জামায়াত ছাড়ার শর্ত, উভয় সংকটে বিএনপি
প্রকাশিত:
৭ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ১১:০৮
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৬

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে বিএনপির যুক্ত হওয়ার পথে প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে জামায়াত। বি. চৌধুরী, ড. কামাল ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নার সাফ কথা- এই ঐক্যে জামায়াত থাকতে পারবে না। তবে বিএনপি এ ব্যাপারে ‘হাঁ’ ‘না’ কোনটিই বলতে পারছে না। বিএনপিও মনে-প্রাণে এই ঐক্য চায়, তবে জামায়াতের সঙ্গত্যাগের জন্য ঐক্যের অন্য উদ্যোক্তাদের প্রকাশ্য শর্ত নিয়ে উভয় সংকটে পড়েছেন দলটির নীতিকাররা।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট শরিক জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার কথা বলার পাশাপাশি আরও দুটি ইস্যুকে গুরুত্ব দিচ্ছেন ঐক্যের অন্য উদ্যোক্তারা। বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা, আ.স.ম আবদুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি ও মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্যের সমন্বয়ে গঠিত যুক্তফ্রন্ট আগামী নির্বাচনে বিএনপির কাছে ১৫০টি আসনে ছাড় চায়। তারা বলছেন, রাজনীতিতে ভারসাম্য আনতে এবং আগামীতে সরকার গঠন করতে পারলে ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টির লক্ষ্যেই তারা আসনের এই সমতা চান। বি. চৌধুরী স্পষ্ট করে ১৫০ আসনের কথা বললেও মান্না অবশ্য এটাকে কিছুটা রয়েসয়ে বলছে ‘হয়তো বাস্তবসম্মত নয়’। আর রব এ প্রশ্নে তার অবস্থান স্পষ্ট করেননি। দ্বিতীয় ইস্যুটি হচ্ছে- বর্তমান সরকার বিদায় নিলে নতুন সরকার এসেও যেন স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে না পারে, বিএনপির কাছে সেই প্রতিশ্রুতি চান অন্যরা। প্রতিশ্রুতি মিললে প্রয়োজনে বিএনপির সাথে লিখিত চুক্তির কথাও ভাবছেন তারা। এইলক্ষ্যে তারা উদাহরণ হিসেবে সামনে আনছেন মালয়েশিয়ায় ড. মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির কথা। বি. চৌধুরী ইতোমধ্যে মাহাথির-ইব্রাহিমের ওই চুক্তির কপি সংগ্রহের চেষ্টা করছেন।
বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবে নাগরিক ঐক্যের উদ্যোগে আয়োজিত ‘ইভিএম বর্জন, জাতীয় নির্বাচন ও রাজনৈতিক জোট’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সামনেই উল্লেখিত দুটি ইস্যুতে এবং জামায়াতকে ছাড়ার কথা বলেন ড. কামালসহ অন্যরা। বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কার্যত: এই তিনটি ইস্যুতে মিটমাট হচ্ছে না বলেই বিএনপির সঙ্গে অন্যদের জোড়া লাগছে-লাগছে করেও লাগছে না। আর বিএনপির দায়িত্বশীল একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন এবং দলের কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তিই এখন তাদের কাছে অগ্রাধিকার। তাদের মতে, অন্য ইস্যুকে সামনে এনে ঐক্যের উদ্যোগ যেন বিফলে না যায়।
যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারা সভাপতি অধ্যাপক বি. চৌধুরী গতকাল বৃহস্পতিবার ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাদের এক কথা- জামায়াতসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কোনো দল বা শক্তি এই ঐক্যে থাকবে না। আমরা চাই ভারসাম্যের রাজনীতি। এজন্য বলছি শুধু বিএনপি কেন, আওয়ামী লীগও যেন ১৫০ আসনের বেশি না পায়। আমরা রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর, মন্ত্রিসভায় এবং সংসদ, বিচারবিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যেও ভারসাম্য দেখতে চাই। মালয়েশিয়ায় সরকার গঠন ও মন্ত্রিসভায় কীভাবে ভারসাম্য আনা হয়েছে, সেটি দেখার জন্য আমি ডা. মাহাথির ও আনোয়ার ইব্রাহিমের মধ্যে হওয়া চুক্তির কপি সংগ্রহ করছি।’
