রতিবন্ধী সন্তানটি নিয়ে। থাকেন অনেকক্ষণ। চৌদ্দ-পনেরো বছরের ছেলেকে হাতে ধরে হাঁটেন, কথা বলেন। যদিও ছেলের তার কথা কিছুই বোঝার কথা নয়। কারণ সে এতটাই প্রতিবন্ধী যে, ঢোক গিলতেও পারে না। গলায় আলগা কাপড় বেঁধে রাখতে হয় শার্ট বাঁচাতে। ফুলের টবগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে, ফোটা ফুল দেখিয়ে, মুকুল নেড়ে কখনো আকাশে আঙুল নির্দেশ করে কী যে তিনি ছেলেকে বলেন, শিপলুর বড় লোভ হয় ওই প্রতিবন্ধীর জায়গায় নিজেকে কল্পনা করতে।

মহিলার চোখে মুখে যে বিষন্ন ভাব, ওটুকুই তার কাছে পরম লাবণ্য মনে হয়। বুকের ভেতরে মোচড় দিয়ে ওঠে। ওইটুকুুতে শিপলুর মনে সমস্ত আকাশ মেঘে মেঘে থৈ থৈ করে। মহিলার প্রতি কতদিন কপালে হাত ঠেকিয়ে ‘স্লামালেকুম’ বলতে কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি চোখ সরিয়ে নিয়েছেন। শিপলু বুঝে ফেলেছে বাড়িওয়ালা-ভাড়াটিয়া সম্পর্ক বজায় রাখতে একটি ‘টানটান ভাব’ তিনি সবসময় রক্ষা করেন। উনি ছাদে থাকাকালীন অন্য ভাড়াটিয়া মহিলা এলেও উনি তটস্থ হয়ে ওঠেন মুখে গাম্ভীর্য ফোটাতে। তবু শিপলু মরিয়া হয়ে ওঠে কখন সূর্য ঢলে পাটে বসবে! কখন? কখন নিষ্করুণ মুখচ্ছবি আর ভারাক্রান্ত জীবনের গ্লানি ওই প্রতিবন্ধীটিকে নিয়ে তিনি ছাদে আসবেন? কারণ উনি এলেই না এই স্বল্প পরিসরের ছাদখানা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ঐশ্বর্যেম-িত হয়ে ওঠে তার কাছে।

তাহেরের পারদচটা ওই পুরোনো আয়নায় শিপলু দেখেছে আয়নার ফোঁটা তার নিজের প্রতিবিম্বে ওই মহিলার ছায়া। আবার ওই মহিলার অবয়বে ওই আয়নার প্রতিবিম্বের আবছায়। তৃষ্ণাও হাহাকারে পুড়ে ছাই হতে থাকে শিপলু। প্রতিদিন যেন যন্ত্রণাদগ্ধ শরীরে নতুন প্রাণ পায় সে একটু করুণার মেঘ গলে সিক্ত হওয়ার আশায়। বাড়িওয়ালাকেও দেখেছে শিপলু। এ ছাদেই দেখেছে। ভদ্রলোক ফুড ইন্সপেক্টর, প্রচুর টাকা করেছেন। অপ্রসদ্ধপায়ে বোঝাই যায়। তবু চেহারা ভ্যাবচ্যাকা খাওয়া। পোষা বেড়ালমার্কা। কারণ স্ত্রীর সঙ্গে পেয়েছেন শ্বশুরের সবটুকু সম্পত্তিও। চাকরিটিও শ্বশুরের টাকা ঘুষ দিয়ে পাওয়া। শ্বশুরই পাইয়ে দিয়েছিলো! কিছু বিগড়ানো ভাড়াটিয়ার কানাঘুষায় কথাগুলো কখন যে শিপলুর শ্রুতিতে ঢুকে গেছে! কাপড় নাড়তে-শুকোতে এসে এদের ভাব যেমন হয়, খুনসুঁটিও কম নয়।

পাথরের নিচে চাপাপড়া ঘাসের মতো মনে হয় তার এই পরিবারটিকে। কারণ কীসের অহংকার এদের? বিধাতা কী দিয়েছেন এদের অহংকার করার মতো? টাকা-পয়সার প্রাচুর্যে অন্ধ হয়ে আছে বলেই না গ্লানি কী তা বুঝতে পারে না, এই যা।

তাহের আবার ধমকালো শিপলুকে, ‘লেখাপড়া নষ্ট হলে শেষে চাচা আমাকে দোষ দেবেন। দুনিয়া বড় কঠিন ঠাঁই দেখিস। তুই দেখি কেমন ল্যাজব্যাজ করছিস। কাল থেকে আমার সঙ্গে বেরিয়ে পড়বি। দু’মাস হলো এখানে এসেছি। একহাজার করে টাকা গুনতে জীবন শেষ। তার উপর বাড়িওয়ালি ঝালিয়ে নিয়েছে, পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া শোধ করতে না পারলে জিনিসপত্র রেখে আমাদের বের করে দেবে। ওই দেখো, ওই বাঁশ-কাঠের উপর দুটো ভরা বস্তা। আগে যারা ছিলো তারা ভাড়া দিতে দেরি করেছিলো বলে জিনিসপত্র রেখে তাদের বের করে দিয়েছে।

যখন তারা টাকা দিয়ে এগুলো নিতে পারবে, নেবে। না হলে পড়ে থাকবে। শিপলু চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠলো তাহেরের কথা শুনে। সে চোখ আর সে ছোট করতে পারলো না। সকালে তাহের ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে রেডি হয়ে থাকলো টিউশানি যোগাড় করতে। তার আগে ঘুরে ফিরে কাউকে কাউকে তো চিনতে হবে। না হলে বলবে কাকে? যতটা পারলো ফিটফাট হয়ে দু’জন বেরিয়ে পড়লো। শিপলু হাঁটছে একটু আগে। পিছনে চোখ ফেটে কেন যেন পানি ঠেলে আসতে চাইলো তাহেরের।

সেদিনই রাতে খেতে বসে তাহের বললো, বাড়ি থেকে চিঠি এসেছে। জরুরি ভিত্তিতে মা আমাকে যেতে লিখেছেন। কটা দিন তুই একা থাকতে পারবি না?
-চাচি আমার কথা কিছু লিখেন নাই?
-না তো! 
-চাচি জানে আমি তোমার কাছে আছি। শিপলুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। মুখ শুকিয়ে আসছে লক্ষ করে তাহের বললো, চাচা তোর চিঠির উত্তর দেয়নি! 
-তোমার যা ঠিকানা! লিখলেও পাবো না।
-তুই আবার লেখ। এ বাড়ির ঠিকানা দিয়ে।
তাহের চলে গেছে সেদিনই। একঘরে নিজেকে খোঁয়াড়বন্দি মনে হয় শিপলুর। একটা বই, খবরের কাগজ কিছুই নেই, যাতে চোখ বুলোতে পারে সে। দুটো টিউশনি জোগাড় হয়ে গেছে। ভীষণ মনোযোগ দিয়ে পড়ায় সে ছাত্রদের। তবু পড়ানোর সময় এক ছাত্রের বাবা কেমন করে তাকায় তার দিকে। মনে হয় সে যেন পড়াতে ফাঁকি দিচ্ছে। আরেক জায়গায় ফাইভ সিক্সে পড়া দুটি মেয়েকে পড়ায়। দু’বোন ওরা। ব্রেন একদম ডাল। মুখ দিয়ে ফেনা উঠে যায় বোঝাতে বোঝাতে তবু তারা বোঝে না। ওদের বাবা-মাও লেখাপড়া সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না। পরের মাসে আরো একটা টিউশনি পেয়ে যায় শিপলু। আরো ভালো কাউকে পেলে আগের দুটো ছেড়ে দেবে ভাবছে।

দেখতে দেখতে পনেরো দিন হয়ে গেছে তাহের যাওয়ার। শিপলুর ছাত্র পড়ানো শেষ হলেই সে চিলেকোঠার ছাদে আবার ছুটে আসে। বিকেলে ওই সময়টুকু সে কোথাও থাকতে পারে না। চেষ্টা করে দেখেছে। পারে না। এর মধ্যে এক বিকেলে বাড়িওয়ালি তার ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তার উদ্দেশে বললেন, ‘এই ছেলে শোনো’ মাত্র কয়েক গজ জায়গার মাঝখানে শিপলু ছুটে তার কাছে গেলো বাজপাখির মতো। তারপর নদীবন্দী দু’টি চোখে আকুল তাকিয়ে বললো, ‘বলেন’।
-তোমার সঙ্গে যে ছেলেটি ছিলো, মানে যে রুম ভাড়া নিয়েছিলো সে কোথায়? -কপাল কুঁচকে তীব্র কৈফিয়ৎ বাড়িওয়ালির।
-ওর মা চিঠি লিখেছেন ওকে যাওয়ার জন্য...। ক’দিনের মধ্যে এসে পড়বে। কথাগুলো এমনি বলে ফেললো শিপলু। কিছু একটা বলতে হয় তাই।
-পাঁচ তারিখে ভাড়া দেয়ার কথা, অথচ মাস শেষ হয়ে যাচ্ছে।
-দেখি আমি যদি টাকা যোগাড় করে আনতে পারি।
-হ্যাঁ দেখো, বলে বাড়িওয়ালি হনহন করে নেমে গেলেন।

মাস শেষ হলেই টিউশনির টাকা সহজে তোলা যায় না। তার উপর আবার মাস থাকতে। তবু শিপলু বড় অনুনয় করে কিছু টাকা তুললো ছাত্রদের বাবা-মার কাছ থেকে। পরদিন দুপুর নাগাদ খুচরো খুচরো টাকায় একহাজার পুরিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে বাড়ির মালিকের দরজায় টোকা দিলো। কাজের ছেলেটি দরজা খুলতেই শিপলু বললো, ‘আমি ভাড়ার টাকা নিয়ে এসেছি।’ আবার ছেলেটি ভেতরে গিয়ে ফেরৎ এলো, ‘আমার কাছে দ্যান। আম্মা বিশ্রাম লইতাছে।’ টাকাটা শিপলু ওর হাতে গুঁজে দিয়ে প্রায় লাফাতে লাফাতে উপরে উঠে এলো। বুকের ভেতর জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। গ্লাস নিয়ে বাথরুমে ঢুকলো সে। ট্যাপ ছেড়ে পর পর যে সে কয়েক গ্লাস পানি খেয়ে ফেললো। কিন্তু রোদের আঁচে ফোটা গরম পানিতে যে উদর ভর্তি করে নিয়েছে টেরই পায়নি। এরপর যা হলো কেউই জানলো না। শরীর ও মনের যন্ত্রণা সমান হয়ে উদভ্রান্ত শিপলুর কী প্রশান্তিতে কেটে গেলো বেহুঁশ একটি বেলা।

ঘুম যখন ভাঙলো তখন গভীর রাত। বিকেলটির জন্য শিপলুর বেদনা হচ্ছে শুধু। আজ আর উঠে কী হবে। পাশ ফিরতেই টের পেলো তার ওপর জেঁকে বসে আছে অসংখ্য মশা। মশারি বাঁধতে গিয়েও মনে হলো না সে দুপুরে খায়নি। সকালেও না-খাওয়া অবস্থায় ছিলো। অতঃপর গড়ানো রাতেই সে বাবাকে লিখতে শুরু করলো।

বাবা,
বাবা তুমি আমাকে কোথাও পাঠাতে চাওনি। আমিই জোর করে এসে পড়েছি। এসে যে কী ভালো হয়েছে না বাবা। প্রথমে  যেখানে উঠেছিলাম একেবারে বস্তি যাকে বলে। পরে শুধু আমার জন্য তাহের ভাই এক বাড়ির পাঁচতলার উপর একটি রুম ভাড়া নিয়েছে।
সামনেই কয়েকটা ফুলের টব। কালো গোলাপ দেখেছো বাবা? এখানে আছে। এ বাড়ির বাড়িওয়ালিকে আমার কাছে তোমার সেই গল্পের নায়িকার মতো মনে হচ্ছে। নাকি হঠাৎ শোনা গল্পের মতো তোমার সত্যি কাহিনীটি আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে? তবে এঁর নামও সুরমা খন্দকার। বাড়ির দেয়ালে গাঁথা শ্বেতপাথরে জ্বলছে নামটি। যে নাম নিভে আছে তোমার প্রাণে, অস্তিত্বে। তোমার জীবনের ওই ঘটনা মনে করে আমার গায়ে কাঁটা দেয় বাবা। মাত্র ভূমিষ্ঠ হওয়া একটা শিশুকে বুকে জড়িয়ে গ্রামে এনে নিজের মায়ের কোলে দিয়ে বললে,  রাস্তায় এভাবে কাপড় পেঁচানো কুড়িয়ে পেয়েছি। একটা জীবন্ত শিশুকে কী করে ফেলে দিই? তারপর তার জন্য সমস্ত উচ্চাশা বর্জন করে আর শহরে গেলে না। গ্রামে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টারি আর মাটি ও বৃক্ষের সঙ্গে সখ্য গড়ে পড়ে থাকলে। অনেক বড়কিছু হতে না পেরে তোমার জীবন অসম্পন্ন রয়ে গেছে আমি তা বলছি না বাবা! বরং বুঝতে পারছি তুমি কত বড়মাপের মানুষ! 
তবে তুমি মাকে কোনোদিন বলো না আমি যে তোমার পালিত ছেলে নই। মনিরা আর শামীমকে কোনোদিন বলতে যেও না আমি ওদের সত্যিকারের ভাই। মনে হয় তাতেই আমি দূরে সরে যাবো। প্রতিপক্ষের মতো হয়ে যাবো। বাবা, আমার বাবা তুমি ভালো থেকো।

ইতি
শিপলু

আরো একটি মাস কেটে গেলো তাহেরের খোঁজ নেই। সুরমা খন্দকার আরো একদিন শিপলুর দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললেন, ‘শোনো ছেলে, তোমাদের অনিয়ম হয়ে যাচ্ছে। তোমরা অন্যখানে বাসা দেখো। আগামী মাসে দু’মাসের ভাড়া একসঙ্গে দিয়ে নেমে যাও...। শিপলু এগিয়ে এসে সুরমা খন্দকারের একেবারে সামনে এসে, একেবারে অবচেতন উচ্ছ্বসিত হয়ে বললো-আপনি মোর্শেদ চৌধুরী নামে কাউকে চেনেন?
হ্যাঁ... না।... সে বহু বছর আগের কথা বোধহয়, যাই হোক। তোমরা অন্যখানে বাসা দেখো! 
সুরমা খন্দকার আজো হনহন করে থেমে যান। আর দু’হাতে চৌকাঠ ধরে দাঁড়িয়ে থাকে শিপলু। যে মেঘখ- সে দুপুরে মাথার ঠিক উপরে দেখেছিলো এখন তা আকাশের শেষ প্রান্তে ঝুলে আছে। রংও আরও তেমনি নেই। বদলাতে বদলাতে কত রং যে খেলে গেলো তাতে! দেড়মাস পর সেদিনই সন্ধ্যায় তাহের এসে পড়ায় দরজা ছেড়ে দাঁড়ালো সে। তারপর খেয়াল হলো খালি গায়ে এভাবে সে ওই মহিলার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলো। তাহের বাড়ি থেকে শুকনো খাবার যা এনেছিলো, তাই দুজনে গোগ্রাসে গিলতে লাগলো। তাহেরকে দেখে শিপলুর অনেকদিন পর একটু ভালো লাগতে শুরু করেছে।
পরদিন শিপলু তার ছাত্রদের বাড়ি থেকে পাওনা টাকাগুলো থেকে একরকম চাপ দিয়েই কিছু তুললো। তারপরও বাড়িভাড়ার সব টাকা সংকুলান হলো না। টাকাগুলো সে তাহেরকে দেখালো না, লুকিয়ে রাখলো এবং তার মাথার একটা বিদঘুটে শখ চেপে বসলো। দুপুরে শিপলু শুকনো চোখে বেরিয়ে গেলো, ফিরলো রাত করে। তাহেরের কেমন ভয় হচ্ছিলো ওর দিকে তাকাতে।  যেন রাশি রাশি বিষন্নতা ফুটে ঝরছে ওর চোখে। ভাড়ার টাকাটা এ বেলায়ই পূর্ণ করলো সে। শরীর টলছে। তাহের জোর করায় খেতে বসতে হলো। কিন্তু তাতে চিবোতে গিয়ে টের পেলো গলা বন্ধ হয়ে আছে। কষ্ট! ভীষণ কষ্ট!! 
রাত গভীর হচ্ছে অথচ ঘুম আসছে না কারোর। তাহেরকে শিপলু বললো-আমি আর এখানে থাকবো না। অন্য কোথাও চলে যাবো।
-কেন?
-জানি না! 
-বললেই হলো! দু’মাসের ভাড়া বাকি।
-একমাসের ভাড়া আমি আগেই দিয়েছি! আর চলতি মাসসহ দু’মাসের টাকাও আমি যোগাড় করেছি তাহের ভাই। কালই তুমি ওই মহিলাকে দিয়ে দিয়ো।
-তোকে কিছু বলেছেন উনি! 
-পাশ ফিরে শুয়ে দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাসে সঙ্গে ‘না’ শব্দটি শুধু জুড়ে দিলো শিপলু। এর বেশি আর কিছুই কি সে বলতে পারে?
-বাসা পাওয়া কত কষ্টের জানিস?
-আমার কি অত ভাগ্য তোমাদের মতো,  যে কষ্টের স্বাদও জানবো?
-এভাবে বলছিস কেন? তোকে কিছু বললে আমি ওই মহিলাকে ছেড়ে দেবো ভাবছিস? কী হয়েছে বল! 
-সে তুমি বুঝবে না।
-চাচা তোর চিঠি পেয়েছে। আমাকে হাত ধরে বলে দিয়েছেন তোকে দেখে রাখতে।
-দাদিমা, মা, শামীম, মনিরা সবাই ভালো?
-সবার খবর বলতে পারবো না। মা’র অসুখ ছিলো তাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কোথাও যেতে পারিনি।
সব কথা শেষে শিপলু জানিয়ে রাখলো তার বাড়ি ভাড়া যোগাড়ের লোমহর্ষক কাহিনীটি। তাহের আর একটি কথাও বলতে পারলো না। তার শীত লাগতে থাকে, কুঁচকে আসে শরীর।

