বেঁচে থাকার আকুতি : জাহানারা নাসরিন


প্রকাশিত:
২৬ আগস্ট ২০২০ ২০:৫১

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ১৯:৪৬

 

ঘরের দরজায় আওয়াজ করতেই দৌঁড়ে এলো মহুয়া। দরজাটা খুলতেই মাথায় যেন বাজ পড়লো। ঘরে চাল, ডাল, তেল, নুন হতে শুরু করে সকল খাদ্যসামগ্রীই ফুরিয়ে গেছে। সারাদিন কিছুই রান্না হয়নি। অথচ ঘরের একমাত্র কর্মক্ষম মানুষটি একেবারে খালি হাতেই ফিরে আসলো। মহুয়া একবার স্বামীর দিকে আরেকবার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দু'টো ছেলেমেয়ে আর বৃদ্ধ শ্বাশুড়িকে দেখে চোখ ফিরিয়ে নিল। ওদের ক্ষুধার্ত অসহায় চোখের এমন চাহনির সাথে খুব একটা পরিচিত নন মহুয়া। দিন এনে দিন খাওয়া সংসারে নিত্য টানাপোড়েন আর নিজেদের একটা স্থায়ী বাসস্থানের অভাব থাকলেও মহুয়াকে কখনও ভাতের অভাব দেখতে হয়নি।

 

অচেনা ভয় বুকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে প্রিয় স্বজনদের গায়ের সুবাসমাখা প্রাণের বাসভূম ছেড়ে ঢাকায় এসে প্রথম প্রথম নানান সংকটময় পরিস্থিতির শিকার হলেও ধীরে ধীরে শহরটা খুব চেনা আর আপন হয়ে উঠলো মহুয়ার কাছে। পোশাক শ্রমিক মহুয়া ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলেন চা দোকানদার জামিলকে। বিয়ের পর দু'টো সন্তান আর অসুস্থ শ্বাশুড়ির দেখাশুনা করার কথা ভেবে বছরখানেক আগেই পোশাক শ্রমিকের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল মহুয়া। 

 

সেমিপাকা দু'টো রুমের একটি বাসা ভাড়া করে মহুয়া কাঁচা হাতেই ঘুছিয়ে নিয়েছিল এই সংসার। বাসার পাশেই ছোট্ট পরিসরে পান-চায়ের দোকান ছিল জামিলের। পান-চা বিক্রি করলেও চলাফেরায় যথেষ্ট ভাব-গাম্ভীর্যের অধিকারী জামিলকে ভেতরে ভেতরে খুব সমীহ করেন মহুয়া।

 

করোনা কালের এই বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আয়ের একমাত্র উৎস চায়ের দোকানটি নিজ থেকেই বন্ধ রেখেছেন জামিল। সংসার খরচ থেকে বাঁচানো মহুয়ার কাছে যে ক'টা জমানো অর্থ ছিল তা শেষ করে বেচবে না বেচবে না বলেও গেছে সপ্তাহেই বেচে দিয়েছে পরম যত্নে তুলে রাখা স্বামীর দেয়া একমাত্র ভালোবাসার উপহার কানের দুলজোড়া। ভাবছিলেন এরই মধ্যে সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে হয়তো। শেষ হয়ে যাবে ঘরে থাকার দিন।

 

কিন্তু আজ যেন মহুয়ার তর সইছেনা। ক্ষুধার জ্বালায় উদর পুড়ে যাওয়া এক অন্য মহুয়াকে দেখছেন জামিল। ক্ষুধার দহনে রোদনশীল সবগুলো চোখ জামিলের দিকেই ঘুরে গেলো। দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে আজ নিজেকে বড্ড পরাজিত মনে হলো জামিলের। দৃঢ় মনোবলে নিত্য নতুন সংকট মোকাবেলার স্পৃহাটা আজ আর কাজ করছেনা। ক্লান্তিতে - অবসাদে চোখ বুজে আসছে। চারদিকে অমাবশ্যার ঘুটঘুটে আঁধার ঘনিয়ে আসতে দেখলেন জামিল। তবুও জীবনের কাছে, পরাক্রমশালী প্রকৃতির কাছে দিনশেষে অতটা সহজেই হেরে যেতে চান না জামিলরা। স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষ যেমন হঠাৎ করে স্মৃতি ফিরে পায় তেমনি চমকে উঠে জামিল বললো, 'তুমি কোন চিন্তা কইরোনা মহুয়া, এক্ষুনি যাইতাছি, তোমাগো জন্যে খাবারের ব্যবস্থা করতাছি।' মহুয়া তবুও কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছেনা নিজেকে। জামিলকে দেখলো দিকভ্রান্তের মতো একবার উত্তরে, একবার দক্ষিণে ছুটছেন। 

 

পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে আর কত সময় লাগবে? COVID-19 কে মানুষ কীভাবে জয় করবে? সামনে কী হবে? কীভাবে চলবে জীবন? জীবন যুদ্ধের অত শত নিয়ম জানা নেই মহুয়ার। কেবল হাত নেড়ে তাড়িয়ে দিতে চায় সকল অশুভকে। দু'টো খেয়ে স্বজনদের নিয়ে নিরাপদে বেঁচে থাকার মতো আগের সেই পৃথিবীটাকে ফেরত চায় মহুয়া।

 

জাহানারা নাসরিন, সহকারী শিক্ষক 
দক্ষিণ পশ্চিম চরফকিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়,
কোম্পানীগঞ্জ, নোয়াখালী। 

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top