ময়ূরভঞ্জ অভয়ারণ্যের অন্দরমহলে-এক অন্যভুবন : সুবীর মণ্ডল


প্রকাশিত:
৩১ জানুয়ারী ২০২৩ ০৩:১৯

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৯:২২

 

রূপসী উড়িষ্যার পর্যটন মানচিত্রে ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝড়ে আর বাংরিপোসি রূপে-রসে অনন্য। ময়ূরভঞ্জের নির্মল প্রকৃতি যেন উজাড় করে দিয়েছে তার সমস্ত ঐশ্বর্য। ময়ূরভঞ্জ অভয়ারণ্যের বৈশিষ্ট্য এমনই আমরা যে অঞ্চলেই যাই না কেন, মুগ্ধ হয়ে দু'চোখ ভরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে হয়। প্রকৃতি নিজে যেন দু'হাত মেলে সাজিয়েছেন এই অঞ্চলকে।আর এই নৈসর্গিক শোভা সম্পূর্ণরূপে উপভোগ করতে হলে বেড়ানো শুরু হয় করতে হবে যশিপুর অথবা বারিপদা দিয়ে।
একদা ভঞ্জ রাজবংশের মৃগয়াক্ষেত্র আজ সিমলিপাল ব্যঘ্র প্রকল্প নামে পরিচিত। ওড়িশা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলায় অবস্থিত ২৭৫০ বর্গ কিমি বিস্তীর্ণ এই বনভুমির ১১৯৪ বর্গ কিমি কোর এলাকা। শাল মহুয়া কুসমি পলাশের ছায়াঘেরা, উস্রি বড়েহাপানি জোরান্ডা র মত অজস্র ছোট বড়ো ঝর্নার জলে পুষ্ট খৈরী -বোধবালাঙ্গা -পলপলার মত সাত আটটি ছোট- বড়ো নদী শিরা উপশিরার মত জড়িয়ে রেখেছে এই বনভুমিকে। জীব বৈচিত্রে সমৃদ্ধ এই মালভুমির উচ্চতম অঞ্চল মেঘহাসানি টুংকিবুরু।

ছবিঃ লেখক সুবীর মণ্ডল

ছেলেবেলায় পড়েছিলাম সরোজ রাজ চৌধুরীর পোষা বাঘিনী খৈরীর কথা। পরবর্তীতে বুদ্ধদেব গুহ"র লেখা সিমলিপালের প্রতি আকর্ষণ বাড়িয়ে দেয় অনেকগুণ। বার দুয়েক আশেপাশে ঘোরাঘুরি করলেও গভীরে জঙ্গলের ভিতর ঘোরার সৌভাগ্য হল গত ডিসেম্বরের শেষে আমার শালক ও তার স্ত্রীর সৌজন্যে। কেওয়নঝড় ভ্রমণের পর পৌঁছলাম জশিপুরে পৌঁছলাম সন্ধ্যার সময়।ময়ূরভঞ্জ অভয়ারণ্য প্রবেশের যাবতীয় কাগজপত্র রেডি করেদেন যশিপুরের সাইরাম হোটেলের মালিক। নিজের গাড়ি নিয়ে অভয়ারণ্যে প্রবেশ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে আমরা ৪০০০ টাকা দিয়ে ভাড়া করলাম বোলেরো গাড়ি। গাড়ির ড্রাইভার খুব অল্প বয়সের। সকাল আটটার সময়ে অভয়ারণ্যের দিকে চললাম। প্রবেশ পথে কাগজপত্র দেখিয়ে শুরু করলাম অভয়ারণ্যের মনোমুগ্ধকর সফর। চারিদিক জুড়েই সবুজের সমুদ্র। কয়েক মিনিট পরে গাড়ি এসে থামল ৩৪০ বছরের সুপ্রাচীন ঐতিহ্যমণ্ডিত এক শাল গাছের কাছে। উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জের মানুষ এই গানকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করেন। মুগ্ধ হলাম। আমাদের গন্তব্যস্হল এবার গভীর অরণ্যে। রাস্তার দুপাশের সবুজের সমারোহ। খৈরী নদী আমাদের চলার পথের সাথী হল। নুড়ি-পাথরের নান্দনিক সৌন্দর্যের মুগ্ধ হলাম। তিরতির করে বয়ে চলেছে আপন ছন্দে।

ভীষণ ভালো লাগার বর্ণময় এক শীতের দুপুর। বহুদিন মনে থাকবে, ভাষায় প্রকাশ করা যায়না। শুধু অনুভবের যোগ্য। চোখের সামনে দুই ভালোবাসার নদী খৈরী আর পলপলা। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি। নুড়ি পাথর আর বালির শরীরে তিরতির করে বয়ে চলেছে খৈরী।তাঁর দু'কূল ছাপিয়ে পড়া জঙলী সবুজের প্রেম। সিল্যুয়েটের মতো দাঁড়িয়ে আছে অতীতের যোগসূত্র কাঠের ভাঙা ব্রিজটা। তাঁর দু'কূল ছোঁয়ার কোনও ইচ্ছেই আর নেই।দিন-মাস-বছর শুধুই অলসতার দিনযাপন! নদীর বুকে হাঁটতে হাঁটতে একটু এগোতেই, মনে হলো এক স্বপ্নের জগতে আমরা। চারিদিকে থমথমে নিঃশব্দতা ,রোমাঞ্চকর, জনমানবহীন। লক্ষ্য করলাম খৈরীর উত্তাল স্রোত নৃত্যের তালে তালে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ছোট ছোট নুড়ি পাথরকে। খৈরীর মতোই পলপলার শরীর জুড়েও নানান আকৃতির নুড়ি-পাথরের নান্দনিক সৌন্দর্যের আলপনা। এই নুড়ি পাথরের প্রাণ ছুঁয়ে ছুঁয়ে বয়ে চলেছে খৈরী। তাঁর একপাশে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রহরীর মতো সবুজ পাহাড়ের সারি। পাশেই সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের এলাকা। স্রোতস্বিনী নদী খৈরী ও পলপলা, যেন যমজ সহদোরা। চেহারা-চরিত্রে কত মিল ! এবার আমাদের গন্তব্যস্হল অভয়ারণ্যের অন্দরমহল-বিভিন্ন আদিবাসীদের গ্রাম। গ্রামের ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা আমাদের গাড়ির শব্দে ছুটে এল। হাত নাড়তে থাকল। কেউ কেউ আবার নিজেদের বাগানের ফল নিয়ে এল। সীমাহীন দারিদ্র্য ও অসহায়তার ছবি দেখে মনটা খারাপ হল।কিছু ফল কিনলাম। অভয়ারণ্যের মধ্যে জীবন নির্বাহের করুন দৃশ্য দেখলাম। ক্রমশ আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল গভীর অরণ্যের মধ্যে। রাস্তা অত্যন্ত বিপজ্জনক। দক্ষ ড্রাইভার ছাড়া এই ধরনের রাস্তায় গাড়ি চালান অসম্ভব বলে মনে হল।

ক্রমশই ঘন হচ্ছে জঙ্গল। এ -যেন এক অনন্তযাত্রা।মাঝে মাঝে সঙ্গী হচ্ছে পরিযায়ীর পাখিদের দল। বিভিন্ন ধরনের পাখির শব্দ ছাড়া চারপাশে জমাট বেঁধে আছে অস্বাভাবিক নীরবতা।এ-যেন আমার পৃথিবী নয়, এখানে আমরা অনুপ্রবেশ কারি। এ --জগৎ মনুষ‍্যতরদের। প্রতিটি মূহুর্তে বেঁচে থাকার লড়াই। সময়ের হাত ধরেই সূর্যদেব পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়ছে। বন্য জীবনের এই অভিজ্ঞতা বহুদিন মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূপ হয়ে থাকবে। আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রান্তিক মানুষের জীবন-যাপনের ছন্দ খোঁজার চেষ্টা করছিলাম। হঠাৎ দেখা হল অভয়ারণ্যের গ্রাম পঞ্চায়েতের এক সদস্যের সঙ্গে। আলাপচারিতায় মার্জিত রুচির ছাপ পরিলক্ষিত হল। মুখে অমলিন হাসি।
দূর জঙ্গলের মধ্যে চোখে পড়ল হাতের তালুর মতো দু'-একটা সাঁওতালি গ্রাম।খড়ে ছাওয়া মাটির বাড়ি। মাটির দেওয়ালের গায়ে রঙ আঁকা লতাপাতার বিচিত্র ডিজাইন। দারিদ্র্য আর শিল্পবোধের অকৃত্রিম সহাবস্থান। অপলক নয়নে সেই অরণ্য শোভার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হলো প্রকৃতির তুলির টানে অবনঠাকুরের কি রামকিঙ্করের কল্পনার ছোঁয়া। দুপুরের খাবার পর্ব সারলাম জোরান্ডার সবুজ উপত্যকার অনিন্দ্যসুন্দর এক আদিবাসীদের গ্রামে।গ্রামের মানুষের রান্না অসাধারণ। দেশী মুরগির মাংস পোড়া এক কথায় অনবদ্য। এই মাংসের স্বাদ বহুদিন মনে থাকবে।
আবার পথ চলা ।প্রকৃতির অপরূপ ছড়িয়ে আছে।এক অজানা নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। জোরান্ডা, বড়াহিপাণি পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম। বিকাল বেলায় তখন সূর্যের আলো বড়াহিপাণি পাহাড়ের কালো পাথরের ওপর পড়েছে,তখন অপরূপ লাগল। ময়ূরভঞ্জের বিস্তৃত সবুজ উপত্যকার মাঝে শান্ত স্নিগ্ধ চাওয়ালা পড়ন্ত বিকেলে হরিণ সহ বিভিন্ন প্রাণীর আগমন ঘটে। এবার ফেরার পথে ঘন সবুজের ঘেরা টোপে ছোট্ট আদিবাসী জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের জনপদভূমি। প্রকৃতি যেন তার রঙিন ডানা মেলে রয়েছে।সহজ,সরল আদিবাসী মানুষ গুলোর হৃদয় ওপড়ানো অকৃত্রিম ভালোবাসা প্রকৃতির অপরূপ ক্যানভাসে ঠিক যেন পটে আঁকা ছবি।ময়ূরভঞ্জের নির্মল অনাঘ্রাত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এক কথায় অনন্য। জায়গাটা কিছুটা হলেও দুর্গম। দুদিকে পাহাড় আর পাহাড়ের কোলে সবুজ ধানক্ষেত। যেন প্রকৃতির সবুজ কার্পেট। এইভাবেই আমাদের স্বাগত জানাল আদিবাসীদের গ্রাম। এখানে মেঘ যেন গাভীর মতো চরে। শুধু সবুজের সমারোহ। নির্জনতাই ভাষা। অপার বিস্ময় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সবুজ উপত্যকা। চড়াই-উৎড়াই ছাড়াও ছোটবড় পাথরের সমাবেশ জায়গাটিকে আ্যডভেঞ্চার প্রিয় মানুষের প্রিয় জায়গা করে তুলেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে। অভয়ারণ্যের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই। রাস্তার ধারে মোবাইল ঝুলে আছে। যাদের খুব প্রয়োজন তারা এই মোবাইল-এর মাধ্যমে যোগাযোগ করে। কাছেপিঠের একমাত্র শহর যশিপুর। ভূমিজ, মাহালি গোডি ,সাঁওতাল সহ আনুমানিক ১৫টি উপজাতির মানুষ এখানে বসবাস করে, এদের মধ্যে কয়েকটি উপজাতির মানুষ বনের মধু সংগ্রহ করে। মাহালি সম্প্রদায়ের মানুষ বাঁশের কাজে দক্ষ। এখানকার গ্রামীণ খাদ্য অসাধারণ।

চিকেন পোতুয়া হল সিমলিপাল অভয়ারণ্যের খুবই জনপ্রিয় ও সুস্বাদু খাবার। সিমলিপাল জঙ্গলে ঘুরতে গিয়ে এই পোতুয়ার স্বাদ আস্বাদন না করলে সিমলিপাল জঙ্গলে ঘোরাটায় অপূর্ণ রয়ে যাবে বলে মনে হয়েছিল। এই জঙ্গলের মধ্যে যে সমস্ত আদিবাসী মানুষজন নিজেদেরকে অত্যাধুনিক ও যান্ত্রিক জনজীবন থেকে এখনো আলাদা রেখেছে তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র রান্নার শৈলী। যদিও সিমলিপাল সংলগ্ন প্রায় সমস্ত হোটেল ও রেস্টুরেন্টের মেনুকার্ড এ এই খাবারটি জায়গা করে নিয়েছে। যদিও সেটি জঙ্গলের মধ্যেকার পোতুয়ার আধুনিকরণ। তবে পোতুয়ার অরিজিনাল স্বাদ পেতে হলে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে চোখের সামনে বানানো গরমাগরম পোতুয়া খাওয়ার সুযোগহয়েছিল। এই পোতুয়া খেতে যেমনি সুস্বাদু তেমনি সুন্দর এর প্রিপারেশন। আমাদের ড্রাইভারের কাছ থেকে জানলাম, এই পোতুয়া বানানোর জন্য চিকেনকে খুব ছোট ছোট করে কুচিয়ে ভালো করে ধুয়ে ওর মধ্যে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, লঙ্কা ও সরষে বাটা আর সবশেষে সরষের তেল‌ দিয়ে খুব ভালো করে মেখে সদ্য গাছ থেকে পেড়ে আনা বড় কচি শালপাতাতে মুড়িয়ে লোহার সরু তার দিয়ে ভালো করে বেঁধে দেয়। তারপর জঙ্গলেরই শাল কাঠের গনগনে আগুনের মধ্যে এপিঠ ওপিঠ করে ভালো করে পুড়িয়ে আর একটা শালপাতাতে দিয়ে ওর উপরে টাটকা ধনেপাতা কুচি ও পেঁয়াজ কুচি দিয়ে তার উপর পাতি লেবুর রস ছড়িয়ে খেতে দেয়। সত্যিই অসাধারণ।এক একটি পোতুয়া মাত্র ত্রিশ টাকা। চার পাঁচ পিস মাংস থাকে, পরিমাণ প্রায় পঞ্চাশ - ষাট গ্রাম। অভয়ারণ্যের মনোমুগ্ধকর সফর এইভাবেই শেষ করলাম।

মসৃণ স্বপ্নের পথ ধরলাম দিনান্তের ম্লান আলোয় ময়ূরভঞ্জের উঁচু পাহাড়গুলোর মাথা গেরুয়ারঙে মৌন, তপস্বীর মতো সমাহিত। আমরা তখন ফেরার পথে, হঠাৎ কানে ভেসে আসে সাঁওতালি মেঠোসুর। মাদলের চাপা আওয়াজ দ্রিমি দ্রিমী। সে সুর কেমন যেন মাতাল করা। চেয়ে দেখি দূর পাহাড়ের গায়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে আল পথ বেয়ে চলেছে একদল সাঁওতালি পুরুষ আর রমনী। মেয়েদের মাথায় গোঁজা বনফুল,নাকে নোলক পায়ে মল সহ ঘুঙুর। মাথায় জঙ্গলের ডালপালার বোঝা। দলের শেষে সাঁওতাল যুবকদের হাতে মাদল। যেন অবশ করা ঘুম পাড়ানি বোল। সবকিছু দেখে মনে হলো ঘুঙুর আর মলের শব্দে ঢাকার চেষ্টা করছে অভাব আর জীবনের অপ্রাপ্তির ক্ষত। গাড়ি চলছে দু রন্তগতিতে । বেলপাহাড়ি-ঝিলিমিলি -বাঁশপাহাড়ী অতিক্রম করে রানীবাঁধের ১২ মাইল পেরিয়ে চলেছি। ঝিলিমিলি আর রানীবাঁধের পাহাড়ের পিছনে লাল রঙের পূর্ণিমার চাঁদ চুপিসারে উঠেছে, সবুজ অন্ধকারে। আমরা প্রায় বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছি। দুই দিনের প্রাপ্তির স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে বিভিন্ন জনপদভূমি অতিক্রম করছি। মন ভারাক্রান্ত। আবার সেই কেজো জীবনে প্রত্যাবর্তন। ঘড়িতে তখন রাত এগারোটা বেজে গেছে। মন জুড়ে একটা মুগ্ধতা ও বিষন্নতা। রাত বাড়ে, পাহাড়, জঙ্গল আর নদীর গান শেষ হয় না। আকাশ ভরা তারায় তারায় শেষ হলো জঙ্গল জীবনের বর্ণময় এক ভ্রমণের জীবন।

 

ডঃ সুবীর মণ্ডল
বাঁকুড়া, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত (গবেষক, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্প ও ভ্রমণ লেখক)

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top