সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ১৯শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৪ঠা আশ্বিন ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুর ছবি তোলা এবং আমি: আলোকচিত্রী লুৎফর রহমান


প্রকাশিত:
১৪ মে ২০১৯ ১৬:৪৯

আপডেট:
৪ মে ২০২০ ২১:২৫

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

 

বাঙালির জাতির একটি চূড়ান্ত  সন্ধিক্ষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঠিক ও বলিষ্ঠ নেতৃত্ব,  তার ৭ই মার্চের ভাষণে উদ্ধৃদ্ধ বাঙালি বারুদমাখা গন্ধ গায়ে শক্রমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরেছে। বিশ্ব দরবারে বাঙালির এক সাগর রক্তের পাড়ি দেওয়া লাল সবুজের পতাকা উড়ছে। ১০ জানুয়ারি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান থেকে কারামুক্ত হয়ে দেশে ফিরে এলেন। 

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনগঠনে সবাইকে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানালেন। গণতন্ত্রের সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখমুজিব জনমত যাচাইয়ে ১৯৭৩ সালে সাধারণ নির্বাচন দিলেন। সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির একটি বুথে নিজের ভোট দেবেন। এ ছবি তোলার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠলাম। কিন্তু  সবাই আমাকে নিষেধ করতে লাগল। কারণ তখন আর আমি চোখে দেখি না। দু‘চোখেই ছানি পড়ে  গেছে। একটা চোখে অল্প দেখতে পাই। তাও ঝাপসা। তাই কারও বাধা না শুনে আমার পরিচিত একজনের হাত ধরে চলে যাই ধানমন্ডির নির্ধারিত ওই ভোটবুথে। শত শত দেশি বিদেশি ক্যামেরাম্যান প্রস্তুত। বঙ্গবন্ধু ব্যালট বাক্সে ভোট দেবেন সেই ছবি তোলার জন্যে সবাই উম্মুখ। ভোট কেন্দ্রে আসার সাথে সাথে ফ্লাশের ঝলকানি আর ধাক্কাধাক্কি শুরু হলো।  আমিও আমার জায়গা হারিয়ে ফেললাম। ক্যামেরা থেকে পড়ে গেল লেন্স। তাই বঙ্গবন্ধুর বিপরীত দিক থেকে তার ছবি তোলার সিদ্ধান্ত নিলাম এবং বঙ্গবন্ধুর ভোট দেওয়ার ছবিও তুললাম। ছবিটা এতই ভালো হলো যে, পত্র পত্রিকা এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ওই ছবিটা ছাপে। 

প্রায় দেড়মাস পর এক ক্যামেরাম্যান আমার ক্যামেরার লেন্সটি ফেরত দিয়ে বলল ভোটের দিন আপনার এ লেন্সটি কেন্দ্রে কুড়িয়ে পেয়েছি। কিন্ত সেই লেন্স দিয়ে কী করব? চোখে তো দেখি না। তাই ছবিও তোলা হয় না।  আমার অফিস তখন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। চোখে না দেখার কারণে কোনো কাজ করতে পারি না। মাসের শেষে গেয়ে শুধু বেতন নিয়ে আসি। একবার বেতন তুলতে গিয়ে শুনি, আমার ফিটনেস সার্টিফিকেট লাগবে। তা না হলে আর বেতন তোলা যাবে না। মাথার উপর যেন বাজ পড়ল।

এখন কী হবে মনে মনে তা ভাবছি। পিন পতন শব্দ নেই।  নীরবতা ভেঙে তিনিই বললেন, আপনি কাল সিভিল সার্জেন্টের অফিসে যাবেন। আমার কথা বলবেন। তিনিই আপনার ফিটনেস সার্টিফিকেট দিয়ে দিবেন। কিছুটা আস্বস্থ হয়ে ফিরে এলাম। পরদিন যথারীতি সিভিল সার্জেন্ট অফিসে গেলাম কিন্তু কোন কাজ হলো না।  বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আমাকে ধমকের সুরে বললেন আপনাকে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া যাবে না।  কারণ আপনি দেখেও দেখেন না। ত্যক্তবিরক্ত হয়ে ফিরে গেলাম যিনি আমাকে পাঠিয়েছিলেন তার কাছে। সব শুনে তিনি বললেন ঠিক আছে। আপনি কাল অথবা পরশু আবার তার সাথে দেখা করবেন। বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে তাকে বলিয়ে দেবসে মতো আবার গেলাম সিভিলসার্জেন্ট অফিসে।সিভিলসার্জেন্ট এবার আমাকে  অভ্যর্থনা   জানালেন।  হাসিমুখে বললেন আপনাকে  ফেরানো যাবেনা। ফিটনেস সার্টিফিকেট তো দিলেনই সাথে ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালের ডা. ওয়াদুদকে আমার চোখ অপারেশন করার জন্যে একটি অনুরোধ পত্রও লিখে দিলেন। বুঝলাম সঠিক রোগের সঠিক ওষুধ পড়েছে। তিনি এ কথাও বললেন,যত দ্রুত সম্ভব চোখ অপারেশন করিয়ে নেবেন। সেই থেকে আবারও আলোকিত এই পৃথিবী দেখছি। সবাইকে চিনছি।

রেডিও পাকিস্তানে মুখপাত্র ছিল এলান। তার দায়িত্বে ছিলেন ফজল-এ- খোদা ১৯৭১ এর  অসহযোগের সময় একদিন তিনি আমায় বললেন,লুৎফর,পত্রিকা ও রেডিওর নাম পাল্টাতে হবে। আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কী রকম? উত্তরে তিনি  জানালেন পত্রিকার নাম হবে বেতার বাংলা, আর রেডিওর নাম পাল্টাতে হবে  বাংলাদেশ বেতার।  সম্মতিদিলাম। পরদিন  দুজন ছুটলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে ছাত্রনেতাদের প্রস্তাবটা দিলাম। সেখানে শেখ কামালও  ছিল। পরদিন তারা জানালেন ঠিক আছে। নাম বদলে ফেলুন। বঙ্গবন্ধু অনুমতি দিয়েছেন। বলেছেন সবকিছু বাংলা করে ফেল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন প্রধানমন্ত্রী। ভারতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সাথে প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী হেমন্ত মুখোপদ্যায় এদেশে  এসেছেন। ঢাকা বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক মুক্তিযোদ্ধা কামাল লোহানী।

ঢাকা বেতারে গান করার জন্য তিনি  কামাল লোহানীর  ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছেন আর আপ্যায়িত হচ্ছেন।  আমি তাদের ছবি তুলছি। হঠাৎ করেই হেমন্ত বাবু বঙ্গবন্ধুর সাথে সাক্ষ্যাতের উচ্ছে ব্যক্ত করলেন। জানালেন তিনি জাতির পিতাকে শ্রদ্ধা জানাতে চান। বঙ্গবন্ধু বাসভবনে যোগাযোগ করা হলো। যথারীতি বঙ্গবন্ধু সময়ও দিলেন। আমরা সকলে মিলে ছুটলাম  তার বাসভবনের দিকে। সেখানে পৌছানোর পর বঙ্গবন্ধ শেখমুজিব যখন আমাদের সামনে এলেন, তখন শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তাকে প্রণাম  করতে উদ্যত হলে  বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

বলে ওঠো,একি করছেন হেমন্ত বাবু। যার গান শোনার জন্য দেশিবিদেশি মানুষ উম্মুখ, সেই আপনি কিনা আমার মতো সাধারণ মানুষকে প্রণাম করে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? হেমন্তবাবু  আত্ম-প্রত্যয়ে উত্তর দিলেন, আমি বাঙালি জাতির জনককে প্রণাম করে ধন্য হলাম। ১৯৭৩-৭৪ সালের দিকের কথা। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ফটোগ্রাফী কম্পিটিশনে ছবি যাচ্ছে।  আমি সেখানে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দুটো ছবি পাঠালাম। সবাইকে  অবাক এবং আমাকে  বিষ্মিত করে ঐ কম্পিটিশনে আমার ছবি প্রথম ও দ্বিতীয় হলো। আমার জীবনে অভাবনীয় পাওয়া।  জীবনের কাজে স্বকৃতি পাওয়া কার না ভালো লাগে? ষাটের দশকেফটোগ্রাফিতে অবদান রাখার জন্য বিভিন্ন পর্যায়ে ১২টি সার্টিফিকেট ও পদক পেয়েছি।

স্বাধীন বাংলাদেশে টেনাশিস পুরস্কারও আমার কপালে জুটেছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য ভারত সরকারে কাছ থেকেও দুটি প্রশংসা পত্র পেয়েছি। তবে জীবনের সবচেয়ে  বড় পাওয়া আমার তোলা  বঙ্গবন্ধুর ছবি৫,১০,ও ১০০ টাকার নোটে মুদ্রিত হওয়া। বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত নতুন নোট মুদ্রণের জন্যে বঙ্গবন্ধুর ছবি চাওয়া হলো ফট্রোগ্রাফারদের কাছ থেকে। আমি বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর যে ছবি তুলেছি তার মধ্য থেকে একটি ছবি বাছাই করে জমা দেই। কিন্ত কি আশ্চর্য।  ফলাফল বের হলে দেখা গেল আমার ছবিই নির্বাচিত হয়েছে।  নির্বাচনের পর এক বিদেশী বিশেষজ্ঞ জানতে চাইলেন ঐ ছবির কপি আর কাউকে দিয়েছি কি না? আমি তাকে জানালাম,বঙ্গবন্ধু তিন ভক্তকে ঐ ছবির তিনকপি দিয়েছি। তিনি ঐ ছবিগুলো ওদের কাছ থেকে ফেরত নেয়ার জন্যে তাৎক্ষণিকভাবে  বললেন এবং তিনজন পুলিশসহ আমাকে একটি জীপে তুলে দেয়া হলো। আমার কাছ থেকে নেগিটিভও নিয়ে নেয়া হলো। আমি পুলিশসহ ঐ তিন ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে ছবিগুলো ফেরৎ নিয়ে এলাম। তারপর অপেক্ষার পালা। কবে আসে  বঙ্গবন্ধুর ছবি সম্বলিত কাগজি নোট। এক সময় অপেক্ষার পালা শেষ হলো। বাজারে এলো ৫ ও ১০ টাকার নতুন নোট। তাতে আমার তোলা বঙ্গবন্ধুর মুদ্রিত ছবি দেখে সত্যিই অভিভূত হলাম। টাকা মুদ্রণকারী বিদেশি সংস্থা আমাকে পুরস্কৃত করলো হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ। সেখানে আমাকে দেয়া হলো একটি দামি ক্যামেরা আর প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিুৃর রহমানের পক্ষথেকে তার প্রেস সেক্রেটারী আমিনুল হক বাদশা সচিবালয় ডেকে আমাকে হাতে তুলে দিলে নগদ তিন হাজার  টাকা। বজ্র দৃপ্ত কন্ঠের ঘোষণাঃ এবারের সংগ্রাম, আমারদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম এবং যার যা আছে তা নিয়েই শক্রর মোকাবিলা করবে। এ মন্ত্রে উজ্জীবিত  জাতি ভুল কেরেনি। বস্তুত  এখান থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাঙালি জাতি গঠনের নতুন অধ্যায়। নতুন কর্মসূচি,নতুন ইতিহাস।

     এই প্রথম পরিচয়, প্রথম আলাপচারিতা জাতির  কিংবদন্তী নেতার সাথে। এ ঘটনার পর থেকে বঙ্গবন্ধুুর প্রয়াণের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের সাথে ফটোসাংবাদিক লুৎফর রহমানের ঘনিষ্ঠতা অক্ষুন্ন ছিল।



ব্যক্তিগত জীবনে হাসিখুশী সদালাপী লুৎফর রহমান ১ পুত্র এবং তিন কন্যা সন্তানের জনক ছিলেন। তার পুত্র মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু দেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্রী  হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এক কন্যা অস্ট্রেয়িাতে আছেন। বাকী দু জনকে প্রতিষ্ঠিত ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। প্রখ্যাত এই আলোকচিত্রী ২০০৬ সালে মারা যান। 

লুৎফর রহমান লেখক বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ক্যামেরা ম্যানদের মধ্যে একজন ছিলেন। বর্তমানে তিনি মরহুম। তাঁর সন্তান ফটোগ্রাফার মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টুর সৌজন্য লেখাটি প্রাপ্ত।



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top