সিডনী রবিবার, ২৮শে এপ্রিল ২০২৪, ১৪ই বৈশাখ ১৪৩১


ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্বের পরিপ্রেক্ষিতে ‛মুড সুইং’ সমস্যার পর্যালোচনা : জয়দেব বেরা


প্রকাশিত:
১ মার্চ ২০২৩ ০৩:০৭

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০২:৩৯

 ছবিঃ জয়দেব বেরা

 

ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব (Clinical Sociology) হল ব্যবহারিক সমাজতত্ত্বের (Applied Sociology) একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা। এটি ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ত্বেরই মত একটি বিষয়। Clinical Sociology শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন শিকাগোর সমাজতাত্ত্বিক Loui Wirth 1931 সালে। মনোবিদ, সমাজকর্মী এবং মানসিক রোগের চিকিৎসকদের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নিযুক্ত সমাজতাত্ত্বিকদের ক্রিয়াকর্ম বোঝাতেই তিনি এই কথাটি ব্যবহার করেছেন। এককথায় রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণার সাহায্যের উদ্দেশ্যে সমাজতাত্ত্বিক (sociological) জ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগ হল ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব। অন্যভাবে বললে বলা যায়, কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্যদের সামাজিক এবং মানসিক উন্নতি সাধনের জন্য একপ্রকার Sociological diagnosis এবং Treatment- ই হল ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব। অর্থাৎ সমাজতত্ত্বের যে শাখাতে সমাজতাত্ত্বিক জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে যখন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সদস্যদেরকে সামাজিক ও মানসিকভাবে উন্নতি সাধন ও সহায়তা করা হয় তখন তাকে বলা হয় ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব। ব্যক্তিবর্গের মানসিকতার উন্নতি সাধনের উপায় পদ্ধতির অধ্যয়ন-অনুসন্ধান এই ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্বের আওতায় আসে। Clinical Sociology এর সংজ্ঞা প্রসঙ্গে সমাজতাত্ত্বিক Glassner and Freedman (1979) বলেছেন, “Clinical sociology is the application of a variety of critically applied practices which attempt sociological diagnosis and treatment of groups and group members in the community.” (Applied sociology for nurses-R sreevani)

ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব যেহেতু ব্যক্তিবর্গের মানসিক বিষয় গুলোকে সমাজতাত্ত্বিকভাবে পর্যালোচনা করে এবং সমস্যা গুলোকেও সমাধান করে, তাই এই পরিপ্রেক্ষিতের উপর ভিত্তি করে আমরা ‛মুড সুইং’ (Mood Swing) এর বিষয়টিকে নিয়েও সমাজতাত্ত্বিকভাবে পর্যালোচনা করতেই পারি। ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্বের উপর ভিত্তি করেও এই মুড সুইং এর বিষয়টিকে সমাধান করা যেতে পারে। যাইহোক, মুড সুইং বিষয়টি আসলে কি? এবং কিভাবে এই সমস্যাটিকে sociological diagnosis এর উপর ভিত্তি করে সমাধান করা যেতে পারে তা নিয়ে আলোচনা করব। সাধারণভাবে কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ যখন কোনো ব্যক্তির মেজাজ বা মনের আকস্মিক পরিবর্তন হয় অৰ্থাৎ হঠাৎ করে কোনো কারণ ছাড়াই বা ছোটো ছোটো কারণে রেগে যাওয়া, কান্নাকাটি করা, বিষণ্নতার ভোগা, হতাশা অনুভব করা, ওভার রিয়েক্ট করা ইত্যাদিকে বলা হয় মুড সুইং। তবে এটি কোনো শারীরিক বা মানসিক রোগ নয়। এটি একপ্রকার ব্যক্তির সামাজিক-মনস্তাত্ত্বিক পর্যায়। মুড সুইং একটি জটিল নয়, স্বাভাবিক সমস্যা। এই সমস্যাটি পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে বেশি লক্ষ্যণীয়। নানান কারণে ( হরমোনজনিত কারণ, পুষ্টিহীনতা, নানা রোগ, মেডিসিনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া, সামাজিক-মানসিক চাপ ও ডিপ্রেশন, ঘুমের অভাব, মাদকাসক্তি, অতিরিক্ত কাজের ও পড়াশোনার চাপ প্রভৃতি) এই মুড সুইং সমস্যাটি হতে পারে। মহিলাদের এই সমস্যাটি মূলত পিরিয়ড চক্র চলাকালীন কিছু হরমোন ঘটিত কারণের প্রভাবে হয়ে থাকে। এইসময় মেয়েদের ইমোশনাল ব্রেক ডাউন এর সৃষ্টি হয় যার ফলে মনের/ মেজাজেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে। মুড সুইং এর ফলে মেয়েরা নিজেদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনেক সময় ব্যর্থ হয়ে থাকে। যার ফলে নিজের কাছের মানুষটির উপর ওভার রিয়েক্ট করে বসে। এই সময় হঠাৎ করেই কোনো কিছু সেরকম ভালো লাগে না, পড়াশোনাতেও মন বসে না, মনে একটা বিরক্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এইরকম পরিস্থিতি হলে বুঝবেন মুড সুইং এর শিকার হয়েছেন।

এই সমস্যাটি যত তাড়াতাড়ি সৃষ্টি হয় আবার তত তাড়াতাড়ি কিন্তু ঠিক হয়ে যায়। ক্লিনিক্যাল সমাজতত্ত্ব বা sociologial diagonsis এর উপর ভিত্তি করে এই সমস্যাটিকেও সমাধান করা যেতে পারে।কারণ,এই সমস্যা টি জৈবিক কারণের পাশাপাশি সামাজিক-মানসিক কারণেও হয়ে থাকে। তাই সেক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে তা হল কখনো কোনো ছেলে / মেয়ের মুড সুইং হলে তাকে সাইকো বা ন্যাকামি বলে উপহাস করবেন না। এই সময় তাকে যতটা সম্ভব উৎসাহ দিন, ভালো ভালো কিছু রোমান্টিক কথা বলুন, মজার মজার গল্প, ভিডিও দেখান, তার ছোটো ছোটো চাহিদাগুলোকে পূরণ করুন, পছন্দের খাবার এনে দিন, তার উপর রাগ না দেখিয়ে যেকোনো উপায়ে রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করুন, তার প্রতি সহানুভূতিশীল হন প্রভৃতি। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে এই সময় কোনোভাবেই কিন্তু রাগ দেখানো যাবে না, তাহলেই এই ছোটো মুড সুইং এর সমস্যাটি একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ সম্পর্ককে ভেঙে দিতেও ক্ষমতা রাখে। এই সমস্যাটি একজন ছেলে/ মেয়ে তথা শিক্ষার্থীর জীবনে অন্ধকার নামিয়েও আনতে সক্ষম। তাই এই সময় প্রিয় মানুষটিকে সর্বদা হাসি খুশিতে রাখুন, মানসিক চাপ কম দিন, বাইরে বেড়াতে যাওয়ার বা পিকনিক করার প্ল্যান করুন। তাহলেই দেখবেন এই সমস্যাটিকে খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। যেহেতু মেয়েদের এই সমস্যাটি বেশি হয় তাই উপরিউক্ত বিষয় গুলির পাশাপাশি এই সময় তাকে খারাপ কথা না শুনিয়ে, অবহেলা না করে তার প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে যত্ন নিন, তাকে গুরুত্ব ও সময় দিন। এছাড়াও যে বিষয়গুলো ধ্যান রাখতে হবে তা হল - ব্যায়ামের অভ্যাস, সুষম খাদ্যগ্রহণ, পর্যাপ্ত ঘুম, নেশা না করা, সর্বদা হাসি খুশিতে থাকা, অতিরিক্ত সামাজিক ও মানসিক চাপ না নেওয়া প্রভৃতি। সবসময় চেষ্টা করবেন হাসিখুশিতে থাকতে কারণ মানুষ হাসিখুশি যখন থাকে তখন তার দেহে ‛অক্সিটোসিন’ নামক হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মানুষকে সামাজিক ও মানসিক শান্তি দেয়। এই সমস্ত বিষয়গুলো মেনে চললে দেখবেন মুড সুইং সমস্যাকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে এবং সম্পর্ক গুলোও সুন্দর থাকবে। মানুষের সম্পর্ক সুন্দর থাকলে জীবনও সুন্দর হয়ে উঠবে। সবশেষে যে বিষয়টি বলা প্রয়োজন তা হল যদি এই সমস্যাটি খুব অতিরিক্ত পর্যায়ে চলে যায় তখন তাকে পাগল বা সাইকো বলে অপমান-অবহেলা না করে ভালো কোনো মনোবিদ, চিকিৎসক, কাউন্সেলর, ক্লিনিক্যাল সমাজতাত্ত্বিকদের কাছে নিয়ে যাবেন বা পরার্মশ নেবেন। সবার শারীরিক-সামাজিক-মানসিক সুস্থতা কামনা করি।

●সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি ও বৈদ্যুতিন তথ্য সূত্র:

1)Sreevani, R(2022); ' Applied sociology for nurses, Jaypee brother medical publishers, New Delhi.

2)Dunham warren, H. (1982, vol-1); ' Clinical sociology its nature and function' , Clinical Sociology Review.

3) মহাপাত্র, অনাদিকুমার (2022); ' বিষয় সমাজতত্ত্ব' সন্ধ্যা প্রকাশনী,কলকাতা।

(4) The DU Speech-
https://www.duspeech.com/2022/07/what-is-mood-swing.html?m=1

5) বাংলাদেশ জার্নাল (প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২০, ২২:০৭) 'মেয়েদের মুড সুইং করলে যা করণীয়'।

জয়দেব বেরাঃ কবি, লেখক ও সম্পাদক- মানসী সাহিত্য পত্রিকা

 



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top