মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো (পর্ব- ২) : কাজী জাকির হাসান
প্রকাশিত:
৬ জুলাই ২০২০ ২২:৩০
আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ০২:০৩
প্রস্তুতি
কিছুটা হলেও নিরাপদ আশ্রয়ে তো এলাম। কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছিলাম না এসেও। বন্ধু-বান্ধবরা কে কোথায়, কি করছে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো মন। খোঁজ যে নেব তারও উপায় নেই কোন। আমাকে ঘিরে সতর্ক পাহারা আব্বা-আম্মার।
দিন দুই কেটে গেল এভাবেই। তৃতীয় দিনের দুপুর বেলা তখন। আশ্রয়দাতার বাড়ির উঠোনে গাব গাছের তলে বাঁশের টং-এ শুয়ে ভাবছিলাম এলোমেলো অনেক কিছু। এমন সময় সমবয়সী ভাতিজা মুবিন এসে সংবাদ দিলো ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিচ্ছে কুড়িগ্রামের ছাত্র একদল। বিদ্যুৎ খেলে গেল গোটা শরীরে সংবাদটা শোনা মাত্রই। মনে মনে এই রকমই কিছু একটা ভাবছিলাম। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমিও যাবো। ভাই-বোনদের কাউকেই দেখছিনা আশে পাশে কোথাও। আম্মা গেছে গোসল করতে পাশের বাড়িতে। ঘরে ঢুকে দড়িতে ঝুলানো আম্মার শাড়ির আঁচল হাতড়ে পয়সা পেলাম বারো আনা। তাই সম্বল করে রওয়ানা হলাম দ্রুত ভুরুঙ্গামারীর উদ্দেশ্যে মুবিন ও চাচাতো ভাই রাজুকে সঙ্গে নিয়ে।
ভাতিপাড়া দিয়ে পাটেশ্বরী বাসস্ট্যান্ডের দিকে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল হঠাৎ বাড়ির কথা। পা'দুটো আপনা আপনি চলতে লাগলো সেদিকে। উদাস হাওয়ার ঝাপটা লেগে শরীরে আনচান করে উঠলো মন। বিশাল বাঁশঝাড়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের শন্ শন্ শব্দ কানে বাজছে ঠিক যেন কান্নার মত।
বাড়ির সম্মুখে পুকুর। পানিতে মাথা উঁচু করে ফুটে রয়েছে শ্বেত, রক্ত রঙের ভ্যাটফুল। ফুটে আছে পাড় ঘেঁষে কচুরীপানা ফুল। নেই কেউ তোলার এগুলো। নিঃশব্দ, স্থীর হয়ে আছে সব কিছুই। দাঁড়ালাম এসে বাড়ির উঠোনে। শ্মশানপুরী যেন। পরিত্যক্ত ভিটেতে এই ক'দিনে গাছ-গাছালির পাতা আর শ্যওলা জমে ভুতরে দেখাচ্ছে বাড়িটা। উল্টে পড়ে রয়েছে বাঁশের পাঁচিল। হাট করে খোলা দরোজা মেইন গেইটের। সুনসান, গা ছমছম পরিবেশ। একটু এগিয়ে যেতে চোখে পড়লো খোলা কপাট শোবার ঘরের দরোজার। কিন্তু মনে পড়ে যতদূর তালা লাগানো হয়েছিল সব ঘরের। সন্দেহ হলো। পা টিপে টিপে ঢুকলাম ঘরে। চমকে উঠলাম তাকিয়েই। বই-পুস্তক, চিনেমাটি আর কাঁসার বাসনপত্র মাটি চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে যে জায়গায় তার ওপর পাটের ছালা বিছিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছেন আব্বা শুন্যে দৃষ্টি মেলে। দু'চোখের কোল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি তখনও। ভ্রুক্ষেপ নেই কোন দিকেই। বোধকরি আমার উপস্থিতি টের পাননি তিনি। সাড়া দিলাম না আমিও ইচ্ছে করে। দূর থেকে পা বরাবর মাটি ছুঁয়ে সালাম করলাম। তাকিয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ মুখের দিকে। ভাবান্তর নেই কোন। নির্বিকার দৃষ্টি পাথরের মতই স্থির। উঠে দাঁড়ালাম। বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে ধীরে ধীরে।
ভীতিকর অবস্থার মধ্যেও সলতে বাতির টিমটিমে আলোর মতই দু'একটা সার্ভিস বাস তখনও চলাচল করছে পাটেশ্বরী-ভুরুঙ্গামারির মধ্যে। বাসে করেই পৌঁছলাম ভুরুঙ্গামারী। এখানকার পরিস্থিতি তুলনামূলক নিরাপদ বলেই মনে হলো। খুঁজতে লাগলাম ট্রেনিং সেন্টার। সম্ভাব্য সব জায়গা খুঁজেও পেলাম না কোথাও ছাত্রলীগ নেতা আমিনুল ইসলাম (মঞ্জু মণ্ডল) ও আখতারুজ্জামান মন্ডলকে। জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তোর পেলাম না কারও কাছ থেকে ট্রেনিং সেন্টারের অস্থিত্ব। বাড়ি যে ফিরে যাব তারও সঠিক মনে হলো না এ অবস্থায়।
সাত আট মাইল দূরে পাথরডুবি। আমার খালার বাড়ি। নাজিরহাট সীমান্ত ঘেঁষে। সীমানার দু'অংশে প্রবাহিত সংকোষ নদী। এই নদীতে ডুব সাঁতার দিয়ে এর আগেও কয়েকবার বেড়াতে গিয়েছিলাম ভারতে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল নয়। কাঁচা রাস্তায় দু'একটা রিকসা সবেমাত্র চলাচল শুরু করেছে ভুরুঙ্গামারী-পাথরডুবির মধ্যে। পাওয়া গেল না তাও প্রয়োজনের সময়। হেঁটেই রওয়ানা হলাম পাথরডুবির পথে।
যেতে যেতে মত পাল্টে ফেললাম। খালার বাড়িতে যাওয়া বোধকরি ঠিক হবে না আমার জন্যে। জিজ্ঞেস কররলাম রাজু আর মুবিনকে পয়সা-কড়ি কার কত আছে পকেটে। দশ টাকা রাজুর পকেটে, মুবিনের কাছে তিন টাকা, বারো আনা আমার সংগ্রহে। এই টাকা সম্বল করে পথ ধরলাম সোজা সাহেবগঞ্জের দিকে। বাংলাদেশ থেকে আসছি জেনে বিএসএফ জোয়ানরা কেউ কিছু বললো না আমাদের। নির্বিঘ্নে পৌঁছলাম সাহেবগঞ্জে। সেখান থেকে রিকসা করে দিনহাটা পৌঁছতে বেজে গেল দুপুর দু'টো। সম্পূর্ণ অপিরিচিত শহর চিনিনা মানুষ জন কাউকেই। শুনেছি রংপুরের জামান, আখতার ভাই পরিবার নিয়ে উঠেছেন এখানে কোন এক আত্মীয়ের বাড়িতে। ঠিকানা রাজুর জানা থাকলেও সংকোচ হলো উঠতে এই বিপদের সময়েও। ভাবলাম পার্টি নেতা, ছাত্র নেতা কাউকে না কাউকে অন্তত পাওয়া যাবে এখানে। কিন্তু খুঁজবো কোথায়। ক্ষুধাও লেগেছে খুব। পয়সা যা ছিলো পকেটে শেষ হয়ে গেছে সব রিকসা ভাড়া দিতে গিয়ে। উদ্ভ্রান্তের মত হাঁটতে লাগলাম রাস্তার এদিক ওদিকে।
মহকুমা শহর দিনহাটা। সহজেই চোখে পড়ে গেলাম মানুষ-জনের। কৌত‚হলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সবাই আমাদের দিকে। এতে অস্বস্থি বোধ করতে লাগলাম। দাঁড়িয়ে পড়লাম এক জায়গায়। এমনি সময় ধীর পাঁয়ে এগিয়ে এলো আমাদের বয়সী যুবক একজন। জিজ্ঞেস করলো বিনয়ের সঙ্গে, ‘দাদারা কি জয়বাংলা থেকে এসেছেন?'
