বিপন্নের পথে ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর ভাষাগুলো
প্রকাশিত:
১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ১২:৪৪
আপডেট:
১৬ মার্চ ২০২৫ ০৯:৪৭

পৃথিবীর অন্যতম প্রধান শ্রুতিমধুর ভাষা হলো বাংলা। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ, কিন্তু বহুজাতির বহুভাষার বৈচিত্র্যও বিদ্যমান। প্রায় পঞ্চাশটি, সংখ্যায় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী চল্লিশটি পৃথক ভাষায় কথা বলে। ষোল কোটির দেশে আটানব্বই ভাগ মানুষ বাংলা ব্যবহার করলেও সমতল ও পাহাড়ী এলাকায় বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ত্রিশ লাখ মানুষ পৃথক চল্লিশটি ভাষা ব্যবহার করে। এধরনের ৪১টি ভাষার মধ্যে ১৪টি ভাষা নানা কারণে বিপন্নের পথে।
আবির্ভাবের শুরুতে মানুষ চিত্রের মাধ্যমে কোন কিছুর প্রতীকধর্মী ছবি এঁকে মনের ভাব জানাতো। এরপর ধ্বনি থেকে লিপি, তারপর অক্ষরলিপির মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করে। ব্রাহ্মি লিপির নানা বিবর্তনের ধারাবাহকতায় বাংলা লিপি আজকের জায়গায় এসেছে।
পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানসহ সিলেট, গাজীপুর, মধুপুরের বনাঞ্চলে সংখ্যায় ক্ষুদ্র প্রায় ৩০ লক্ষ জাতিগোষ্ঠীর বাস। তারা দেশের মোট জনসংখ্যার দুই শতাংশ। এই জনগোষ্ঠীগুলো ৪০টি পৃথক ভাষায় কথা বলে। সেগুলোর কয়েকটি ভাষায় দূর অতীতে সাহিত্য রচিত হলেও এখন হারিয়ে যেতে বসেছে।
মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকা, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব ও জীবিকার প্রয়োজনে নিজের আদি নিবাস ত্যাগ করে শহরে বসবাসসহ নানা কারণে চাক, কোডা, কোল, কন্দ, খুমিসহ প্রায় ১৪টি ভাষা বিপন্ন হবার পথে।
গাজীপুরের ২৫ বছর বয়সী সুশান্ত বর্মন স্নাতকের ছাত্র। নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে পারেন না। তাই অনুশোচনায় ভোগেন জানালেন। সুশান্ত বর্মন একা নন, এ গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দারাও নিজের ভাষা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
বিবর্তনের ধারায় পৃথিবীতে অগণিত ভাষা বিলুপ্ত হয়েছে। দেশে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বয়োজ্যেষ্ঠরা নিজের ভাষার চর্চা করলেও নতুন প্রজন্ম পড়ালেখা আর পেশার কারণে সেই চর্চার প্রয়োজন হারিয়েছে।
বাংলাদেশে বসবাসরত অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণমালা নাই। উত্তরাঞ্চলের সব উপজাতি যেমন সাঁওতাল (দ্বিতীয় বৃহত্তম), উঁরাও, মুণ্ডা, মাহালি, পাহাড়ি, মাহাতো, পাহান, রাজবংশী, কোঁচ, কৈর্বত্যসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বসবাসরত গারো, লুসাই, মুরং, খ্যাং, খুমি ইত্যাদি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের ভাষা মূলত কথ্য ভাষা, লিখিত ভাষা নয়। অর্থাৎ অধিকাংশ ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মুখের ভাষাকে লিপিবদ্ধ করে লিখিত রূপ দেবার মতো কোনো অক্ষরই উদ্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর নেই। সহজ কথায় এরা বর্ণহীন পরিবারের সদস্য। এ কারণে বাংলাদেশে বসবাসরত অধিকাংশ উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কোনো প্রামাণ্য গ্রন্থ, এমনকি ধর্মীয় গ্রন্থও নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার প্রয়োজনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।
ভাষাবিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে জীবিত প্রায় সাত হাজার ভাষার মধ্যে চার হাজারেরও বেশি ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে। এ ভাষাগুলো চিরদিনের মতো হারিয়ে গেলে তা মানবজাতির জন্য হবে বিপর্যয়কর ও দুর্ভাগ্যজনক। সে বিবেচনায় বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণের বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকদের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত বলে তারা মনে করেন।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা সংরক্ষণ কেবল ওই গোষ্ঠীর জন্যই নয়, বরং তা সমগ্র দেশ ও জাতির জন্যই সম্মান ও গৌরব বয়ে আনতে পারে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণে বাংলা একাডেমী, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও ফোকলোর বিভাগ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মনে করেন ভাষাবিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা হলেও আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা পাওয়ার ফলে পৃথিবীব্যাপী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে বাংলা ভাষার প্রতি আগ্রহ ও কৌতূহল বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য মানুষ আগ্রহী হয়ে উঠছেন। ক্ষুদ্র নৃ- গোষ্ঠীর মানুষ ছাড়া এ দেশের নাগরিকরা যুগপৎ বাঙালি ও বাংলাদেশী।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, মনের ভাব প্রকাশ ও যে কোনো বিষয় হৃদয়ঙ্গম করার জন্য বাংলা ভাষা শিক্ষা যতটা সহজসাধ্য, তা অন্য কোনো ভাষার জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত অক্ষর লেখা ও আয়ত্ত করা বেশ সহজ। এ অর্থে যে কোনো শিশুর পক্ষেই বাংলা ভাষা আয়ত্ত করা সহজসাধ্য হবে এবং বাংলা বর্ণে সাঁওতালী ভাষায় রচিত পাঠ্যপুস্তক কোমলমতি শিশুর জন্য সুখপাঠ্য হয়ে উঠবে।
তাছাড়া প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণের জন্য রচিত গ্রন্থটি শুধু পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হবে এবং পরে বাংলাদেশে ঐ পুস্তকের বা সে ভাষার উপযোগিতা থাকবে না। যেহেতু উপজাতি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বর্ণ বা অক্ষর নেই এবং মাতৃভাষা চর্চার জন্য যে কোনো একটি ভাষার বর্ণমালাকে গ্রহণ করতে হবে, তাই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এ দেশের বর্ণমালাকেই গ্রহণ করা সঙ্গত ও অধিকতর যুক্তিসঙ্গত হবে।
এতে করে স্বদেশ প্রেম প্রমাণিত হবে এবং বৃহৎ বাঙালি জাতির সাথে অধিকতর সুসম্পর্ক সৃষ্টিতে স্থায়ী ভূমিকা রাখবে। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, আস্থা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাবে বলেও জানান গবেষকরা।
ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের ঝরে পরা রোধসহ জনশক্তিকে শিক্ষিত জনসম্পদে পরিণত করার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষা গ্রহণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধান ভাষা বাংলার বর্ণমালা গ্রহণ করার মধ্যে তাৎক্ষণিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে বলেও মনে করে ভাষাবিজ্ঞানীরা।
উৎসঃ purboposhchim
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: