সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৫ই বৈশাখ ১৪৩১

ফেদারডেল ওয়াইল্ড পার্ক

নিলাম্বরী অস্ট্রেলিয়া (দ্বিতীয় পর্ব) : শাহান আরা জাকির


প্রকাশিত:
২৮ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৪৭

আপডেট:
৩১ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৪:৫৮

ছবি: শাহান আরা জাকির পারুল

 

ক’দিন রেস্ট নেয়ার পর রবিবার ছুটির দিন আমরা ফেদারডেল ওয়াইল্ড পার্ক এ যাবো সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।যেকোন চিড়িয়াখান দেখার বিষয়ে আমার দারুন আগ্রহ আছে।
আমরা যখন অস্ট্রেলিয়াতে আছি তখন বেশ ঠান্ডা চলছে।সব্বাই শীতের কাপড় জড়িয়ে গাড়িতে উঠলাম।আমাদের বাসা থেকে খুব বেশি দূরে নয় ফেদারডেল পার্ক।
ফেদারডেল ওয়াইল্ড পার্ক এর অবস্থান ব্ল্যাক টাউনের কাছে কিলডেয়ার রোড(Kildare Road)ডোন সাইড -এ।
পার্কের কাছে এসে খুব আশ্বস্ত হলাম।
কেননা ওয়াইল্ড লাইফ পার্ক বলে আমি ভেবেছিলাম,হয়তো
কোন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আমাদের হেটে হেটে যেতে হবে।আমার ধারনা ভূল ছিলো।
এখানে তেমন কোন জঙ্গলই নেই।
সামনে বিশাল চত্ত্বর।চমৎকার কার পার্কিং এর জায়গা।সবকিছু গোছানো ছিমছাম।রয়েছে চমৎকার স্থাপনা।
আমরা বেশকিছু ছবি তুললাম সবাই। বেটা গেলো পার্কের ভেতরে ঢোকার টিকেট কাটতে।
লোকজনের খুব একটা ভিড় নেই। কিন্তু টিকিটের দাম বেশ চড়া।আমার কেমন অস্বস্তি অস্বস্তি লাগছিল।এতো দাম দিয়েটিকেট কাটছে বেটা।
আমরা ওয়াইল্ড পার্কে ঢুকে পড়লাম।
ঢোকার পথেই নানারকম পাখির কিচিরমিচির ও বিভিন্ন পয়েন্ট এ পাখিদের দৃষ্টিনন্দন মুর্তি দেখতে পেলাম।কিছুদুর যেতেই একপাল ক্যাঙ্গারু হেটে বেড়াচ্ছে দেখেই তাসুমনি টুনটুনিসহ আমরা সব্বাই খুব উৎফুল্ল হলাম।ছবি তোলার জন্য এগিয়ে গেলাম ক্যাঙ্গারুর দিকে।বেশি বিরক্ত করলে ক্যাঙ্গারু অন্যদিকে হাঁটা দেয়।
সাইনবোর্ডে দেখলাম এখানে রক (Rock)ক্যাঙ্গারু ও ওয়ালাবি( Wallaby) ক্যাঙ্গারুসহ বেশ কয়েকজাতির ক্যাঙ্গারু আছে।প্রাণী হিসেবে ক্যাঙ্গারু নিরীহ একটি প্রাণী।
অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় প্রাণী ক্যাঙ্গারু!
ক্যাঙারুরা প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর আগে, মায়োসিন যুগে, অস্ট্রেলিয়ায় আসে। বর্তমানে সেখানে সাড়ে তিন কোটি ক্যাঙারু আছে।
ক্যাঙারু মারসুপিয়াল গোত্রের এক প্রকারের স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের বাচ্চারা মায়ের দুধ পান করে বড় হয়।

ক্যাঙারু শুধু অস্ট্রেলিয়া এবং তার আশপাশের দ্বীপগুলোতে দেখা যায়। এরা পিছনের দুই পায়ের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলে।

লাল ও ধূসর ক্যাঙারু আকারে সবচেয়ে বড় হয়। এরা লম্বায় ২ মিটার দীর্ঘ এবং ৮৫ কেজি ওজনের হতে পারে। সবচেয়ে ছোট ক্যাঙারু হলো ইঁদুর-ক্যাঙারু। এরা লম্বায় লেজ বাদে এক ফুটের মতো হয়।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, সুদূর অতীতে ক্যাঙারু আকারে অনেক বড় ছিল। ওজন ছিল প্রায় ২০০ কেজি।

ধারণা করা হয়, ক্যাঙারুরা প্রায় ১৫ মিলিয়ন বছর আগে, মায়োসিন যুগে, অস্ট্রেলিয়ায় আসে। বর্তমানে সেখানে সাড়ে তিন কোটি ক্যাঙারু আছে।

তৃণভোজী এই প্রাণীটি ঘাস, লতাপাতা খেয়েই বেঁচে থাকে।

এদের সামনের পা দুটি ছোট, পেছনের দুই পা বড়। লম্বা লেজে ভর করে চলে। সাধারণত লাফিয়ে লাফিয়েই চলে।
ক্যাঙ্গারুর মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে,এরা দীর্ঘ লাফের জন্য চ্যাম্পিয়ন।
একটি পূর্ণবয়স্ক ক্যাঙারু ৩০ ফুট পর্যন্ত লাফাতে পারে। এদের লাফানোর গতি চিতাবাঘের চেয়েও বেশি। এভাবে এরা এক দিনে ৪৮ কিলোমিটার পর্যন্ত লাফিয়ে চলতে পারে। লাফানোর সময় এদের লেজ শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখে।

পৃথিবীর অন্য প্রাণী থেকে ক্যাঙারুর আলাদা বৈশিষ্ট্য হলো এদের থলে। মেয়ে ক্যাঙারুর পেটের কাছে বড় আকারের একটি থলে থাকে। এই থলেতে তারা বাচ্চা বহন করে। বাচ্চা ক্যাঙারুর থলেতে থাকতে পারে প্রায় চার মাস বয়স পর্যন্ত।
বলে রাখা ভালো মানূষের যেমন মনমেজাজের ব্যাপার রয়েছে,ঠিক তেমনি ক্যাঙ্গারুর ও নিরীহ স্বভাব হলেও কোনকারনে অসহ্য হয়ে ক্ষেপে গেলে খুনখারাবিসহ অনেক ভয়াবহ ঘটনা তারা ঘটিয়ে ফেলতে পারে।
কেননা বেশ কিছুদিন আগে পত্রিকায় বেরিয়েছিল,
ক্যাঙ্গারুর হামলায় এক বৃদ্ধ অষ্ট্রেলিয়ান মহিলা জখম হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন।
কিছুদুর যাওয়ার পর দেখলাম, বেশ কিছু বেশকিছু ক্যাঙ্গারু খোলা জায়গায় ঘুরাঘুরি করছে। শুয়ে বসে কেউ বিশ্রাম করছে।পাশেই ক্যাঙ্গারুদের জন্য খাবার বিক্রি হচ্ছে।টুরিস্টদের কেউ খাবার কিনে খাওয়াচ্ছে দেখে আমরাও খাবার কিনে ওদের খাওয়ালাম। তিন চারটে ছোট বড় ক্যাঙ্গারু খুব শান্তশিষ্টভাবে খেল। আমরা সেটা ক্যামেরাবন্দি করে রাখলাম।
এরপর একটু সামনে এগিয়ে গেলাম।এখানে সব কোয়ালা রয়েছে। কোয়ালা অস্ট্রেলিয়ার আর একটি উল্লেখযোগ্য প্রানি।খুব শান্ত ও নিরীহ সভাবের।নড়াচড়া খুব একটা করেনা। নবাবের মতো লেদু হয়ে বসে থাকে।
এই জোনে দেখলাম বেশিরভাগ স্টাফ মেয়ে। তারা কোয়েলাকে আদর করে গাছের ডালে বসিয়ে দিছছে।পর্যটকরা মজা করে কেউ কেউ ছবি তুলছে।
জানলাম প্রায় সাত একর জায়গার উপর এই প্রাইভেট পার্কে শুধুমাত্র অস্ট্রেলিয়ান প্রাণীদেরই আবাস এতা।তাও সংখ্যায় খুবই কম।এখানে কোন বাঘ,ভল্লুক, সিংহ এসব নেই।
ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম আর একপাশে পার্কের ভেতর অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ইমুপাখি পার্কের ভেতর মানুষের সাথে সাথে হাঁটাহাঁটি করছে।এদের আকৃতি বিশাল। এরা পাখি হলেও উড়তে পারেনা। এরাও নিরিহ গ্রুপের পাখি।
এক জোন থেকে আর এক্তা জোনের মাঝখানে ছোট ছোট গেত বসান। প্রানিরা ছাড়া থাকলেও তারা যেন এক জায়গা ছেড়ে আর এক জায়গায় না যেতে পারে ।কিছুদুর পর আমরা স্নেক এরিয়াতে এসে পরলাম। বিশাল আকৃতির অজগর ও বিভিন্ন প্রজাতির স্নেক দেখেতো আমি ভয়ে শিউরে উথলাম।কিন্তু তাসুমনি ঐ শিশু বাচ্চা স্নেক এর গায়ে হাত দিয়ে আদর করতে গেল।আমি ভয়ে টান দিয়ে নিয়ে আসলাম। ওখান থেকে আমরা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলাম। এখানে অসংখ্য নানা প্রজাতির ময়ুর ঘুরাঘুরি করছে। আমাদের খুব কাছে এরা চলে আসছিল। পেখম মেলে কেউ কেউ নাচানাচি করছিল। এই জোনের পাশেই বসবার জায়গা ছিল। আমরা সঙ্গে নিয়ে আসা কিছু হাল্কা খাবার এখানে বসে খেয়ে নিলাম।
এরপরেই আমরা ডিঙ্গো(Dingo)নামের এক কুকুরের খাঁচার পাশে চলে এলাম।এই কুকুর খুব হিংস্র প্রকৃতির। একে গ্রিলের ভেতর বন্দি করে রাখা হয়েছে।মাথার ওপর দিয়ে একটা পাখি উড়ে যাচ্ছিলো দেখে ডিঙ্গো ওখান থেকেই লাফ দিয়ে পাখিটিকে তাড়া করছিল।
কিছুদুর যেতেই সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে তাসমানিয়ান ডেভিল(Tasmanian Devil)।এটা অস্ট্রেলিয়ার একটা হিংস্র জানয়ার। প্রাণীটি যেমন নামে শয়তান ,তেমন দেখতেও খুব কুতসিত।আচরণেও ভয়ঙ্কর হিংস্র ও শয়তান। পরিচিতিমূলক সাইনবোর্ডে এসব কথা লেখা ছিল।
এরপর কিছুদুর পর ছিল বাদুরের খাঁচা। আমরা ওদিকে আর এগুছছিলাম না।কিন্তু বেশ কিছু টুরিস্ট এর ভিড় দেখে একটু দারালাম। দেখলাম টিশার্কাট পরা কালো চামড়ার এক ছেলে বাদুর বিষয়ে বয়ান করছে। আর টুরিস্টরা খুব মন দিয়ে সে বয়ান সুঞ্ছে।মনে মনে ভাব্লাম, বাদুর বাংলাদেশে বর্তমানে নিপা ভাইরাস এর বাহক।ভদ্রসমাজ এসব নিপা ভাইরাসকে দারুন ভয় পায়। এটা শুনলে হয়তো এরা এখুনি দৌড়ে পালাবে।
এরপর আমরা এলাম যেখানে, সেখানে বিশাল আকৃতির কুমির ছিল।কুমিরটি মূর্তির মত হা করে ছিল।তার এই ভয়ানক আকৃতি দেখে খুব ভয় পাছছিলাম।এর মধ্যে তাসুমনি ও টুনটুনি দুই পুচকা কুমিরের কাছে যাওয়ার জন্য কান্না জুড়ে দিল।আমরা টেনে নিয়ে এলাম।
আরও খানিকটা জায়গা পার হয়ে ছোট একটা মাঠের মত জায়গায় দেখলাম ছাগল ও ভেড়া রাখা আছে।সাথে ফান করার জন্য খরগোশ ও শুকরের রঙিন কার্টুন বরদ।পর্যটকরা ওখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।তাসুমনি ও টুনটুনিকে নিয়ে আমরা সেখানে গেলাম।খুব মজা পেল তারা দুজনেই কার্টুন বোর্ড দেখে।তারা ওখানে দাড়িয়ে ছবি তোলার জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরল। তাদের সাথে সাথে আমরাও ছবি তুললাম।
এরপর আর দেখার কিছু ছিলনা।
আমার পরানবন্ধু ও তার আর্টিফিশিয়াল পা পরে হেঁটে হেঁটে খুব টায়ার্ড হয়ে পরেছিল।
আমরা সবাই ওখান থেকে বেরিয়ে এলাম।
(চলবে)

নীলাম্বরী অস্ট্রেলিয়া (প্রথম পর্ব)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top