‘জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়া’র আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ও ভারসাম্যপূর্ণ ক্ষমতার লক্ষ্যে আমরা শুরু থেকেই জনগণের তথা জাতীয় ঐক্যের কথা বলে আসছি। দলমত নির্বিশেষে এই ঐক্য হতে হবে। এখানে কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি থাকবে না। ঐক্য হতে হবে দেশ ও জনগণের স্বার্থে। তিনি বলেন, জামায়াতের কথা না বলে পারি না। তারা যেভাবে ধর্মকে ব্যবহার করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, তাদের নিয়ে তো স্বাধীন দেশে আমরা ঐক্য করতে পারি না। পাকিস্তান যখন আত্মসমর্পণ করলো জামায়াত নেতা গোলাম আযম তখন সৌদিআরবে পালিয়ে যান। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা্লের পর তিনি দেশে ফিরে আসেন, তখন গোলাম আযম বলেছিলেন- মৃত্যুর পর তার কবর যেন এই মাটিতে হতে পারে সেজন্যই তিনি দেশে ফিরতে চান। সেই গোলাম আযম ও জামায়াত পরবর্তীতে এদেশে রাজনীতি করবে এটা তো আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি।
ড. কামাল আরও বলেন, আমরা চাই কোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন আমাদের এই ঐক্যের উদ্যোগে বিভাজন সৃষ্টি করতে না পারে। আমরা নির্ভেজাল গণতন্ত্র গড়তে চাই। এক ব্যক্তির শাসনও দেখতে চাই না, রাজতন্ত্র দেখতে চাওয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা যদি এই চেতনার ভিত্তিতে ঐক্য করতে পারি, তাহলে দেশের ১৬ কোটি মানুষ সমর্থন জানাবে।
বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে হলে এর ভিত্তি কী কী হবে, সেই ব্যাপারে বুধবারের আলোচনা সভায় যুক্তফ্রন্ট নেতা ও জেএসডি সভাপতি আ.স.ম রব বলেছেন, এ সরকারের পতনের জন্য আমরা ঐক্য চাই। তবে আবারও যেন স্বৈরতন্ত্র সৃষ্টি হতে না পারে-সেটাও আমাদের দেখতে হবে। আর যুক্তফ্রন্ট নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ‘এরশাদের পতনের পর থেকে আমরা দেখে আসছি যে ক্ষমতায় গেছে সেই স্বৈরাচার হয়েছে। এক স্বৈরাচার গেলে আরেক স্বৈরাচার আসবে-এটা বন্ধ করতে হবে। বারেবারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাবে ধান, এটা চলতে দেয়া যায় না। রাজনীতি ও ক্ষমতার ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। আমরা স্বৈরাচার ও স্বৈরতন্ত্রমুক্ত বাংলাদেশ দেখতে চাই।’ ঐক্যের লক্ষ্যে বিএনপি সাতটি দফা দিয়েছে উল্লেখ করে মান্না বলেন, আমরা যে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি সেখানে জামায়াত থাকতে পারবে না।
ঐক্যের অন্য উদ্যোক্তাদের জামায়াত নিয়ে আপত্তিসহ অন্যান্য বিষয় প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমরা ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য চাই। কারাগারে যাবার আগে আমাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াও জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার ডাক দিয়েছেন। আমাদের পক্ষ থেকে আমরা বারবার বলেছি খালেদা জিয়াসহ সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে, বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে, নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে এবং নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে। বাংলাদেশকে ও দেশের মানুষকে আজকের দুঃশাসন থেকে মুক্ত করা জরুরি। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা জরুরি। এগুলোর ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব।
ইত্তেফাক
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: