মেজর জিয়া কোথায়?
প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২০
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৮:২২

সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত, জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যুক্ত মেজর জিয়ার হদিস মিলছে না। পালিয়ে তিনি কোথায় আছেন, এখনো তিনি জঙ্গি তৎপরতায় যুক্ত কি না; সে সম্পর্কে কিছু জানা যাচ্ছে না। বিভিন্ন জঙ্গির স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, অসংখ্য হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তিনি। অথচ দেশজুড়ে চলা বিভিন্ন অভিযানের পরও তাঁকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি) এবিটির মাঠপর্যায়ের জঙ্গি আসাদুল্লাকে গ্রেপ্তারের পর জানতে পারে, মেজর জিয়া বেশির ভাগ সময় চট্টগ্রাম এলাকায় থাকেন। গ্রেপ্তার হওয়ার কদিন আগে মেজর জিয়ার সঙ্গে ওই জঙ্গির সাক্ষাৎ হয়েছিল। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিটিসির এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মেজর জিয়ার অপতৎপরতা আপাতত নেই। তবে সে গ্রেপ্তার না হলে ভবিষ্যতে আরো হামলা চালানোর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
মেজর জিয়া সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত হন ২০১২ সালের জানুয়ারিতে। মিরপুর সেনানিবাস থেকে বের হয়েই তিনি আত্মগোপনে চলে যান। ২০১১ সালের ডিসেম্বরে সরকার উত্খাতের ষড়যন্ত্রের চেষ্টায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান কালের কণ্ঠকে জানান, আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) এই জঙ্গি নেতাকে খোঁজা হচ্ছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা গেলে অনেক হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে।
র্যাব-পুলিশের একাধিক সূত্র এবং মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাকরিচ্যুত হওয়ার পরই মেজর জিয়া সরকার উত্খাত, দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে নানা অপতৎপরতায় যুক্ত হয়ে পড়েন। নিষিদ্ধ ঘোষিত হিযবুত তাহ্রীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরকারবিরোধী তৎপরতায় জড়িত হন প্রথমে। পাশাপাশি নিষিদ্ধ ঘোষিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে
থাকেন। এতে সফলও হন তিনি। একপর্যায়ে তিনি এবিটির সামরিক শাখার প্রধান হন। দায়িত্ব নেন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের (এবিটি) বিভিন্ন কিলিং স্কোয়াডের। নব্য জেএমবির সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ চলতে থাকে তাঁর। কোমলমতি তরুণদের বিপথগামী করতে থাকেন তিনি। এবিটির মধ্যেই সৃষ্টি করেন আটটির বেশি কিলিং সোয়াদ ইউনিট। তাদের নিয়ে মুক্তমনা ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার মিশনে নামেন। এসব হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মেজর জিয়া।
সম্প্রতি প্রকাশক দীপন হত্যা মামলা এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যা মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। ওই চার্জশিটে জঙ্গিদের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, অন্তত ৯টি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কুশীলব মেজর জিয়া। এ ছাড়া আরো বেশ কজনকে হত্যার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর। মেজর জিয়ার বেশ কজন সহযোগী গ্রেপ্তার হলে আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
২০১৩ সালের আগস্টে গ্রেপ্তার হন এবিটির আধ্যাত্মিক গুরু জসিম উদ্দিন রাহমানী। তিনি বিভিন্ন ধরনের ভ্রান্ত ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে সদস্যদের উদ্বুদ্ধ করতেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হয় মেজর জিয়ার। গুরু জসিম গ্রেপ্তারের পরই আলোচনায় আসে জিয়ার নাম। গুরু জসিমকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই জানা যায়, মেজর জিয়া এবিটির সামরিক শাখার দায়িত্ব নিয়েছেন। জসিম গ্রেপ্তারের আগে ২০১৩ সালের প্রথম দিকে পল্লবীতে খুন হন ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার। ওই মামলায় জসিমের স্বীকারোক্তিতে জানা যায়, মেজর জিয়া এবিটির হাল ধরেছেন।
জঙ্গিবাদী এই সংগঠনকে শুধু সামরিক সহযোগিতা নয়, আর্থিক সহযোগিতাও দিয়ে আসছেন মেজর জিয়া। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পাঁচজন ব্লগার, একজন প্রকাশক ও দুইজন এনজিওকর্মী খুন হন। এসব খুনের সঙ্গে এবিটি জড়িত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির অদূরে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়, তেজগাঁওয়ে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবু, সিলেটের সুবিদবাজার এলাকায় অন্তত বিজয় দাশ, আজিজ সুপার মার্কেটে প্রকাশক দীপন ও রাজধানীর গোড়ানে নীলাদ্রি চ্যাটার্জি ওরফে নিলয়কে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল কলাবাগানের একটি বাসায় জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব তনয় নামে দুজন এনজিও কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়। এর আগে একই বছরের ৫ এপ্রিল রাজধানীর সূত্রাপুরে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
রাজধানী ও আশপাশে টার্গেট কিলিংয়ে জড়িত কজন জঙ্গিকে গ্রেপ্তারের পর তাদের স্বীকারোক্তি থেকে জানা যায়, মেজর জিয়া এসব হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব জঙ্গির মোবাইল ফোনের কল রেকর্ড পর্যালোচনা, ই-মেইল অ্যাকাউন্ট, ফেসবুক ও টুইটার অ্যাকাউন্ট ঘেঁটেও অনেক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে মেজর জিয়া সম্পর্কে।
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটে নিজ কার্যালয়ে দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে জঙ্গিরা। এ ঘটনায় ওই দিনই বিকেলে তাঁর স্ত্রী রাজিয়া রহমান শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। পরে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করে। জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের ছয় সদস্যকে এ মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।
সুনামগঞ্জের মইনুল হাসান শামীম ওরফে সিফাত ওরফে সামির ওরফে ইমরান, কুমিল্লার মো. আব্দুস সবুর ওরফে আব্দুস সামাদ ওরফে সুজন ওরফে রাজু ওরফে স্বাদ, চট্টগ্রামের খায়রুল ইসলাম ওরফে জামিল ওরফে রিফাত ওরফে ফাহিম ওরফে জিসান ও মো. শেখ আবদুল্লাহ ওরফে জুবায়ের ওরফে জায়েদ ওরফে জাবেদ ওরফে আবু ওমায়ের, লালমনিরহাটের মো. আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, ময়মনসিংহের মো. মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন স্বীকারোক্তিতে জানায়, জিয়াই এসব হত্যার পরিকল্পনা করেন।
অভিজিৎ হত্যা মামলায় চার্জশিটে মেজর জিয়া ছাড়াও আসামি হলো—আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে শাহাব (৩৪), মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন ওরফে শাহরিয়ার (২৫), আরাফাত রহমান ওরফে সিয়াম (২৪), শফিউর রহমান ফারাবী (২৯) ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ৩০)। এদের মধ্যে জিয়া ও আকরাম পলাতক রয়েছেন।
অভিজিৎ রায়কে কিভাবে হত্যা করা হয়, কারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়, মামলার আসামি আবু সিদ্দিক সোহেল আদালতে এর বিস্তারিত বর্ণনা দেয়। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সোহেল বলে, ২০১৪ সালে সে এবিটির সদস্য হয়। পরে মেজর জিয়ার সঙ্গে পরিচয় হয়। সে জিয়া ও আবিরের কাছে প্রশিক্ষণ নেয়। জিয়াই তাদের টিমকে অভিজিৎ হত্যার নির্দেশ দেন। কিভাবে হত্যা করতে হবে তার রূপরেখা দেন। আসামি সায়মন ও হাসানও একই ধরনের স্বীকারোক্তি দেয়।
এনজিও কর্মকর্তা জুলহাস-তনয়, অনন্ত বিজয়, দীপন হত্যাকাণ্ডও মেজর জিয়ার নির্দেশে হয় বলে আসামিরা জবানবন্দিতে জানিয়েছে। এ অবস্থায় জিয়ার পালিয়ে থাকাটা উদ্বেগজনক। একেক সময় একেক ছদ্মবেশে জিয়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে সাংগঠনিক কাজে সম্পৃক্ত রয়েছেন বলে তাঁর সহযোগীরা গ্রেপ্তারের পর স্বীকারোক্তিতে জানিয়েছে।
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: