মোহর আলী : অমিতা মজুমদার
প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২০ ২১:৫০
আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৮

ছানিপড়া চোখে কুঁজো হয়ে হাঁটতে হাঁটতে রোজ সুর্য ওঠার আগে আবার সুর্য ডোবার আগে বড়খালের মুখে এসে বসবে মোহর মাঝি। শীত গ্রীস্ম বর্ষা কোন কালেই তার এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনা। ঘরে ছেলের বৌ নাতি অনেক বলেছে ,কিন্তু মোহর কারও কথা শোনেনা। শীতে যখন যায় ঠান্ডা লাগে আবার শ্লেস্মার সমস্যাও আছে সব হ্যাপা ছেলের বৌ জরিনাকেই সামাল দিতে হয়। ছেলে আকবর তো টাউনে অটো চালায়। সপ্তাহে একদিন আসে । মেহমানের মতো থেকে চলে যায়। নাতি রুবেল আবার স্কুলে যায়। ক্লাস ওয়ানে পড়ে, বাড়ির কাছেই মাদ্রাসা স্কুল। সেই নাতি জানতে চায় দাদাজান এই হুগনা খালের মাতায় বইয়া থাহে ক্যা?
মোহর আলি মনে মনে ভাবে, রুবেল কি করে জানবে সেকথা! এই খাল কি এইরহম হুগনা খটখটা আছিলো। হগলডি কইতো সুগন্দা নদী খান দুইবাগ অইয়া দক্ষিনে গেছে ধানসিঁড়ি, উত্তরে গেছে ধানসিদ্ধ, আর পশ্চিমে গেছে গাবখান ধানসিঁড়ি নামে। তয় মোহর মাঝি অতকিছু জানেনা। হের টাবুরে নাও লইয়া উত্তর দক্ষিন পশ্চিম পুব হগল দিকেই যাইতো। দক্ষিনে মোল্লাবাড়ির ঘাট ছাড়াইয়া এট্টু আউগাইলেই ছত্তরকান্দার ঠোডা। এই ঠোডাই অইলো বড় খালের মুখ। মোহর আলীর নৌকা ছত্তরকান্দার ঘাটে বাঁধা থাকে। যখন যেদিকে কেরায়া পেত সেদিকেই চলে যেত। তখন মোহর মাঝির একটা দিন বসার ফুরসত ছিলনা। আজ এবাড়ির মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি থেকে আনতে হবে,তো কাল ওবাড়ির নতুন বৌকে নাইওর নিয়া যেতে হবে তার বাপের বাড়ি। গৃহস্থবাড়ির গিন্নী মায়েরা তাকে খুব ভরসা করতেন। নদীর স্রোতের গতি বুঝে সময় ঠিক করে নিত মোহর মাঝি। বলে যেত মাঠাকুরন,কর্তামা,গিন্নীমা,বা খালাম্মা যাইহোক না কেন রাইত এক পশর থাকতেই কইলোম রওয়ানা দেতে অবে। নাইলে বাডি লাগলে কোইলোম হাটা লাগবে হগলডির কইয়া গেলাম। সূর্য ওঠার আগে মোহর মাঝি বাড়ির উঠানে এসে হাঁক পাড়তো,কইগো মা-জননীরা তোমরা যোগাড় অইয়া তরাতরি নায় ওডো। গিন্নীমা বোজাবিড়া কিছু দেবেন নাকি লইয়া যাই। গিন্নীমা মাইয়ার বাড়ি দেওয়ার লইগগা জোড়া-নারিকেল, মুড়ির টিন,খইয়ের টিন দিয়া দিত। আবার পথে খাওয়ার জন্য আলাদা করে মোহরের গামছায় বেঁধে দিত। সব বাড়ি থেকে যে একইরকম ব্যাবহার পেত তা নয়। বাপের বাড়ি থেকে মেয়ে শ্বশুরবাড়ি গেলে যেমন মন খারাপ থাকতো,আবার শ্বশুরঘর থেকে বাপের ঘরে আসার সময় মেয়ের মন খুশীতে ডগোমগো থাকতো।ছোট ছোট পোলাপান লইয়া নায় ওডলে বেশি সতর্ক অইয়া নাও বাইতে অইতো। পোলাপানে তো বোজেনা নাও বাওয়া অতো সহজ কামনা। মাঝ গাঙে আল্লা রসুলের নাম লইয়া নাও বাইতে অয়। নায়ের চরনদারের জীবন থাহে মাজির আতে।এট্টু ঊনিশ বিশ অওয়ার জো নাই। পোলাপান এই কবে পেচ্ছাপ করমু। হেরে নায়ের ডালিতে বওয়াইয়া করাইতে না করাইতে আর একজন আইয়া খাড়া অইয়া গাঙের পানি বাড়াইয়া দেয়। এর লগে লাফালাফি, খাওয়ার বায়না তো আছেই। তয় গোনের সময় ভরা খালে নাও বাইয়া সুখ। খালি বৈডাখান দইরগা রাহো ঠিকমতো, নাও আউগাইয়া যাবে পঙ্খীরাজ ঘোড়ার নাহান। তহন মনের সুখে গান ধরা যায়। মাঝি বাইয়া যাওরে --অকুল দরিয়ার মাঝে আমার ভাঙা নাও----। শেষবেলায় যহন পৌছাইতো তখন বাড়ির ভেতর থেকে সিদা দিতো। সিদাও যে সব বাড়ির সমান অইতো তেমন না। কোন বাড়ি একখান এনামেল (এলুমিনিয়াম) বা কউরগা ( একরকম সাদা থালা ) থালে দুগগা চাউল,পাশে কলাপাতায় ডাল,হলুদ,মরিচ,লবন, আর এট্টু তেল দিত মাঝির বোতলে। কিন্তু কোন কোন বাড়ির গিন্নী মায়েরা বিশেষ করে বড় বাড়ির ক্ষেপ লইয়া যে সকল জায়গায় যাইত সে সকল বাড়ির সিদাই ছিল আলাদা। চাল ,ডাল,লবন মরিচ তো ছিলই,সাথে আলু,বেগুন,কলা,দুইচার টুকরা মাছ দেতই। সিদা লইয়া নৌকায় আইয়া চুলায় রান্ধন চড়াইয়া দিতাম। রান্ধন অইলে মাতায় এট্টু কউরগার (সরিষা) তেল দিয়া খালে এউক্কা ডুব দিয়া লইতাম। হেরপরে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত খেয়ে এট্টু ঘুম দিতাম। ঘুম থেইকা উঠে ফেরার জন্য নৌকা ছাড়ার আয়োজন করতাম। অবশ্য এই ফেরার আয়োজন নির্ভর করতো নদীর উপর। যারে আমাগো মাঝিগো ভাষায় কয় গোন আর উজান।
দেশ স্বাধীনের পর সব যেমন বদলাইতে আছিলো তার লগে যেন নদীনালা খাল-বিল ও বদলাইতে লাগলো। পেরথমে খাল কাডা অইলো,তারপরে হেই খালে স্লুইস না কি যেন নাম গেইট করা অইলো। জলেরেও মানুষ বান্দা শুরু করলো। হেয়ারপরে মাঝির হাতে বৈঠাটানা নাওয়ের বদলে কলের নাও আইলো
ধীরেধীরে মানুষ কম সময়ে যাতায়াতের জন্য কলের নৌকায় যাতায়াত শুরু করলো। তখন মোহরের বড়ছেলে মতিউর বলেছিল বাবা অন্য মাঝিরা তিন-চার জনে মিলে কলের নৌকা বানাচ্ছে,আমরাও ওদের সাথে সামিল হই। কিন্তু মোহর রাজী হয়নি। তার ইজ্জতে লেগেছিল। তার মতো মাঝি এ তল্লাটে আর কেউ আছে নাকি? সব গৃহস্থ বাড়িতে তার ডাক পড়ে। সে কিনা যাবে ঐ ভাগের কলের নৌকা চালাতে। কিন্তু খাল-বিল এমনভাবে শুকিয়ে যেতে শুরু করলো যে টাবুরে মাঝির নৌকা আর চালানোই গেলনা। একসময় গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে বৌরাও হেটে বড়খাল অব্দি গিয়ে কলের নৌকায় চড়ে নদী পার হওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
মোহর আলীর আদরের নৌকাখানা জলের অভাবে,রোদে পুড়ে একসময় জ্বালানী কাঠেরও অযোগ্য হয়ে গেল।
তারপর সব কেমন চোখের পলকে বদলে গেল। কলের নৌকাও চলা বন্ধ হয়ে গেল। খাল-বিলের উপর কেমন সেতু তৈরি হয়ে গেল,মাটির রাস্তা সব পাকা হয়ে গেল। তার উপর দিয়ে ফটর ফটর আওয়াজ তুলে নানা রকমের গাড়ি যাওয়া আসা শুরু করল। সাধের ধানসিঁড়ি নদীখানা কেমন মরে গেলো। পেরথম কয়দিন ফেরি না কি যেন তাতে করে গাড়ি পার হতো। তারপর একদিন শোনা গেলো এই নদীর উপর সেতু হবে। যা মোহর আলী স্বপ্নেও ভাবেনি কোনদিন। এমন উথাল-পাথাল নদী তারে কি বান্ধা যায় ! কিন্তু না সত্যি সত্যি ধানসিঁড়ি নদীতেও সেতু হলো। আর সেই সেতুর উপর দিয়ে কত রকমের নামের গাড়ি যাতায়াত করে, বাস,ট্রাক,ভ্যান,অটো,টেম্পু সবার নামও মোহর জানেনা। তার মতো যারা মাঝি,কিষান কিংবা দিনমজুর ছিল তাদের ছেলে পুলেরা কেউ রিক্সা চালায়,কেউ অটো চালায় আবার কেউ শহরে গিয়া ড্রাইভারি শিখে বড় গাড়ি চালায়।
অগ্রহায়নের শেষেই কেমন শীত পড়ছে। সকালের ঠান্ডায় নদীর পারে এসে বসায় মোহরের শ্বাসের টান কেমন বেড়ে যায়। কাশিটাও যেন থামতে চায়না। হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে ছানিপড়া চোখে আন্দাজ করে হাটতে হাটতে বাড়ির পথ ধরে মোহর আলী। বাড়ি বলতে একখানা ভাঙা ঝুপড়ি। যেখানে দুমুঠো খাওয়া হয়তো জোটে ছেলের বৌয়ের কাছে সাথে মুখ ঝামটাও জোটে প্রচুর। তবে নাতিটা তার বড্ড ভালো। তাকে খুব ভালোবাসে। নাতি তার কাছে নদীর কথা,নায়ের কথা তার দাদির কথা শোনে মন দিয়ে। আর বলে দাদা তুমি দুঃখ করোনা, আমি লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে তোমার এই সকল কথা লিখে জানাব সকলকে।
বিষয়: অমিতা মজুমদার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: