মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো (পর্ব- ১) : কাজী জাকির হাসান


প্রকাশিত:
২৯ জুন ২০২০ ২১:৩৫

আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ০২:০৫

ছবিঃ কাজী জাকির হাসান

 

পটভূমি

১৯৭০-এ দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত মোট ১৬৯টি আসনের মধ্যে মোট ১৬৭টি আসন লাভ করলো। সঙ্গত কারণেই আমরা ভেবে নিয়েছিলাম নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগকেই সরকার গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। কিন্তু তা হলো না। সংবিধান প্রণয়ন, ক্ষমতা হস্তান্তর সহ বিভিন্ন বিষয়ে ভুট্টো, ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলোচনার নাম করে কালক্ষেপণের মধ্য দিয়ে ষড়যন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে লাগলেন। এমন পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা শহর এবং ৩ মার্চ ১৯৭১ প্রদেশ ব্যাপী হরতাল পালনসহ ৭ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভা আহবান করলেন শেখ মুজিব। ঘোষণা অনুযায়ী ২ মার্চ ১৯৭১ ঢাকা শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হলো। গুলি বর্ষিত হলো হরতালকারীদের ওপর। উত্তাল জনতা আরো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাদের প্রতিহত করার জন্য জারি করা হলো কারফিউ। কিন্তু জনতা কারফিউ আদেশ অমান্য করে মশাল মিছিল বের করলো ঢাকার রাজপথে। ব্যারিকেড সৃষ্টি করলো সেনাবাহিনীর চলাচল প্রতিহত করার জন্য। ক্রমে পরিস্থিতি আরো চরমে পৌঁছালো। প্রদেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও গুলিবর্ষণের দুঃসংবাদ এলো। ৩ মার্চ ১৯৭১ ছাত্র গণজামায়েতে বাঙালি জাতিসত্ত¡ার বিকাশ ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তিতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। এই সভাতেই শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক ঘোষণা করা হয় এবং নির্ধারণ করা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত। ৪ মার্চ ১৯৭১ প্রদেশব্যাপী সকল সরকারি, বেসরকারি অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সমস্ত প্রকারের যানবাহন ব্যবস্থাসহ ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানে স্বতঃস্ফুর্ত পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের এমনি দুর্বার গণ-আন্দোলনকে ব্যাহত করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন প্রশাসক এবং গভর্নর হিসেবে পাঠালেন জেনারেল টিক্কা খানকে।

এলো ঐতিহাসিক ৭ মার্চ ১৯৭১। স্মরণাতীতকালের উত্তাল জনতার মিছিলে মিছিলে ভরে গেল ঢাকার রেসকোর্স ময়দান। সবাই অপেক্ষা করছেন বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ শোনার জন্য। লক্ষ জনতার মুহুর্মুহু শ্লোগান এবং করতালির মধ্যে নেতা এক সময় সভা মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। একটা নতুন দিক-নিদের্শনার অপেক্ষায় লক্ষ জনতার নিবিষ্ট দৃষ্টি তখন শেখ মুজিবের প্রতি। মুজিব তার ভাষণে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আলোচনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে লক্ষ জনতার উদ্দেশ্যে ঘোষণা করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয়বাংলা।'

৯ মার্চ ১৯৭১। ঢাকায় পল্টনের জনসভায় বয়োবৃদ্ধ জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী মুজিব নির্দেশিত দাবী-দাওয়া ২৫ মার্চ ১৯৭১ এর মধ্যে না মানা হলে চূড়ান্ত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের লক্ষে সংগ্রাম সূচনার আহবান জানিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় সরকার গঠনের দাবি তুললেন।

১৬ মার্চ ১৯৭১। মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক বসলো। একই সাথে চললো সাড়ে সাত কোটি বাঙালির দুর্বার গণদাবির মিছিল। গণউত্তেজনা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকলো প্রদেশের সর্বত্র। একই সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকলো প্রতিরোধ আন্দোলনও।

এমন অস্থির এবং অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে আমাকে নিয়ে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেলেন আব্বা। কি করবেন এ অবস্থার দ্বিধা-দ্বন্দে¡ পড়ে গেলেন সিদ্ধান্ত নিতে। জরুরি সার্ভিসের আওতায় এই মুহুর্তে তাঁর কর্মস্থল রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা থেকে ছুটি যে পাবেন সেও অসম্ভব।

১৮ মার্চ ১৯৭১। সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়ে ফেললেন আব্বা। দীর্ঘ চাকরি জীবনের মায়া ত্যাগ করে রওয়ানা হলেন বাড়ির পথে আমাকে সঙ্গে নিয়ে।

যোগাযোগের বেহাল অবস্থায় কখনো পায়ে হেঁটে, কখনো স্টীমারে চরে বাহাদুরাবাদ-ফুলছড়ি ঘাট হয়ে ২০ মার্চ ১৯৭১ এসে পৌঁছলাম গ্রামের বাড়িতে।

গণহত্যা

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশেষ করে ঢাকায় দেখে আসা গণউত্তেজনার কথা ভেবে গ্রামের বাড়িতে এসেও স্বস্থি পাচ্ছিলাম না কোন রকম। সারাক্ষণই প্রায় রেডিও সেট আগলে বসে থাকি সর্বশেষ পরিস্থিতির সংবাদ জানার জন্য। ঐতিহ্যগতভাবে রাজনীতির সঙ্গে আমার পরিবারের সম্পৃক্ততা থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে কখনোই কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নই আমি। তবুও গ্রামের পথে চলতে মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে একটি বিষয় স্পষ্ট হলো আমার কাছে রাজনীতি নিয়ে কখনো মাথা ঘামাতো না যে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ তারাও কেমন যেন ভীত-সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর কিছু একটা ঘটার আশংকায়। হাট-বাজারে, পথে-ঘাটে আলোচনার বিষয় একটিই কি ঘটবে শেষ পর্যন্ত। অদৃশ্য আতঙ্ক ছায়ার মত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে সমগ্র বাঙালি জাতিকে।

২৬ মার্চ ১৯৭১। সকালের খবরে প্রচারিত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেপ্তারের সংবাদ। ভেঙ্গে পড়লাম কান্নায় উপস্থিত সবাই। আবেগ আগ্লুত হয়ে বড় আব্বা প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘একটি বাঙালিকেও ওরা (পাঞ্জাবী) বাঁচাতে দেবে না আর।'

মুহুর্তের মধ্যে নেমে এলো মৃত্যু শীতল স্তব্ধতা গোটা গ্রামের প্রতিটি ঘরে ঘরে। ঢাকার প্রকৃত অবস্থা তখনও অজানা আমাদের। কি ঘটছে ঢাকায় জানার জন্য আব্বা কলকাতা কেন্দ্র টিউন করতেই ভেসে এলো সংবাদ পাঠকের কণ্ঠে, ‘গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে পূর্ব পাকিস্তানে'।

প্রচণ্ড হতাশা আর অস্থীরতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আব্বা। শুষ্কো মুখে হা হুতাস করতে লাগলেন রেডিও'তে তার সহকর্মীদের নিরাপত্তা চিন্তায়। কারণ শেখ মুজিবের ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ঐতিহাসিক ভাষণ ঢাকার রেসকোর্স ময়দান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের সব বেতারে একই সঙ্গে সম্প্রচারের ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও স্বৈরাচারী সামরিক সরকারের আকস্মিক সিদ্ধান্তে সেদিন তা সম্প্রচারিত হয় নি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সর্বস্তরের কর্মচারীর বেতার কেন্দ্র বয়কটের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারকে। ৮ মার্চ ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ ১৯৭১ এর রেকর্ডকৃত পুরো ভাষণই ঢাকা বেতার থেকে প্রচারিত হয়েছিল।

এসব কথা ভেবে ক্লান্ত স্বরে আব্বা বললেন, ‘ওরা নিশ্চয়ই কেউ রেহাই পায় নি।'

২৭ মার্চ ১৯৭১। রাত দশটা প্রায়। আকাশবানীর সংবাদের সূত্র ধরে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ঢাকায় প্রকৃতপক্ষে কি ঘটছে তা জানার ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, কলকাতা কেন্দ্র ধরতে পর্যায়ক্রমে রেডিওর নব ঘুরাচ্ছিলেন আব্বা। আমরাও বসে রয়েছি রেডিও সেট ঘিরে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা নিয়ে। হঠাৎ নব থামিয়ে দিলেন আব্বা। যান্ত্রিক গোলযোগের মধ্যে শোনা গেল একটি অস্পষ্ট কণ্ঠ, ‘বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র।' উল্লসিত শ্রোতা সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম রেডিও সেটের ওপর। কিন্তু শোনা গেল না আর কিছু। ‘নব' সরে গেছে এই ভেবে আব্বা রেগে উঠলেন চিৎকার করে। পরক্ষণেই যান্ত্রিক গোলযোগের মধ্যে শোনা গেল আবার মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘোষণা পাঠ।

বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেই জানতে পারলাম প্রথম ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবর। পিলখানায় ই.পি.আর. ক্যাম্প, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা সবই হামলার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র, যুবক, বাঙালি ই.পি.আর, পুলিশ আর শ্রমজীবি মানুষের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। স্তূপীকৃত লাশে ভরে উঠেছে ঢাকার রাজপথ। অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জ্বিত পাকিস্তানী বাহিনী যা পাচ্ছে সামনে তাই মিশিয়ে দিচ্ছে মাটির সঙ্গে।

হত্যাকাণ্ড শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকলো না, বাংলাদেশের ছোট-বড় সব শহরে ছড়িয়ে পড়লো তা অল্প কিছু দিনের মধ্যে।

হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ বাঁচার তাগিদে ছুটতে লাগলো নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে।

আক্রান্ত দেশ আর বিপন্ন মানুষের করুন পরিণতি দেখে উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলো তারুন্য। হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর অত্যাচার কুড়িগ্রাম শহর পর্যন্ত বিস্তৃত হলো। আগুনের লেলিহান শিখা আর মৃত প্রায় মানুষের চিৎকার ভোগডাংগা পর্যন্ত ভেসে আসতে লাগলো।

১ এপ্রিল ১৯৭১ হুলুস্থূল পড়ে গেল ভোগডাংগায়। ধরলা নদী পার হয়ে আর্মি আসছে শুনে ধান, চাল, ডাল যে যা পারছে সঙ্গে নিয়ে ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ভিতরের গ্রামগুলোর দিকে। জীবন বাঁচানোর তাগিদে বাধ্য হলাম আমরাও পালিয়ে যেতে। সে এক অমানবিক অভিজ্ঞতা যা বর্ণনা করার মত নয়। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে কোনদিন যে নানীকে এক সের ওজনের ভারি জিনিস বহন করতে দেখিনি সেই নানীকে দেখছি লোহার ঢাউস একটা ট্রাংক মাথায় চাপিয়ে ছুটে চলছেন ক্ষেত-খামার মাড়িয়ে আশ্রয়ের খোঁজে। ছুটছেন যতটা প্রাণপনে-পড়ে যাচ্ছেন ততটা সজেরো উষ্টা খেয়ে খড়ার ক্ষেতে মাটির শুকনো ঢেলায় বারি লেগে। চোখ ফেটে পানি এসে যাচ্ছে তাঁর এই করুন অবস্থা দেখে। কিন্তু পারছিনা করতে কিছুই বাক্স-প্যাটরা মাথায় চাপানো তখন আমারও। ছুটছে মানুষের কাফেলা পিঁপড়ার সারির মত হাওড়-জঙ্গল ভেঙ্গে ঊর্ধ্বশ্বাসে।

 

(চলবে)


মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ১
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ২
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৩
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৫
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : শেষ পর্ব

 

কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top