৬ ঘণ্টায় সাড়ে ১৬ লাখ ভোট গ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন


প্রকাশিত:
৮ মার্চ ২০১৯ ০৫:১৭

আপডেট:
১৬ মার্চ ২০২৫ ০০:৩১

৬ ঘণ্টায় সাড়ে ১৬ লাখ ভোট গ্রহণ নিয়ে প্রশ্ন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনে ৬ ঘণ্টায় প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ ভোট গ্রহণের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীর ভোটদানে এ সময় যথেষ্ট নয়।



ছাত্রলীগ ছাড়া প্রায় সব ছাত্র সংগঠনই বলছে, নির্ধারিত এ সময়ের মধ্যে এত ভোটারের ভোট গ্রহণের সক্ষমতা নেই বিশ্ববিদ্যালয়ের। এটা অসম্ভব। সেজন্য ভোট গ্রহণের সময় অন্তত ৪ ঘণ্টা বাড়ানোর দাবি তাদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘এখন আর ভোট গ্রহণের সময় বৃদ্ধির সুযোগ নেই।’



২৮ বছর পর অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনে এক শিক্ষার্থীকে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫টি এবং হল সংসদে ১৩টি পদে মোট ৩৮টি ভোট দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সংসদে ২২৯ প্রার্থীর মধ্য থেকে ২৫ জনকে এবং হল সংসদে গড়ে ৩০ জনের মধ্য থেকে ১৩ জনকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেবেন ভোটাররা। ভোট গ্রহণ চলবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। অর্থাৎ ৬ ঘণ্টায় ৪৩ হাজার ২৫৬ শিক্ষার্থীর ৩৮টি করে ১৬ লাখ ৪৩ হাজার ৭২৮টি ভোট গ্রহণ করা হবে।



সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পছন্দের প্রার্থী বাছাই করে ৩৮টি পদে ভোট দিতে একজন শিক্ষার্থীর ৭-৮ মিনিট সময় লাগবে। গড়ে ৭ মিনিট করে ধরলে মোট ভোটারের জন্য সময় প্রয়োজন ৫ হাজার ৪৭ ভোটগ্রহণঘণ্টা। ১৮টি হলে এই ভোট গ্রহণ হবে।



প্রতিটি হলে গড়ে ভোটার রয়েছে ২ হাজার ৪০৩ জন। ফলে প্রতিটি হলে ভোট গ্রহণে সময় প্রয়োজন হবে ন্যূনতম ২৮০ ভোটগ্রহণঘণ্টা। একটি হলে ৩০টি করে বুথ স্থাপন করে ভোট গ্রহণ করা হলেও ৬ ঘণ্টায় ১৮০ ভোটগ্রহণঘণ্টা হয়। বাকি থাকে আরও ১০০ ভোটগ্রহণঘণ্টা।



এই ১০০ ভোটগ্রহণঘণ্টায় ভোট দিতে হবে ৮৫৭ শিক্ষার্থীকে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্ধারিত সময়ে এ ১০০ ভোটগ্রহণঘণ্টার কোনো হিসাব নেই। প্রতিটি হলে ৩০ বুথে ভোট গ্রহণ করে আরও ৪ ঘণ্টা সময় বাড়ালেই কেবল সব ভোটারের ভোট গ্রহণ সুষ্ঠুভাবে সম্ভব।



সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ হলের ৩০টির বেশি বুথ করারই সক্ষমতা ও প্রস্তুতি নেই। ফলে ৬ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তাই সময় বাড়ানোর দাবি তাদের।



সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো বলছে, প্রশাসন ‘স্বৈরাচারী স্টাইলে’ ডাকসু নির্বাচন পরিচালনা করছে। তারা বাস্তবতার নিরিখে কাজ না করে, ছাত্রলীগকে সুবিধা দিতেই একের পর এক অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। তবে ছাত্রলীগ বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সবকিছু বুঝেশুনেই ভোটের সময় নির্ধারণ করেছে।



চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী, ডাকসু ও হল সংসদের মোট ভোটার ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে প্রার্থী রয়েছেন ৭৩৮ জন। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ২৫ পদের বিপরীতে ২২৯ জন এবং হল সংসদে ১৩টি করে ২৩৪ পদের বিপরীতে ৫০৯ জন।



এর মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদে ভিপি পদে ২১ জনের মধ্য থেকে একজন, জিএস পদে ১৪ জনের মধ্য থেকে একজন এবং এজিএস পদে ১৩ জন থেকে একজনকে প্রতিনিধি হিসেবে বেছে নেবেন শিক্ষার্থীরা।



এর বাইরে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক পদে ১১, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক পদে ৯, কমনরুম ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে ৯, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক পদে ১১, সাহিত্য সম্পাদক পদে ৮, সংস্কৃতি সম্পাদক পদে ১২, ক্রীড়া সম্পাদক পদে ১১, ছাত্র পরিবহন সম্পাদক পদে ১০, সমাজসেবা সম্পাদক পদে ১৪ জন থেকে একজন করে এবং সদস্য পদে ৮৬ জন থেকে ১৩ জনকে বেছে নেবেন ভোটাররা।



১৮টি হল সংসদে ১৩টি করে মোট ২৩৪টি পদ রয়েছে। আর এই পদের বিপরীতে প্রার্থী রয়েছেন ৫০৯ জন। গড়ে প্রায় ২৯ প্রার্থী রয়েছেন একেকটি হলে। অর্থাৎ হল সংসদে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য একজন শিক্ষার্থীকে ২৯ জনের মধ্য থেকে ১৩ জনকে বেছে নিতে হবে।



ফলে কেন্দ্রীয় ও হল সংসদ মিলিয়ে তাকে মোট ভোট দিতে হবে ৩৮টি। স্বল্প সময়ে এত বড়সংখ্যক ভোটারের ভোট গ্রহণ নিয়ে শঙ্কা ক্রমশই বাড়ছে। ফলে ২৮ বছর পর ১১ মার্চ অনুষ্ঠেয় ভোটের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।



এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমরা শুরু থেকেই দাবি জানিয়ে আসছি হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোট কেন্দ্র করার। ছাত্রলীগ ছাড়া সব ছাত্র সংগঠন এই দাবির সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেছে।



অথচ প্রশাসন ছাত্রলীগের দাবি পূরণে সেটি করেনি। এখন আবার হলের বাইরের শিক্ষার্থীরা যাতে ভোট দিতে না পারে এবং ছাত্রলীগের পক্ষে নির্বাচনের ফল যায়, সেজন্য ভোট গ্রহণের জন্য মাত্র ৬ ঘণ্টা সময় রেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।



বাম জোটের ভিপি প্রার্থী ও ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী যুগান্তরকে বলেন, প্রশাসন চাচ্ছে না হলের বাইরের অনাবাসিক শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে আসুক। ভোট যত কম পড়বে, ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন (ছাত্রলীগ) তত সুবিধা পাবে।



এটা একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন, একটি ছাত্র সংগঠনকে জেতানোর জন্য তারা সামগ্রিক পরিকল্পনা করছে। ডাকসুর গঠনতন্ত্র প্রণয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনের প্রতিটি ধাপেই সেটি পরিলক্ষিত হয়েছে।



ভোট গ্রহণের সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বাড়ানোর দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, প্রশাসন বলছে, তারা অনেক বুথ করবে। আমরা বলছি, যত বুথই করা হোক না কেন, এত অল্প সময়ে এত অধিকসংখ্যক শিক্ষার্থীর ভোট গ্রহণ সম্ভব নয়।



কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্লাটফর্ম ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের’ ভিপি প্রার্থী নুরুল হক নুরু যুগান্তরকে বলেন, আমরা প্রশাসনকে এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানাই। সবাই যাতে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেজন্য ভোট দেয়ার সময় আরও অন্তত ৩ ঘণ্টা বাড়াতে হবে।



স্বতন্ত্র জিএস প্রার্থী এআরএম আসিফুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ৩৮টি করে ভোট দিতে হবে। ৪৩ হাজার ভোটার এত কম সময়ে এত ভোট দিতে পারবে না। আমরা সেজন্য সময় আরও চার ঘণ্টা বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি। ভোটের সময় সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারার দাবিতে ভিসিকে স্মারকলিপিও দিয়েছেন এই প্রার্থী।



এ বিষয়ে ছাত্রলীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস বলেন, আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এগুলো ঠিক করেছে খোঁজখবর নিয়ে, হিসাব-নিকাশ করে ও গবেষণা করে।



কোন সময়ে ভোটগ্রহণ শুরু হবে বা শেষ হবে, বুথ কত হবে, এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সিদ্ধান্তকেই আমরা চূড়ান্ত বলে মনে করি। ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর জিএস পদপ্রার্থী সাদ্দাম হোসেন বলেন, সুষ্ঠু ভোটের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমরা সেটিকে স্বাগত জানাই।



এ বিষয়ে জানতে চেষ্টা করেও কথা বলা যায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ও ডাকসুর সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান ও ডাকসু নির্বাচনের প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক ড. এসএম মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে। কথা বলতে রাজি হননি অন্য দুই রিটার্নিং কর্মকর্তাও।



বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী যুগান্তরকে বলেন, এখন আর সময় বাড়ানোর সুযোগ নেই। তবে কেন্দ্রগুলোয় পর্যাপ্তসংখ্যক বুথ থাকবে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেন্দ্রে উপস্থিত হলে যতক্ষণ পর্যন্ত ভোটার শেষ না হবে, ততক্ষণ ভোট গ্রহণ চলবে।



তিনি বলেন, ছাত্রলীগকে সুবিধা দেয়ার জন্য নয়, বরং নির্বাচন প্রক্রিয়াকে একটি কাঠামোর মধ্যে আনতেই এমন সিদ্ধান্ত। এর আগে বুধবার ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামানও জানিয়েছিলেন, ‘ভোট গ্রহণের সময় বাড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।’


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top