কুয়াশার চাদর সরিয়ে : বটু কৃষ্ণ হালদার
প্রকাশিত:
২৮ এপ্রিল ২০২০ ২৩:২৫
আপডেট:
১০ জুন ২০২০ ২০:৪২

তখন আমার আস্তানা জঙ্গলের ভিতরে নদীর ধারে র বাংলো। এক সন্ধ্যাবেলায় বারান্দায় বসে আছি ।সামনে কুয়াশার চাদরে মোড়া অমাবস্যার জঙ্গল। কানে আসছে নদীর জলের আওয়াজ। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ভিতর হতে শিয়ালের হুক্কা হুয়ার ডাক ভেসে আসছে। ঘন জঙ্গল ভেদ করে শো শো করে বইছে হিমেল হাওয়া। সারা শরীরে কাঁপুনি ধরেছে। মনে হল জ্বরটা বাড়ছে। আমি বারান্দা থেকে ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। দরজাটা আলতো বন্ধ করে বিছানায় গিয়ে চাদর জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। গত দুই দিন ধরে বিদ্যুৎ নেই। তাই বৃন্দাবন হ্যারিকেনটা জ্বালিয়ে বাজারে গেছে আমার জন্য ওষুধ নিতে।বাংলোর কেয়ার টেকারটা আজ আবার ছুটি নিয়েছে। আমার কেমন ভয় ভয় করছে। কিন্তু এই অবস্থায় বৃন্দাবনের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু ছিল না। চোখটা জ্বালা করছিল, তাই চাদর মুড়ি দিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইলাম। আর মনে হরে কৃষ্ণ, হরে রাম জপতে থাকলাম। কখন যে চোখটা বুজে এসেছিল বুঝতে পারিনি। কে যেন আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকলো_ সুবিমল, এই সুবিমল
আমি ধর পড় করে জেগে উঠে বসলাম, ভাবলাম বৃন্দাবন ফিরে এসেছে। কিন্তু সামনে তাকিয়ে দেখি একটা মহিলা দাঁড়িয়ে। আমি চমকে উঠে বললাম কে?
কি রে ভয় পেয়ে গেলি যে, চিনতে পারলি না আমাকে?
আমি আধো আধো স্বরে বললাম না, আসলে বিদ্যুতের আলো নেই তো, চোখে চশমাটা ও নেই, তাই।
ভুলে যাবার তো কথা, তাই নয় কি? আমি ঈশিতা রে।
ঈশিতা, আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কিন্তু তুই এখানে?
হ্যাঁ, এমন তো কথা ছিল,
কিন্তু এত বছর পর, কিভাবে এখানে এলি? আর জানলি কিভাবে আমরা এখানে আছি?
সব উত্তর কি একসাথে নিবি? কিন্তু আমার কাছে এত সময় তো নেই এখন। বাজারে বৃন্দাবনের সঙ্গে দেখা হল, তুই অসুস্থ শুনে তোকে দেখতে এলাম। কিন্তু তুই কিভাবে আমাকে ভুলে গেলি বল?
আমি ভুলে গেছি? কলেজ শেষ করার পর তোর বাবা এসেছিল আমার কাছে,তোর সাথে দেখা করার চেষ্টা করলে সে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। একথা তুই জানতিস না?
না, আমি এসব কিছু জানতাম না বিশ্বাস কর। আমি ও ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে ঠকে গেলাম রে। আচ্ছা শোন আমি এখন আসছি, বাকিটা বৃন্দাবনের থেকে জেনে নিস।
আমি চমকে উঠলাম, বৃন্দাবনের থেকে জেনে নেবো মানে?
আমার বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত সবকিছুই বৃন্দাবন জানতো।
কই,বৃন্দাবন তো আমাকে কোনদিন কিছুই বলেনি।
আসলে মৃত্যু কালে আমার বাবাকে সে কথা দিয়েছিল, আমার কথা কোনদিন তোকে জানাবে না। আচ্ছা, আমি আজ আসি, আবার আসব ফিরে, আবার হয় তো দেখা হবে কোনোদিন।
এই বলে ঈশিতা হওয়ার আগে দরজা দিয়ে মিলিয়ে যায় কুয়াশার মেঘ সরিয়ে ওই দূরের জঙ্গলে
আমি কত ডাকলাম, ঈশিতা, ঈশিতা......
হঠাৎ করে ঘরের বিজলি বাতিগুলো জ্বলে ওঠে। আমি নিথর হয়ে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
ঘরের টেবিলে টিভি টা এমনি এমনি চলতে শুরু করে। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। স্টার আনন্দ চ্যানেল খবর চলছে। হেড লাইনে শুধুই দেখাচ্ছে মেদিনীপুরে বাস একসিডেন্টে বহু লোক মারা গেছে।
ইতিমধ্যে বৃন্দাবন আমার কাছে এসে দাঁড়ায়। আমার গায়ে হাত দিয়ে ডাকে সুবিমল। আমি চশমাটা পরে বৃন্দাবনের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
বৃন্দাবন জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে রে সুবিমল, শরীরটা খারাপ লাগছে?
আমি বললাম,ঈশিতা এসেছিল।
বৃন্দাবন পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছে নেয়। আবার আমার গায়ে হাত দিয়ে জ্বর মাপতে থাকে। তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে?
মাথা খারাপ কেন হবে?সত্যি কথা বলছি রে বন্ধু।
বৃন্দাবন বলে,আজ দুপুরে বাস এক্সিডেন্ট এ ঈশিতা মারা গেছে,আমি সেই খবরটা তোকে দেবো বলে দৌড়ে দৌড়ে এলাম। আর তুই বলছিস ঈশিতা এখানে এসেছিল?
আমি গায়ের চাদর সরিয়ে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম।
বটু কৃষ্ণ হালদার
কবরডাঙ্গা,কলকাতা
বিষয়: বটু কৃষ্ণ হালদার
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: