সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৩শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১


একুশের চেতনা ও আমার বোন কমলা ভট্টাচার্য


প্রকাশিত:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০৫:৪৬

আপডেট:
৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ২৩:০৮

শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুর বেলার অক্ত
বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?
বরকতের রক্ত।’
(কবি আল মাহমুদ)
একুশে ফেব্রুয়ারী যুগপৎভাবে বাঙালির ভাষা আন্দোলনের গৌরব আর বেদনা-বিদীর্ণ শোকের দিন। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার আন্দোলনে সালাম, রফিক, বরকত অকাতরে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছিলেন। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি। ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখটি তাই স্বীকৃতি লাভ করে ভাষা দিবস বা শহীদ দিবস হিসেবে। ভাষার জন্য এই ত্যাগ ও ভালবাসার স্বীকৃতি দিতে এ দিবসটিকে জাতিসংঘ ঘোষণা করেছে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের সকল মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষ আজ এ দিবসটি নিয়ে গর্ব করে, উদযাপন করে।

১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে ঢাকার শহীদদের এই সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের কথা আমাদের সবার জানা থাকলেও তার এক দশকের ভেতরেই ১৯৬১ সালের ১৯ মে তারিখে ভারতের আসাম রাজ্যে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ১১ জন তরুণ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হয়েছিলেন সে ঘটনার কথা হয়ত আমরা অনেকেই জানি না। বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের মতোই আসামের ভাষা-আন্দোলনও একটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল আন্দোলন। এই উপমহাদেশে গণমানুষের স্বাধীকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাসে বাংলাদেশের ২১ ফেব্রুয়ারি ও আসামের ১৯ মে একই সূত্রে গাঁথা।

বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের সে লড়াইয়ে পুরুষদের পাশাপাশি একজন নারীও সেদিন আত্মাহুতি দিয়েছিলেন। তার নাম কমলা ভট্টাচার্য। ষাটের দশকের সেই সময়কালের প্রেক্ষাপটে এটি একটি অসাধারণ ঘটনা। মাত্র ১৬ বছর বয়সে আন্দোলনের পুরোভাগে থেকে নিজের জীবন বিলিয়ে দেয়ার মতো দুঃসাহসী এ তরুণীই হলেন সমগ্র বাঙালি নারী সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী পৃথিবীর সর্বপ্রথম শহীদ নারী ভাষাসৈনিক। আজ আমাদের সেই সাহসী বোন কমলা ভট্টাচার্যকে নিয়ে কিছু কথা লিখব।

কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম অবিভক্ত বাংলার সিলেটে (তখন নাম ছিল শ্রীহট্ট), ১৯৪৫ সালে। রামরমন ভট্টাচার্য ও সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তানের মধ্যে কমলা ছিল পঞ্চম । সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় কমলার পরিবার পাকিস্তানে থেকে গেলেও পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের উপর হত্যা-নির্যাতন শুরু হলে কমলার পরিবার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। আর তারই রেশ ধরে ১৯৫০ সালে সাত সন্তানকে নিয়ে বিধবা সুপ্রবাসিনী দেবী ভারতে পাড়ি জমান। অন্য বেশিরভাগ উদ্বাস্তু হিন্দুদের মতো পশ্চিমবঙ্গে না গিয়ে তিনি আশ্রয় নেন একসময়ের অবিভক্ত বৃহত্তর সিলেটের (আসাম) কাছাড় জেলার শিলচরে। ভারত বিভক্তির আগে বৃহত্তর কাছাড় জেলা নিয়ে বরাক উপত্যকা গঠিত। বর্তমানে কাছাড় জেলাকে বিভক্ত করে তিনটি প্রশাসনিক জেলায় রূপান্তর করা হয়েছে। এগুলো হল কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি জেলা, যা বাংলাদেশের সিলেট জেলা সংলগ্ন আসামের দক্ষিণ সীমান্তে অবস্থিত।

ছবিঃ কমলা ভট্টাচার্য

মাত্র ৫ বছর বয়সে উদ্বাস্তু হয়ে শিলচরে পা রেখেছিল কমলা। শিলচর পাবলিক স্কুল রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া নিয়ে থাকতেন তাঁর পরিবার। পিতৃহীন আট জনের এই সংসারে কমলার মেজদিদি প্রতিভা অনেক কষ্টে শিক্ষিকা হিসেবে একটি চাকুরী যোগার করতে পেরেছিলেন। তাঁর আয়েই চলত গোটা পরিবার। সন্তানদের জন্য স্কুলের প্রয়োজনীয় সব পাঠ্যপুস্তক কেনার সাধ্য ছিল না পরিবারটির। সুতরাং কমলা তার সহপাঠীদের কাছ থেকে পাঠ্যপুস্তক ধার করে পাঠের বিষয়বস্তু খাতায় টুকে নিতো। তবুও শত প্রতিকূলতার মাঝে কমলা স্বপ্ন দেখত উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার।

১৯৬০ সালের ৩ মার্চ আসামের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা বিধান সভার এক অধিবেশনে জানান অসমিয়াকে আসাম রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষণা করা হবে। এ ঘোষণার প্রতিবাদে ১৯৬০ সালের ১৬ এপ্রিল শিলচরে বাংলাভাষা-ভাষী বাঙালিরা এক নাগরিক সভা আহ্বান করেন। তখন বরাক উপত্যকায় প্রায় ৪০ লক্ষ বাঙালী মানুষ বসবাস করতেন। তারাই ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রতিবেশী পূর্ব পাকিস্তানের সাম্প্রতিক একুশে ফেব্রুয়ারীর ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ বরাকের বাঙ্গালিরা বাংলা ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে গোটা বরাক জুড়ে শুরু করে আন্দোলন। এ আন্দোলন ও দাবীকে গুরুত্ব না দিয়েই ১৯৬০ সালের ১০ অক্টোবর আসাম রাজ্যের সবর্ত্র অসমিয়া ভাষা প্রয়োগের জন্য বিধান সভায় ভাষা বিল উত্থাপন ও পাস হয়।

নতুন এই আইনের প্রতিবাদে বাংলা ভাষার স্বপক্ষ শক্তি আরো ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখে। ১৯৬১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে গঠিত হয় সংগ্রাম পরিষদ। সেখানেই নেতাদের বক্তৃতা শুনে ভাষা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ হয় কমলা। সামনেই তখন তার মাধ্যমিক পরীক্ষা। তবুও পড়ার ফাঁকে ফাঁকে সে চলে যেতো সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীদের বক্তৃতা শুনতে। ১৯৬১ সালের ১৪ এপ্রিল নববর্ষের দিনে আন্দোলনকারীদের সংকল্প দিবসে সেও অংশগ্রহণ করে, শপথ নেয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এদিকে সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারীরা ১৯ এপ্রিল এক পদযাত্রা শুরু করে ২ মে শিলচরে পৌছায় নেতারা। কথা ছিল ১৩ এপ্রিলের মধ্যে ভাষা বিল বাতিল না হলে ১৯ মে বরাক উপত্যকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হবে।

আন্দোলন-সংগ্রামের এ ডামাডোলের মাঝেই কমলা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল পরীক্ষার পর টাইপিং শেখার। ১৯ মে তারিখে তাঁর ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার ঠিক পরদিন শিলচর রেল স্টেশনে মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষার দাবীতে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে একটি পিকেটিং বা গণঅবস্থান কর্মসূচীর ঘোষণা দেওয়া হয়। সকালে মেজদিদি প্রতিভার স্কুলে যাওয়ার জন্য রাখা শাড়ি আর ব্লাউজ পরেই কমলা বের হয়ে যায়। যাওয়ার আগে মায়ের কাছ থেকে সে এক টুকরো কাপড় চেয়ে নেয়, পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়লে যেন মুখে চেপে ধরতে পারে। যাওয়ার আগে কিছু খেয়ে যেতে চেয়েছিল কমলা, কিন্তু ঘরে খাওয়ার কিছু না থাকায় খালি পেটেই সে বের হয়। সাথে ছিল সবসময়ের সঙ্গী ১১ বছর বয়সী ছোট বোন মঙ্গলা।

স্থানীয় সত্যাগ্রহ আন্দোলনের নেত্রী জ্যোৎস্না চন্দের ডাকে ২০/২২ জন নারীর দলে যোগ দেয় কমলা, গন্তব্য শিলচর রেলওয়ে স্টেশন। সেদিন সকালে রেল অবরোধ কর্মসূচী শান্তিপূর্ণভাবেই পালিত হয়েছিলো। যদিও অবস্থানের সময়সূচী ছিল সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা, তবে সেদিন শেষ ট্রেনটির যাওয়ার সময় ছিল বিকেল ৪টা নাগাদ, যার পর গণঅবস্থান কর্মসূচী স্বভাবতই শিথিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু দুপুরের পর থেকেই অসম রাইফেলসের জওয়ানরা জায়গাটাকে ঘিরে ফেলতে শুরু করে।

বেলা ২টা ৪৫মিনিট নাগাদ বিনা উস্কানীতেই তারা অবস্থানকারী ছাত্রছাত্রীদের উপর নির্মমভাবে লাঠি ও বন্দুকের কুঁদো দিয়ে আক্রমণ করে বসে। এলোপাথাড়ি লাঠিচার্জে এসময় অবস্থানকারী জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় ও দিকবিদিক-জ্ঞানশুন্য হয়ে যে যেদিকে পারে পালাতে থাকে। কমলার ছোটবোন মঙ্গলা পুলিশের লাঠির আঘাতে মাটিতে পরে যায় এবং সাহায্যের জন্য বড় বোন কমলার উদ্দেশ্যে চিৎকার করতে থাকে। ইতিমধ্যে অসম রাইফেলসের জওয়ানরা পলায়নরত জনতার উপর গুলিবৃষ্টি শুরু করে। ছোটবোন মঙ্গলাকে বাঁচাতে কমলা ছুটে গেলে হঠাৎ একটি গুলি তাঁর চোখ ভেদ করে মাথার খুলি চুরমার করে দেয়। অন্যান্য আহত ও গুলিবিদ্ধ অবস্থানকারীদের সাথে কমলাকেও হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় কিন্তু শেষপর্যন্ত তাকে বাঁচানো আর সম্ভব হয়নি। সেদিন তাঁর আহত ছোটবোন মঙ্গলাকেও সংজ্ঞাহীন অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দীর্ঘ এক মাস বাদে মঙ্গলার জ্ঞান ফিরেছিলো কিন্তু বাকি জীবনের জন্য তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পঙ্গু হয়ে যান।

শেষপর্যন্ত টাইপিং আর শেখা হয়নি বীর এবং সংগ্রামী এই মেয়েটির। উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে চাকুরী করে সংসারের অভাব দূর করার স্বপ্ন তাঁর স্বপ্নই থেকে যায়। তাঁর মৃত্যূর পর ম্যাট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছিল। মেধাবী ছাত্রী কমলা পরীক্ষাতে ভাল ভাবেই পাশ করেছিল। তাঁর সেই রেজাল্ট দেখে অভাগা মায়ের বুকফাটা করুন আর্তনাদ করা ছাড়া আর যেন কিছুই করার ছিল না।
উপনিবেশী শাসকদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটিতে ১৯ মে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা এক মর্মন্তুদ ও রক্তাক্ত ইতিহাস হিসেবে রয়ে গেছে। তবে কমলার আত্মদান বৃথা যায়নি। কমলাসহ সেদিনের ১১ জন শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাকে আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয় সরকার। এই অঞ্চলের বাংলাভাষী জনগণ কমলা ভট্টাচার্যের মতো সর্বোচ্চ ত্যাগস্বীকারকারী মানুষদের প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

বাংলা ভাষার সম্মান ও মর্যাদা আজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং সমাদৃত। কিন্তু বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা-শহীদ কমলা ভট্টাচার্যকে কি আমরা মনে রেখেছি? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না একুশ আমাদের চেতনা এবং কমলা আমাদের প্রেরণা। আজ আমাদের না দেখা সেই সাহসী বোন কমলার মতই সারা বিশ্বে বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষীরা একুশের চেতনায় নতুন করে নিজেদের উজ্জীবিত করুক, ভাষার প্রতি ভালোবাসাকে প্রতিনিয়ত নবায়ন করুক, এই প্রত্যাশাটুকু থাকলো।

লেখক: শ্রাবন্তী কাজী আশরাফী
প্রধান সম্পাদক, প্রভাত ফেরী
ও 
ডিরেক্টর, অস্ট্রেলিসিয়ান ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি (AIA), অস্ট্রেলিয়া



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top