দেশের বন্যা পরিস্থিতির অবনতি
প্রকাশিত:
১৩ জুলাই ২০১৯ ১৫:৩৬
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৬

দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে যাচ্ছে। ভারী বর্ষণের কারণে ১০ জেলায় নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের তথ্য মতে, বৃহস্পতিবার ছিল ১২টি, গতকাল শুক্রবার দেশের ১৪টি পয়েন্টে নদ-নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব পয়েন্টে পানির উচ্চতা ক্রমাগত বাড়ছে। ফলে আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশংকা রয়েছে। এদিকে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, আগামি কয়েক দিন ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকতে পারে, তাতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে। এছাড়া, জামালপুরে ভাঙনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে এবং লালমনিহাটে তিস্তা নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় দেশের নদ-নদীগুলোর ৬২৮টি ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্ট নির্ধারণ করেছে, এর মধ্যে ২৬টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।
বন্যা পরিস্থিতির এই নাজুক অবস্থা সামাল দিতে সরকারের প্রস্তুতির খবরও এসেছে। সচিবালয়ে গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনেও আন্তঃমন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির এক সভা শেষে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান দেশের কয়েকটি অঞ্চলে বন্যার আশঙ্কা দেখা দেওয়ায় মাঠ পর্যায়ের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রস্তুতি নিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কথা জানান। এ সময় ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী আরও জানান, শুক্রবার সকাল পর্যন্ত লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, কক্সবাজার এবং নীলফামারী জেলায় বন্যা পরিস্থির অবনতি হয়েছে। উজানে ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বাংলাদেশে যমুনা নদীতে পানি আরও বাড়বে। পাশাপাশি উজানে গঙ্গার পানি বাড়ায় বালাদেশে পদ্মা অববাহিকায় বন্যা দেখা দিতে পারে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফুজ্জামান ভুঁইয়া ইত্তেফাককে জানান, ইতোমধ্যেই নদীর ১৪টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল তিস্তা নদীর পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপদসীমার ১০০ সেন্টিমিটার ও সুনামগঞ্জ পয়েন্টে ৯০ সেন্টিমিটার, সিলেট পয়েন্টে ২৫ সেন্টিমিটার, হবিগঞ্চে খোয়াই নদীর পানি বল্লা পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার, সোমেশ্বরী নদীর পানি কমলাকান্দা পয়েন্টে ২৭ সেন্টিমিটার, কংস নদীর পানি জারিয়াজাজইল পয়েন্টে ৭০ সেন্টিমিটার, সাঙ্গু নদীর পানি দোহাজারি পয়েন্টে ৪৫ সেন্টিমিটার ও বান্দরবান পয়েন্টে ১৭৭ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসিদ পয়েন্টে ৬০ সেন্টিমিটার, শেরপুর পয়েন্টে ৫৫ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৫৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে যমুনা নদীর পানি বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে ১ সেন্টিমিটার ও চিলমারি পয়েন্টে ৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়াও, সুনামগঞ্জের চেলা নদীর পানি বিপদসীমার ৯০ সেন্টিমিটার, পিয়াইন নদীর পানি ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ডাইকি, বটেরখাল ও বোকা নদীর পানিও ১০০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
সুরমা অববাহিকায় দেড় লাখ লোক পানিবন্দি
ঢল ও বর্ষণজনিত কারণে বৃহত্তর সিলেটের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। নদ-নদীর পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুনামগঞ্জে ৩শ’ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। বন্ধ হয়েছে অর্ধেকেরও বেশী। সিলেটে ৬০ প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ। সিলেট, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের অন্তত দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এই তিন জেলায় এক হাজার ৯৯৩ হেক্টরের আউস, বোনা আমন ও রোপা বীজতলা নিমজ্জিত হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়।
গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় শহরের সাথে গ্রামের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। বাড়ির আঙ্গিনাসহ নিম্মাঞ্চলের অনেক বসত ঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। পানিবন্দি মানুষের জন্য কোন আশ্রয় কেন্দ্র খোলার খবর এখনও পাওয়া যায়নি।
বন্যায় বান্দরবানে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষ পানিবন্দি
অবিরাম বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে বান্দরবানের সাত উপজেলায় প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার পানিতে প্রধান সড়কসহ অভ্যন্তরীণ বেশিরভাগ সড়ক প্লাবিত হওয়ায় চতুর্থ দিনেও চালু হয়নি সারাদেশের সঙ্গে পর্যটন শহর বান্দরবানের সড়ক যোগাযোগ। এছাড়াও পাহাড় ধস এবং সড়কে পানি উঠায় জেলার রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি, লামা, আলীকদম, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অভ্যন্তরীণ সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও বন্ধ রয়েছে। সাঙ্গু এবং মাতামুহুরী নদীর পানি এখনো বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সাইক্লোন সেন্টারে খোলা ১২৬টি আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে হাজার হাজার বন্যা দূর্গত পরিবার।
এদিকে, চট্টগ্রামের রাউজানে অতিবর্ষণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢলে ডাবুয়া খাল ও সর্তা খালের বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে জনবসতি। চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। এই ভাঙনের ফলে উপজেলার নোয়াজিসপুর, চিকদাইর, ডাবুয়া ইউনিয়ন ও পৌর এলাকার পশ্চিম সুলতানপুরে কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকায় পানির তীব্র সে্রাতে তালিয়ে গেছে আমনের বীজতলাসহ নানা ফসলি ক্ষেত। বন্ধ হয়ে পড়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষাকার্যক্রম। এছাড়াও টানা একসপ্তাহ ধরে বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের প্রভাবে উপজেলার সদরের ঢেউয়া হাজিপাড়া, মোহাম্মদপুর , পাহাড়তলী ইউনিয়নের খৈয়াখালী, দেওয়ানপুর ,বাগোয়ান ইউনিয়নের কর্ণফুলীতীরবর্তী কিছু এলাকা, নোয়াপাড়া, উকিরচর, পশ্চিম গুজরা ও বিনাজুরি ইউনিয়নের হালদানদী তীরবর্তী কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
অন্যদিকে পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমার ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। উজানের ঢল সামাল দিতে খুলে রাখা হয়েছে তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি কপাট। ফলে নীলফামারীর ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলা ও উপজেলার প্রায় ১৫টি চর গ্রাম হাঁটু থেকে কোমর পানিতে তলিয়ে যেতে শুরু করেছে। এতে প্রায় ১০ হাজার পরিবার বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। এছাড়া তিস্তা বিপদসীমায় চলে যাওয়া নদীর বিভিন্ন স্থানের বাঁধে আঘাত করছে স্রোত। ফলে বাঁধগুলো হুমকির মুখে পড়েছে। লালমনিরহাট জেলার তিস্তা ও ধরলা নদীর কূলবর্তী এলাকা নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় ১২ হাজার পরিবার। বন্যার পানির কারনে হাতিবান্ধা উপজেলার গড্রিমারী তালেব মোড় এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত বাধেঁ ফাটল দেখা দিয়েছে। নতুন করে প্লাবিত গ্রামগুলো হচ্ছে, পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, আঙ্গোরপোতা, হাতিবান্ধা উপজেলার ডাউয়াবাড়ী, সিন্দুরনা, পাটিকাপাড়া, সিঙ্গিমারী, গড্রিমারী, কালীগঞ্জের ভোটমারী, শোলমারী, আদিতমারী উপজেলার গোর্বধন, মহিষখোচা ও লালমনিরহাট সদর উপজেলার খুনিয়াগাছ, কালমাটি এলাকার প্রায় ১২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার কারনে জেলার ২০টি বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা করেছে। বন্যার্ত পরিবারগুলো হাটু পানিতে বসবাস করছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুরে টানা বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ব্রহ্মপূত্র ও তিস্তা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। তিস্তা ও ব্রহ্মপূত্র নদ অববাহিকার ৮ ইউনিয়নের ৪৯টি গ্রামের প্রায় ১১ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সেই সাথে আমন বীজতলা,
যমুনার পুর্ব পাড়ে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের চৌহালীতে নদী ভাঙনে ৪ বছর আগেই পুরো উপজেলা পরিষদ ও সদরের ৭/৮টি গ্রাম বিলীন হয়েছে। হাতে গোনা আর ১০/১২টি গ্রাম থাকলেও ভাঙন রোধে কার্যকরি পদক্ষেপ না থাকায় তাও এখন বিলীনের পথে। গত দু’সপ্তাহের ব্যবধানে এখানে ৫ শতাধিক ঘর-বাড়ি, আবাদী জমি বিলীনের পর বোয়ালকান্দি, মহেশপুর ও বারবালা গ্রাম এখন অনেকটাই নিশ্চিহ্ন। এখানে থাকা ৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাখিল মাদ্রাসাসহ ৫ শতাধিক ঘরবাড়ি রয়েছে হুমকিতে।
উৎসঃ ইত্তেফাক
বিষয়:
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: