অবশেষে বাটু কেভ (Batu Caves) : মালয়েশিয়া ভ্রমণ - আনিসুল কবীর
প্রকাশিত:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০১:০৪
আপডেট:
১৩ এপ্রিল ২০২০ ০৩:০৯
আজ থেকে অনেক অনেক দিন আগে আমি প্রথম বাটু কেভের ছবি দেখি। সম্ভবত ১৯৯৬ সালে। সেই বছরে আমার বড় আপা আর বড় দুলাভাই চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলো। আসার পথে উনারা ৩-৪ দিন মালয়েশিয়ায় ঘুরাঘুরি করে এসেছিলেন। সে সময় সবাই ফিল্মের ক্যামেরায় ছবি তুলতো এবং সেই সব ছবি কাগজে প্রিন্ট করা হতো। উনাদের মালয়েশিয়া ট্যুরের ছবিতে অদ্ভূত সুন্দর আর বিশাল এক গুহার ছবি দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এতবড় আর অদ্ভূত কিম্ভূতাকার কোন পাহাড়ী গুহা যে হতে পারে সে সময় আমার কোন ধারনাই ছিলো না। আর তখন ক্যাবল টিভি থাকলেও জিটিভিতে ফিলিপস্ টপটেন টাইপ প্রোগাম ছাড়া দেশ বিদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার কোন চ্যানেল ছিলো না।
এছাড়া ইন্টারনেটও ছিলো না। ফলে পৃথিবীর সুন্দর জায়গা আর বিভিন্ন দেশের ছবি বা তথ্য আমাদের জন্য সহজলভ্য ছিলো না। দেশ হিসাবে মালয়েশিয়া সম্পর্কে আমার ধারনাও ছিলো অনেক কম। বড় আপাদের প্রিন্ট করা ছবিতে মালয়েশিয়ার অনেক সুন্দর সুন্দর ছবি দেখে মালয়েশিয়া সম্পর্কে ধারনা খুব উচুঁ হয়েছিলো তখন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে সেই গুহার ছবিগুলোই মাথায় বেশি স্থায়ী হয়েছিলো।
তারপর অনেক সময় পার হয়েছে। পৃথিবীর অনেক পর্যটন প্রিয় দেশ আর স্থান সম্পর্কেই এখন আমার মোটামুটি ধারনা হয়েছে। মালয়েশিয়াতেও ৩ বার ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছি গত আট বছরে। প্রথম দুই সফরে দেশটির পর্যটনপ্রিয় বেশ কিছু মার্কামারা শহর আর জায়গাও দেখার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু সেই অবাক করা গুহায় আর যাওয়া হয়নি। তবে ২০১৯ এর অক্টোবরে সর্বশেষ মালয়েশিয়া ভ্রমণে অপেক্ষার অবসান ঘটেছে। একা একা আরাম করেই দেখে এসেছি দুইযুগ অপেক্ষার সেই আরাধ্য প্রাকৃতিক আশ্চর্য বাটু কেভকে।
অনেকে হয়তো ভাবতে বসেছে মালয়েশিয়ার এতো সুন্দর আর বিখ্যাত জায়গা রেখে বাটু কেভ বা বাটু গুহা নিয়ে এতো আদিখ্যেতার কারন কি? কারন আর কিছুই না, কারণ সেই ২৪-২৫ বছর আগের স্মৃতি। আর আমি ঠিক করেছি মালয়েশিয়ার অন্য জায়গা নিয়েও আলোচনা করে ফেলবো এই লেখায় এবং ধারাবাহিক অন্য লেখাতে। তার আগে বলে নিতে চাই বাটু কেভ বা Batu Caves আসলে একটি প্রাকৃতিক গুহা নয়। এখানে বেশ কিছু গুহা আছে। যদিও এসব গুহা প্রাকৃতিক ভাবে তৈরী এবং সৌন্দর্য মন্ডিত তদুপরি এখানে বেশ কিছু হিন্দু মন্দীর থাকায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থও বটে। এছাড়া ২০০৭ সালে বাটু কেভের মুখে পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ লর্ড মুরুগান বা কার্তিক দেবের মূর্তি স্থাপন করা হয়। মূর্তির উচ্চতা ১৪০ ফুট। এছাড়া বাটু কেভে উঠার জন্য প্রায় ১০০ মিটার উচ্চতা অতিক্রম করতে হয়। এই ১০০ মিটার উচ্চতা ২৭২টি সিড়ি ভেঙ্গে পৌছাতে হয়। এখানে একটা বাটু কেভের ছবি দিয়ে দেই তাহলে সবার হালকা একটা ধারনা হয়ে যাবে। তারপর বলি আগের দুই ট্যুরে কেন যেতে পারিনাই এ্ই জায়গায়। তারপর শেষে বলবো এবারের সফল বাটু কেভ সফরের বিস্তারিত আর সুন্দর সব ছবি দিয়ে ডিটেল দেখিয়ে দিবো জায়গাটির সৌন্দর্য।
আমি প্রথমবার মালয়েশিয়া যাই ২০১১ সালে। সাথে ছিলো দুই কলিগ। দুইজনই আমার চেয়ে বয়সে বেশ বড় এবং উনাদের মধ্যে তৌহিদ ভাইয়ের ছেলে মালয়েশিয়ার মোনাস ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা করছিলো তখন। আর দুলাল ভাই মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের জন্য খোঁজ খবর করছিলেন। দুজনেই প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং মালয়েশিয়া বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ ছিলেন। উনাদের প্রায়ই মালয়েশিয়া যাওয়া-আসা ছিলো। ফলে মালয়েশিয়ায় ঘুরাঘুরি বিষয়ে দুজনার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিলোনা। তারপরেও আমরা কুয়ালালামপুর, গ্যান্টিং হাইল্যান্ড আর পেনাং ঘুরেছিলাম। বাটু কেভ যদিও শহরের মধ্যে আর গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে যাওয়া পথেই ঘুরে আসা যায়, সে বিষয়ে আমার ধারনা না থাকাতে আর তৌহিদ ভাইয়ের ঘুরাঘুরি বিষয়ে কিঞ্চিৎ অনাগ্রহের জন্য উনাকে চাপ দিতে পারিনি। আমরা বাসে করে গ্যান্টিং হাইল্যান্ডে ঘুরতে গিয়েছিলাম কুয়ালালামপুরে থাকা দুইদিনের একদিনে। আর বাকি একদিন কুয়ালামপুরের মার্কেটে মার্কেটে ঘুরেছি। বাকি দুইদিন পেনাং শহরে যাওয়া আসা আর পেনাং ভ্রমণে ব্যয় হয়েছিলো, তাই বাটু কেভ দেখার সৌভাগ্য হয়নি সেবার। আর আমার তেমন কোন আইডিয়াও ছিলো না বাটু কেভের অবস্থান বিষয়ে বা কতটা সময় লাগতে পারে, সে বিষয়ে।
দ্বিতীয়বার মালয়েশিয়া যাই ২০১৩ সালে। এক ট্যুরে একসাথে মালয়েশিয়া আর সিংগাপুর ঘুরতে যাওয়া। সাথে ভাইবোন মিলে তিন পরিবারের ১১ জনের বিরাট টিম। মালয়েশিয়ায় কুয়ালালামপুর, পেনাং আর লাংকাউয়ি দ্বীপ ঘুরতে যাই। কুয়ালালামপুরে তেমন কিছু দেখা হয়নি, শুধু মালয়েশিয়ার অফিশিয়াল রাজধানী পুত্রাজায়া ঘুরে আমরা লাংকাউয়ি দ্বীপে রওনা হয়ে যাই। পিছে পড়ে থাকে আমার পছন্দের বাটু কেভ। বিরাট দলের টাইট সফরে অনেক অদ্ভূত সুন্দর জায়গা ঘুরেছি সেবার। অনেক সুন্দর স্মৃতি এখনও আন্দোলিত করে আমাকে। তবে বাটু কেভ সেবারও থেকে যায় ধরা ছোয়ার বাহিরে। মজার ব্যাপার প্রথম দুই সফরে আমি যে শুধু বাটু কেভ মিস করেছি তা নয়, সাথে সাথে মিস করেছি পৃথিবীর অন্যতম উচ্চতম ইমারত পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারকে। টুইন টাওয়ারের সাথে ছবি নাই মানে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার প্রমান না থাকা টাইপ অবস্থা। তবে আমার কেন যেন কৃত্রিম বা মানুষ্যনির্মিত জিনিসের প্রতি আগ্রহ কিছু্টা কম। তাই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সাথে আমার কোন ছবি নেই, সে বিষয়ে আমার কোন হতাশা ছিলোনা। যেটুকু হতাশা প্রথম দুই ট্যুরের সেটা একমাত্র বাটু কেভ দেখতে না পারা নিয়ে। চুনাপাথরের পাহাড়ের খাঁজের মাঝে ডাইনোসরের হা করা মুখের মতো সেই প্রকান্ড গুহা দেখতে না পারার হতাশা আমাকে কুরে কুরে খেয়েছে দীর্ঘদিন। পরিচিত যারা মালয়েশিয়া ভ্রমণ করেছে তাদের বাটু কেভের ছবি দেখে হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি।
তবে মালয়েশিয়ার তৃতীয় সফরটি করেছি ২০১৯ সালের অক্টোবরের ২৪ থেকে ২৮ তারিখ পর্যন্ত। ৪ দিনই মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর আর আশেপাশের জায়গাতেই ঘুরেছি। মালাক্কা শহরে একদিন যাওয়ার কথা থাকলেও যাওয়া হয়ে উঠেনি। এবারের মালয়েশিয়া সফর হঠাৎ করেই করতে হয়েছে। বন্ধু জহির মালয়েশিয়াতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের কর্মকর্তা হিসাবে বদলি হওয়ার পর থেকে মালয়েশিয়া ঘুরতে যাওয়া শুধু সময়ের ব্যাপার ছিলো। অনলাইনে ভিসাও করে রেখেছিলাম যখন সুযোগ পাবো তখন ঘুরে আসবো বলে। দেখতে দেখতে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিলো বলে একলাই রওনা দেই মালয়েশিয়াতে।
২৪ অক্টোবর রাতে রওনা দিয়ে ২৫ তারিখ সকালে পৌছাই মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে। যেহেতু ভিসার মেয়াদ বিষয়ক জটিলতা এবং বন্ধুর সাথে দেখা করাই মুল উদ্দেশ্য ছিলো সেজন্য মনে মনে ভেবে রেখেছিলাম ট্যুরটা একটু রয়ে সয়েই করবো। হুড়োহুড়ি করে সবকিছু দেখে নেয়ার জন্য দৌড়াদৌড়ি করবোনা বলে ঠিক করে রেখেছিলাম। আর জহিরের সাথে আমার বিদেশে ঘুরার সুযোগ বেশ কয়েকবার হয়েছে। সেজন্য ওর সাথে বিদেশে আড্ডা মারার সুযোগটাই অনেক আনন্দের বলে মনে হয়েছে আমার। তবে কিছু দেখি আর না দেখি বাটু কেভ আর পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার না ঘুরে আসবোনা ঠিক করে রেখেছিলাম। বাকেট লিষ্ট বলতে ঐ দুইটা জায়গাই ঠিক করা ছিলো।
জহির প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ। মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাই কমিশন (এম্বাসি) প্রচন্ড ব্যস্ত জায়গা। মালয়েশিয়াতে যেহেতু প্রচুর শ্রমিক থাকে তাই লেবার কাউন্সিলর হিসাবে জহিরেরও সারাদিন ব্যস্ত থাকতে হয়। ছুটির দিনও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের অর্থাৎ মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ের অনেককে প্রটোকল দিতে ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলে আমি জহিরের বাসায় না উঠে উঠেছিলাম আমপাং এলাকার ডি পালমা হোটেলে। জহিরের বাসা হোটেলের বেশ কাছে ছিলো। ২৫ তারিখ ছিলো ছুটির দিন। প্রথমদিন হোটেলে চেকইন করার আগেই এয়ারপোর্ট থেকে এসে জহিরের পুরো পরিবারের সাথে গ্যান্টিং হাইল্যান্ড ঘুরে আসি। সারাদিন গ্যান্টিংয়ে ঘুরে আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যায় জহির আর ভাবি।
হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে ২৪ ঘন্টা না ঘুমানোর ক্লান্তি কাটাতে ২ ঘন্টা ঘুম দিয়ে নেই। ডি পালমা হোটেলের রুমটা ছিলো আট তালাতে। রুমের একটা জানালা প্রায় দেয়াল জুড়ে হওয়াতে বেশ সুন্দর দৃশ্য দেখা যাচ্ছিলো। দুরের পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার আর নতুন দুটি উঁচু বিল্ডিং দেখা যাচ্ছিলো। বোঝা যাচ্ছিলো নতুন বিল্ডিং দুটির উচ্চতা পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের চেয়ে উঁচুই হবে। আমপাং জায়গাটা সুন্দর। হোটেলের জানালা দিয়ে আরেক দিকে তাকালে বেশ উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছিলো শহরের বাহিরের দিকে। প্রচুর হোটেল ছড়ানো আশেপাশে। পাশেই আমপাং প্লাজা। জহিরের সাথে কথা হলো যে ও অফিসে কাজ না থাকলে সকাল ১০টার মধ্যে আমাকে নিতে হোটেলে আসবে। কোথায় যাওয়া যায় চিন্তা করতেই আমার মাথায় তখন ২৪ বছর আগের বাটু কেভের ছবি চলে এসেছিলো। ঠিক করলাম জহির যদি সকালে আসতে পারে তো ওর সাথে সারাদিন শহরে ঘুরবো, আর যদি আসতে দেরী করে তবে আমি নিজেই বাটু কেভে ঘুরতে চলে যাবো। আগের দিন এয়ারপোর্ট থেকে মোবাইল এপ গ্র্যাব ইন্সটল করে নিয়েছিলাম। মালয়েশিয়াতে উবার উঠে গিয়েছে আগেই, তাই গ্র্যাব ই ভরসা। রাতে পাশের একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে ডিনার করে বাটু কেভ নিয়ে হালকা গবেষণা করে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ভ্রমণে গেলে আমার ঘুম এমনিতেই অনেক কম হয়। তার মধ্যে একা একা ঘুম আরও কম হলো মনে হলো। ঘুম থেকে উঠে হোটেলের জানালা দিয়ে ভোর হওয়া দেখলাম, ফেসবুক নোটিফিকেশন চেক করলাম তারপর আবার কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি। সকাল ৮টায় উঠে গোছল করে নাস্তা খেয়ে বাহিরে বেরুলাম। হোটেলের সামনেই আমপাং প্লাজা। একটু খুঁজতেই স্টারবাকস্ পেয়ে গেলাম। একটা এক্সপ্রেসো কফি নিয়ে মিনিট পনেরো বসে থেকে সময় কাটানোর চেষ্টা। তারপর হোটেলে এসে জহিরের জন্য ঘন্টাখানেক অপেক্ষার পর যখন জহিরের ফোনে কানেক্ট করতে পারলাম না, তখন নিজে থেকেই বের হলাম আমার বহু কাংখিত বাটু কেভ অভিযানে। আগেই দেখে রেখেছিলাম বাটু কেভের দুরত্ব খুব বেশি না আমপাং থেকে ১০ কিলোমিটার মাত্র। গ্র্যাবে ভাড়া দেখাচ্ছিলো ৩১ রিঙ্গিতের মতো। তবে জহির বলেছিলো পারলে বাসে যেতে পারিস সব জায়গায়। হোটেলের রিসেপশন থেকে শুনে নিলাম বাস স্টপেজ কোন দিকে। পাশেই আমপাং প্লাজার এক কোনেই বাস স্ট্যান্ড। তবে বাস স্ট্যান্ড গিয়ে লাভ হলো না, কারন বাসে চড়তে কার্ড কেনার দরকার ছিলো। নগদ টাকার কারবার নাই। কি আর করা গ্র্যাবেই গাড়ি কল করলাম। পিকআপ পয়েন্ট হিসাবে প্লাজা আমপাং দেয়া ছিলো। কিন্তু আমি যেহেতু মার্কেটের মেইন গেট থেকে একটু দুরে সেজন্য ড্রাইভারকে ফোন দিলাম আমার অবস্থান জানানোর জন্য।
ড্রাইভার ফোনটা পিক না করে মেসেজ দিলো, যেটা পড়ে আমার আক্কেলগুড়ুম। ড্রাইভার সাহেব বোবা এবং বধির। কানেও শোনেনা এবং কথা বলতে পারেনা, সেজন্য মেসেজে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। আমি হাসবো না কাঁদবো ভাবছি আর চিন্তা করছি যে মালয়েশিয়ার মতো একদা অনুন্নত দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তো পশ্চিমা দেশগুলোর মতো হয়ে গেছে?শারীরিক প্রতিবন্ধীদেরকেও তারা ঠিকই কাজে লাগাচ্ছে এবং সমঅধিকার দিয়েছে। এমন একজন ড্রাইভার আমাকে এতটা দুরের পথ কিভাবে নিয়ে যাবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। এই ট্রিপটা ক্যান্সেল করে আবার নতুন গাড়ি ডাক দিবো নাকি চিন্তা করেছিলাম তখন। মনে হলো, যা থাকে কপালে। দেখিই না কি হয়। দেখা গেলো ২৪-২৫ বছরের একটা মিষ্টি চেহারার চাইনিজ ছেলেই আমার বাটু কেভ অভিযানের সাথি। কথা বলতে না পারলেও মাথা ঝাকিয়ে আর বুড়ো আংগুল দেখিয়ে যাত্রা শুরু করে দিলো? গাড়িতে মোবাইল চার্জ দেয়ার জায়গা আছে কি না ভূলে জিজ্ঞাসা করে বেকুব হয়ে মেসেজ পাঠালাম। মেসেজ দেখে চার্জার পয়েন্ট বের করে দিলো আর হেসে বুড়ো আংগুল দেখালো। প্রতি উত্তরে আমিও দেখিয়ে দিলাম বুড়ো আংগুল।
কুয়ালালামপুরের শহরের যে কোন জায়গা থেকেই টুইন টাওয়ারসহ বড় বড় বিল্ডিংগুলো দেখা যায়। যাত্রাপথের রাস্তা বেশ সুন্দর। কুয়ালালামপুর সিটি সেন্টার বা কেএলসিসি থেকে বাটু কেভের দুরত্ব মাত্র ১৩ কিলোমিটার, অর্থাৎ এটা শহরের মধ্যেই বলা যায়। এক সময়ের গ্রাম্য এলাকা এখন ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা সাথে বেশ কিছু নামকরা আবাসিক এলাকাও বাটু কেভ এলাকায় আছে। রাস্তাটা যখন দুরে দেখা পাহাড়ের পাশে পাশে চলা শুরু করলো, তখন বুঝতে পারলাম বাটু কেভের কাছাকাছি চলে এসেছি। রাস্তার ডানপাশের চুনাপাথরের পাহাড়গুলো বেশ সুন্দর, এমনিতেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছিলো। মোবাইল দিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে কয়েকটা ঝাপসা ছবিও তুলে ফেললাম। ছবি তুলতে তুলতেই একটা সময় বাটু কেভের গেটে চলে আসলাম। বাটু কেভ মুলত মালয়েশিয়ার গোম্বাক এলাকার সেলেংগরে অবস্থিত। বাটু কেভ বা Batu Caves মানে বাটু গুহাসমূহ। মানে এখানে বড় একটা গুহা সহ ছোট বেশ কিছু গুহা বা কেভ আছে। বেশ কিছু মন্দির, লর্ড মুরুগানের ১৪০ ফুট উঁচু মূর্তি আর নানা রঙে রাঙানো ২৭২ টি সিঁড়ির ধাপ মিলে বাটু কেভ আসলে বেশ জমজমাট জায়গা। মজার ব্যাপার আমি যেদিন বাটু কেভ দেখতে গিয়েছি সেদিন ছিলো হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব দিওয়ালীর দিন। ফলে মাত্রাতিরিক্ত ভীড় ছিলো। মনে হচ্ছিলো যেন দক্ষিন ভারতের কোন জায়গায় চলে এসেছি। তামিল মানুষরা সাদা লুঙ্গি পরে হাটাহাটি করছিলো পুরো এলাকাজুড়ে। মনে মনে একটু হতাশ হয়েছিলাম যে একদম শহরের মধ্যে আমার দীর্ঘ দিনের আপেক্ষার জায়গাটি অবস্থিত বলে। গেটের সামনে রাস্তায় প্রচন্ড ভীড়। মাথার উপরে মেট্রোরেল হুসহাস শব্দ করে ছুটে চলেছে।
গ্রাবের টাকা চুকিয়ে আমার জীবনের অন্যতম এক্সাইটিং রাইড শেষে মিষ্টি ছেলেটাকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে দিলাম হাত পা সব অক্ষত অবস্থায় বাটু কেভে পৌছে দেয়ার জন্য। বাটু কেভ কমপ্লেক্সটি যদিও লোকে ভরপুর ছিলো কিন্তু সামনে তাকাতেই মনটা হঠাৎই প্রসন্ন হয়ে গেলো প্রকৃতির এক বিরাট আশ্চর্য বস্তু সামনে দেখে। সামনের বেশ কিছু দোকান, মন্দির আর লর্ড মুরুগান বা কার্তিকের বিশাল মূর্তি, ২৭২টি রংধনু রঙা সিড়ির ধাপ পেড়িয়ে চোখ চলে যাচ্ছিলো মুল গুহামূখের দিকে। বিরাট দৌত্যের মুখ থেকে যেন শতশত মানুষ বেড়িয়ে আসছে আর ঢুকে পড়ছে। পুরো পাহাড়টিই অনেক সুন্দর। চুনাপাথরের পাহাড়টির মধ্যে কোটি কোটি বছরে তৈরী হয়েছে গুহা গুলো। হঠাৎই আমার মনে হয়েছে এই প্রাকৃতিক আশ্চর্য জায়গাটা শহর থেকে অনেক দুরে থাকলে বোধহয় আমার অনেক বেশি ভালো লাগতো। একটু হতাশা নিয়েই ডিএসএলআর এবং মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে সামনে আগাই। নিজের সিঙ্গেল ছবি তোলার জন্য একজন ভ্রমণার্থীকে অনুরোধ করতেই বুঝলাম লোকটা বাংলাদেশী।আমার ছবি তুলে দেয়ার সাথে সাথেই বাংলাদেশের খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন, আরও জানালেন জীবিকার জন্য মালয়েশিয়ায় এসেছিলো ৫-৭ বছর আগে। মিনিট দশেক গল্প করে বিদায় জানালাম বছর ৩০শের তরুণ দুজনকে। মাথা ঘুরিয়ে অপূর্ব পাহাড়টি আর বিস্ময়কর গুহাগুলোকে দেখতে দেখতে বাটু কেভের বিখ্যাত সিড়িঁর দিকে এগোলাম। এই সিড়িঁর অনেক গল্প এর মধ্যে অনেকের কাছেই শুনেছি। আসার আগে বন্ধু লুবনা আর মিলন ভাই বলে দিয়েছে গরমের মধ্যে সাবধানে সিড়িঁ দিয়ে উঠতে। আর বড় ভাইয়ের বন্ধু লিংকন ভাই হেসে বলেছিলেন, ‘বাটু কেভে উঠবা হাটু ঠিক আছে তো?’ মনে মনে ভেবেছি মালয়েশিয়া গরমের দেশ বলে হয়তো এই সিড়িঁতে উঠাটা কঠিন কিছুই হবে। ছবি তুলতে তুলতে সেই রংধনু রঙা সিড়িঁর মুখে পৌছে গেলাম। সিড়িঁর ডান পাশে ১৪০ ফুটের বিশাল মূর্তি আর সামনে বিশাল চওয়া দু’মুখি বিশাল চওড়া সিড়িঁর ধাপ উঠে গেছে সোজা ৩০০ ফুট উপরে। আর মাথার উপরে পাহাড়ের ছাদ ঝুলে আছে জুরাসিক সময়ের কোন বিশাল প্রানীর উপরের চোয়ালের মতন।
আমার ভাগ্য ভালো বলতে হবে যে সেদিন সুর্যের আলোর প্রকোপ কিছুটা কম ছিলো। আমি সাধারণত যেখানে বেড়াতে যাই, আমি চাই আমার বন্ধুরাও আমার সাথে জায়গা গুলোতে বেড়ানোর মজা কিছুটা হলেও যেন পায়। অন্তত ভালো একটা আইডিয়া দেয়ার চেষ্টা করি সব সময়। সেজন্য বাটু কেভের সিড়িঁর মুখে জুতা জমা দিয়ে টোকেন নিয়ে বড় একটা দম নিয়ে ফেসবুক লাইভ চালু করে দিয়ে সিড়িঁ ভেঙ্গে উঠা শুরু করলাম। পাহাড় আমার পছন্দের। ২৭২ সিড়িঁ মানে যে ২৭ তালা বিল্ডিং সেটা আমার হিসেব করাই আছে। মধ্য ৪০শেও এটা এমন কোন ব্যাপার না বলেই মনে করি আমি। ফলে ফেসবুক লাইভে বন্ধুদের আশেপাশের দৃশ্য দেখাতে দেখাতে কখন যে সিড়িঁর প্রায় মাথায় পৌছে গেছি বুঝতে পারিনি। প্রথমে সামনের দিকের বাটু কেভের গুহামুখটার দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সিড়িঁ ভেঙ্গে উঠেই গেছি। প্রায় শেষ দিকে হঠাৎ পিছন ফিরে নিচের দিকে তাকালাম। পিছনে যেন আমার জন্য আরেকটি অবাক দৃশ্য অপেক্ষা করছিলো। পাহাড়ের উপর থেকে চোখা আর এবড়োথেবরো ছাদ ঝুলে আছে, চুনাপাথর থেকে পানি চুইয়ে পড়ছিলো। চারিদিকে মানুষের গমগম শব্দ। স্রোতের মতো মানুষ নেমে যাচ্ছে সিড়িঁ ভেঙ্গে। পাহাড়ের উপর থেকে কুয়ালালামপুর শহরের বিশাল এলাকার দৃশ্য যেন লাফ মেরে সামনে চলে এলো। অবাক হয়ে দেখলাম অপূর্ব দৃশ্যটি। বেশ কিছু ছবি তুলে আবার রওনা হলাম মূল বাটু কেভের দিকে। মনে মনে হাসলাম যারা আমাকে বাটু কেভের সিড়িঁ আর হাটু বিষয়ক সতর্কবানী দিয়েছিলো। ফেসবুক লাইভ দিতে দিতেই একবারও না দাড়িয়ে কখন প্রায় পৌছে গেছি খেয়াল ই করিনাই।
বাটু কেভের মূল গুহার সামনে দাড়িয়ে আছি আমি।যাকে মন্দির গুহাও বলা হয়। চুনাপাথর থেকে চুইয়ে নেমে আসা পানি থেকে ক্যামেরা বাচিঁয়ে মূল বাটু কেভে ঢুকে পড়লাম। এই সেই গুহা যার ছবি আমি ২৪ বছর আগে দেখেছিলাম। একটা গুহা যে কত বড় হতে পারে বাটু কেভ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেই বোধহয় ভয়ংকর সুন্দর বলে।এই ভয়ংকর সুন্দর মূল গুহাতেই বেশ কিছু মন্দির আছে আর মানুষ ভক্তিভরে পুজাআর্চা করছিলো। আমি বেশ কিছু ছবি তুলে আর ঘাড় বাঁকা করে উপরের দিকে তাকিয়ে মন ভরে দেখলাম বহু আকাংখিত বাটু কেভকে। মূল কেভের মেঝে একটু নিচে। ৩০-৪০টি সিডিঁ ভেঙ্গে নামতে হয়।মূল গুহা পেরিয়ে ৪০-৫০টি সিড়িঁ ভেঙ্গে উঠে আরও একটা ছোট গুহা আছে। ওখানেও মন্দির আর দেব দেবীর মূর্তি আছে। ভিতরের গুহাটার ছাদ বেশ নিচু। এখানে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রচুর পূজারী পুজা করছে দেখলাম। ধুপধুনো আর মন্দিরের পূজারির হাতের ঘন্টার টুনটুন শব্দ, তার মধ্যেই শতশত পর্যটক। এখানে অল্প কিছু ছবি তুললাম। মজা পেলাম গুহার চুনাপাথরের দেয়ালে আমাদের পূর্বপুরুষদের হুটোপুটি দেখে। এর মধ্যে আমার ফেসবুক লাইভে কার্টুনিষ্ট জুনায়েত সাবধান করেছে বাটু কেভের বানরদের বিষয়ে, তাই আর বেশিক্ষণ থাকার সাহস পেলাম না।
এর মধ্যে বন্ধু জহির ফোন দিয়ে জানালো ওর কাজ শেষ হয়েছে। জানতে চাইলো কোথায় আসবে? আমি বললাম ‘তুই পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের সামনে আয়, আমি বাটু কেভ থেকে রওনা দিচ্ছি’। আর বেশিক্ষণ না থেকে বহু প্রতিক্ষিত বাটু কেভ দেখতে দেখতে সিড়িঁ ভেঙ্গে নেমে এক লিটার পানি কিনে গ্র্যাব ডাক দিলাম মালয়েশিয়ার আরেক না দেখা জায়গা দেখার জন্য, একসময়ের পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন পেট্রোনাস টুইন টাওয়ারের দিকে।
লেখক: আনিসুল কবীর
বিষয়: আনিসুল কবীর
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: