চরৈবতি : কৃষ্ণা গুহ রায়


প্রকাশিত:
১৮ অক্টোবর ২০২১ ২০:২৩

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৯

ছবিঃ কৃষ্ণা গুহ রায়

 

বালিগঞ্জে অভিজাত তিনতলা বাড়ি৷ বর্ধিষ্ণু পরিবার৷ কনিষ্ক আর ইরার দুই ছেলে মেয়ে, রোনক আর অর্চিতা৷ কনিষ্ক সরকারী মেডিকেল ইনস্যুরেন্সের উচ্চ আধিকারিক আর ইরা মেডিকেল কলেজের ডাক্তার৷ কনিষ্করা তিন ভাই আর বাবা, মা, নিয়ে এই বাড়িতে বসবাস৷ কনিষ্কর পূর্বপুরুষ এক সময়ে পূর্ববঙ্গের বর্ধিষ্ণু পরিবার ছিল৷ দেশ ভাগের সময় ওর বাবা সপরিবারে এই দেশে চলে আসেন৷ যেটুকু সম্বল ছিল তা দিয়ে মাথা গোঁজার জন্য ছোট একটা জায়গা আর গড়িয়াহাট অঞ্চলে ব্যবসা শুরু করেন ৷ তারপর আস্তে আস্তে সংসারে আর্থিক সঙ্গতি হয়৷ বোনেদের বিয়ে দিয়ে নিজে বিয়ে করেন৷ বাবা, মাকে সঙ্গে নিয়ে দুর্গানাথ বালিগঞ্জ এলাকায় বাড়ি কিনে সংসার শুরু করেন৷ তারপর দুর্গানাথের স্ত্রী বিভাদেবী কোল আলো করে তিন পুত্র সন্তানের জন্ম দেন৷ বড় ছেলে বিনয়, মেজ কনিষ্ক আর ছোট অজয়৷ তারপর এক সময় তিন ছেলের বিয়ে দিয়ে নাতি নাতনির মুখ দর্শণ করে দুর্গানাথ আর বিভাদেবী স্বর্গে পাড়ি দেন৷ বাবা,মা চলে যাবার পর কনিষ্করা তিন ভাই নিজেদের মধ্যে কথা বলে তিনতলা বাড়ির এক এক তলায় নিজেদের সংসার আলাদা করে নিল৷ পৃথক হলেও ওদের মধ্যে পারিবারিক সখ্যতার অভাব ছিল না৷ সময়ের ধারাপাতে ওদের তিন ভাইয়ের চুলেও পাক ধরল৷ ছেলে মেয়েরাও বড় হয়ে গেল৷
কনিষ্কর দাদার দুই ছেলে বিদেশে সেটল হয়ে গেল৷ ছোট ভাইয়ের দু'মেয়েই কলেজে পড়ে৷ কনিষ্কর ছেলে রোনক মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বেলজিয়াম চলে গেল৷ অর্চিতাই একটু অন্যরকম বিষয় পছন্দ করল৷ আসলে রক্তর ধারা বলে একটা জিনিস আছে সেটাই অর্চিতার মধ্যে প্রবাহিত হল৷ অর্চিতার দাদু দুর্গানাথ দেশভাগের আগে ওপার বাংলার টোলের পন্ডিত ছিলেন৷ সংস্কৃততে ছিল তার অগাধ পান্ডিত্য৷ কিন্তু অন্ন সংস্থানের তাগিদে এদেশে এসে ফুটপাতে অল্প পুঁজি দিয়ে গামছা, লুঙ্গির ব্যবসা শুরু করলেন৷ মনের ভেতরে রয়ে গেল সংস্কৃতর বীজমন্ত্র৷ অবসর সময়ে সেই বীজমন্ত্র তিনি বপন করে গিয়েছিলেন নাতনি অর্চিতার মধ্যে৷
সব সময়ে আদি ভাষার উপর গল্প করতেন বলে অন্য নাতি নাতনিরা অত দাদুর গায়ে না ঘেষলেও অর্চিতা চুপটি করে দাদুর কথা শুনতো৷ দেখত আদি ভাষার বিকৃত রূপ দাদুকে কতটা কষ্ট দিত৷ কথা শেষ করে দাদুর দু' চোখ বেয়ে জলের ধারা নেমে আসত৷
দাদু একটা কথা খুব বলতেন চরৈবতি চরৈবতি৷
অর্চিতা জিজ্ঞাসা করত, দাদু এই কথাটার মানে কি?
দুর্গানাথ স্মিত হেসে বলতেন, চরৈবতি শব্দর অর্থ সামনে এগিয়ে যাওয়া৷
শুদ্রাণী মায়ের গর্ভের সন্তানকে বিদ্যা দান করতে ব্রাক্ষ্মণ পিতা অস্বীকার করেছিলেন৷ তখন মা তার পুত্রর শিক্ষার জন্য মা বসুন্ধরার শরণাপন্ন হলেন৷ মা বসুন্ধরা সেই পুত্রকে সর্ব শাস্ত্রে পন্ডিত করে শুদ্রাণী মায়ের কাছে তাকে ফিরিয়ে দিলেন৷ তখন সেই ছেলে তার বাল্যকালের অপমানের শোধ তুললেন৷ তিনি ঋগ্বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থ লিখলেন৷ আজ যে যত বড় বিশুদ্ধ ব্রাক্ষ্মণই হোক না কেন তাকে ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থখানি না পড়লে ঋগ্বেদ পড়া তার কাছে সম্ভবপর নয়৷
তারপর তিনি যে শূদ্রাণী অর্থাৎ ইতরার ছেলে সেটা খুব ভালো করে বুঝিয়ে দেবার জন্য তিনি নিজেকে ইতরার পুত্র ঐতরেয় নামে খ্যাত করলেন। যেহেতু ব্রাক্ষ্মণ গ্রন্থখানি রচনা করেছিলেন সেই থেকে তার নাম হল ঐতরেয় ব্রাহ্মণ। শূদ্রাণীর ছেলের আসল নামটি ঐতরেয় নামের তলায় চাপা পড়ে গেল। মহীর শিষ্য বলে তাকে মহী দাসও বলা হয়। তাই ঐতরেয় মহী দাসই তার আসল পরিচয়। ঋগ্বেদ জানতে হলেই যে ওই ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এর প্রয়োজন শুধু এই কথা বললে খুব অল্প বলা হবে। বড় বড় চিরন্তন সত্য ওই গ্রন্থে এমন ভাবে দেওয়া হয়েছে যে তা দেখলে আশ্চর্য হতে হয় দিদিভাই। পুরনো যুগে স্থিতিশীলতাই ছিল ধর্ম। কিন্তু ঐতরেয় ব্রাহ্মণে আছে এগিয়ে চলাই ধর্ম অর্থাৎ যাকে বলা হয় চরৈবতি। তুমিও এগিয়ে যেও দিদিভাই৷

অর্চিতা যখন ক্লাস টেনে পড়ে তখন দাদু ইহলোকের মায়া ত্যাগ করলেন৷ মাধ্যমিকে সায়েন্স গ্রুপে লেটার পাওয়ার পরও এক রকম জোর করেই অর্চিতা আর্টস নিল, সঙ্গে নিল সংস্কৃত৷ এই নিয়ে কনিষ্ক আর ইরার কাছে অর্চিতার কম বকুনি খেতে হল না৷ তবুও মেয়ের জিদের কাছে অবশেষে ওরাও হার মানল৷ উচ্চমাধ্যমিকে সংস্কৃততে খুব ভালো নাম্বার পেয়ে সংস্কৃততে অনার্স নিয়ে পাশ করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত নিয়ে এম এতে ভর্তি হল অর্চিতা৷ গুটি কয়েক পড়ুয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শুরু হল৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একটা ঘটনা ঘটল৷
অর্চিতার এক বন্ধু তৃষা একটা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখিয়ে বলল, জানিস একটা শর্ট ফিল্ম তৈরি হচ্ছে যেটা বৈদিক যুগের উপর, সেখানে সংস্কৃত জানা মেয়েদের চাইছে৷ যাবি অডিশন দিতে৷
অর্চিতা এক বাক্যে রাজী হয়ে গেল৷ ওরা দুই বন্ধু গেল অডিশন দিতে৷ দুজনেই অডিশনে চান্স পেয়ে গেল৷ সংস্কৃত কলেজে, আর গঙ্গার ধারে শুটিঙ চলল৷ প্রায় তিন মাস ধরে এই কাজ চলল৷ অর্চিতা আর তৃষা দুজনেই দিনের বেলায় ইউনিভার্সিটির ক্লাস ম্যানেজ করে শুটিঙ করত৷ কাজেই বাড়ির লোক ঘুনাক্ষরে এই বিষয়ে জানতে পারল না৷ তৃষার বাড়িতে যদিও জানত কিন্তু অর্চিতার বাড়ি রক্ষণশীল কাজেই অর্চিতাকে বিষয়টা গোপন রাখতেই হল৷ র্নিবিঘ্নেই শুটিঙ শেষ হল৷
তখন এম. এর ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে৷ টেস্ট হয়ে গেছে৷ কণিষ্ক অফিস থেকে বেশ গম্ভীর মুখেই বাড়ি ফিরলেন৷ ইরাকে ঘরে ডেকে বললেন, আমার বন্ধুর ছেলে আমেরিকায় থাকে, য়োটেকনোলজিস্ট৷ ওর সঙ্গে অর্চিতার বিয়ে ফাইনাল করে এলাম৷
ইরা আঁতকে উঠল, সে কি তুমি এত বড় ডিসিশন নিলে, আমাকে জানালে পর্যন্ত না৷
অর্চিও তো জানে না৷
- জানাবার প্রয়োজন মনে করলে নিশ্চয়ই জানাতাম৷ তাছাড়া এই তো জানালাম৷ আগামী রবিবার পাত্রপক্ষর বাড়িতে আমরা যাব৷ ওখানেই ডেট ফাইনাল হবে৷
ইরা বললেন, এত তাড়াহুড়োর কারণটা কি ?
- তুমি কি জানো তোমার মেয়ে ফিল্ম করছে?
- না তো, সে কি?
- আমার অফিসের এক কলিগ আনন্দলোক এনে তোমার মেয়ের ছবি দেখাল৷ আর আজকেই আমি আমার উকিল বন্ধু তাপসের ছেলের সঙ্গে অর্চির বিয়ের কথা ফোনে বলে দিয়েছি, আর আগামী রবিবার তোমাকে নিয়ে যাব সেকথাও বলে দিয়েছি৷ অনেকদিন ধরেই তাপস ওর ছেলের জন্য অর্চির কথা বলছিল, আমি বলছিলাম, এখন তো পড়াশুনো করছে, আগে পড়াশুনো শেষ করুক তারপর দেখছি৷
আমি আর দেরী করতে চাই না৷
ইরা এই বিষয়ে আর কিছু বললেন না৷ আর তাপসবাবুর পরিবার ওনারা যেমন জানেন, তাপসবাবুও ইরাদের পরিবার সম্বন্ধে জানেন৷ কাজেই আপত্তির কিছু নেই৷
রবিবার কণিষ্ক আর ইরা হিন্দুস্থান পার্কে তাপসবাবুর বাড়ি গিয়ে বিয়ের কথাবার্তা পাকা করে এলেন৷ অর্চিতা কিছুই জানতে পারল না৷ আনন্দলোকে যে ওর ছবি বেড়িয়েছে সেটা অর্চিতা তৃষার কাছে জেনেছিল, বেশ খুশীতেই ছিল তাই৷
যথা সময়ে এম, এ, পার্ট টু শেষ হল৷ নন্দনে শর্ট ফিল্ম উৎসবে ওদের শর্ট ফিল্মটা রিলিজ হবে সেরকমই ঠিক হয়েছে, তার আগেই অর্চিতার বাড়িতে সানাই বেজে উঠল৷ তাকে না জানিয়ে এভাবে হঠাৎ করে তার বিয়ে ঠিক হবার কারণ যে অভিনয় করা, সে যখন জানতে পারল, মুখে কিছু না বললেও, মনে মনে ঠিক করল বাবা, মায়ের সঙ্গে সে আর কোনওভাবেই সম্পর্ক রাখবে না৷ বিয়ে, দ্বিরা গমণ সেরে বরের সঙ্গে পাড়ি দিল আমেরিকা৷
অর্চিতার বর অর্ক বেশ খোলা মনের মানুষ৷ অর্চিতার সঙ্গে অর্কর খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল৷
ডালাসে ওরা থাকে৷ ওখানে একটা বাচ্চাদের স্কুলে অর্চিতা পড়াবার কাজও পেয়ে গেল৷ ওর স্কুলের কলিগ মেম, সাহেবদের সঙ্গে অর্চিতা বেদ, উপনিষদ নিয়ে বিভিন্ন গল্প করত৷ এতে আমেরিকানদের এই বিষয়ের উপর খুব আগ্রহ তৈরি হল৷ ওরাই তখন স্কুলের প্রিন্সিপালকে গিয়ে বলল, স্কুল আওয়ারের পর ওরা অর্চিতার কাছ থেকে বেদ, উপনিষদের কথা ইংলিশ ভার্সানে শুনবে৷ আমেরিকান প্রিন্সিপালও রাজী হয়ে গেলেন৷ প্রথমদিন স্কুল আওয়ারের শেষে ওনাদের সেমিনার হলে অর্চিতা সবাইকে বলল, চরৈবতি অর্থাৎ move forward৷ তারপর কালিদাসের কুমারসম্ভব দিয়ে শুরু করল৷
আমেরিকানরা স্তব্ধ৷ তারা মুগ্ধ৷ অর্চিতার জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল৷ এই ক্লাসের জন্য ওরা অর্চিতাকে প্রত্যেক মাসে একটা সাম্মানিকও দেওয়া শুরু করল৷ আমেরিকার বিভিন্ন জার্নালে অর্চিতার কথা প্রকাশিত হল৷ ডালাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট এল রুটিন ভিজিট করতে৷ অর্চিতা প্রেসিডেন্টের সম্বর্ধণা অনুষ্ঠানে সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ করল, তার ইংরেজি তর্জমা করল অর্চিতারই এক আমেরিকান ছাত্র৷ আর স্তোত্রপাঠ করার আগে অর্চিতা মাইক্রোফোন হাতে তুলে বসুধৈব কুটুম্বকম বলে ইংলিশে বলেছিল ,The entire population of the world are our relatives. প্রেসিডেন্ট মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলেন অর্চিতার দিকে৷ তিনি এতটাই খুশী হলেন যে সর্ব সমক্ষে ঘোষণা করলেন আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার উপর তিনি বিশেষ ব্যবস্থা নেবেন৷ আর সেজন্য অর্চিতাকে তিনি বললেন একটা টিম তৈরি করে এই দায়িত্ব নিতে৷
বউয়ের সাফল্যে অর্ক খুব খুশী৷ এই খবর আমেরিকার বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হল৷
সাগরপারের খবর ভারতের বিভিন্ন মিডিয়াতেও ছড়িয়ে পরল৷ কণিষ্ক আর ইরাও খুব খুশী৷
অর্চিতারও বাবা, মায়ের উপর রাগ ততদিনে জল হয়ে গিয়েছে৷ যে অর্চিতা বাবা, মা ফোন করলে বা ইন্ডিয়ায় যাবার কথা বললে কাজের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যেত, কণিষ্ক অর্চিতার সাফল্যের খবর পাবার পর ফোন করলে সেই অর্চিতাই ফোন ধরে বলল, বাবা তুমি যে আমার বিয়ের সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে, তা আমি এখন বুঝতে পারছি৷ জানো বাবা আজকে দাদুর কথা খুব মনে পরছে, দাদু আদি ভাষার যে বীজ বপন করেছিলেন আমার মধ্যে সেটাই এখন পুষ্প পত্রে শোভিত হয়ে গাছ হয়েছে৷ আর অর্কর মতন স্বামী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের৷ অর্ক শুধু আমার স্বামী নয় আমার বেস্ট ফ্রেন্ড৷ বাবা আমরা খুব শিগগিরই ইন্ডিয়া আসছি৷
মোবাইলটা রেখে অর্চিতার কানে তখন দুর্গানাথের বলা শব্দটাই অনুরনিত হতে থাকল, এগিয়ে যেও দিদিভাই, চরৈবতি৷


কৃষ্ণা গুহ রায়
সাহিত্যকর্মী
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত 

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top