সিডনী মঙ্গলবার, ১৯শে মার্চ ২০২৪, ৫ই চৈত্র ১৪৩০


লাল শাড়িটি : নুসরাত সুলতানা


প্রকাশিত:
১৯ জুন ২০২১ ১৯:৫৭

আপডেট:
২৬ জুলাই ২০২১ ১৮:৩৭

 

সারাবাড়ি জুড়ে  খুশি আর আনন্দের আবহ চলছে। চাচা -চাচী চাচাতো ভাই -বোন সবাই আজ খুবই খুশি। নীরু আসবে আজ বরকে নিয়ে বেড়াতে। পাঁচ ভাইয়ের ভেতর নীরু বড় ভাই রফিক চৌধুরীর মেয়ে। এর আগে দুই প্রজন্মে কোনো মেয়ে ছিল না। নীরুর দাদী স্কুলে যাওয়া মেয়েদের ডেকে চুল আঁচড়ে দিতেন। তারপর নীরু যখন জন্মালো হয়ে উঠল একেবারে ননীর পুতুল। তারপর যদিবা ছোট ভাই ছাড়া সকলেরই মেয়ে হয়েছে কিন্তু নীরুর জায়গা আর কেউ নিতে পারেনি। বাবা-চাচারা নীরুকে ডাকে মনু। প্লেট থেকে মুরগির পা,পাখা, গিলা তুলে খাওয়ায়। এতে অবশ্য কেউ কেউ বেশ ঈর্ষান্বিত।

বিশেষ করে মেজ ভাইয়ের মেয়েরা এবং মেজ ভাই।

নীরুকে যখন শ্বশুর বাড়ি তুলে নেয়া হয়েছিল চাচীদের প্রতিযোগিতা লেগে গিয়েছিল; কে কি পদ বানাবে কেউ বানায় করল্লার মোরোব্বা কেউ বানায় চন্দ্রপুলি কেউবা বানায় চিংড়ি কাবাব, কেউ বানায় কচুর পিঠা, কেউবা নানা পদের  হালুয়া। 

নীরুর বিয়ে হয়েছিল একটু বেশি বয়সে। এত আদরের মেয়ের জন্য পাত্র পছন্দ হচ্ছিল না বাবা চাচাদের। জামিল তালুকদার পটুয়াখালী ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী অধ্যাপক। 

পাঁচ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা। গায়ের রঙ ধবধবে শাদা। এই পাত্রকে নিয়েও যখন বাবা চাচাদের দ্বিধা, দ্বন্দ্ব তখন জামিল তালুকদার বলেছে, আপনাদের শ্যামলা মেয়ে আমার কাছে বিয়ে দেবেন না কেন?

পাত্রের এই আত্মবিশ্বাস ভালো লেগে যায় বাবা আর চাচাদের।

বিয়ের পরে নীরু আর জামিল প্রথম আসছে দাদা বাড়ি। নীরুর বাবা পটুয়াখালি শহরের  খাদ্য পরিদর্শক সেখানে ই হয়েছে সব অনুষ্ঠান।   এবারই প্রথম বংশের বড় মেয়ে দাদাবড়ি এসেছে জামাই নিয়ে। সমস্ত বাড়িতে একেবারে ঈদের আমেজ। একেকদিন একেক চাচার ঘরে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন।

পাঁচ ভাইয়ের ভেতর মধ্যবর্তী তিন ভাই গ্রামের বাড়িতে বসবাস করেন; মেঝ, সেঝ, আর নোয়া ভাই। বড় ভাই পটুয়াখালী শহর আর ছোট ভাই থাকেন কুষ্টিয়া শহরে। সেঝ আর নোয়া চাচার ঘরেই আয়োজন বেশি নীরু আর তার বর আসা উপলক্ষে। মেজ চাচার ঘরেও দাওয়াত হয় কালেভদ্রে।  

সোনা চাচা আর সোনা চাচীও বেশ কাজে হাত লাগায় প্রতিদিন। সোনা চাচা আর সোনা চাচী বড় ভাইয়ের গ্রামের ঘরে আশ্রিতা থাকেন। সোনা চাচা, সোনা চাচীর চেয়ে বয়সে বেশ বড়। সোনা চাচার চোখগুলো কোটরে ঢুকে গিয়েছে, গাল ভাঙা, থুতনির নীচে অল্প কয়েকটি কাঁচাপাকা দাঁড়ি।

সোনা চাচীর গায়ের রঙ উজ্জ্বল নয় কিন্তু মসৃণ ত্বক, বড় চোখ, চ্যাপ্টা ঠোঁট এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা ছড়ায়। পাঁচ ফুট উচ্চতার সোনা চাচী খুবই মিষ্টভাষী। সোনা চাচা আর সোনা চাচীর জীবনের চাহিদাও খুব কম। সোনা চাচা গ্রামের বিভিন্ন মানুষের গোল পাতার আর ছনের চালা ছেয়ে(বানিয়ে দেন) আর তাতেই টোনাটুনির সংসার বেশ চলে। কারণ তারা নিঃসন্তান আর চাহিদাও খুব কম। 

সেদিন ছিল নোয়া চাচা মানে আউয়াল চৌধুরীর ঘরে সবার দাওয়াত। সবাই সকাল থেকে খুশি মনে রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে। নীরুর বর জামিল তালুকদার বাড়ির বড় পুকুরে জাল ফেলে ধরেছে চার কেজি ওজনের রুই মাছ, পাঁচ কেজি ওজনের কাতলা, ছোট বড় ওজনের মৃগেল মাছ। মাছ ধরার জন্য বানানো হয়েছে কলা গাছের ভেলা। ছোটরা তাতে  চড়ে  বেশ আনন্দ কুড়াচ্ছে। সবাই হাতে হাতে বানাচ্ছে চালের রুটি, রান্না হচ্ছে রাজহাঁস,  মাছ, পোলাও, মুরগী,  চিংড়ি, পিঠা, পায়েস। গোসল সেরে নীরু পরেছে একটা লাল সুতি শাড়ি।  লাল জমিনে হলুদ আর ফিরোজা ব্লু ডালিয়া ফুলের ছাপা শাড়িটিতে। পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি লম্বা, কোঁকড়া চুল আর বড় চোখের নীরুকে দেখছে আর  ছোট বোনরা বলছে, আর বড় আপা আপনাকে কি সুন্দর লাগছে!  নীরু অমলিন হাসি হাসে। বাড়ির পুরুষদের খাওয়া হলে মেয়েরা খেতে বসেছে। খেতে বসেই বোনরা পরিকল্পনা করে; বিকেলে যাবে কীর্তনখোলা নদীর পাড়ে সবাই মিলে। 

সময়টা ছিল আশির দশক। এনালগ ক্যামেরায় ছবি তোলারও পরিকল্পনা করে তারা। বাড়ির দু একজন ছেলে ততদিনে চলে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। নদীর পাড়ে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুতি নেয়ার জন্য কাপড় বদলায়। কাপড় বদলে নীরু একটি নীল কাতান শাড়ি পরে আর  লাল শাড়িটি শুকাতে দেয় বাড়ির উঠানে। 

 সব বোনেরা লিপষ্টিক, চুড়ি আর টিপ পরে বেশ সাজগোজ করে বেড়াতে যায় নদীর পাড়ে। মেঝ চাচার কোনো মেয়েই গেল না। নদীর পাড় হয়ে গ্রামের স্কুল ঘরে যেয়ে চা, বিস্কুট খেয়ে সবাই যখন সন্ধ্যায় হুড়োহুড়ি করে বাড়ি ফেরে তখন নীরু এসে আর তার লাল শাড়িটি উঠানে দেখতে পায় না। মাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে ; আম্মা আপনি আমার শাড়ি উঠাইছেন ঘরে? নীরুর মা বলে না তো। শুরু হল লাল শাড়ির খোঁজাখুঁজি। রাতে পুরো বাড়ি ছড়িয়ে পরল; নীরুর লাল শাড়িটি পাওয়া যাচ্ছে না। আনন্দমুখর পরিবেশে নিমিষেই ছড়িয়ে পরে বিষাদের আবহ। 

সকালে উঠে শুরু হয় ব্যাপক খোঁজাখুঁজি। কারণ মেয়ের বিয়ের শাড়ি হারিয়ে যাওয়া খুব অমঙ্গলের কথা। তাছাড়া দাদা বাড়ি এসে শাড়ি হারালে নীরু জামিলের কাছে মুখ দেখাবে কি করে! শুরু হয় ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ। সবার আগে জিজ্ঞেস করা হয় বড় চাচার কাজের মেয়ে সকিনা কে। ওকে বলা হয় তোকে দুইটা শাড়ি কিনে দেয়া হবে তুই ভুলে লুকিয়ে রাখলে দিয়ে দে। সকিনা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলে বড়াপার শাড়ি মুই ক্যা নিমু? মুই কোনোদিন কিছু নিছি? আর আব্বায়(বড় চাচা) মোরে নিজের মাইয়ার মতো ভালোপায় মুই কোনোদিন ও এইরহম কাম করতে পারি না। এরপর জিজ্ঞেস করা হল সোনাচাচা আর সোনাচাচীকে তাদের এক উত্তর  গরীব অইতে পারি খাইট্টা খাইতে পারি কিন্তু মোরা চোর না। লাগলে মোগো বিছানা -বালিশ  সব তালাশ কইররা দেহেন।

বাড়ির ওপর বসবাস করা বংশীয় ফুপু বল্ল;

এক কাজ কর স্কুল ঘরের মসজিদের হুজুর কে এনে বাটি চালান দাও। বাটি ঘুরতে ঘুরতে এসে চোরের কাছে থামবে। আনা হল হুজুর কে। বাড়ির ফুটবল মাঠের মতো বিশাল উঠানে দাঁড় করানো হল ছোট বড় সবাইকে। ভয়ে, উত্তেজনায় সবার মুখ শুকিয়ে গেছে। কার কাছে যেয়ে বাটি থামবে!

বাটি কেবল ঘুরতেই থাকল; থামলোনা কোথাও।

হুজুর বললেন; চাল আনো চাল পরা দেব। চাল মুখে নিলেই চোরের মুখ থেকে রক্ত বেরুবে। সবাই

ওযু করে এসে সবাই বিসমিল্লাহ বলে চাল মুখে দেবে। নাতিদীর্ঘ, ছাগল দাড়িওয়ালা হুজুর একদম ধ্যানমগ্ন হয়ে দোয়া পড়ে ফু দিলেন বড় এক গামলা চালে।হুজুর বললেন, বাড়ির কেউ বাদ যেতে পারবে না। ছোটরা এবার প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে, যদি মুখ থেকে রক্ত পরে!

ছোটদের বোঝানো হল, তোমাদের কিছু হবে না।কারণ তোমরা তো নাওনি। বাড়ির সবাই চাল পরা খেল কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মেজ চাচা খেলেন না। উনার এক কথা এইসব বুজরুকিতে আমার কোনো বিশ্বাস নেই। আমি কি চোর!

দুপুরের পর এক ভীষণ অপ্রত্যাশিত ঘটনা শুরু হয়। মেজ চাচা, সোনা চাচা আর সোনা চাচীকে প্রহার করা শুরু করলেন। শুধু বলছেন; স্বীকার কর যে, তোরা শাড়ি নিছিস। স্বীকার করলে ছেড়ে দেব কিছু বলব না। কিন্তু স্বীকার করতে হবে। ৫ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা মেজ চাচার বই পড়া আর দুর্বলকে অত্যাচার করা দুইই খুব প্রিয়। অবশ্য গরীব সুন্দরী নারীদের তিনি সাহায্য নিতেও আহবান জানান। যদিও চাচীকে পাঁচ মেয়ে আর দুই ছেলের সংসার অনেক সময়ই ধনী বাবার বাড়ি থেকে চাল-ডাল, টাকা-পয়সা এনে সামলাতে হয়।

প্রহার করতে করতে যখন নিজেই ক্লান্ত হয়ে যান তখন সোনা চাচা, সোনা চাচী বসে কাঁদেন। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে ছিল সর্বহারাদের দাপট। আর মেজ চাচা ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। এলাকার সবাই তাকে সমীহ করত। তাছাড়া অন্য ভাইয়েরা তার বদমেজাজ সম্পর্কে জানত। তাই  যে কেউই তার সামনে যেতে বিরক্ত বোধ করত। চিকন লাঠি দিয়ে দিয়ে মেরে কয়েকটা লাঠি ভেঙেছেন। এরপর বাঁশ দিয়ে বাড়ি দিলে সোনাচাচীর কপাল ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসে। এবাএ ক্ষেপে যান বড়চাচা। ধমক দিয়ে বলেন তোকে কে বলেছে শাড়ি উদ্ধার করতে? আমি নীরুকে তিনটা লাল শাড়ি কিনে দেব। জামিলও এসে বলে চাচা গরীবকে এইভাবে অত্যাচার করে! কি প্রমাণ আছে আপনার কাছে যে উনারাই শাড়িটি নিয়েছেন? সবাই প্রতিবাদে ফুসে উঠলে মেজ চাচা লাঠি ফেলে ঘরে চলে যান। সোনা চাচা আর চাচীও বেরিয়ে যান নীরুর দাদা বাড়ি থেকে। 

বাড়ির ছোটদের খুবই মন খারাপ হয় সোনা চাচা আর চাচীর জন্য। বড়দের মনেও বেশ দাগ কাটে ঘটনাটি।

সোনা চাচা আর চাচীর সঙ্গে রাস্তা ঘাটে দেখা হলে ছোটদের সাথে কথা বলত। এলাকায় বেশ একটা চাপা ক্ষোভ সবার ভেতরেই ছিল। কিন্তু প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কেউই কিছু বলতে সাহস করেনি।

এর এক বছর পর নীরুর সেজ চাচা হাফিজ চৌধুরীর বড় মেয়ের বিয়ের জন্য দাওয়াত দিয়ে যায় মেজ চাচার বড় মেয়ে এষার স্বামীর বাড়ি সাগরদিতে। এষার বাড়ির উঠানে একটা লাল শাড়ি ঝোলানো। শাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে হাফিজ চৌধুরী স্তব্ধ হয়ে যান। তার চোখে ভেসে ওঠে সোনা চাচীর ফাটা কপাল থেকে ঝরে পড়া রক্ত, শাড়িটি পরিহিত নীরুর খুশি খুশি মুখচ্ছবি। আবার আকাশ -পাতাল ভাবেন একইরকম শাড়িতো হতেই পারে। 

এমন সময় বেরিয়ে আসে এষা। হাসিমুখে বলে, আরে সেজকাকু আসেন। বাড়ির সবাই ভালো আছে? হাফিজ চৌধুরী বলেন হ্যাঁ মা ভালো। তোমরা ভালো আছ? এষা বলে শুকরিয়া কাকু। 

আপনি বসেন, আমি একটু চা বানাই। সদর দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এষা চলে যায়। ফিরে আসে কাজের মেয়ে কয়েকরকম মিষ্টি, ফল, কেক, দামী বিস্কুট ইত্যাদি নাশতা নিয়ে। এষা বলে, কাকু আজ থেকে যাবেন। আপনার জামাই আসতেছে। চলে গেলে আমাকে বকা দেবে খুব। হাফিজ চৌধুরী ঘরে চোখ বুলিয়ে দেখেন ; ঘরে দামী সোফা, টিভি, ফ্রিজ আসবাবপত্র সবই আছে। হাফিজ সাহেব আলোর জন্য বা কি ভেবে খুলে দেন সদর দরজা। কিন্তু লালশাড়িটি দেখা গেল না। দ্বিতীয়বার অন্তর্ধান হল লাল শাড়িটি।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top