'সিজোফ্রেনিয়া ' একটা কঠিন জীবনের গল্প - শাহানারা পারভীন শিখা
প্রকাশিত:
১৭ মার্চ ২০২১ ২১:৫০
আপডেট:
১৭ মার্চ ২০২১ ২২:৪২
শ্বাশুড়ির রুমের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চোখ যায় বিছানায়। শ্বাশুড়িমা পায়ের উপর পা তুলে নাড়াচ্ছেন। হাত ইশারায় কাউকে ডাকছে। একা একাই হাসছেন। অথচ ঘরে তখন কেউ নেই। সঙ্গে আসা তার বড় মেয়ে মানে আমার ননাশ তখন বাথরুমে গোসলে।
ননাশ গোসল সেরে বেরোতেই তাকে বললাম ঘটনাটা। উনি নির্বিকার ভাবে বললেন, আম্মার জ্বিন আছে হয়তো। তার সাথেই কথা বলেন।
আমার কাছে সেটা মনে হলো না। কারণ সে-ধরনের কোন লক্ষণ শ্বাশুড়ির মধ্যে আমি দেখিনি কখনো।
আমি ননাশের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললাম, আসলে বুবু, আম্মার মধ্যে ছেলেমানুষী ভাবটা খুব বেশি। নিশ্চয়ই একা একা ছেলে বেলার কোন মজার স্মৃতি মনে করে একা একা হাসেন। অথবা কারো কথা মনে করে আপন মনে কথা বলেন। ননাশের আমার কথা বিশেষ পছন্দ হলো বলে মনে হলো না।
আমার শ্বাশুড়ি আম্মা। এখন নব্বই বছরের উপর বয়স।এক বাপের এক মেয়ে। বেশ জেদি এবং রাগীও বটে। তবে তার আচরণে শিশু সুলভ স্বভাব খুবই বেশি। গ্রামের বাড়িতে থাকেন। আমার বাসায় নিয়ম করে বেড়াতে আসেন। আমরাও যাই গ্রামে। তেমন কোন অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি এতো বছর।
পরিবর্তনটা এবার গ্রামের বাড়িতে যেয়েই বেশি চোখে পড়লো। অনর্গল কথা বলা। নির্দিষ্ট একটা কাহিনি নিজের মতো বানিয়ে সেটাই বারবার বলা। চিৎকার চেচামেচি করা। সবাই তাকে মেরে ফেলতে চায়।
কেমন একটা বিকারের মতো। গ্রামে এটাকে ছিটা ওঠা বলে। পরে আবার মোটামুটি স্বভাবিক আচরণে ফিরে আসেন।
শ্বাশুড়ির এরকম অবস্থা দেখে মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। বার্ধক্যের কঠিন অবস্থা ভেবে মনটা কেঁদে উঠে। ঢাকায় আসার কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন। বেশ কিছুদিন পর সবকিছু গুছিয়ে আমার বড় ননাশকে সাথে নিয়ে আমার বাসায় এলেন।
প্রথম রাতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি উনার। পরের সারা দিন অনর্গল কথা বলে গেছেন আগের মতো। একই কথা একই কাহিনি বারবার। এটাকেই সবাই স্বাভাবিক ধরে নিয়েছি আমরা।
পরের দিন বেশ রাতে শুনি শ্বাশুড়ির উচ্চস্বরে কথাবার্তা। উঠে উনার ঘরে গেলাম।
দেখি বসে আছে তার ব্যাগ হাতে নিয়ে। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, 'আমার বেড়ানো শেষ। আমাকে বাড়িতে দিয়ে আস। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই যেতে হবে। ' বলেই আমার হাত ধরে হাঁটা ধরলেন।
আমি তাকে বসিয়ে দিয়ে বললাম, আম্মা এখন অনেক রাত। এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। সকাল হলে আপনাকে নিয়ে যাবো। উনি কিছুতেই বিশ্বাস করছেন না যে এখন রাত। বুঝলাম উনি দিন রাতের হিসেবটা গুলিয়ে ফেলেছেন এখানে। এবং স্থানও।
ঘরময় ছুটে বেড়াতে লাগলেন। দরজা খুলে দিতে বলছেন। এবং একসময় তার মনে হলো তাকে আমরা সবাই আটকিয়ে রেখেছি অথবা উনি পথ হারিয়ে ফেলেছেন। কাঁদতে লাগলেন শব্দ করে।
হাত ধরে বসতে বলতেই চিৎকার করে উঠলেন " বাঁচাও বাঁচাও। আমাকে মেরে ফেললো।'
বুঝলাম উনি এক ঘোরের জগতে চলে গেছেন। কঠিন রাত পার হলো।
গ্রামের বাড়িতে ও ঘোরের মধ্যে কেউ শরীরে হাত দিলেই বাঁচাও বাঁচাও মেরে ফেললো বলে চিৎকার করতেন বেশ কিছুদিন থেকেই। এটা শুনেছি আগেই। আবার ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণ পর বলছেন উনি খাননি।
অবিবাহিত নাতি বিয়ে করে বউ লুকিয়ে রেখেছে। এধরনের গল্প উনি স্বাভাবিক ভাবেই বলছেন সবার কাছে। গল্পের ধরনের জন্য অনেকের কাছেই অলিক বিষয়গুলোকে সত্য মনে হচ্ছে। অথচ পুরো ঘটনায় নিজের কল্প জগতের তৈরি।
ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। নিউরো ডাক্তার। এ সময়ে এতো বয়সী মাকে হাসপাতালে / চেম্বারে নিতে না করলেন। সব শুনে ডাক্তার বললেন উনি ডিমেনশিয়া এবং সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। কিছু ওষুধ দিলেন। বয়স অনেক বেশি হওয়ার কারণে ওষুধে খুব একটা কাজ হবে না জানালেন।
এরপর দিন পনেরো ছিলেন আমাদের কাছে। প্রতিদিনই দেখেছি বার্ধক্যের শেষ সীমানায় পৌঁছানো মানুষটার দ্বৈত সত্বা নিয়ে বাস করতে। বাস্তব আর কল্পনার জগতে বিচরণ করতে।
সিজোফ্রেনিয়া রোগের কথা আমরা শুনেছি। কিন্তু আমাদের দেশে এই রোগটা সম্পর্কে আমাদের তেমন জানা নেই। সাধারণত বেশি বয়সীদের ক্ষেত্রে বার্ধক্যজনিত সমস্যা মনে করে থাকি আমরা। আর অন্যান্য বয়সীদের ক্ষেত্রে মানুষিক রোগ বা পাগল বলে থাকি।অথচ আমরা কেউ জানতেও পারিনা কি কঠিন একটা রোগ নিয়ে সেই মানুষটা মনোজাগতিক বৈকল্যের দিকে চলে যাচ্ছেন।
এটা নিশ্চয়ই বহু আগেই হয়েছে তাঁর। শারীরিক ভাবে সুস্থ মানুষটার মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়লেও কারোরই মনে আসেনি এটা একটা রোগ। সময়মত চিকিৎসা করলে হয়তো এই রোগটা নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতো।
বয়স এবং সময়ের সাথে সাথে এটা ভয়ানক জটিল পর্যায়ে চলে আসে।
সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত রোগী এবং তার পরিবার একটা কঠিন অবস্থার মধ্যে দিয়ে পার করে প্রত্যেকটা দিন।
আমাদের কাছের মানুষগুলোর আচরণে কোন অস্বাভাবিকতা চোখে পড়লে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।
শাহানারা পারভীন শিখা
বিষয়: শাহানারা পারভীন শিখা
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: