সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ৯ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

অরুন্ধতী রায়কে এখন কি ভিন্নভাবে পড়া যায়


প্রকাশিত:
২৯ জুন ২০১৯ ০৬:১৯

আপডেট:
১৫ এপ্রিল ২০২০ ০২:৪০

 

বিশ্বপুঁজিবাদ ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার বিরুদ্ধে গত তিন দশক ধরে লড়াই করে যাচ্ছেন অরুন্ধতী রায়। সম্প্রতি ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে বুকারজয়ী এই লেখকের। নব্য-ফ্যাসিবাদের এই সময়ে অরুন্ধতী রায়কে পড়ার যৌক্তিকতা ও অযৌক্তিকতা নিয়ে লিখেছেন সামান্থ সুব্রামানিয়ান। ‘দ্য নিউইয়র্কার’র প্রকাশিত লেখাটি এখানে জবানের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করা হয়েছে।

নয়টা মাস একজন ব্যক্তিকে গড়ে তুলতে পারে অথবা পুনর্গঠন করতে পারে। ১৯৯৭ সালের অক্টোবর মাসে অরুন্ধতী রায় তার প্রথম উপন্যাস এ গড অফ স্মল থিংস’র জন্য বুকার প্রাইজ অর্জন করেন। তখন ভারত সবে মাত্র (স্বাধীন দেশ হিসেবে) পঞ্চাশে পদার্পণ করেছে, এবং তাদের উদযাপনের অনুষঙ্গ প্রয়োজন। অরুন্ধতী রায় তাদের একজন হয়ে উঠলেন স্বাভাবিক ভাবেই। তারপর ১৯৯৮ সালের জুলাই মাসে তিনি একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করলেন : রাজস্থানের উপত্যকায় সরকার কর্তৃক পরিচালিত পাঁচটি পারমানবিক বোমার সিরিজ পরীক্ষার বিষয়ে। প্রবন্ধটি, হাজার হাজার জীবন বিপন্ন করার জন্যেই যে ভারতের পারমানবিক পলিসি তা উপস্থাপন করে, এটি যদিও আরামে নিশ্বাস নেওয়ার মতো কোন লেখা ছিল না। অরুন্ধতী মুহূর্তের মধ্যেই প্রিয়তম থেকে প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলেন, এবং প্রতিকূল পরিবেশে পতিত হলেন। ভারতে, আর কখনও তিনি সেই তোষামোদ পুনরুদ্ধার করতে পারেননি।

কয়েক দশক ধরে তিনি তার জ্বালাময়ী লেখালেখি চালিয়ে যান, এবং সেই সকল লেখালেখির প্রায় নয়শ পাতার ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’ নামক একটি ভলিউম প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি

আবার এটা নয় যে, তিনি তা পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন। এরপর কয়েক দশক ধরে তিনি তার জ্বালাময়ী লেখালেখি চালিয়ে যান, এবং সেই সকল লেখালেখির প্রায় নয়শ পাতার ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’ নামক একটি ভলিউম প্রকাশ করেছেন সম্প্রতি।

বইটি শুরু হয়েছে ১৯৯৮ সালের সেই ‘দি এন্ড অফ ইমাজিনেশন’ দিয়ে, কিন্তু ভারতের পারমানবিক পরীক্ষাই তার প্রথম উদ্বেগ নয়। এমনকি, ১৯৯৪ সালে যখন তার আর্কিটেকচার স্কুলের গ্রাজুয়েশন শেষ হয়েছে এবং সেই সময়টাতে তিনি ইন্ডিয়ান ফিল্মে অভিনয় করছেন, অ্যারোবিক্স শেখাচ্ছেন এবং তার প্রথম উপন্যাস নিয়ে কাজ করছেন— তিনি বলিউডের একটি সিনেমার তীব্র সমালোচনা কলে একটি লেখা লিখেছিলেন, যে সিনেমাটিতে একজন জীবিত এবং ধর্ষিতা নারীকে নির্লজ্জভাবে উপস্থাপন করা হয়েছিলো। তার এই স্বর কখনোই আর পশ্চাৎপদ হয়নি। ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’র প্রতিটি নিবন্ধই -এই ক্ষিপ্রতা নিয়ে রচিত।

অরুন্ধতী রায়কে প্রায়ই প্রশ্ন করা হয়, কেন আপনি ফিকশনে ফিরে গেলেন। (যদিও ২০১৭ সালের আগে তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মিনিস্ট্রি অফ আটমোস্ট হ্যাপিনেস প্রকাশিত হয়নি।) “আরেকটা বই? এখনই?” তিনি একটা একজন সাংবাদিককে বলেছিলেন। “এই পারমানবিক যুদ্ধ- সংগীত, শিল্প, সাহিত্য এবং সেসব যা সভ্যতাকে সংজ্ঞায়িত করে, এই সবকিছুকে তাচ্ছিল্য করে, তাহলে আমার কোন ধরনের বই লেখা উচিত?

এর চেয়ে মজার প্রশ্ন হলো, কেন অরুন্ধতী নন-ফিকশনের সাথে সংযুক্ত থাকেন এবং কীভাবে এই সকল কিছুর মধ্যে জড়িয়ে পড়েন? — ডেমোগোগুরি, বৈষম্য, কর্পোরেট ক্ষয়ক্ষতি, পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রতিক্রিয়ায় তার অবস্থান ব্যক্ত করেন। পশ্চিমা উদার নাগরিকেরা এই ধরনের উত্তেজনার প্রতি প্রতিক্রিয়া জানাতে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন : ঠাণ্ডা ভারসাম্য অথবা অসহায় ক্রোধে অসম্মান অথবা একটা মৌলবাদী বাম সংগঠনকে উপযোগীতা প্রদান এবং আরও কিছু উপায়ের জন্য অরুন্ধতীকে দেখতে পারেন। তিনি গত পঁচিশ বছর ধরে এই ফিল্ড চষে বেড়াচ্ছেন।

আমি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ভারত এবং আমেরিকান রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ/ সব ধরনের পারমানবিক অস্ত্র এবং অপরাধ, একই সাথে নোংরা শিক্ষা ব্যবস্থা/ দুর্নীতি/ নিপীড়ন/ পরিবেশ বিপর্যয় এবং অন্য সমস্ত দুর্ভোগের বিরুদ্ধে। আমি বেকারত্বের বিরুদ্ধেও। 

‘মাই সিডিয়াস হার্ট’ গ্রন্থে অরুন্ধতী নিজের ডেকে আনা বিপদের মোকাবেলা করেছেন। প্রায়ই তিনি ভারতের বড় বাঁধ তৈরি করার প্রবণতা এবং এর ফলে মানুষকে বাস্তুচ্যূত করার নৃসংশতার সমালোচনা করেছেন। তিনি কড়াভাবে আমেরিকান সাম্রাজ্য এবং তার অতি-উৎসাহী পুঁজিবাদ, বিশ্ব ব্যাংকের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও কর্পোরেট ক্ষুধার সমালোচনা করেছেন। তিনি হিন্দুত্ববাদীদের ছাল তুলে নিয়েছেন যারা পরিকল্পিত হত্যার সাথে জড়িত, যারা সম্প্রদায়কে বিভক্ত করে এবং তাদের ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখে, এবং তিনি লিখেছেন মাওবাদীদের প্রতি সহানুভূতির দৃষ্টিতে, যারা কেন্দ্রীয় ভারতের কাছে জঙ্গি রাজদ্রোহী হিসেবে পরিচিত এবং তারা একটি রাজ্যে আকরিক ও কয়লার অপহরণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। অরুন্ধতীর এই বিষয়গুলোতে এতো বেশি তন্ময় ছিলেন যে তার দ্বিতীয় উপন্যাসের চরিত্রগুলোতে এর কারণগুলো সঞ্চার করলেন। ‘আজাদ ভারতীয়’ নামের একটি চরিত্র যার অনুবাদ হয় ‘স্বাধীন ভারত’, আজাদ ভারতীয় নানা রকম দুর্ভোগের বিরুদ্ধে ১১ বছর যাবৎ অনশন করছেন এবং তার প্রতিবাদের স্থানে লেমিনেশন করা কার্ডবোর্ডে এই দুর্ভোগের একটা তালিকা টানিয়ে দিয়েছেন:

আমি পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে, একই সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, ভারত এবং আমেরিকান রাষ্ট্রের সন্ত্রাসবাদ/ সব ধরনের পারমানবিক অস্ত্র এবং অপরাধ, একই সাথে নোংরা শিক্ষা ব্যবস্থা/ দুর্নীতি/ নিপীড়ন/ পরিবেশ বিপর্যয় এবং অন্য সমস্ত দুর্ভোগের বিরুদ্ধে। আমি বেকারত্বের বিরুদ্ধেও। আমি সমগ্র বুর্জোয়া শ্রেণির সম্পূর্ণ বিলোপের জন্যও অনশন করছি।

যদি অরুন্ধতী রয় অনশন শুরু করেন, আমার ধারণা তিনি নিজেকে এই প্লাকার্ডগুলোর পিছনে অবস্থান করাবেন।

বিস্তৃত অর্থে, টেক্সটগুলোতে আছে অলঙ্কারপূর্ণ প্রশ্ন এবং রূপক দ্বারা উপস্থাপিত হয়েছে। (“ডেমোক্রেসি: হু ইজ সি হোয়েন সি অ্যাট হোম?” নামক একটি লেখায়, তিনি তিনটি ছবির সাথে দুটি বাক্য জুড়ে দিয়ে দেখিয়েছেন কীভাবে পলিটিক্যাল পার্টি ভারতের গণতন্ত্রের জন্য কাজ করছে: তারা এখনো খনন করছে, নির্বাচনের সুবিধার জন্য এবং উইঢিবির মতো সুড়ঙ্গ খুড়ে যাচ্ছে।) এবং তার উপস্থাপিত তথ্য পক্ষপাতমূলক হতে পারে। বারবার, তিনি লিখছেন যে ৮০ লক্ষ ভারতীয় প্রতিদিন বিশ রুপিরও কম টাকায় জীবন যাপন করে। এই পরিসংখ্যান ২০০৫ সালের সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী। ২০১১ সালে, যখন তিনি এই পরিসংখ্যান ব্যবহার করছেন, তা পরিবর্তন হয়েছে। সরকার বের করেছে, আনুমানিক ২৭০ মিলিয়ন মানুষ প্রতিদিন ত্রিশ রুপিরও কম টাকায় জীবনযাপন করে। হ্রাসকৃত এই মান ব্যবহার করলে তার যুক্তি জটিল হয়ে পড়বে, যার কারণেই মূলত তিনি এই তথ্য আপডেট করান না।

যতক্ষণ পর্যন্ত এই সংখ্যাগুলো বড় ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়, অরুন্ধতীকে পড়া সহজ এবং সাবলীল হয়। তার মতামতকে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং সম্ভবত সেগুলোকে নিশ্চিত করতে তিনি ভারতজুড়ে ব্যপকভাবে ভ্রমণ করেন। মানুষের সামনা-সামনি তার বর্ণনাগুলো নমনীয়, তার গদ্যগুলো বিরল নৈঃশব্দ দ্বারা ঘেরা। ২০১০ সালে কাশ্মিরে, আপেল- উৎপাদনের সময় তখন। তিনি লিখছেন, আমি ভীত/চিন্তিত একজোড়া লাশ চেক জামা পড়া শিশু, যাদের দেখতে ঠিক আপেলের মতই লাগে। ওরাই হয়তো আমার ভুলটির জন্ম দিবে।

বাঁধ এবং খাল খনন প্রকল্পে বিলীন হয়ে যাওয়া উনদাভা গ্রামে, অরুন্ধতী রায় ‘ভাইজি ভাই’ নামক এক ব্যক্তির সাথে দেখা করেন, সরকার যার উনিশ একর জমি থেকে সতেরো একর জমি অধিগ্রহণ করে। তিনি লিখেছেন, “ধৈর্যের সাথে তিনি (ভাইজি) যা বললেন, তা আমার হৃদয়কে আহত করলো। আমি বলতে পারতাম তিনি এটি বার বার বলছেন, আশা করছেন, প্রার্থণা করছেন যে একদিন একজন আগন্তুক এদিক দিয়ে যাবে এবং উনদাভার সৌভাগ্য কামনা করবে।”

২০০৪ সালে হরসুদের একটি শহর জলাধারে ডুবে যাচ্ছিল। “একটি শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে, তার প্রাইভেসি বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার অভ্যন্তর উন্মোচিত হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত জিনিসপত্র, বিছানা, কাপবোর্ড, জামা-কাপড়, ফটোগ্রাফ, পাত্র ও কড়াই সমস্তই রাস্তায় পড়ে আছে … হরসুদের মানুষেরা মাটির সমতলে তাদের শহরকে নিয়ে এসেছে নিজেই।” শেষ শব্দটি এই ঘটনার কীম্ভূতকিমাকার ট্রাজেডি তুলে ধরে—গরীবদের জীবনে গরীবরাই কষ্টগুলো ডেকে নিয়ে আসেন এবং এই যাতনার মাধ্যমেই জীবন শেষ করে দিতে রাজি হতে বাধ্য হন। 

অরুন্ধতীর এই ধরনের প্রবন্ধ ‘ওয়াকিং উইথ কমরেডস’ যা আবিষ্কারের তরল ধারণা এবং নৈতিক উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা উভয়ই ধারণ করে। ২০১০ সালে যখন এটি প্রথম প্রকাশিত হয়, ঐ লেখায় ভারতীয় সাপ্তাহিক ‘আউটলুক’র অনেক ইস্যুই ছিল । এর মধ্যে অরুন্ধতী রায় সেন্ট্রাল ভারতের বনে একটি মাওবাদী দলের সাথে কয়েক সপ্তাহ ভ্রমণের আমন্ত্রণ পান। প্রধানমন্ত্রী মাওবাদীদের দেশের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি মনে করে, কিন্তু অরুন্ধতী সে সকল নারী ও পুরুষকে খুঁজে বেড়ায় যারা বার বার অধিকারচ্যূত হয় এবং যারা গ্রামবাসী ও স্থানীয় আদিবাসীদের এই ধরনের সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করে। সরকার তার এই অংশে মিলিশিয়া নিয়োগ করছে যারা মাওবাদীদের সমর্থন করছে এমন সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের হত্যা করছে কিংবা আহত করছে যাতে কর্পোরেশনগুলো বন কেঁটে পরিস্কার করতে পারে এবং তাদের জমি খনন করতে পারে।

এটা বাস্তব এবং চরম নৃশংসতা। কিন্তু যখন অরুন্ধতী মাওবাদীদের নিজেদের শক্তির ব্যবহারকে বিবেচনা করেন, তিনি একটি শালীন দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন। তিনি গণ আদালতে বর্ণনা করেন, যেখানে বিদ্রোহীরা পুলিশ অফিসারের মৃত্যুদণ্ডের আগে বিচারের জন্য দাঁড়ায় এটাকে -“আমরা কীভাবে গ্রহণ করবো? অথবা এই রকম অযৌক্তিক বিচারের ধরনকে কীভাবে স্বীকৃতি দেবো?” অরুন্ধতী লেখেন। তারপর তিনি রাষ্ট্রের জঘন্য বিচার এবং মৃত্যুদণ্ডের উল্লেখ করে এটির স্বীকৃতি দেন। তিনি লেখেন, “গণ আদালতের ক্ষেত্রে ‘জমায়েত তার নিজস্ব সিদ্ধান্ত নিতে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন’। এই রায় সেই বিচারকের মাধ্যমে দেয়া হয়নি যিনি বহুদিন আগেই জনগণের সংস্পর্শে নেই, যিনি অনুপস্থিত ব্যক্তিদের পক্ষে কথা বলার দুঃসাহস দেখান।” বিচার বিভাগকে বিবেচনা করার এটি একটি অদ্ভূত উপায়, গণতন্ত্রের প্রতিনিধিত্বশীল স্তম্ভ যা তিনি অনেক বেশি মজুদ করতে চান।

অরুন্ধতীর অনেক অবস্থানেই এমন কঠিন নৈতিক স্বচ্ছতা রয়েছে। তিনি ঘোষণা করেন যে মুক্ত বাজার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছে, তাদের সম্পর্কের মধ্যে কোন জটিলতা নেই। কোম্পানির ফান্ডিংয়ে চলা অনুদান ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরাসরি সন্দেহ করা হয়, কেননা তাদের অনুদানে থাকে মুক্ত বাজারে অচল বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করার বিষয়গুলো এবং জনসাধারণকে ক্রেতায় পরিণত করার কাজ।

তিনি ফোর্ড ফাউন্ডেশনের ক্ষেত্রে কর্কশ শব্দ ব্যবহার করেন— এবং তারপর সেই সংগঠনকে অপরাধী মনে করেন। এবং মনে করেন ভারতীয় ননপ্রফিটেবল সংগঠন যারা এই ধরনের অনুদান গ্রহণ করেন তারা জনগণের জন্য সত্যিকারের ভাবে তেমন কাজে আসেন না। ( এটা নোট করা উচিত, তার উচিত ছিল বুকার পুরস্কার প্রত্যাখান করা কেননা এটি এমন একটি ব্রিটিশ কোম্পানি দ্বারা পৃষ্ঠপোষকতা পায় যারা ক্রমে ধনী হয়ে উঠছে। তাদের নিজের এলাকার আখচাষে শর্তাবদ্ধ শ্রম ব্যবহার করে।) সমস্ত বড় বাঁধই ধ্বংসাত্মক, পারমানবিক অস্ত্রের সাথে তুলনা করে অরুন্ধতী বারবার বলেন : “এরা উভয়ই ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অস্ত্র। এই উভয় অস্ত্রই সরকার তার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যাবহার করে।

তিনি অবাক হন এটা ভেবে যে যারা বেশি বেশি কষ্ট ভোগ করে তারাও নিঃশ্চুপ থাকেন। এটি তাকে ক্রুব্ধ করে। তিনি মনে করেন, যেমনটা আমাকে আঘাত করেছে এবং সন্দেহ নেই অন্য যারা ভারতে বাস করে তাদের জন্য এটা বিস্ময়কর যে একটা দেশ এত অবিচারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারপরও কোন বিপ্লবের সাক্ষী হতে পারেনি। 

তার রচনাবলি একটা তৎপরতায় অংশ নিতে আহ্বান জানায়। ভারতের সবচেয়ে বিতর্কিত বাঁধের এলাকায় আমাদের প্রতিবাদের জন্যে আহ্বান জানিয়ে তিনি লেখেন, “সীমানা খোলা আছে, আসুন”। ‘ডু তুর্কিস এনজয় থ্যাঙ্কসগিভিং’ শিরোনামের লেখায় তিনি লিখেছেন, “আমাদের প্রতিরোধ শুরু হয়েছে মার্কিনিদের ইরাকে দখলদ্বারিত্বের বৈধতা প্রত্যাখানের মধ্য দিয়ে।” সেই সব কোম্পানির উপর চড়াও হও যারা এই ভোগদখলের যুদ্ধে লাভবান হচ্ছে, এই অনৈতিক যুদ্ধে লড়াই করতে অস্বীকার করো। তিনি অবাক হন এটা ভেবে যে যারা বেশি বেশি কষ্ট ভোগ করে তারাও নিঃশ্চুপ থাকেন। এটি তাকে ক্রুব্ধ করে। তিনি মনে করেন, যেমনটা আমাকে আঘাত করেছে এবং সন্দেহ নেই অন্য যারা ভারতে বাস করে তাদের জন্য এটা বিস্ময়কর যে একটা দেশ এত অবিচারের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তারপরও কোন বিপ্লবের সাক্ষী হতে পারেনি। অরুন্ধতী লেখেন, “ভাইজি ভাই, ভাইজি ভাই, যখন আপনি রাগান্বিত হবেন? যখন আপনি অপেক্ষা করা বন্ধ করবেন? যখন আপনি বলবেন, ‘যথেষ্ঠ হয়েছে!’ এবং আপনার অস্ত্রের নিকট পৌঁছাবেন, তা সে যাই হোক না কেন?

এই লেখাগুলোর স্টাইল সরাসরি উইলিয়াম হাজলিটের কাছ থেকে এসেছে যিনি তার অগ্রসরমান-সহকর্মীদের কোনও শাস্তি না দিতে পরামর্শ দেন। অরুন্ধতীর মতো হাজলিটও ক্ষমতা নামক এই ভয়াবহ প্রতিমাকে অবিশ্বাস করেন। ১৮১৭ সালে তার বিতর্কিত এক লেখা ‘অন দ্যা কানেকসন বিটউইন টোড-ইস্টার অ্যান্ড টায়ার‌্যান্টস”এ তিনি লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিরোধের একটি মানদণ্ড প্রণয়ন করেন। প্রথমত, “একজন ভালো ঘৃণাকারী হয়ে উঠুন।” আপনার স্মৃতি দীর্ঘ রাখুন এবং আপনার ইচ্ছা শক্তিশালী রাখুন। স্বাধীনতার প্রকৃত প্রেমিক, একজন অন্যায়কাজের ঘৃণাকারী “তাকে তার বিশ্রাম থেকে বঞ্চিত করে”। এটি তার রক্তে প্রবাহিত হয়। এটি বিষধর জিহ্বার সাথে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয়। সারাজীবনে, হাজলিট আনুষ্ঠানিক নির্জীব রাজনৈতিক গদ্য রচনা থেকে বিরত ছিলেন। তিনি চিন্তা করলেন, প্রগতিশীলদের ভাষা হবে উদ্দীপ্ত এবং তাদের কল্পনা হবে ক্রোধ দ্বারা কষাঘাত করা। তিনি লিখেছেন, “বিমূর্ত কারণ, প্যাশন দ্বারা অসহযোগিতাপূর্ণ। এতে ক্ষমতা এবং পক্ষপাতের কোন মিল নেই।”

এই গুণগুলি, যদিও অরুন্ধতী তার সহকর্মীদের কাছ থেকে অপমান অর্জন করেছিলেন। তিনি সর্বদা জাতীয়তাবাদ, কর্পোরেট ভারত এবং রাষ্ট্রকে খেপিয়ে তোলার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন। (২০০২ সালে, তার সমালোচনাকে বিচার ব্যবস্থার সমালোচনাকে অপরাধমূলক হিসেবে সুপ্রীম কোর্ট শ্রেণিবদ্ধ করলে তিনি জরিমানা দিয়েছিলেন এবং একদিন কারাভোগ করেছিলেন।) কিন্তু ভারতীয় বামেদের মধ্যেও তার পদ্ধতির জন্য উষ্ণতার অভাব খুঁজে পাবেন, এবং সন্দেহ যে এখন পরিচিত। কেউ কেউ বলেন তার বিচরণের ক্ষেত্র বিস্তৃত। তিনি মাওবাদীদের সহিংসতার সুবিধাজনক নৈতিক উপায় তৈরি করেছিলেন। তার বৃহৎ বাঁধ ও নিউক্লিয়ার বোমার সমীকরণ— তিনি কি আদৌ পার্থক্য অনুভব করেননি? তার পুঁজিবাদকে হ্রাস করার প্রবণতা এবং কিছু বাজার সংষ্কার পলিসি যা ভারতীয়দের দারিদ্র্য মুক্তি ঘটাবে— তা কি বামপন্থীদের অযৌক্তিক হিসেবে চিত্রায়িত করেনি? অরুন্ধতী অল্পসংখ্যক মানুষ ও প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়েছিলেন যখন বামেদের প্রত্যেককেই প্রয়োজন ছিল যা তাদের আকর্ষণ করে।

তারপর যখন এই উদ্বেগগুলোর যত্ন নেয়া হয়েছে বা নার্সিং করা হয়েছে, বিশ্ব অরুন্ধতীর ক্রোধের থেকে আরও বেশি চেয়েছে। বিশেষত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত বড় কোম্পানিগুলো এত দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে উন্মোচিত হয়েছে যে তারা গণতন্ত্রের প্রকৃতি বিকৃত করেছে। রাষ্ট্র তার নাগরিককে নজরদারির মধ্যে নিয়ে এসেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং পরিবেশগত সংকট বেড়েছে। ন্যাটিভিস্ট ও ডানপন্থী মতাদর্শীরা তাদের অফিসে শ্রেণি ও জাতের বিভাজন সম্প্রসারিত করেছে। ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’ পড়ার কালে, আপনি দেখবেন যে অরুন্ধতী বহু বছর ধরে চিৎকার করছে, আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে, এবং আমরা খাঁড়া পাহাড়ের প্রান্তের দিকে আমাদের যাত্রা অব্যাহত রেখেছি।

বিশেষত ভারতের হতাশাগ্রস্ত একটি সময়ে এই বই প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের নামমাত্র নিবন্ধে যা ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয়েছে, অরুন্ধতী নিজেকে ভীরু হিসেবে অনুমান করেছে হিন্দু ডানপন্থীদের ‘ম্যানিফেস্টো অফ হেট’র প্রতিরোধে। তিনি লিখেছেন, “একটু একটু করে জনগণ এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে শুরু করেছে।” কিন্তু মে মাসে, ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় ফিরে আসে তার মহৎ(!) ম্যান্ডেট নিয়ে, এর প্রচারণা ছিল সংখ্যালঘু-নিগ্রহ ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনের মাল্টি-বিলিয়নস ডলার উৎপাদন। এই জয়জয়কার অরুন্ধতীর লোপ কিংবা হ্রাস উদ্ধার করতে সমর্থ হয়নি, কিন্তু এটি তাকে ক্রুদ্ধ করেছে যা তার লেখার অপরিহার্য বিষয়? তার ক্রোধ এই ভয়ঙ্কর এবং অনাড়ম্বর সময়ের জন্য উপযুক্ত। এটি নিয়ন্ত্রণ ও পরিসংখ্যানের চেয়ে বর্তমান বাস্তবতার সাথে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। অরুন্ধতী নন-ফিকশন লেখা শুরু করলেন যখন বিশ্বের সবাই ভালো আছে। ‘মাই সিডিসিয়াস হার্ট’ আমাদের বলতে আসলো যে না, পৃথিবী ধ্বসে পড়েনি কিন্তু ততটা ভালো নেই যতটা আমরা বিশ্বাস করি।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top