শিপলুও তো তাই জানতো, বাবা তাকে কুড়িয়ে পেয়েছিলো। কিন্তু বাবা বহুদিন যাবৎ কী যেন বলতে চান, কিন্তু পারেন না, দেখে শিপলু বাবাকেই জোর করলো। একদিন হালটের মধ্যে সরু আলপথটি বেয়ে একত্রিত কবরের উপর বেয়ে ওঠা লম্বা শনের গুচ্ছের পাশে গিয়ে বসলো দু’জন। বাবার শুরু করতে কষ্ট হয় গল্পটি। ছেলেকে তিনি প্রখর সূর্যের তাপের মতো ঠেলে দিলেন রূঢ় এক বাস্তবে। তার জন্মের ইতিহাসটি শুনিয়ে বোধহয় এও বোঝাতে চেয়েছেন মনিরা এবং শামীমের থেকে তিনি শিপলুকে কম ভালোবাসতে পারেন না। কারণ শিপলু তার নিজেরই ছেলে!

ছোটবেলায় বাবার মৃত্যু হয়েছিলো মোর্শেদ চৌধুরীর। কষ্টে শিষ্টে বিএ পাস করে গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে উঠেছিলো সুদর্শন তরুণ মোর্শেদ। মেসে থাকত। বাড়ি থেকে কোনো টাকা-পয়সা পেত না। নিজেও তেমন কিছু করে উঠতে পারছিলো না। একদিন এক রুমমেট তাকে একটি লজিং ঠিক করে দেয়। কিন্তু কদিনেই মোর্শেদ টের পেয়েছিলো এখানে লজিং মানে লেখাপড়া করানোর কাজ নয়। পুলিশ-কর্মকর্তা বাবার কিশোরী, আদুরে মেয়ে সকালে কুকুর নিয়ে জগিং করবে না তার পিছনে পিছনে ছুটে মেয়ে ও কুকুরটিকে পাহারা দিতে হবে। ওরকম হিমসিম মোর্শেদের মতো আরো অনেকে খেয়েও গেছে। অবশেষে মান না হলেও জানটি নিয়ে পালিয়েছে কেউ কেউ।

মোর্শেদের প্রতি মেয়েটির আচরণ ওই কুকুরের চেয়ে খুব বেশি ভালো ছিলো না। কিন্তু কখনো কখনো বেশি ভেবে তিনি ভুলটি করেছিলেন বা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মা ছিলো না মেয়েটির। মেয়ের উচ্ছন্নভাব আর তার পিতার শারীরিক, মানসিক অত্যাচারে দ্রুত অক্কা পেয়ে তিনি বেঁচে গেছেন। মেয়ের শরীরের অবস্থা যখন আর চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর নয় তখনই এসপি সাহেবের নজরে পড়লো। ডাক্তার এসে জানালেন এ সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে দিতে হবে। কারণ নষ্ট করার সময় পার হয়ে গেছে। এসপি সাহেব চাবুক নিয়ে ছুটে এলেন মোর্শেদের দিকে। থামিয়ে দিলো তার মেয়ে। ওর কোনো দোষ নেই, বলে।

বিশ্বস্ত কাজের লোক দু-একজন রেখে, সবাইকে বিদায় দিলেন এসপি সাহেব। আত্মীয়স্বজনেরও আসা বন্ধ হলো। কিন্তু মোর্শেদকে তিনি বাড়িতে বন্দি করে রাখলেন। কারণ তার পাপ তাকেই খতম করতে হবে। না হলের খুনের দায় কে নেবে?

আমি বলেছিলাম, আমি সুরমাকে বিয়ে করবো! কিন্তু আমাকে সেও তার যোগ্য মনে করেনি। তাদের তথাকথিক স্ট্যাটাস বলে কথা! তারপর সেদিন তাদের বাপবেটির সংলাপ শুনেই বুঝেছিলাম হর-হামেশাই ও মেয়ে ও-রকম ঘটাতে পারে এবং ঘটিয়েছেও। বাপ ছিলো একটা মাতাল লম্পটেরও চরম। মূল্যবোধ বলে আর কিছুই ছিলো না ওদের...।
-তারপর? শিপলুর উদ্বিগ্ন প্রশ্ন।
-শিশুটি ভূমিষ্ট হওয়ামাত্রই আমার সামনে এনে দেয়া হলো, মেরে ফেলতে।
-বাবা! কেঁদে উঠলো শিপলু।
শিপলুর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে ঋজু দেহের, কাঁচাপাকা চুলের গাম্ভীর্যে উজ্জ্বল মোর্শেদ চৌধুরী ধীরে ধীরে বললেন, তারপর সবকিছু পিছনে ফেলে আমি শুধু ছুটেছি তোকে বুকে নিয়ে! 
সকালে ঘুম থেকে উঠে তাহের দেখলো শিপলু ঘরে নেই, দরজা খোলা। আরেকটু পরেই টের পেলো ও-ওর সবকিছু নিয়ে চলে গেছে। শুধু চাবির ছড়া দিয়ে চাপা রেখে গেছে ভাড়ার টাকাগুলো। হঠাৎই তাহেরের মেজাজ বিগড়ে উঠলো-বড় লোকগুলো কী পেয়েছে গরিব মানুষদের? মানুষের সুবিধা-অসুবিধা থাকতে নেই! বাড়িতে গিয়ে আটকে গেলো সে। ওইটুকু ছেলে কীভাবে চলেছে, কী খেয়েছে জানা হলো না। তাহের টাকাগুলো হাতে নিয়ে বাড়িওয়ালির কাছে গেলো। তাকে ডেকে বললো, আপনি শিপলুকে কিছু বলেছেন?
-হ্যাঁ, তোমরা ঠিকমতো ভাড়া দিতে পারো না, তাই দু’মাসে ভাড়া দিয়ে নেমে যেতে বলেছি।
-আপনি ওইটুকু ছেলেকে এইভাবে বলতে পারলেন? আপনি জানেন আপনি কী করেছেন? সব টাকা যোগাড় করতে পারেনি। শেষে রক্ত বিক্রি করে টাকা রেখে ও চলে গেছে। আমাকে বলে পর্যন্ত যায়নি। গলা ধরে আসে, চোখ মোছে তাহের। আর কিছু বলতে রাগে থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিন্তু রুচিতেও বাঁধছে। এত জঘন্য মানুষ থাকে?
তবুও আবার বলে ফেলে, শুধু আপনাকে বিকেল বেলায় একটু দেখার জন্য ও কোথাও থাকত না-এটা আমি বুঝতাম। কিন্তু না বোঝার ভান করে থাকতাম।
-এ কথার পর আমতা আমতা করে সুরমা খন্দকার বললেন-আচ্ছা, ও একদিন মোর্শেদ চৌধুরীর কথা বলেছিলো! -হ্যাঁ ওর বাবা। ওর আপন বাবা নয় অবশ্য। মোর্শেদ চৌধুরী চট্টগ্রামের রাস্তায় ওকে কুড়িয়ে পেয়েছিলেন।তাহের বকবক করে আরো কী বলেছিলো, কিন্তু সুরমা খন্দকারের মাথায়, মগজে মননে ঢুকলো না তার কিছুই। তাহের ফিরে এসে নিজের জিনিসপত্র বাঁধায় ব্যস্ত হয়ে উঠলো। বড় মানুষেরা এত ছোট? এত হীন হয়! জীবনে কখনো বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতেও তার ঘেন্না করতে থাকে। গা গুলিয়ে ওঠে তাহেরের। দ্রুত এখান থেকে সরতে হবে।

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top