দু'বাংলার উপন্যাসে দেশ-ভাগের ছবিঃ আগামী প্রজন্মের পাঠ : ডঃ সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:০৭

আপডেট:
৩০ ডিসেম্বর ২০২০ ২২:৩৫

ছবিঃ ডঃ সুবীর মণ্ডল

 

সাহিত্য মানুষের বাস্তব জীবনের দর্পণ,কারণ দর্পণে যেমন ফুটে ওঠে প্রতিবিম্ব, তেমনি সাহিত্যের দর্পণে প্রতিফলিত হয় মানব জীবনেরই  প্রতিচ্ছবি। খুব সহজ ভাষায় বললে, উপন্যাস হলো কান্না-হাসির দোল-দোলানী, পৌষ -ফাগুণের পালা। সাধারণত সমাজ ও মানব জীবনের সামগ্রিক দিক প্রতিফলিত হয়  উপন্যাসে। ছোটগল্প অনেক খানি ওয়ান, ডে ক্রিকেটের মতো। এক লহমায় জীবনের খণ্ডচিত্র  তুলে ধরার শিল্পীত রূপ। অন্যদিকে উপন্যাসকে পাঁচ দিনের ক্রিকেট খেলার সঙ্গে আমরা তুলনা করলে, খুব বেশি ভুল হবে না। জীবনের সামগ্রিক দিক তুলে ধরা হয় উপন্যাসে, সেই সঙ্গে সমকালীন সময়কে। সাহিত্য সৃষ্টির সময় পারিপার্শ্বিক জীবন ধারাকে কখন ও ভুলে যাওয়া যায় না। তাই তার জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে সমকালীন সমাজ ব্যবস্থা বা জীবনযাত্রার ছবি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় রূপলাভ করে। সেই জন্যেই বিশেষ বিশেষ সময়ের সাহিত্যে সমকালীন সমাজের বাস্তব চিত্র, একটি বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে  কোন জনপদ, জীবনের বিশ্বাস, সংস্কার, রীতিনীতি, ধ্যানধারনা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, মন্বন্তর,, দুর্ভিক্ষের ভয়াবহতা, অসামাজিক কর্মধারা, যুদ্ধবিগ্রহ-- প্রভৃতি সমস্ত কিছুই সেই যুগের সাহিত্যে বিশ্বস্ততার সাথে চিত্রিত হয়।

 

বাংলা সাহিত্যের উপন্যাসের বর্ণময় ধারাটি লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাই এই বিশিষ্ট সাহিত্য শৈলীটিতে বিশ্বস্তভাবে চিত্রিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ের বাংলার সামাজিক অবস্থা, অর্থনৈতিক সংকট,অশান্ত জীবনধারা, রাজনৈতিক আন্দোলন, দেশভাগ প্রভৃতি।

উনবিংশ শতকে বাংলার সমাজ জীবন আদুরে-বখাটে ছেলে ছিল বলেই প্যারিচাঁদের 'আলালের ঘরে দুলাল' গ্রন্থে মতিলালের চরিত্রটি গড়ে উঠেছে। 'বিষবৃক্ষ' 'কৃষ্ণকান্তের উইল'  ' চোখের বালি'  'চরিত্রহীন'  ' দেবদাস'   ----প্রভৃতি উপন্যাস গুলিতে যথাক্রমে কুন্দনন্দিনী, রোহিণী। বিনোদিনী, কিরণময়ী, পার্বতী প্রভৃতি চরিত্রগুলি রূপ পেয়েছে। সমসাময়িক কালে বাংলার সমাজে বিধবা, বাল্যবিধবা, প্রণয়বঞ্চিত নারীদের জীবন কাহিনী অবলম্বনে উপন্যাস গুলো লেখা হয়েছে। পরাধীন ভারতবাসীর স্বাধীনতা স্পৃহা এবং স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকা অবলম্বনে রচিত হয়েছে বঙ্কিমচন্দ্রের 'আনন্দমঠ' রবীন্দ্রনাথের 'ঘরে বাইরে', শরৎচন্দ্রের 'পথের দাবী' প্রভৃতি উপন্যাস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে তীব্র মানসিক সংকট ও সীমাহীন নৈরাজ্যের প্রতিধ্বনি  আমরা শুনতে পেলাম কল্লোল যুগের লেখকদের রচনায়।

এরপর এলো সেই অভিশপ্তময় ক্রান্তিকাল। ভারতবর্ষ   স্বাধীনতা পেল, কিন্তু তা খণ্ডিত। সাধারণ মানুষের কাছে ছিলো অত্যন্ত বেদনার ও মর্মান্তিক দু্ঃখের। স্বাধীনতার  সাথে -সাথেই ভাগ হলো  আমাদের সোনার বাংলা। ফলস্বরূপ  বাংলা ও বাঙালির  জীবনে যে অভিশাপ  হিসাবে নেমে এলো তার একেবারেই। অকল্পনীয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিমবাংলায় দেশ ভাগ হয়ে যাওয়ায় এক বৃহৎ বাঙালি গোষ্ঠী ছিন্নমূল হয়ে এপার বাংলায় চলে এলো। তাদের জীবন যন্ত্রণার কথা রূপায়িত হলো সমসাময়িক কালের উপন্যাস গুলিতে। আধুনিক কালের সমাজ সচেতন শিল্পী, কবি, ঔপন্যাসিকদের রচনায় ছিন্নমূল উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য কঠোর জীবনসংগ্রামের কথা, আপন সুখের নীড় ছেড়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ জীবনের পথে পাড়ি দানে বাধ্য হবার অপরিসীম বেদনার কথা, সাহিত্যে চিরস্থায়ীত্ব লাভ করলো পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের এপার বাংলা ও ওপার বাংলার ঔপন্যাসিকদের রচনায়।

পূর্ব-অংশ পূর্ব-পাকিস্হান, পশ্চিম ও খণ্ডিত উত্তরবঙ্গ  থেকে গেলো ভারতের অংশ হিসেবে। এর জন্য না  গাঙ্গেয়  বাঙালি, না পদ্মাতীরের বাঙালি, কেউই তৈরি ছিলনা। একটা অভূতপূর্ব খুনোখুনি, হিংস্রতা, পাশবিকতা, অবিশ্বাস এবং পরিণামে আত্মিক বিপর্যয়, হতাশা নেমে এলো বাঙালির জীবনে ও মানসে। বাঙালির মানসিকতায় এর চেয়ে বড়ো ধাক্কা আর কখনো লাগেনি। এই ঘটনার চরম অভিঘাত পড়ল সমকালীন সাহিত্যে। যেহেতু আশার চেয়ে বেদনা, সুখের চেয়ে যন্ত্রনা বিদীর্ণ মুহূর্তই বেশি, তাই অজস্র উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতায় তার  আরক্তিম প্রকাশ ঘটেছিল,  দুই বাংলার সাহিত্যেই। বয়ঃসন্ধিকালে দাঁড়িয়ে বিমূঢ় কবি সুস্থতারই  স্বপ্ন দেখেছেনঃ

 

জুলাই!  জুলাই! আবার আসুক ফিরে

আজকের কলকাতার এ প্রার্থনা;

দিকে দিকে শুধু মিছিলের কোলাহল--

এখনো পায়ের শব্দ যাচ্ছে শোনা।

অক্টোবরকে জুলাই হতেই হবে

আবার সবাই দাঁড়াব সবার পাশে,

আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর মাস 

এবারের মতো মুছে যাক ইতিহাসে। (সেপ্টেম্বর ১৯৪৬)

অসীম রায়ের  'দেশদ্রোহী' ও কৃষ্ণচক্রবর্তীর ' 'সীমান্ত পেরিয়ে', এই দুটি উপন্যাসে পূর্ববঙ্গের বাস্তুচ্যুত হিন্দু পরিবারের কথাই প্রধান। গ্রামের মাটির সোঁদা গন্ধ, নদীর প্রান্তর, পাখির ডাক--  হারানোর বেদনাই বড়। পশ্চিমবঙ্গের আশ্রয়, জীবনের নিরাপত্তা তাদের সুখী করতে পারেনি। আসলে শেকড় হাড়িয়ে transplantation  হয়না। চরম অরাজকতার একটা নিখুঁত পর্যবেক্ষণ প্রসূত  বর্ণনা।  সীমানার কাঁটাতারের বেড়া মানতে মন চায়না। 'সীমান্ত পেরিয়ে'- র পটভূমিও এক; কিন্তু উপন্যাসের কাহিনি নস্টালজিয়ার সীমান্ত পেরিয়ে গেছে। উপন্যাসে  শুরু হয়েছ   উদ্বাস্তু-বোঝাই  ট্রেন  দিয়ে। চিরকালের মতো জন্মভূমি ছেড়ে আসা অসংখ্য মানুষের ভিড়ে  ট্রেনের কামরা গুদামের মতো ভর্তি। কারোর মুখে কথা নেই, হাসি নেই, গল্প নেই। সব যেন অপরাধি কয়েদী। একটা নির্মমতা, অসহায়তা এবং নৈরাজ্যের ছবি এঁকেছেন লেখক। স্বাধীনতার এই স্বাদ কেউ পেতে চায়নি। লেখকের ভাষায় -  ' কত  পুরুষ ধরে জড়ানো সংসার, বৃদ্ধের চোখে জল ঝরেছে, জোয়ানেরা পিতৃ পিতামহের রেখে যাওয়া ঘরকন্নার মালিকানা ছেড়ে আসতে এক মুহুর্তে থমকে দাড়িয়েছে, শেষে  রওনা দিয়েছে।' 

সলিল সেনের 'নতুন ইহুদী'  এবং নিমাই ঘোষের ' ছিন্নমূল'  মূলত উদ্বাস্তুসমস্যাকে  নিয়ে চলচ্চিত্র। আসলে এই চিত্রনাট্য উপন্যাসের সংকরশিল্প। তবে শক্তিপদ রাজগুরুর ' মেঘে ঢাকা তারা'  ও নারায়নণ সান্যালের 'বকুলতলা পি, এল ক্যাম্প'  ভাঙা বাংলার মানুষের ভাঙা-চোরা মনের এবং জীবন সংগ্রামের সার্থক রূপায়ণ।  চরিত্র-চিত্রণে শক্তিপদরাজগুরু,  নারায়ণ সান্যালের তুলনায় বেদনাবিধুর এবং গভীরতাশ্রয়ী। সমরেশ বসুর 'সুচাঁদের 'স্বদেশযাত্রা' দেশ-ভাগের মানসিক ক্ষতের ছবি তুলে ধরেছে। মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের  'শান্তিলতা' এবং' সোনার চেয়ে দামী'  এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। চন্দ্রনাথ চক্রবর্তী পূর্ববঙ্গের একজন বিশিষ্ট ও প্রতিষ্ঠিত শিক্ষক। অতি সাধারণ ও সরল জীবন যাপনে তিনি সেখানে  স্বস্হানে  সম্মানিত। তাঁরই  মেয়ে শান্তিলতা। কী যে হলো!  দেশভাগের পর আস্তে হলো কলকাতার এক শহরতলীতে।জঘণ্য নোংরা পরিবেশ। মন  বিদ্রোহ করে। একটুকরো আশ্রয় আর কিছুই নয়। সব বিপর্যস্ত। বিশ্বাসের ভিত্তিমূল পর্যন্ত বিচলিত। সুখেন্দুও মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের ছেলে। দেশভাগের ফলে পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু। মধ্যবিত্তের যেসব জীবিকা-তারই একটা জুটে যাবে দেশে। এ-স্বপ্ন  তারও ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার স্বাদ পেতে গিয়ে সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার। কোন কাজ জোটাতে না পেরে সে হয়েছে একটি ছোট কারখানাল মজুর। দেশভাগের পরোক্ষ ও স্থায়ী প্রভাবের উপাদানে চরিত্রগুলির নির্মাণ। মনের সঙ্গে গভীর টানাপোড়েন। মধ্যবিত্তরা  সহজেই শ্রমিকের বৃত্তি গ্রহণ করতো চায় না। সুখেন্দু পরিবেশের সঙ্গে লড়তে  লড়তে খাপ খাইয়ে নিয়েছে। হয়েছে লড়াকু শ্রমিক নেতা। বদলেছে শান্তিলতাও  বড় একটা ভাঙনের পথে আবার গঠনপর্বের শুভ সূচনা। শান্তিলতা মন থেকে শুরুতে সুখেন্দু কে না চাইলেও পরে তাকে গ্রহণ করেছে। পারলেন না চন্দ্রনাথ। আদর্শের পাহাড়চূড়া থেকে পড়লেন খাদে।। ভেঙে পড়লেন। নতুন করে শুরুর আর বয়স নেই।হারিয়েছে  মনও। কালের চাকায় তিনি গুড়িয়ে গেলেন। আদর্শবাদী শিক্ষক  মদের আড়ালে মৃত্যুকে ডেকে আনলেন। 'শান্তিলতা'-র ভাষা শৈলীও  সময়ের অস্থিরতার সাক্ষ্যবহ। ছোট ছোট, সংহত বাক্য। কোন মোহবিস্তারী বর্ণনা  নেই। নেই কোন তাত্ত্বিক প্রচার। নতুন সমাজ বাস্তবতার চেহারা ফুটে উঠেছে। বঙ্কিমচন্দ্র- রবীন্দ্রনাথ- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দেখা জগৎ থেকে সুখেন্দু-শান্তিলতার জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রবোধ সান্যালের'  হাসুবানু' ১৯৫২ সালে লেখা। উৎসর্গপত্রে আছে -'প্রাতঃস্মরণীয় দেশকর্মী'

ও সমাজসেবক স্বগত জনাব লিয়াকত হোসেন ও অগ্রজপ্রতিম শ্রদ্ধেয় বন্ধু  জনাব সোফিয়ার রহমানের পূর্ণস্মৃতির উদ্দেশ্যে। 'ওপার বাংলার ঔপন্যাসিকদের মধ্যে সেলিনা হোসেন তাঁর উপন্যাস 

'যাপিত জীবন'  উৎসর্গপত্রে লিখেছেন----'ডাক্তার চণ্ডীপদ চক্রবর্তী শ্রদ্ধাস্পদেষু। 'হাসুবানুর'  ঘটনাধারা একেবারে সমকালীন। দেশভাগের পরে দুই বাংলার মানসিক পটভূমিকা অবলম্বনে নির্মিত উপন্যাস। উপন্যাসে শ্রেষ্ঠ অংশ হচ্ছে পূর্ব বাংলার মাঠঘাট, নদীর অপূর্ব বর্ণনা। ভিন্ন ঋতুতে তার ভিন্ন চেহারা। এই উপন্যাসের নায়ক হিরণ। সে স্বভাবে কবি, তাই তার চোখ দিয়ে দেখা নিসর্গের ছবি সত্যই  রৌদ্রে দীপ্ত, ছায়ায় স্নিগ্ধ এবং হাওয়ায় কখনো উত্তাল। তবুও  'হাসুবানু'  উপন্যাসে দেশ-বিভাগের সর্বনাশা একটা চেহারা উন্মোচিত হয়েছে। একটি অসাধারণ কালজয়ী উপন্যাস সেলিনা হোসেন-এর 'যাপিত জীবন'। এই উপন্যাসের সোহরাব আলি, আনসারা খাতুন, মারুফ, ছায়ার, দীপু,---বহরমপুরের সম্পন্ন  গৃহস্থ। এখানেও সেই আগুনের ভয়। বিপুল সম্পত্তি, সাজানো গোছানো বাগান ফেলে সরকারি কর্মচারী আলি সাহেব অপশন দিয়ে এসেছেন ঢাকায়। উঠেছেন টিকাটুলিতে। নোংরা জায়গা, প্রতিবেশী অমার্জিত,  নিম্নবর্গের। বহরমপুরের বাড়ি-বাগান, বাগানের গোলাপ - সবই প্রতীকী অর্থে সুখ-সৌন্দর্য স্হিতির স্বর্গে পরিণত। হারানোর জন্য নস্টালজিয়া। বর্তমানের  জীবনযাপন নয়, অতীতের যাপিত জীবনের মৌ-সৌরভেই  আলি -পরিবার আবিষ্ট, অভিভূত। প্রফুল্ল রায়ের কালজয়ী উপন্যাস 'কেয়াপাতার নৌকা'-র  বক্তব্য যাই হোক, নায়ক বিনুর ভাবনায় দেশভাগজনিত  বঞ্চনা-ক্ষোভ এবং অসহায়তার ছবি আছে বেশি করে। অতীন  বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে' উপন্যাসটির কথনভঙ্গি  রূপকথার মতো হলেও সোনা চরিত্রটি স্বদেশ-স্বজন হারানো মানুষের সার্থক রূপায়ণ।  শহীদুল্লাহ কায়সারের কালজয়ী উপন্যাস 'সংশপ্তক' বিশেষ আলোচনার দাবি রাখে। 'মেঘনাদবধ' কাব্য যে অর্থে এপিক নয়-এপিলিং, ‘সংশপ্তক'  সেই অর্থে মহাকাব্যীয় সম্ভাবনাযুক্ত। দরবেশ, ফেলু মিঞা, জাহেদ সেকেন্দার মাস্টার ,রামদয়াল, অশোক, রমজান, লেকু, কপির, আরিফা, রানু, রিহানা, মালু প্রমুখকে নিয়ে বিভাগ পূর্ব, দাঙ্গা-কালীন এবং দেশবিভাগ  পরবর্তী   বাংলার অনবদ্য আলেখ্য। লেখকের রাজনৈতিক দর্শন ঠিক ইতিহাস প্রেক্ষিতে বিষয় বিন্যাসের সুযোগ দিয়েছে। সে সব চরিত্র সংগ্রামের শরিক, তারা লেখকের বিবেকের প্রতিভাস,তারা  কেউ বিভ্রান্তির শিকার হয়নি। সত্যের জন্য সংশপ্তকেরা আজ ও  লড়ছে দেশে দেশে।ভাবনায়, চেতনায় এক অসাধারণ উপন্যাস।

গৌরকিশোর ঘোষের 'প্রেম নেই' ঠিক দেশভাগের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস নয় কিন্তু তবু ত্রিশের দশক থেকে দেশমাতার কিনারে এসে লেখক চেয়েছেন। এর আগে আর কোন হিন্দু লেখক এমন গভীর মমতা ও সহানুভূতি নিয়ে মুসলমান সমাজকে দেখার চেষ্টা করেন নি। লেখক যেন ঐ  সমাজের একজন  হতে পেরেছেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের  দুই কালজয়ী উপন্যাস 'সেই সময়'ও' পূর্ব-পশ্চিম' দেশভাগের পটভূমিকায় লেখা উপন্যাস। দেশভাগের যন্ত্রনা, কষ্ট, উদ্বাস্তু জীবনের সমস্যা উন্মোচিত হয়েছে।এক অনবদ্য সামাজিক দলিল। সমকালীন সময়কে  সুন্দর  ভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে এই উপন্যাসের জন্ম। দেশভাগের পর ২০বছর  অপেক্ষা করতে হয়েছে একটি উপন্যাসের জন্য। জ্যোতির্ময়ী দেবীর 'এপার গঙ্গা ও পারগঙ্গা' । প্রকাশ কাল ১৯৬৭ সাল। এছাড়াও সমরেশ বসুর 'সুচাঁদের স্বদেশযাত্রা' ও অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'গড়শ্রীখণ্ড' এই দুটি উপন্যাসে দেশভাগের ছবি বিধৃত।

এছাড়াও দেশ-বিভাগের  পটভূমিকায় বহু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস রচিত হয়েছিল, সেই সময় বাঙালির ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে। (১) শ্যামলগঙ্গোপাধ্যায়ের জীবনরহস্য, (২) শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের 'পারাপার', (৩) কবি, অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের 'সুপুরিবনের সারি' (৪) আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ' খোয়াবনামা' ( ৫) সাবিত্রী রায়ের 'বদ্বীপ ও স্বরলিপি' (৬) মনোজ বসুর 'এপার ওপার'  (৭) রমেশ চন্দ্র সেনের 'পুব থেকে পশ্চিমে' (৮)  আবু ইসহাকের  ' সূর্যদীঘল বাড়ি' (৯) জীবনানন্দ দাশের 'জলপাই হাটি' ( ১০)হাসান আজিজুল হকের 'আগুনপাখি' ( ১১) আবদুস সামাদের 'দো গজ জমিন' (১২) আবু জাফর  শামসুদ্দীন-এর 'ভাওয়াল গড়ের  উপাখ্যান' ও 'পদ্মা-মেঘনা-- যমুনা' এবং ' সংকর সংকীর্তন' (১৩) অমর মিত্রের 'ধুলোগ্রাম' (১৪) সরদার জয়েন উদ্দীনের 'অনেক সূর্যের আকাশ' (১৫) সেলিনা হোসেন-এর 'যাপিত জীবন' ও 'গায়ত্রী সন্ধ্যা' এবং ' কাঁটাতারে প্রজাপতি' (১৬) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম' (প্রথমখণ্ড) ও 'অর্জুন' (১৭ )নির্মেলেন্দু গুণের 'দেশান্তর'  (১৮) হুয়ায়ুন আহমেদের' 'সূর্যের দিন'   ' নির্বাসন' ‌‌ শ্যামলছায়া   এবং 'আগুনের পরশমণি' (১৯) গৌরকিশোর ঘোষের, 'প্রতিবেশী' (২০) সরোজ রায়চৌধুরীর' নীল আগুন' (২১) তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'একটি কালো মেয়ের কথা' (২২) শওকত ওসমানের ' জাহান্নম হইতে বিদায়'ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

দুই বাংলার দেশভাগের কিছু উপন্যাসের বিষয় বিশ্লেষণঃ                                                   

১৯৪৭ সালে দেশভাগ জনিত কারণে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নতুন কেন্দ্র গড়ে ওঠে। এপার বাংলার বাঙালি মুসলমান লেখক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। দেশভাগ নিয়ে অনেকেই উপন্যাস লিখেছিলেন। এদের উপন্যাসে দেশবিভাগ প্রসঙ্গ-অনুসঙ্গ ও কাহিনির মৌল বিবেচ্য বিষয় হয়েছে। পরবর্তী সময়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শওকত আলী এবং সেলিনা হোসেনের উপন্যাসেও দেশবিভাগের ইতিহাস--অভিঘাত রূপায়িত হয়েছে। এদের উপন্যাস গুলিতে উদ্বাস্তু-সমস্যা, বাস্তুচ্যুতির জন্য বেদনাবোধ, স্মৃতিকাতরতা ও ভয়ার্ত অস্তিত্ব--সংগ্রামের ইতিবৃত্ত লেখকদের উদারনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপন করতে দেখা যায়। পঞ্চাশের মন্বন্তর অর্থাৎ ১৯৪৪ থেকে দেশবিভাগ (১৯৪৭) সময়বৃত্তে সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের বস্তনিষ্ঠ বর্ণনা ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা গভীর ভাবে গুরুত্ব লাভ করে। রাজিয়া খানের 'বটতলা' উপন্যাসে'-এ দেশভাগ জনিত সংকট, এক উপমহাদেশের বিশাল পরিসরে চরিত্র-পাত্রের জটিল সমস্যার বিন্যাস। দেখিনো হয়েছে।আবুল ফজলের 'রাঙাপ্রভাত' -এ দেশভাগ, পাকিস্তান শাসিত পূর্ব বাংলার ছবি  ফুটে উঠেছে। হাসান আজিজুল হকের অন্যতম উপন্যাসটির নাম 'আগুনপাখি', প্রকাশকাল, ২০০৬। উপন্যাসটি দেশভাগের পটভূমিকায় এক নারীর বাস্তুর প্রতি মমত্ববোধের মানবিক আখ্যান। এক নারীর জবানীতে বর্ণনা করা। উপন্যাসটিকে বলা হয়ে থাকে-- লেখকের আত্মজীবনী মূলক উপন্যাস।

সেলিনা হোসেনের 'যাপিত জীবন' ও গায়ত্রীসন্ধ্যা' -তে  দেশভাগের প্রত্যক্ষ অভিঘাতের  কথা বর্ণিত হয়েছে। 'কাঁটাতারে প্রজাপতি' উপন্যাসে ইলামিত্রের সংগ্রামী জীবন ও তেভাগা  প্রসঙ্গের রূপায়নে পরোক্ষভাবে দেশভাগের প্রসঙ্গ রেখায়িত। আবু জাফর শামসুদ্দীন-এর 'ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান', পদ্মা- মেঘনা-যমুনা'  এবং 'সংকর সংকীর্তন' এই তিনটি উপন্যাসে একটি পরিবারের যোগসূত্রে বাঙালি মুসলমানের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনের আলেখ্য রচনা করেছেন ঔপন্যাসিক।

'পদ্মা-মেঘনা-যমুনা'--র কাহিনী শেষ হয়েছে ১৯৪৭ সালে এসে, এরপরে দেশভাগ থেকে শুরু হয়েছে 'সংকীর্তন'এর কাহিনী বা ঘটনা। অমর মিত্রের 'ধুলোগ্রাম' (২০১৫), ১৯৭১এর মুক্তিযুদ্ধ ও দেশভাগের পটভূমিকায়। বাংলা  উপন্যাসের  জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'পূর্ব-পশ্চিম' (প্রথমখণ্ড) লেখকের ভাষায়----'এই উপন্যাসের পশ্চাৎপটে আছে সমসাময়িক ইতিহাস, বেশ কিছু রাজনৈতিক পালাবদল, আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্বকে উপস্থিত করা হয়েছে সরাসরি'। তিনি আরো বলেছেন-'পূর্ব-পশ্চিম' লেখার সময় আমার মাথায় ছিল দেশভাগ এবং দুদিকের বাঙালি।' ওপার বাংলার প্রথিতযশা কথা সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের,' খোয়াবনামা'তে দেশভাগের এক অন্য অনুভূতি ব্যক্ত হয়েছে। কথাসাহিত্যিক ব্যস্ত ছিলেন দেশভাগের বেদনাবিধুরতা নিয়ে। ১৯৪৭-১৯৭২ পর্যন্ত বিভিন্ন কালানুক্রমিক ঘটনাধারা আজকের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানসে অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মানবতা আদর্শ এবং প্রগতিশীল-গনতান্ত্রিক জীবনবোধের বিকাশ ঘটানোয় মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে এই উপন্যাসের উপজীব্য ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। আগামী প্রজন্মের তরুণদের কাছে, এক সময়ের দলিল হিসাবে বিবেচিত হবে। বিশ্বসাহিত্যে দেশভাগ যেন ট্রাজিক অভিজ্ঞতা।

 

১৯৪৭ সালে অখণ্ড ভারত ভাগ  হওয়ায় নতুন দুটি দেশের গৃহহীন ও বাস্তুচ্যুত পরিবার পারস্পরিক গৃহবিনিময় করে উভয় রাষ্ট্রে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষকে উদ্বাস্তু হতে হয়, এবং মুখোমুখি হতে হয়েছিল কঠিন -কঠোর বাস্তবতার। জন্মভূমি বাংলাদেশ থেকে অনেককেই এপার বাংলায় আসতে হয়েছিল, তেমনি এপার বাংলা থেকে অনেককেই ওপার বাংলায় যেতে হয়েছিল বাধ্যহয়ে। এই জন্মভূমি ছেড়ে আসার আঘাতের রক্তক্ষরণ, নির্মম সময়ের দাগ দু'বাংলার  সাহিত্যে ছাপ ফেলেছিল। এটাই ইতিহাসগত ভাবেই সত্য।

 

সময়ের বিশ্বস্ত দলিল ও আগামী প্রজন্মের পাঠঃ

কবি শঙ্খঘোষের 'দেশহীন' কবিতার এই শব্দমালা আমাদের সেই অনুভবের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় যা  আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি,যে অনুভবের নাম 'দেশভাগ' একটি ছোট্ট শব্দের মধ্যে যে হাহাকার, রক্তক্ষরণ আর যন্ত্রনা লুকিয়ে থাকে, তার অনুসন্ধানে আগামী প্রজন্ম তখন কৌতূহলী হয়ে ওঠে, তখন তাদের হাতে এসে পৌঁছয় অসংখ্য কলমের নির্যাস-- ইতিহাস থেকে সাহিত্য, স্মৃতিকথা থেকে সরকারি তথ্যপঞ্জীর অনর্গল ধারাবাহিকতা। কথা সাহিত্যিক প্রফুল্ল রায়ের মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ--'দেশভাগের কারণে জন্মভূমি থেকে আমাকে উৎখাত হয়ে চলে আসতে হয়‌। দেশ হারানোর সেই যন্ত্রনা আমি চিরকাল ভোগ করে চলেছি।' সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে--'দেশভাগ নিয়ে কোন  সার্থক উপন্যাস লেখা যায় না। কেননা সেরকম  লেখা  আর একটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উস্কে দিতে পারে।'

'দেশভাগ' শব্দটির ও দুটি ভিন্ন মাত্রা। প্রথমটি ১৯৪৭-এর বিভাজন, যে বিভাজন জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল  সাধারন মানুষের উপর। কিছু  মানুষের নিজস্ব   স্বার্থের জন্য এই বিভাজন হয়েছিল। দ্বিতীয়টি ১৯৭১ সালের দেশভাগ। পাকিস্তানের হাত থেকে বাঙালি ছিনিয়ে নিল আপন ভূখণ্ড বাংলাদেশ। এই দেশভাগ বাঙালির গৌরবের, স্বপ্নের, কাঙ্ক্ষিত।

 

শেষকথাঃ                                                     

 

একটা দেশের মানচিত্র টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়ার ইতিহাস তখন উপন্যাসের আখর থেকে খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ, সেই সব মানুষ  যারা দেশভাগ দেখেনি, ভাষা আন্দোলন দেখেনি, মুক্তিযুদ্ধের সময়  যারা  নেহাতই সদ্যোজাত  অথবা শৈশবের আঙিনায়--  তখন তাদের আশ্রয় ইতিহাসের পাতা আর সাহিত্যে প্রতিফলিত সময়। ফেলে আসা সময়ের পাতা উলটে তারা  দেখেছে, উপন্যাসের পাতায় পাতায় সময়ের ইতিহাস নেই, একটা প্রজন্মের পথ হাঁটার ইতিহাস ও  লেখা হয়ে যায় সেই সঙ্গে। 'নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে'র সোনা, 'মানুষের ঘরবাড়ি-'র বিলু, 'কেয়াপাতার নৌকা'-র বিনু, পূর্ব-পশ্চিম'এর যে বাবলু,  'সংশপ্তক'  এর মালু, 'যাপিত জীবন' এর জাফর এবং দীপু, গায়ন্ত্রী সন্ধ্যা'র প্রদীপ্ত এবং প্রতীক –----- এরা সবাই শৈশব--কৈশোরের পথ পেরিয়ে,এক রক্তাক্ত রাজনীতির পথ মাড়িয়ে আর এক রক্তাক্ত রাজপথের পথিক হয়ে ওঠে। সুতরাং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌছে যায় ফেলে আসা দিনের বার্তা, তাদের পাঠ হোক নিজস্ব দর্শনের আয়নায়  আজকের প্রজন্ম স্থিত হোক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের  'পারাপার' কবিতার  পংক্তির মতো এক দৃঢ় প্রত্যয়ে--" দুয়োরে খিল/টান 

দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানালা/ ওপারে যে বাংলাদেশে/এপারেও সেই বাংলা।"

 

তথ্যসূত্র-

(১) দেশভাগ-বাঙালির সাংস্কৃতিক জীবনচর্চায় এক অভিশপ্ত ক্ষতচিহ্ন,কল্লোল বন্দ্যোপাধ্যায়

(২) দেশভাগের পটভূমি: বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্য, অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়

(৩) দেশভাগের সাহিত্য: শিল্পের বেদনায় বহুমাত্রিক ক্যানভাস, সেলিনা হোসেন, সম্পদনা-মনন কুমার মণ্ডল, গাঙচিল,

(৪) শিকড়ের খোঁজে, অমর মিত্র, ভাসিয়ে দিয়েছি কপোতাক্ষ জলে, দে'জ পাবলিশার্স ২০০৫

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
লোক গবেষক , প্রাবন্ধিক,অণুগল্প-ছোটগল্প, রম্যরচনা ও চিত্রনাট্য এবং ভ্রমণকাহিনীর রচয়িতা 
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top