কান টানলে আজও আসবে মাথা'ই! : তন্ময় সিংহ রায়


প্রকাশিত:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ১৮:০৭

আপডেট:
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ২০:৪৫

ছবিঃ সুজিত চট্টোপাধ্যায়

ছবিঃ সুজিত চট্টোপাধ্যায়

 

উনি নিজেও জানতেন না যে, শরীরটার বয়েস হলেও, তরতাজা যুবক মনুষ্যত্বের সু-উজ্বল এই নিদর্শন'ই সযত্নে ওনার হাত ধরে ধীরে ধীরে একদিন ঠিক পৌঁছে দেবে ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক 'পদ্মশ্রী'-এর মতন সম্মাননাতে। মানবিকতার উর্ধ্বে এ ঘটনা আজ তো রীতিমতন বিরল, তাই স্বভাবতই হৃদয়ে রেখাপাতের সংখ্যাটাও হয়ে দাঁড়ায় যথেষ্ট বেশি।

দীর্ঘ ৪০ টি বছর 'রামনগর উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়'-এ শিক্ষকতার পর ২০০৪-এ অবসর গ্রহণ করেও, পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের রামনগরের বাসিন্দা ৭৮ বছরের মাষ্টারমশাই সুজিত চট্টোপাধ্যায়, ১৮ টি বছর অনায়াসে কাঁধে তুলে বহন করে আসছেন গ্রামের নবম থেকে তৃতীয় বর্ষের (গ্র‍্যাজুয়েশন) হতদরিদ্র, দুঃস্থ ও অসহায় ছেলেমেয়েদের যথাসাধ্য শিক্ষাদানের মতন গুরুদায়িত্ব! 

শুধু কি তাই? 

ছাত্রের পর ছাত্র পড়িয়েই চলেছেন তিনি প্রায় সকাল থেকে, আর ওনার পাঠশালায় মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ৩০০ মতন। আর গুরুদক্ষিণা হিসেবে তিনি নিতেন বাৎসরিক ২ টাকা ও ৪ টি চকলেট। আত্মসুখের চেয়েও মনুষ্যত্বের দৈর্ঘ্য যাঁদের বড়, তাঁদের শুধু ইচ্ছাশক্তির জোরেই হয়ে যায় অসাধ্য সাধন, আর বারেবারেই তা প্রমাণিত। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া প্রায় ২৫০ পরিবারের হাতে মোট ৪ দফায় এই মাষ্টারমশাই তুলে দিয়েছেন ৭৫ হাজার টাকার নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। 

গ্রামের ৭-৮ জন থ্যালাসেমিয়া রোগীর যথাসাধ্য শুশ্রূষার পিছনেও আছেন এই সুজিতবাবুই, আর বছরে একটি বার হলেও তাঁদের হাতে তিনি তুলে দেন ৫ হাজার করে টাকা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র, আর এই সমস্ত

কর্মকাণ্ডটাই চলে ওনার পেনশনের টাকায়।

 

সেদিন সোমবার অর্থাৎ, ২৫ শে জানুয়ারি ২০২১, বিকেল পৌনে ৫ টা থেকে ৫ টার মধ্যে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে হঠাৎই ফোন আসে সুজিতবাবুর ভাইপো উৎসব চট্টোপাধ্যায়ের মোবাইলে। চাওয়া হয় সুজিত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের সাথে সরাসরি ফোনে কথা বলার জন্যে। 

ফোনটা পেতেই তাঁকে প্রশ্ন করা হল, 

'হ্যালো!, আমি কি সুজিত চট্টোপাধ্যায় বাবুর সাথে কথা বলছি?'

'হ্যাঁ আমি সুজিতবাবুই বলছি।'

'এবারের পদ্মশ্রী প্রাপক তালিকায় আপনার নামটি নির্বাচিত হয়েছে এবং আগামী মার্চের শেষের দিকে দিল্লিতে এসে আপনাকে সেটি সংগ্রহ করতে হবে, ব্যবস্থা সব আমরাই করে দেবো।'

উড়ন্ত এক ফোনের অপর প্রান্ত থেকে হঠাৎ এ হেন ওজনের সুসংবাদ প্রথমে বিশ্বাস করতেই কেমন যেন লাগছিল মাষ্টারমশাইয়ের! 

মেয়েকে এমনকি অস্ফুটে তো বলেই ফেললেন যে, 'এখন এ বিষয়ে কাউকে কিছুই দরকার নেই বলার।'

এরপর শুভাকাঙ্ক্ষীদের একের পর এক ফোনে বিষয়টি অবশেষে এসে দাঁড়ায় বিশ্বাসযোগ্যতার দোড়গোড়ায়।

 

শিক্ষকতাতেও আজ আর নেই সেই পূর্বের স্বচ্ছতা, এ যেন আজ ক্রমশই হয়ে উঠছে এক এমন পেশা, যেখানে আছে শুধু বাধ্য হয়ে কর্তব্য পালন, আর দায়িত্ব এবং আদর্শের জীর্ণ-শীর্ণকায় শরীরগুলো সেখানে আছে মুখ থুবড়ে পড়ে!

শুধু ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের ২৩ টা জেলায় সমস্ত সরকারী ইস্কুলে যদি উদাহরণস্বরূপ ধরা যায় যে, সর্বমোট শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যাটা ৫০০০, তো সেখানে যেন বর্তমানে টেলিস্কোপ বসিয়ে দেখতে হবে যে প্রকৃত দায়িত্ববান বা দায়িত্ববতী শিক্ষক-শিক্ষিকা ঠিক কতজন? সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ছেলে-মেয়েদের গুরুদায়িত্ব ওনারা বহন করে চলেছেন যেভাবে, তা কি যথার্থই?

রাজ্যের সরকারী ইস্কুলের পড়াশোনার মান যদি থেকে থাকে ঠিক'ই, তবে সেই ইস্কুলগুলিতে শিক্ষকতা করা সিংহভাগ শিক্ষক-শিক্ষিকার ছেলে-মেয়েরা কেন ভর্তি হয় প্রাইভেট স্কুলে?  

কারণ অর্থ ছাড়া হয়তো নিজেদের ইস্কুলের প্রতি এনাদের নিজেদেরই নেই কোনো ভরসা!

দিনের পর দিন ব্যাঙের ছাতার মতন চতুর্দিকে গজিয়ে উঠছে বেসরকারি ইস্কুল, যেখানে অর্থাভাবে আবার দরিদ্র এই ছেলেমেয়েগুলোর প্রবেশাধিকার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ!  

তবে উপায়?

আর এই মানুষগুলোর অসহায় ছেলেমেয়েরা তাঁদের পাকস্থলীর আর্তনাদ থামায় পাঁচবেলার আপেল, মাখন আর হরলিক্স-এ নয়, একবেলার মিড-ডে-মিল-এ। তাও সাধুবাদ ও শ্রদ্ধা জানাই এই প্রশংসনীয় পদক্ষেপকে। আগে ছিল শিক্ষকদের মাইনে কম, আদর্শ ও খাটনি বেশি,  আর এখন শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসিকতার সাইক্লোনে তা গেছে সম্পূর্ণ উল্টে! তাহলে দিনের পর দিন এভাবেই কি গড়াবে এই সিস্টেমের চাকা? 

গরীবরা প্রায় সর্বক্ষেত্রে আজীবন যেন থেকে গেল এক অভিশাপ হয়েই!  

 

তন্ময় সিংহ রায়
কোলকাতা, ভারত

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top