কর্মক্ষেত্রেও হয়রানি ও সহিংসতার শিকার নারী, আইনে নেই প্রতিকার


প্রকাশিত:
৪ মে ২০১৯ ১৬:৪৪

আপডেট:
১৬ মার্চ ২০২৫ ০৯:৩৭

কর্মক্ষেত্রেও হয়রানি ও সহিংসতার শিকার নারী, আইনে নেই প্রতিকার

একদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত নারীরা যৌন হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে এই সহিংসতা প্রতিরোধে আইনী কাঠামোতে নেই সুনির্দিষ্ট দিক নিদের্শনা। ফলে কর্মক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নারীর অংশগ্রহণ এবং উপস্থিতি। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন।



 



একশনএইড বাংলাদেশের নতুন এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার ঢাকার গুলশান শুটিং ক্লাবে ‘নারীবান্ধব নিরাপদ কর্মস্থল’ নামে একটি আন্তর্জাতিক ক্যাম্পেইনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এই প্রতিবেদন তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ।



 



অনুষ্ঠানে যোগ দেয়া বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নারীদের প্রতি সহিংসতাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। আর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর কোন প্রতিকার না থাকায় বর্তমান কাঠামো সহিংসতাকে আরো উসকে দেয়। যা নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নকে বাধাগ্রস্ত করছে।



 



“কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা: প্রতিদিন প্রত্যেক কর্মক্ষেত্রে ঘটছে’ নামের গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমিন। যেখানে বলা হয়, বিশ্বব্যাপী, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মানবাধিকারের সর্বাধিক লঙ্ঘনের মধ্যে একটি। এক শুমারী অনুযায়ী, ১৫ বছরের বেশি বয়সী ৩৫শতাংশ নারী (বিশ্বব্যাপী ৮১৮ মিলিয়ন নারী) তাদের বাড়িতে, কমিউনিটিতে অথবা কর্মক্ষেত্রে যৌন বা শারীরিক সহিংসতার শিকার হয়েছে।



 



বাংলাদেশে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ অর্থনৈতিক বৃদ্ধি এবং মানব উন্নয়নে অবদান রাখলেও কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কর্মক্ষেত্রের উৎপাদনশীলতা এবং মুনাফাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাছাড়া, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা নারীর মর্যাদা এবং শারীরিক ও মানসিক কল্যাণে বাধা দেয়। ‘সজাগ নেটওয়ার্ক’ কতৃক পরিচালিত একটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ২২ শতাংশ নারী পোশাক কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে অথবা কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পথে শারীরিক, মানসিক এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উপর বিশ্বাসের অভাবের কারণে তাদের মধ্যে ৬৭ শতাংশ-ই নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ কমিটির কাছে প্রতিকার চায় না।



 



এই পরিস্থিতিতে কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে দেশের বিদ্যমান আইনেরও বিশ্লেষণ করেছে একশনএইড বাংলাদেশ। এই বিশ্লেষণ বলছে, কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতাকে চিহ্নিত করার জন্য সামগ্রিক আইনী কাঠামোয় কার্যকরভাবে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিভিন্ন ধরণ অনুযায়ী উল্লেখ নেই, যার মধ্যে  অন্যতম - যৌন হয়রানি। বিদ্যমান আইনে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি যৌন হয়ারনিকে।



 



শ্রম আইন-২০০৬ কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা চিহ্নিত করতে কার্যকরী ভূমিকা রাখছেনা, সহিংসতা বা যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নেই বিশেষ কোন ব্যবস্থা। বিদ্যমান অপরাধমূলক আইনে যৌন হয়রানিকে সংকীর্ণভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বরং, সেখানে নারীর ‘শালীনতা’র উপর বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ‘শালীনতা’ কিভাবে নির্ধারিত হবে তা স্পষ্ট না করেই। এই আইনগুলো স্পষ্টতই পিতৃতান্ত্রিক ধারণা দ্বারা প্রভাবিত স্টেরিওটাইপ পদ্ধতি সমর্থন করে অপরাধের পরিবর্তে নারীর চরিত্রের উপর গুরুত্ব দেয়। এসকল আইনে শালীনতার অবমাননা করার উদ্দেশ্যেরও প্রমাণ চাওয়া হয় যা বাস্তবে প্রসিকিউশনের জন্য প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব।



 



গবেষণা বলছে, কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সুপ্রিম কোর্ট ২০০৯ সালে একটি নির্দেশনা দেয়। এই নির্দেশনা প্রণয়নের নয় বছর পরেও প্রতিষ্ঠানগুলো যৌন হয়রানি প্রতিরোধে নির্দেশনা অনুযায়ী কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না। একশনএইড বাংলাদেশ-এর গবেষণায় দেখা গেছে, ৮৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী উক্ত দিক-নির্দেশনা সম্পর্কে একেবারেই অবগত নয়, কর্মক্ষেত্রে যার হার ৬৪.৫ শতাংশ।



 



এ প্রসঙ্গে একশনএইড বাংলাদেশ এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, “একদিকে আইনে যৌন হয়রানিকে সজ্ঞায়িত করা হয়নি। অন্যদিকে বিদ্যমান আইনের প্রয়োগেও রয়েছে গুরুতর অভাব। মামলার বিলম্বিত নিষ্পত্তি এবং তদন্ত কর্মকর্তা এবং পাবলিক প্রসিকিউটরদের অদক্ষতা ও অবহেলার কারণে ক্ষতিগ্রস্থরা প্রায়ই বিচার পেতে ব্যর্থ হন। এর প্রভাব পড়ছে নারীর মনে, কাজে, সমাজে।”



 



অনুষ্ঠানে পাঠানো লিখিত বক্তব্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বেগম মুন্নুজান সুফিয়ান- এমপি বলেন, “বাংলাদেশের নারী ও কন্যা শিশুরা কাঠামোগত বৈষম্য এবং সামাজিক রীতির কারণে বিভিন্ন লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সম্মুখীন হন। এটির সমাধান চায় বর্তমান সরকার। প্রয়োজনে আমরা বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেব।”



 



নারী নেত্রী খুশি কবির বলেন, “আমাদের দেশে নারীকে দমন করা ও নির্যাতন করাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। আবার তার শ্রমকে মর্যাদা দেয়া হয় না। আইনের পাশাপাশি দরকার মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মানুষকে শ্রদ্ধা করতে না শিখলে আইনের উন্নতি হবে না। বাস্তবায়ন হবে না। এজন্য আমাদের পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা দরকার।”





আওয়াজ ফাউন্ডেশন-এর নির্বাহী পরিচালক নাজমা আক্তার বলেন, “আমাদের নিরাপত্তার কোন জায়গা নেই। আছে শারীরিক ও মানুষিক নির্যাতন। আছে বৈষম্য। সব মিলিয়ে নারীরা সব সময় ভয় নিয়ে কাজ করছেন। এর প্রতিকার দরকার।”



 



ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেজ এডমিনিস্ট্রেশন-এর অধ্যাপক ও বিজিএমইএ-এর পরিচালক এ. মোমেন বলেন,  “কোন ক্ষেত্রেই আমরা নারীর অবমাননা চাই না। পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা বদলাতে সচেতনতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। পোশাক শিল্প মালিকদের প্রতিনিধি হিসেবে আমি বলতে পারি, শেষ পর্যন্ত দায়টা আমাদের উপর।  আমরা নিরাপত্তা নিশ্চিত কারার মধ্যমে একটি টেকসই ব্যবসা ব্যবস্থা পরিচালনা করতে চাই।  যেখানে কোন সহিংসতা থাকবে না।”





উপস্থাপিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে অপরাধমূলক আইন যেখানে যৌন অপরাধগুলি সংজ্ঞায়িত করা হয় এবং শাস্তি দেওয়া হয় তা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবেলায় পর্যাপ্ত নয়। মহিলা ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইন ২০০০ এর ধারা ৯-এ ধর্ষণের সংজ্ঞা দন্ডবিধির ধারা ৩৭৫-এ বর্ণিত ধর্ষণের সংজ্ঞাকেই বহাল রাখে, বৈবাহিক ধর্ষণকে অব্যাহতি দেওয়াসহ। এছাড়াও যৌন সস্পর্কের মত শব্দের সংজ্ঞা না দিয়ে ধর্ষণ সংক্রান্ত একটি সংকীর্ণ বিবরণ রয়েছে এ সংজ্ঞায়। এছাড়াও, ১৮৭২ এর আইনে ধারা ১৫৫ (৪) ধর্ষণের মামলায় ক্ষতিগ্রস্থদের 'অনৈতিক চরিত্র' সম্পর্কিত প্রমাণ অনুমোদন করে বিচারের সময় ক্ষতিগ্রস্থকে আরও হয়রানি করার সুযোগ করে দেয়।  আবার গৃহ নির্যাতনবিষয়ক আইনসমূহও কর্মীদের গৃহ নির্যাতন থেকে রক্ষা ও প্রতিরোধ করতে নিয়োগকারীদের প্রতি বাধ্যবাধকতার পর্যাপ্ত বিধান প্রদান করে না। গৃহকর্মী এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কর্মীরা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা থেকে আইনীসুরক্ষার আওতা বহির্ভুত। শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি এবং এলজিবিটিকিউআই সম্প্রদায়ের মানুষের বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঘটনায় আইনি সুরক্ষা নেই।



 



আলোচনায় অংশ নিয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন বলেন, “লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। প্রয়োজনে সরকার আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রনয়ন করবে। তবে শুধু আইন দিয়ে সহিংসতা বন্ধ করা সম্ভব না। এজন্য আমাদের দৃষ্ঠিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আনতে হবে।”



 



বাংলাদেশে নিযুক্ত অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাই কমিশনার পেনি মর্টন বলেন, “সহিসংতার মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে তার সমাধান করতে হবে। আমার চাই নারীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সংযুক্তি বাড়–ুক। এজন্য নারীর প্রতি সহিংসতা একটি প্রতিবন্ধকতা। এটার সমাধান করতে হবে। কারণ সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা না হলে সমাজের উন্নতি হবে না।”



 



গবেষণায় কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়। উল্লেখযোগ্য সুপরিশ হলো: বিভিন্ন ধরণের যৌন সহিংসতাকে সংজ্ঞায়িত এবং শাস্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে আইনের বিভিন্ন ফাঁক ফোকড় চিহ্নিত করে আইন সংশোধনের জন্য এডভোকেসি বৃদ্ধি ও শক্তিশালী করা; কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বিশেষ আইন প্রণয়নে পদক্ষেপ নেওয়া; যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের নির্দেশিকা কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া;  বৈষম্য বিরোধী আইন প্রণয়নে এবং প্রয়োগ করার পক্ষে সমর্থন জোরদার করা; আনুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের শর্ত নিশ্চিত করার জন্য নীতি প্রণয়ন করা; আইন কার্যকর করা এবং তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এই ব্যবস্থাগুলির মধ্যে আইন প্রয়োগকারী এবং সরকারি প্রসিকিউটরদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা; অপরাধের দ্রুত নিষ্পত্তি এবং বিচারকদের, আইনজীবীদের এবং আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ক মামলা পরিচালনায়  সংবেদনশীলতা বিষয়ক প্রশিক্ষণের প্রয়োজন এবং কর্মস্থলে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা মোকাবেলা এবং চ্যালেঞ্জ করতে নিয়োগকর্তা, মধ্য-স্তরের ব্যবস্থাপনা, সুপারভাইজার, কারখানা পরিদর্শক ও কর্মীদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা।



 



উপরোক্ত প্রেক্ষাপটে, ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌছানোর কর্মসূচির মূলনীতির উপর ভিত্তি করে, একশনএইড ইন্টারন্যাশনাল আগামী তিন বছরের জন্য “নারী বান্ধব নিরাপদ কর্মস্থল” নামে একটি প্রচারাভিযানের উদ্বোধন করেছে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। আলোচনা শেষে আমন্ত্রিত অতিথিরা র্যাালি ও বেলুন উড়িয়ে এই প্রচারাভিযানের উদ্বোধন করেন আমন্ত্রিত অতিথিরা। আগামী তিন বছর গবেষণা


বিষয়:


আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top