বর্ষবরণে যৌন হয়রানি : অধরা পুরস্কার ঘোষিত ৭ জন
প্রকাশিত:
১৪ এপ্রিল ২০১৯ ১২:৩৭
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ২০:৫৮

পহেলা বৈশাখ বাঙালির প্রাণের উৎসব। সেই উৎসবকে কলঙ্কের তিলক পড়িয়ে দেয় ২০১৫ সালের বর্ষবরণে অনুষ্ঠানের একটি ঘটনা।
রাজধানীর বর্ষবরণের মূল উৎসবের কেন্দ্র হচ্ছে রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এদিন এসব স্থানে ঢল নামে লাখো মানুষের। নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয় কয়েকদিন আগ থেকেই। কিন্তু ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে টিএসসিতে ঘটে যৌন হয়রানি। ঘটনার পর নিন্দা ও প্রতিবাদে কেঁপে ওঠে পুরো দেশ। জাতির প্রত্যাশা ছিল ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দ্রুত বিচার সম্পন্ন হবে। দেখতে দেখতে চার বছর কেটে গেলেও শেষ হয়নি মামলার বিচার। আটজন আসামির মধ্যে সাতজনকে এখনো গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। মো. কামাল নামের এক আসামিকে নিয়েই মামলার বিচারকাজ ধীর গতিতে চলছে। তবে মামলা সংশ্লিষ্টরা পুরোনো সেই আশার বাণী শুনিয়েছেন।
এ সম্পর্কে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বিশেষ পুলিশ সুপার আহসান হাবীব পলাশের কাছে সাতজনকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘আপাতত মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি নাই। তবে আমরা মনে করি, আমরা ঠিকঠাক মতো তদন্ত করেছি। তদন্তে যতভাবে সম্ভব তাদের শনাক্তের চেষ্টা করেছি। আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা আবেগের বশে কোনো ইনোসেন্ট লোককে সম্পৃক্ত করতে চাই না। আমরা হয়তো পারিনি , কিন্তু কোনো ইনোসেন্ট লোককে সম্পৃক্ত করিনি। আমরা সতর্কতার সাথে কাজটি করেছি। আমার মনে হয়, কাজটি পরিপূর্ণ হয়নি। কিন্তু ভুল হয়নি। চেষ্টা করেছি, যতটুকু পেরেছি করেছি। নতুন কাউকে সম্পৃক্ত করার তথ্য আমার কাছে নেই।’
২০১৭ সালের ১৯ জুন এ মামলাটিতে একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি। ফৌজদারি কার্যবিধির ১৭১(২) ধারার বিধান মতে, মামলার বিচারের সময় সাক্ষীকে আদালতে হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। চার্জ গঠনের পর থেকে গত আড়াই বছরে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আদালতের ১৩ কার্যদিবস ব্যয় হয়েছে। ইতোমধ্যেই আদালত সাক্ষীদের প্রতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। সর্বশেষ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। কিন্তু এদিন পুলিশ আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় আদালত আগামী ১৭ জুন সাক্ষ্যগ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য করেন। ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক আল আসাদ মো. আসিফুজ্জামানের আদালতে মামলাটি বিচারাধীন।
সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা সাক্ষীদের আনার চেষ্টা করছি। মামলাটি প্রথমে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ , এরপর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫ এ বিচারাধীন ছিল। পরবর্তীকালে মামলাটি এ আদালতে বিচারের জন্য বদলি করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এ মামলার বাদী পুলিশ। সাক্ষীদের আদালতে আনার দায়িত্বও পুলিশের। কিন্তু পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে পারছে না। আদালত সাক্ষীদের প্রতি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। আগামী ধার্য তারিখে সাক্ষী হাজির না হলে আদালতে আবেদন করে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করা হবে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবী আনিসুর রহমান বলেন, ‘মামলার এজাহারে কামালের নাম ছিল না। পুনঃতদন্তে চার্জশিটে তার নাম এসেছে। সে একজন ডায়াবেটিস রোগী। লালবাগের খাজী দেওয়ানে সে সবজির ব্যবসা করে। যেহেতু সে ডায়াবেটিস রোগী, এজন্য ওই দিন সে বের হয়েছিল হাঁটাহাটি করার জন্য। ওই ঘটনা ঘটার পরে জায়গাটা ফাঁকা হয়ে যায়। এরপর কামাল সেখানে হাঁটাহাটি করতে যায়। সেখানে যেকোনো ঘটনা ঘটছে, সে বিষয়ে কামাল কোনো কিছু জানতো না। সে হেঁটে এসেছিল আর তার ছবি ওই ভিডিও ফুটেজে এসেছে। এরপর তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গ্রেপ্তার করেছে। ভিডিও ফুটেজে এমন কিছু আসেনি যে, সে কাউকে ধরছে, টানছে বা শ্লীলতাহানি করছে। ভিডিও ফুটেজে তার ছবি আসার কারণে তাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। অথচ ওই ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রকৃত আসামিদের পুলিশ গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হয়েছে। ন্যায়বিচার সকলের প্রত্যাশা। প্রকৃত আসামিদের গ্রেপ্তার না করে অযথা, ভুলভাবে তাকে মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। আমরা ন্যায়বিচার আশা করছি।’
মানবাধিকার কর্মী ও বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির প্রাক্তন নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, ‘ঠিক নতুন বর্ষবরণের আগেই সাহসী প্রতিবাদী নারী অগ্নিদগ্ধ মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি আমাদের ব্যথিত ও মর্মাহত করে চলে গেল। আমাদের দেশে নুসরাতের মতো প্রতিবাদী কিশোরীর বড়ই প্রয়োজন ছিল। কারণ তার সাহসিকতা পুরো পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে এবং এটা কিশোরীদের প্রতিবাদের ক্ষেত্রে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করবে। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ বিকৃত রুচির মানুষটি (সিরাজ উদ দৌলা) অনেক ছোট ছোট অপরাধ করেই এ ধরনের বড় অপরাধ করতে সাহস পেয়েছে। এর জবাবদিহি সরকার ও প্রশাসনকে দিতে হবে। ’
তিনি বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর কোনো ঘটনায় প্রথমে সরকার নজর দিলেও পরে অপর একটি ঘটনার আড়ালে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। আর এভাবে বিচারিক দীর্ঘসূত্রতায় আসামিরা মামলার প্রমাণাদি নষ্ট করে ফেলে। সব মিলিয়ে যখন অপরাধীদের শাস্তি হয় না, তখন তারা ও অন্যান্য বখাটে নারী নির্যাতনে আরো আগ্রহী হয়। যৌন হয়রানির যে দুই/চারটা মামলা আসে, তা কোনো সময়ই সঠিকভাবে তদন্ত হয় না। বরং এক্ষেত্রে ভিকটিমদের দোষারোপ করা হয়। সরকারের উচিত, এসব ঘটনায় যুক্তিসঙ্গত সময়ের মধ্যে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা।’
২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় কয়েকজন নারীকে যৌন হয়রানি করা হয়। ওই ঘটনায় ভিকটিমদের পক্ষ থেকে কেউ মামলা না করায় শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাদী হয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে অজ্ঞাতদের আসামি করে মামলা দায়ের করেন। শাহবাগ থানার পুলিশ মামলাটি কয়েক দিন তদন্তের পরই তদন্তভার ডিবি পুলিশকে দেওয়া হয়।
মামলার একমাস পর ১৭ মে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ভিডিও থেকে আটজন যৌন হয়রানিকারীকে শনাক্ত ও তাদের ছবি পাওয়ার কথা জানান তৎকালীন পুলিশ প্রধান এ কে এম শহীদুল হক।
শনাক্তকৃতদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করে পুলিশ। কিন্তু তাদের নাম-ঠিকানা না পাওয়ার অজুহাতে ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই দীপক কুমার দাস আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। ওই চূড়ান্ত প্রতিবেদনও গ্রহণ করেন ট্রাইব্যুনাল। পরে শনাক্তকৃত আসামিদের মধ্যে মো. কামাল (৩৫) গ্রেপ্তার হলে তাকে প্রথমে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়।
২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল মামলাটি পুনঃতদন্তের আদেশ দেন। পুনঃতদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৫ ডিসেম্বর পিবিআইয়ের পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক একমাত্র আসামি কামালকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০১৭ সালের ১৯ জুন ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার ওই আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন।
চার্জ গঠনের আদেশে বিচারক উল্লেখ করেন যে, ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে ৬টা থেকে রাত ৯টার মধ্যে যেকোনো সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়স্থ টিএসসি এলাকায় আপনি আসামি মো. কামাল ১লা বৈশাখ ১৪২২ উদযাপন উপলক্ষে হাজার হাজার নারী পুরুষের উপচে পড়া প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে অজ্ঞাতনামা মেয়েদের শরীরে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি ঘটান।’
মামলাটিতে কামাল জামিনে আছেন। হাইকোর্ট থেকে তিনি জামিন পেয়েছেন।
এদিকে, মামলাটির চার্জশিটে ৩৪ জনকে সাক্ষী করে তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, মামলাটি তদন্তকালে একাধিকবার ঘটনাস্থল গিয়ে প্রত্যক্ষ সাক্ষী, ভিকটিমদের সন্ধান এবং আসামিদের সন্ধান ও গ্রেপ্তারের সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়। কামাল ব্যতীত অন্য কোনো আসামির সন্ধান পাওয়া যায়নি। ৮ আসামির জন্য এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণার প্রেক্ষিতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মিডিয়ায় প্রচার করা সত্ত্বেও আসামিদের নাম-ঠিকানা ও সন্ধান পাওয়া যায়নি। বাকি সাতজনের সন্ধান পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হবে।’
পুনঃতদন্তের সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি লিটন নন্দির জবানবন্দিতে ওই দিনের যৌন হয়রানির ঘটনা সম্পর্কে বলা হয়, ‘২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৫টা থেকে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে উপস্থিত ছিলেন। ওইদিন সন্ধ্যে পৌনে ৬টার দিকে দেখতে পাই পাঁচ গ্রুপে বখাটেরা নারীদের লাঞ্ছিত করার চেষ্টা করছে। প্রতিহত করার জন্য আমি ও আমার সঙ্গীরা এগিয়ে যাই। রাজু ভাস্কর্যের পূর্ব পাশে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ৩নং গেটের সামনের রাস্তার ওপর একটি মেয়ের শাড়ি বখাটেরা খুলে ফেলে এবং ব্লাউজ ছিড়ে ফেলে। তখন আমরা বখাটেদের কিলঘুষি মেরে তাড়িয়ে দেই। মেয়েটিকে শরীর ঢাকার জন্য আমার পাঞ্জাবি খুলে দেই। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে বখাটেরা মেয়েদের যৌন হয়রানি করে।’
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: