সিডনী শুক্রবার, ১০ই মে ২০২৪, ২৬শে বৈশাখ ১৪৩১

সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রয়োজন কি ফুরিয়েছে? : কামাল লোহানী


প্রকাশিত:
১৫ আগস্ট ২০১৯ ২৩:০০

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ১৩:২৭

কামাল লোহানী

 

জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসী তৎপরতা, সামাজিক নানা দুস্কর্ম এবং নানা ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতা থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য সংস্কৃতির বিকাশ ও চর্চার কোনো বিকল্প নেই, এ কথা সবাইকে মনে রাখতে হবে। আমাদের সংস্কৃতির যে পুষ্ট ধারা এর গতিশীলতা, বেগমানতা আমাদের নির্মাণের ভূমি করতে পারে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ ও সুন্দর। আমাদের জাতীয় জীবনের এই মৌলিক উপাদান নিয়ে দ্রুত ভাবতে হবে গুরুত্বের সঙ্গে।

ইতোপূর্বে যখনই যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে, তখন তারা নতুন নতুন কর্মপরিকল্পনা নিলেও সাংস্কৃতিক বিষয়টিকে খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। অথচ বঙ্গ সংস্কৃতি এক উত্তরাধিকারের ঐতিহ্য নিয়ে দেশ-বিদেশে আলোচিত। পাকিস্তানিরা যেহেতু বাঙালি সংস্কৃতি ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি বৈরী মনোভাব পোষণ করত, সে কারণে প্রথমেই তারা আমাদের মাতৃভাষার ওপর চড়াও হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস বলছে, পাকিস্তান আমলে গোটা দেশের জনসংখ্যায় আমরাই ছিলাম বেশি। শুধু বেশিই না, অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে অনেক বেশি।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট শেষ হয়ে গেলে দ্বিজাতিতত্ত্বের তকমা নিয়ে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ছিল পশ্চিম অধ্যুষিত। তাই বাংলা ভাষা ও বাংলার মানুষকে অধিকারহীন করে রাখার চক্রান্ত রাষ্ট্র জন্ম নেওয়ার আগ থেকেই চালিয়ে যাচ্ছিল। শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আচরণের বিরুদ্ধে তাই বাংলার তরুণ ছাত্রসমাজ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে মুসলিম লীগ সরকারের গুলিতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েও মাতৃভাষার সল্ফ্ভ্রম রক্ষা করেছিল। কিন্তু তা হলেই-বা কী, ২৩ বছরের পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক শাসন আমাদের যে নির্যাতন-অবহেলা করেছিল, তারই যূথবদ্ধ ক্ষুব্ধ প্রকাশ চরমভাবে দেখা দিল ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে।

৭ মার্চ ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক জনসমুদ্রে অগ্নিগর্ভ পূর্ব বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, 'এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। এই একটি বাক্যে বঙ্গবন্ধু গোটা জাতিকে সাহসের মোড়কে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন, তারই বিষ্পোরণ ঘটল ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ নেতার নির্দেশকে শিরোধার্য করে মহান মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন। প্রতিবেশী ভারত, সুদূরের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়নসহ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করা সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের সমর্থন নিয়ে মুক্তিফৌজ রণাঙ্গনে লড়েছিলেন ৯ মাস, তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের এই মহানায়ক সব গণতান্ত্রিক শক্তি ও রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বিজয় অর্জন করেছিলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিফৌজের যৌথ কমান্ড মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায়।

১০ জানুয়ারি ১৯৭২ পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত স্বদেশে ফিরে এলেন এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাকে পুননির্মাণের কাজে একাগ্রচিত্তে মনোনিবেশ করলেন। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতা ও মন্ত্রিসভার সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমেদ তার সমর্থকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে গোড়া থেকেই যে চক্রান্ত করে যাচ্ছিলেন, তারই নৃশংসতম হত্যাযজ্ঞ ঘটল ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। কিন্তু শাহাদাতবরণের আগে বঙ্গবন্ধু যে সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন, তাতেই তিনি আমাদের মাতৃভূমিকে 'সোনার বাংলায়' রূপান্তরিত করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন। রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক তৎপরতা এবং দেশ পুননির্মাণে ব্যস্ত বঙ্গবন্ধু সবকিছুর সঙ্গে বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে পুনরুদ্ধার, চর্চা এবং দেশ ও বিদেশে উপস্থাাপনার উদ্দেশ্য নিয়ে পাকিস্তান আর্টস কাউন্সিলকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে রূপান্তরিত করলেন ১৯৭৪ সালে। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার ঐতিহ্যবাহী লোকজ সংস্কৃতিকে যথার্থরূপে তুলে ধরে তাকে সমৃদ্ধ করার জন্য। দেশের সর্বত্র এই শিল্পকলা চর্চা ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্য নিয়েই এ ধরনের সংস্কৃতি কেন্দ্র জেলায় জেলায় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কার্যক্রমও গ্রহণ করেছিলেন।

কিন্তু বঙ্গবন্ধু সপরিবারে হত্যার পর সেই কর্মচঞ্চলতা একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। আর তারপর থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এইচএম এরশাদ রাষ্ট্র পরিচালনায় যে সাম্প্রদায়িক মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে গেছেন তাদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে, তাতে রাজনীতির পাশাপাশি সংস্কৃতিও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এর বহুমুখী বিরূপ প্রভাব সমাজে পরিলক্ষিত হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে চরম অবহেলা দেখা যায় এবং এ কারণেই এই শাখার কোনো উন্নতি সামরিক শাসনের সময় হয়নি। বিএনপি শাসনামলে খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের বিচারের দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে ও তার সমন্বয় কমিটিকে যেভাবে হেনস্তা করতে চেয়েছিলেন তাতে বাংলার মাটিতে উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতি বাধাগ্রস্ত হলো পুনর্বার। তাই আমরা দেখেছি সংস্কৃতি অঙ্গনকে পরিপূর্ণতা দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ও অর্থ বরাদ্দ দেওয়া উচিত ছিল, তা আদৌ হয়নি। বাংলার ঐতিহ্যবাহি হারানো সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারের কাজ মুখ থুবড়ে পড়ে।

বাংলার নিজস্ব আদি সম্পদ যাত্রা ও পালাগান আজ তো প্রায় উঠেই গেছে। আগে যেমন খোলা ময়দানে অথবা ধানকাটা শেষে বিস্তৃত ফসলের মাঠে যাত্রার আয়োজন হতো এবং সারারাত ধরে গ্রামবাসী নারী-পুরুষ সেই যাত্রাপালা উপভোগ করতেন, আজ আর তেমন কোনো আয়োজন দেখি না বহুকাল। অজুহাত নিরাপত্তার অভাব। সংস্কৃতি জাতীয় জীবনের একটি মৌলিক উপাদান। এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ অপার। কিন্তু পুলিশি প্রহরার ব্যর্থতার কারণে আজ স্থাানীয় মাস্তান বাহিনীর অপকীর্তিতে এই অনুষ্ঠানগুলো ক্রমে বন্ধ হয়ে গেছে। এর কোনো প্রতিকার আজও হয়নি। তবে শিল্পকলা একাডেমি যাত্রা সংশ্নিষ্ট নেতৃবৃন্দের সহায়তায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে বহুবার বৈঠক করেছে এবং নানা বিকল্পের পরামর্শ দিয়েছে।



কামাল লোহানী
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top