হওয়ার ভেলায় একদিন : মোঃ ইয়াকুব আলী 


প্রকাশিত:
৮ এপ্রিল ২০২১ ১৯:৩৮

আপডেট:
১৫ মার্চ ২০২৫ ০৮:৩৯

ছবিঃ নেটের উপর বিশ্রাম নিচ্ছেন লেখকের দল

 

অস্ট্রেলিয়াতে পঞ্জিকা অনুযায়ী এখন চলছে স্কুল হলিডে। স্কুল হলিডের সাথে বোর্ডের ইস্টারের ছুটি মিলিয়ে আমরা বেশ কয়েকটা দিন একসাথে কাটানোর সুযোগ পেয়ে গেলাম। এইবার আমরা পরিকল্পনা করলাম একটা দিনের জন্য হলেও সিডনির সেন্ট্রাল কোস্টের 'ট্রি টপ' এ বেড়াতে যাবো। সেন্ট্রাল কোস্টের ট্রি টপ অবস্থিত ওয়ায়ং সাবার্বে। সিডনি থেকে এক ঘন্টার ড্রাইভ আর আমাদের বাসা থেকে দেড় ঘন্টার ড্রাইভ। আমরা আর আশফাক ভাইয়েরা মিলে পরিকল্পনা করে ফেললাম। সেই মোতাবেক একদিন সকালে রওয়ানা দিয়ে দিলাম। আমাদের গাড়িতে আমি, গিন্নী, মেয়ে তাহিয়া এবং ছেলে রায়ান আর আশফাক ভাইদের গাড়িতে আশফাক ভাই, দিশা ভাবী উনাদের মেয়ে আলিশা আর ছেলে দৃপ্ত।

দেড় ঘন্টার এই যাত্রাটা একটু বিরক্তিকর। শুরুতে মোটরওয়ে এম ৫ এবং এম ৭ হয়ে আসে নতুন টানেল 'নর্থ কানেক্স' তারপর শুরু হয় এম ১ মোটরওয়ে। এই দীর্ঘ সময়টায় ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখা ছাড়া তেমন কোন কাজ থাকে না তবে এম ১ ওঠার পর চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়। পাহাড় কেটে কেটে এই রাস্তাটা বানানো হয়েছে তাই রাস্তার দুপাশে চৌকিদারের মতো পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। ট্রি টপে পৌঁছে গাড়ি পার্ক করে আমরা কাউন্টারে গেলাম। এখানে পর্যাপ্ত পার্কিং আছে আর যাওয়ার আগে অনলাইনে টিকেট কিনে রাখা ভালো তাহলে আর কোনভাবেই টাইম স্লট মিস হবার সুযোগ থাকে না। নাহলে টাইম স্লট মিস হতে পারে যেমন এবার ইস্টারের ছুটির চাপে ক্রেজি রাইডারের কোন টাইম স্লট ফাঁকা ছিলো না। 

ছবিঃ ট্রি টপের প্রবেশ পথ 

এই ট্রি টপে মোট তিন ধরণের কার্যকলাপ আছে। ট্রি টপ এডভেঞ্চার, ট্রি টপ ক্রেজি রাইডার এবং ট্রি টপ নেটবল। ট্রি টপ এডভেঞ্চার হচ্ছে অনেক উঁচু গাছের উপরে দিয়ে এক গাছ থেকে অন্য গাছের দিকে ঝুলন্ত মইয়ে হেটে যাওয়া। আপনার যদি উচ্চতা ভীতি থাকে তাহলে এটাতে অংশ না নেয়ায় ভালো। ট্রি টপ ক্রেজি রাইডার বেশ সহজ। এখানে মোট দুটো লুপ আছে। গাছের উঁচুতে ঝুলানো রেলিংয়ের সাথে একটা ঝুলন্ত চেয়ার বেঁধে ছেড়ে দেয়া হয়। এই ঝুলন্ত রেলিংয়ের ঢাল এমনভাবে বজায় রাখা হয় যাতেকরে কেউ ঝুলন্ত চেয়ারে করে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় অনায়াসেই যেতে পারে। আর টি টপ নেটবলটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলি একটিভিটি। এখানে পুরো পরিবার উঠে আনন্দ করতে পারে তবে বাচ্চার বয়স অন্ততপক্ষে এক বছর হলে ভালো হয়।

ছবিঃ নেট বলের আনন্দ উপভোগ করছেন ভ্রমনকারীরা

আমরা এর আগেও একবার ওখানে গিয়েছিলাম তাহিয়া এবং রায়ানকে নিয়ে। সেবারও আমরা ট্রি টপ এডভেঞ্চার করতে পারিনি কারণ বাচ্চাদেরকে অন্ততপক্ষে একজন বয়স্ক মানুষের সুপারভিশন দরকার হয় কিন্তু তাহিয়া ক্রেজি রাইডারে উঠেছিলো। আর এইবার আমরা শুধু নেটবলেই উঠতে পেরেছিলাম। এডভেঞ্চার এবং নেটবল দুটোতেই মোটামুটি দু ঘন্টার একটা টাইম স্লট দেয়া হয় তবে ক্রেজি রাইডারে সময়ের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। রাইড শেষ করতে যতখানি সময় লাগে সেটুকুই। ক্রেজি রাইডারে গাছের উপর দিয়ে রেলিংটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। এটা নিচ থেকে দেখতে দারুন লাগে। তাহিয়া এটাতে রাইড করছিলো। আমি আর রায়ান নিচে দাঁড়িয়ে অবাক বিস্ময়ে দেখছিলাম কিভাবে সে এক গাছ থেকে অন্য গাছ এমনকরে ঘুরে ঘুরে পাতার আড়ালে হারিয়ে গেলো।

এইবার আমরা সবাই মিলে নেটবলের বুকিং করলাম। বুকিং শেষ হলে নেটবলে উঠার শুরুতে সবাইকে দাঁড় করিয়ে একটা ছোট ক্লাসের মতো নেয়া হয়। সেখানে বলে দেয়া হয় কি কি করা যাবে আর কি কি করা যাবে না। এরপর একটা একটা করে ধাপ পেরিয়ে গাছের উপরে একটা বেস স্টেশনে যেতে হয়। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন দিকে যাওয়ার রাস্তা আছে। এই রাস্তাগুলো দড়ির তৈরি জালের মতো। পা দিলেই পা দেবে যায় তাই আপনাকে একটু ব্যালান্স রাখতে হবে নাহলে পরে যাওয়ার সমূহ সুযোগ আছে। রায়ানের এইসব ব্যাপারে সীমাহীন উৎসাহ তাই তাকে সবার আগে যেতে দিতে হয় নাহলে সে আর যেতে চায় না।

শুরুতেই একটা বড় জায়গা সেখানে দুটো বড় প্লাস্টিকের বল রাখা। সবাই লাফালাফি করার পাশাপাশি এই বল ঠেলে একজন অন্যজনের গায়ে ফেলে দেয়। অনেকেই জালের উপর শুয়ে পরে তখন অন্যরা বল গড়িয়ে তাদের উপর দিয়ে নিয়ে যায়। নেটবলে উঠার শুরুতে দিশা ভাবি আর আমার গিন্নী রাজি না থাকলেও উপরে যেয়ে তারা ঠিকই উপভোগ করেছিলো। এরপরের জায়গাটাতে রাখা আছে বোলিংয়ের পিনের মতো দুটো প্লাস্টিকের বড় পিন যেগুলোর মধ্যে হাওয়া ভরা। সেটা নিয়ে কেউ মেকি মারামারি করে আবার কেউ সেগুলোর উপর চড়ে বসে। রায়ান সেগুলোর একটাকে ঘোড়া বানিয়ে চড়ে বসলো। এরপরের ঘরে অরে তিনটা দোলনা। সেখানে শুয়ে বা বসে বিশ্রাম নেয়া যায়। সেখানে এসে দিশা ভাবি আর আশফাক ভাই একটার মধ্যে বসে বিশ্রাম নিয়ে নিলেন।

তারপরেরতার মধ্যেও আছে প্লাস্টিকের মাঝারি আকৃতির বল এবং সংখ্যায় অনেক। এগুলো আকারে বেশ ছোট তাই পা দিয়ে লাথি দিয়ে সরানো যায়। আমরা সেগুলোকে লাথি দিয়ে বল বানিয়ে খেলা শুরু করলাম। তারপরেরটাই আছে একেবারে ছোট ছোট টেনিস বলের মতো প্লাস্টিকের বল বং সংখ্যায় অনেক। যেকোন বাচ্চা সেই প্লাস্টিকের বলের পুকুরে ডুব দিয়ে হারিয়ে যেতে পারে। রায়ান, তাহিয়া আর দৃপ্ত শেখেন যেয়ে ডুব দিলো। আমি খুঁজতে যেয়ে দেখি দৃপ্ত নেই। পরে ওর নাম ধরে ডাকলে ও বলের নিচ থেকে উত্তর দিলো। এছাড়াও এই জায়গাগুলোর মাঝ বরারব একটা বড় প্রশস্ত হাঁটার জায়গা। আমরা দলবেঁধে সেখানে দাঁড়িয়ে দৌড় প্রযোগিতায় নেমে পড়লাম।

ছবিঃ ভ্রমনের শেষে বিশ্রাম এবং স্ন্যাক্স খাওয়া

নেটবলের সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হচ্ছে এর উপর দিয়ে হাটা বা লাফানোর সময় আপনার মনেহবে আপনি মহাশুন্যের কোন মহাকাশযানে আছেন। আপনি মোটেও অভিকর্ষ  অনুভব করবেন না। পা দিলেই সেটা দেবে যাবে আবার পরমুহূর্তেই সেটা বাউন্স করবে। মনেহবে যেন আপনি যেন হওয়ার ভেলায় ভেসে বেড়াচ্ছেন। এই দৌড়ে একেবারে রায়ান থেকে শুরু করে সবাই অংশ নিলো। সবার অভিব্যক্তি দেখে মনেহচ্ছিলো সবাই যেন তাঁদের ছোটবেলায় ফিরে গেছেন যেখানে পাড়া বা মহল্লার মোড়ে দলবেঁধে সবাই একসাথে খেলাধুলা এবং দৌড়াদৌড়ি করতো। এভাবেই লাফালাফি, হাটাহাটি, দৌড়াদৌড়ি করতে করতে কখন যে আমাদের জন্য নির্ধারিত দুঘন্টা পেরিয়ে গেছে খেয়ালই করিনি কিন্তু অবশেষে নেমে আসতে হলো।         

নিচে এসেই আমরা সবাই ভ্রাম্যমাণ খাবার ভ্যান থেকে ঠান্ডা পানীয় নিয়ে নিলাম। আর অনেকেই ভ্রাম্যমাণ টয়লেটে গেলো। এরপর একটা টেবিলে বসে আমাদের সাথে নিয়ে যাওয়া খাবার খেতে বসলাম। এখানে গেলে খাবার সাথে করে নিয়ে যাওয়া ভালো কারণ ভ্রাম্যমাণ খাবার দোকানে স্ন্যাকস ছাড়া তেমন কিছুই পাওয়া যায় না। এতে আপনার তৃষ্ণা মিটলেও ক্ষুধা নিবৃত হবে না। আর একটা ব্যাপার লক্ষণীয় সেটা হলো এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুবই দুর্বল তাই গ্ৰুপে গেলে আগে থেকেই কর্ম পরিকল্পনা করে নেয়া যুক্তিযুক্ত। 

এখানকার রাইডগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে অবধারিতভাবেই এগুলোকে আপনাকে আবার আপনার শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে। নতুনভাবে নিজের ভেতরের শিশুটাকে আবারো আবিষ্কার করবেন। আর উত্তেজনাগুলো দৈনন্দিন জীবনের ক্লান্তিকে ধুয়ে মুছে নিয়ে যাবে। এখান থেকে বের হবেন একেবারে নতুন একটা মন নিয়ে। দিন শুরু করতে পারবেন একেবারে নতুনভাবে। আর বাচ্চারা বয়ে নিয়ে আসবে নতুন সব স্মৃতি। তাই আর দেরি কেন আজই বেরিয়ে পড়ুন ট্রি টপ সেন্ট্রাল কোষ্টের উদ্দেশ্যে আর একটা দিনের জন্য হলেও নিজেকে ভাসিয়ে দিন হওয়ার ভেলায় আর ভুলে যান দৈনন্দিন জীবনের যাবতীয় দুঃখ কষ্ট।

 

মোঃ ইয়াকুব আলী 
সিডনি অস্ট্রেলিয়া

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Top