বললাম তিনজন একসঙ্গে, হ্যাঁ।
কাছে এগিয়ে এসে যুবক দাঁড়াল ঘনিষ্ঠ ভাবে। হাত মেলালো সহাস্যে। বললো, ‘খুঁজছেন কাউকে?' কথা বলার আন্তরিকতায় বিশ্বাস খুঁজে পেলাম। খুলে বললাম সব। শুনলো মন দিয়ে। বয়সের তুলনায় বেশ ধীর স্থীর। রাস্তার উল্টো দিকে একটি ঘর দেখিয়ে বললো, ‘ওখানে গিয়ে যোগাযোগ করুন একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে আপনাদের।' কথা কটি বলেই চলে গেল যুবক নিরুত্তাপ ভঙ্গিতে।
হাঁটা চলা করছিলাম এতক্ষণ যে ফুটপাত ধরে তার উল্টো দিকেই মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা টিনের ঘর একটি। দারোজার ওপর সাইনবোর্ডে লেখা ফরোয়ার্ড ব্লক অফিস। গিয়ে ঢুকলাম সংকোচে। মধ্যবয়সী ভদ্রলোক একজন পত্রিকা পড়ছেন কাঠের চেয়ারে হেলান দিয়ে।
মোটা সোটা। কালো গায়ের রং। সামনে টেবিলের ওপর চারমিনার সিগারেটের প্যাকেট একটি। ঘর ভরে সিগারেটের ধোঁয়া উড়ছে তখনও। গলা খাকাড়ি দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম। নড়ে বসলেন ভদ্রলোক। খবরের কাগজ সরিয়ে তাকালেন আমাদের দিকে।
: আপনারা?
জিজ্ঞেস করলেন।
পরিচয় দিলাম আমাদের। বসতে বললেন। শুনলেন সব কিছু আমাদের মুখ থেকে। বললেন না একটি কথাও। টেবিলের ওপর থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা টেনে নিয়ে ছিঁড়লেন একটি অংশ। লিখলেন কি যেন তাতে।
: পাশেই মুসলিম হোটেল। খেয়ে আসুন আগে।
সিগারেটের প্যাকেটে লেখা স্লিপ হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি এখানেই অপেক্ষা করবো আপনাদের জন্য'।
কথা শেষ করে চোখের সামনে পত্রিকা তুলে নিয়ে পড়তে লাগলেন আবার।
খাওয়া দাওয়া সেরে অফিস ঘরে ঢুকে দেখি আগের মতই চেয়ারে হেলান দিয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে খেলছেন ভদ্রলোক টেবিলের ওপর ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে টোকা মেরে। খেলা থামালেন আমাদের দেখে। ড্রয়ার থেকে একটা খাম বের করে ধরিয়ে দিলেন রাজুর হাতে, বললেন, ‘বিকেলের ট্রেনেই কোচবিচার চলে যান ঠিকানা মত। যা হোক ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। টাকা পয়সা নেই নিশ্চয়ই—
পকেট থেকে পাঁচখানা দশ টাকার নোট বের করে হাতে দিলেন।
ফরোয়ার্ড ব্লক অফিস থেকে বেরিয়ে কৌতুহল হলো ভদ্রলোকের পরিচয় জানার জন্য। গাম গালানো চিঠির মুখ খুললাম সন্তর্পণে। ইংরেজিতে লেখা চিঠির প্রেরকের নাম কমলগুহ (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের কৃষিমন্ত্রী)।
কোচবিহার গামী ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে প্লাটফর্মে। মিনিট কয়েক বাকি তখনো ট্রেন ছাড়ার। টিকেট কেটে বাইরে উঁকি মারলাম একটু দেখার জন্য। সাদৃশ্যে কুড়িগ্রাম স্টেশনের মতই অনেকটা। একটি মাত্র রাস্তা মূল শহরের দিকে চলে গেছে স্টেশন থেকে। গরুর গোবর, উচ্ছিষ্ট আর প্যাক-কাদা যথেষ্ট নোংরা বাইরের দিকটা। গা ঘিন ঘিন করে উঠলো ঘৃনায়। মুখটা দ্রুত ঘুরিয়ে নিয়ে হাঁটা দিলাম প্লাটফর্মের দিকে। পেছন থেকে কে যেন নিক নাম ধরে ডাক দিল আমাকে। থমকে দাঁড়ালাম। শুনতে ভুল হয়েছে ভেবে হাঁটতে লাগলাম আবার। ডাকটা এবার আরো কাছে থেকে শুনলাম স্পষ্ট। পেছন ফিরে তাকিয়ে বিস্মত হলাম।
: ভরত।
আমার স্কুল বন্ধু। কুড়িগ্রাম রিভার ভিউ হাই স্কুলে পড়েছি এক সাথে এসএসসি পর্যন্ত। এরপর আমি ভর্তি হয়েছি এসে ঢাকা আবুজর গিফারী কলেজে। ও পাশ করতে পারিনি সে বছর। ছাড়াছাড়ি সেই থেকে। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে।
: তুই এখানে!
গলা থেকে হাত দুটো ছাড়িয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
: বাব মারা গেছে জানিস তো। মা ভাই বোন নিয়ে পালিয়ে এসেছি। স্টেশনের বাইরে একটা বাক্স নিয়ে পানের দোকান দিয়ে বসেছি, ছোট ভাইটাকে লাগিয়ে দিয়েছি একটা বিস্কুটের কারখানায়—
হয়তো আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো ভরত। থামিয়ে দিলাম মাঝপথে। কেন জানি এসব কথা ভাল লাগছিলোনা আমার। সিটি বেজে উঠলো গার্ডের। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। দৌড়ে গিয়ে চলন্ত ট্রেনের পাদানিতে দাঁড়ালাম। তাকালাম একবার পিছন ফিরে। ভরত তাকিয়ে রয়েছে তখনও আমার দিকে।
নিউ কোচবিহার স্টেশনে যখন ট্রেন এসে দাঁড়ালো তখন রাত আটটা প্রায়। অপরিচিত শহরে রাত একটু গভীর বলেই মনে হলো। চিঠির ঠিকানা ধরে এই রাত্রে গিয়ে হয়তো পাওয়া যাবে না ভদ্রলোককে। অযথা অজানা অচেনা জায়গায় ঘোরাঘুরি না করে বরং রাতটা স্টেশনের ওয়েটিং রুমে কিংবা প্লাটফর্মের বেঞ্চে শুয়ে বসে কাটিয়ে দেয়াই শ্রেয় মনে করলাম। যাত্রী-কুলির ঠেলাঠেলি, কোলাহল স্টেশনের থিতিয়ে এলো এক সময়। রয়ে গেলাম শুধু আমরা তিনজন আর ভাসমান বাসিন্দা যারা স্টেশনের। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকার পর রাজু বললো, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়? ব্যঙ চাতরা রোডে আমার মামার বাড়ি। রাতটা না হয় ওখানে গিয়েই উঠি। সকালে যা হোক—
: কেমন মামা তোর?
জিজ্ঞেস করলো মুবিন।
আম্মার আপন চাচাতো ভাই। আসা যাওয়া করতে করতে আপন মামার চেয়েও আপন হয়ে গেছেন।
এইতো ক'দিন আগেও চিঠি লিখেছেন আমাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য।
রাত দশটায় পৌঁলাম এসে ব্যাঙ চাতরা রোডে। মোটামুটি নিঝুম পরিবেশ এদিকটায়। আলো জ্বলছে কেবল রাস্তার লাইট পোস্টে। কড়া নাড়ার কিছুক্ষণ পর সদর দরোজা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো যে ছেলেটি তার নাম বাবুল রাজুর মামাতো ভাই। আমাদেরই বয়েসী। রাজুকে দেখে ডগমগ হয়ে উঠলো খুশিতে।
উচ্চস্বরে ডাক দিলো গদগদ কণ্ঠে, ‘বাবা-মা-বড়দি-দেখে যাও কে এসেছে।'
: কে এসেছে রে বাবুল?
ঘরের ভিতর থেকেই পুরুষ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
: পাকিস্তান থেকে রাজুদা এসেছে।
ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এলো একজন তরুণী। বছর বিশেক বয়স হবে। লম্বায় সাড়ে পাঁচ ফুট প্রায়। মোটাগাটা স্বাস্থ্য। ফর্সা গায়ের রং। মুখের আদল জাপানিদের মত অনেকটা। রাজুর কথা শুনে ছুটে বেরিয়ে এসে সামনে আমাদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো বারান্দায়। অপ্রস্তুত ভাবটা ক্রমশঃ সামলে নিয়ে বললো বাবুলকে, ‘বাইরের ঘরে নিয়ে গিয়ে বসাও ওদের।'
বাইরের ঘর বলতে দোচালা টিনের ঘর একটি। কুড়ি বাই পনের ফুট। ভিতরের বেশি অর্ধেকটা জুড়ে খড়ির চালা। বাকি অর্ধেকটায় কাঠের চৌকি একটি তাতে কাঁথা বিছানো একখানা। বসলাম ওর ওপরই। বাবুলই একমাত্র সরব ব্যক্তি এ বাড়িতে। আর কেউ যে আছে এ বাড়িতে তা বোঝা গেল না আর। রাজুর নিয়মিত যাতায়াত আছে এ বাড়িতে সেটা স্পষ্ট হলো বাবুলের কথাবার্তা শুনে। বেশ আমুদে আর আন্তরিক ছেলে। পূর্ব পাকিস্তানে যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে সবই জানে তারা। দলে দলে শরণার্থী যে ঢুকছে ভারতে সে খবরও অজানা নয় তাদের।
: তোমরা কি রাজুদা পালিয়ে এসেছে?
: না।
সংক্ষিপ্ত উত্তর দেয় রাজু।
: তবে—
রাত বাড়ছে। বুঁজে আসছে দু'চোখ ক্লান্তিতে। কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছি কখন বলতে পারব না। ঘুম ভাঙ্গতেই পেট চিন চিন করে উঠলো ক্ষুধায়। সকাল হয়ে গেছে। রাতে কেউ খাবার খেতে ডেকেছিলো কিনা মনে করতে পারলাম না। কলপার থেকে হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখি বিছানার ওপরই একবাটি শুকনো মুড়ি আর লাল চা তিন কাপ। ক্ষুধার পেটে তাই মুঠো দুয়েক গিলে রওয়ানা দিলাম চিঠির ঠিকানায়। বাবুলও সঙ্গে নিলো আমাদের। ভিতর থেকে কে যেন বাধা দিল। কান দিল না বাবুল সে কথায়।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু রোডে ডাক্তার পি.সি. বড়–য়ার চেম্বারে এলাম। অত্যন্ত রাশভারী ভদ্রলোক। পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়স। ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি। বড় বড় চোখ দু'টোতে পুরু লেঞ্চের চশমা। ধূপ দুরন্ত ধুতি। কোচড় ঢুকানো বাংলা সার্টের পকেটে মেলে আছে যেন পদ্ম ফুলের মত। ইঙ্গিতে বসতে বললেন আমাদের। কমল গুহের চিঠিখানা পড়ে মুখ তুলে তাকালেন। কিছু জিজ্ঞেস না করেই প্রেসক্রিপশন লেখার কাগজে ঠিকানা লিখে যেতে বললেন বাবুল সঙ্গে থাকাতে ঠিকানায় পৌঁঁছতে সহজ হয়ে গেল আমাদের। রাজবাড়ির চৌহদ্দির ভিতরে মূল ফটক থেকে প্রায় পাঁচশ গজ পশ্চিমে সরু গলির মতো রাস্তা হেঁটে এসে দাঁড়ালাম একটি দালানের সামনে। দালানটা পুরনো প্যার্টানে তৈরি হলেও রাজবাড়ির অন্য সব দালান থেকে এটাকে স্বতন্ত্র মনে হলো। ভিতরে ঢোকার পথটা অন্ধকারাচ্ছন্ন। ঘুমঘর যেন। গা ছমছম পরিবেশ। আবর্জনার মধ্য দিয়ে দোতলা ওঠার সিঁড়ি। নড়বড়ে রেলিং এ হাত রেখে উঠে এলাম দোতলায়। ছোট ছোট কুঠুরী। অপর্যাপ্ত আলোয় হঠাৎ করে দেখা যায় না কিছু। প্রতিটি কুঠরীতে জ্বলছে মোমবাতি। ওরই মধ্যে নিবিষ্ট চিত্তে কাজ করে চলেছে বিভিন্ন বয়সের ছেলেরা। পিন পতন শব্দ নেই কোথাও। আমাদের উপস্থিতিতেও কারো কোন কৌতুহল নেই। ফিরেও তাকাচ্ছে না কেউ আমাদের দিকে। পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগলাম আধো অন্ধকারে। কাজ করছে যে ছেলেগুলো তাদের একজনের পাশে এসে দাঁড়ালাম। কাজের ধরণ দেখে ভয়ে শুকিয়ে গেল ভেতরটা। বোমা পাইপগানসহ বিভিন্ন ধরনের আগ্নেয়অস্ত্র তৈরি করছে ওরা। এরই মধ্যে একজন যুবক এসে দাঁড়ালো সামনে। হালকা পাতলা চোহারা। তামাটে গায়ের রং। বাটি ছাট চুল মাথার। টানাটানা ডাগর চোখের মুখটা বসন্তের গর্তে ভরা। হাত দুটোতেও বসন্তের কালো দাগ ফুটে রয়েছে। গায়ে ফতুয়া। ঘ্যাগের মত কন্টিহার বেরিয়ে এসেছে সামনের দিকে।
: আমার নামই সুবিনয়।
চেহারা এবং কণ্ঠের মধ্যে আশ্চর্য রকমের অমিল।
সু-মিষ্ট কণ্ঠস্বর। মুগ্ধ হওয়ার মত। বোঝা গেল আমাদের আগমন বার্তা আগেই পৌঁছে গেছে তার কাছে।
: চাইলে আপনারা আজকেই কাজে লেগে যেতে পারেন।
দ্বিধা জড়িত কণ্ঠে বললাম, ‘দু'টো দিন অন্তত সময় চাই। আত্মীয়ের বাড়িতে এসে দ্বিধা জড়িত কণ্ঠে বললাম, ‘দু'টো দিন অন্তত সময় চাই। আত্মীয়ের বাড়িতে এসে উঠেছি কিনা'।
: বেশতো, আপনাদের সুবিধা মতই আসবেন।
বাড়তি কথা নেই একটিও। সম্বোধনও নেই কোন। যেমন এসেছিলেন সুবিনয় চলে গেলেন তেমনি অন্ধকার সঙ্গে নিয়ে।
এক রকম ছুটে বেরিয়ে এলাম অন্ধকূপ থেকে। ভয়ে শরীরটা কাঁপছে তখনও। ব্যস্ত রাস্তায় এসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস টানলাম। পুনঃজীবন ফিরে পেলাম যেন। আর নয় এখানে যত শীঘ্র সম্ভব দিনহাটা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার এই সিদ্ধান্তে বোধ করি বাবুল একটু অখুশীই হলো। তার ইচ্ছে শহরটা আমাদেরকে ঘুরে দেখানো। কথাটা সে বলে ফেললো রাজুকে।
: আমরা তো বেড়াতে আসিনি বাবুল।
শীতল কণ্ঠ রাজুর। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য যে উচ্ছাস নিয়ে ঘর ছেড়েছিলো রাজু আমাদের সঙ্গে, খেয়াল করছি সেই উচ্ছল চোখে-মুখে রাজুর লেপ্টে আছে কেমন যেন এক বিষাদের ছায়া। ছিলো না যা গত কাল সন্ধ্যা রাত পর্যন্ত।
: আজকের রাতটা অন্তত থেকে যাও রাজুদা। ভাল দুটো হিন্দি ছবি চলছে এখানকার হলে, তোমাদের সঙ্গে আমিও দেখবো ভেবেছিলাম। নতুন নায়ক নায়িকার ছবি।
সিনেমা। তাও আবার হিন্দি। মনটা আনচান করে উঠলো এই মহাসংকটের মধ্যেও। মুবিনও গড়িমিসি করতে লাগলো দিনহাটা ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে। একা কি করবে রাজু। সম্মতি দিতে হলো অনিচ্ছা সত্তে¡ও। তবে একটা শর্ত সে রাখলো বাবুলের কাছে। রাত্রের আগে বাড়ি ফেরা যাবে না কোনক্রমেই। বাবুল রাজী তাতেই। কিন্তু কেন এই শর্তারোপ? অন্য দুজন না বুঝলেও আমি স্পষ্ট বুঝলাম। সরল রাজুর মনের গভীরে যে একটা ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে তা ঢাকতেই পালিয়ে বেড়ানোর এই অভিনয়টুকু করতে হচ্ছে তাকে।
চষে বেড়ালাম কোচবিহার শহর। রাজবাড়ি ঘুরে দেখতেই বিকেল গড়িয়ে গেল। সন্ধ্যায় রেখা, নবীন নিচল নতুন জুটির ‘শাওন ভাদো' ভবানী কি বৈশাখী হলে (সঠিক মনে নেই) এবং নাইট শো'তে ‘জান মেরা নাম' দেবানন্দ, হেমা মালিনী জুটির ছবি ‘কো-অপারেটিভ' হলে দেখে রাত্রি বারোটা নাগাদ ফিরে এলাম রাজুর মামা বাড়িতে। আমাদের ফিরে আসার শব্দে আলো জ্বলে উঠলো শোবার ঘরে। দরোজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে এলেন বাবুলের বড় বোন যুথি আপা। আমাদের ফেরার অপেক্ষাতেই বোধ করি জেগে বসে ছিলেন এতক্ষণ। রুষ্ট কণ্ঠে বললেন, ‘তোমার ঘরের টেবিলে খাবার ঢাকা রয়েছে, খেয়ে নিও।' ঘরে ঢুকে সশব্দে কপাট বন্ধ করে লাইট অফ করে দিলেন।
মেঝেতে মাদুর পেতে খেতে বসলাম চারজন। ভাত ছোট একটি গামলায়। ক্ষুধা পেটে বড় জোর একজনের পেট ভরতে পারে ঐ ভাতে। তরকারি কাঁসার বাটিতে। হাঁসের একটা ডিম চার ফালি করে ভাগ করা। ঝোলের পানিতে ভাসছে ফালি কয়েক আলু। টকটক ঘ্রান বের হচ্ছে ডিমের ঝোল থেকে। চোখের সামনে এই খাবার দেখে মনে পড়ে গেল নিজের জীবনের একটি ঘটনার কথা।
তখন কুড়িগ্রাম রিভার ভিউ হাই স্কুলের ছাত্র আমি। আমার গ্রাম সদর মহকুমায় হলেও বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব প্রায় মাইল তিনেক। ধরলার খেয়া পার হয়ে যাতায়াত করতে হয়। খড়া মৌসুমে পায়ে হেঁটে প্রতিদিন আসা যাওয়া করতে অসুবিধা হতো না কোন। কিন্তু বর্ষাকালে এই তিন মাইল দূরত্বের পথ হয়ে যেত প্রায় ছ-সাত মাইল। খড়স্রোতা ধরলার ভয়াল রুপে দেখা যেত না তখন নদীর একূল-ওকূল। পাটেশ্বরী বন্দর থেকে কুড়িগ্রাম পর্যন্ত দীর্ঘ এই নদী পথে নৌকা করে আসা-যাওয়া ছিল খুবই বিপদজ্জনক। এই সময়টাতে শহরে কারো না কারো বাসা বাড়িতে আশ্রয় নিতে হতো কিংবা লজিং থাকতে হতো। কিন্তু লজিং থাকার ঝক্কি ঝামেলা আমি সামলাতে পারতাম না বলেই থাকতাম এখানে সেখানে। একবার আশ্রয় জুটলো নিকট এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তবে ঘরে নয়-ঘরের বাইরে বারান্দার মেঝেতে। ঝড়-বৃষ্টি এলে বিছানাপত্র গুটিয়ে বসে থাকতাম সারারাতে গুটিশুটি মেরে। স্বস্তি পেতাম এই ভেবে তবুও তো আশ্রয় পেয়েছি একটা। যদিও তাদের বিত্ত-ভৈববের তুলনায় আমাদের সাংসারিক স্বচ্ছলতা ততোটা ভাল ছিল না, তবুও প্রখর আ—মর্যাদা সম্পন্ন আম্মা মাসের প্রয়োজনীয় চাল-ডাল, সম্ভব যতটা তরি-তরকারিও সঙ্গে দিয়ে দিতেন আমার। সেই হিসেব কষে আত্মীয়া পরিমাণ মত চাল কাপড়ে বেঁধে পুটলীটা ছেড়ে দিতেন তাদের ভাতের পাতিলে। পরে কাপড়ের পুটলী সমেত সেই ভাত থালায় খেতে দিতেন আমাকে। অনেক সময় পুটলী খুলতে গিয়ে রুচি নষ্ট হয়ে যেত ভাতের সাথে জড়িয়ে থাকা কাপড়ের সুতো দেখে। সেদিনটা উপোস দিতাম শুধু পানি খেয়ে। গ্রামের ছেলে আমরা পরিমাণে ভাত একটু বেশিই খাই, এই বেশি অংশটুকু যাতে তাদের ভাত থেকে না যায় সেজন্যই এই ব্যবস্থা করেছিলেন আমার হিসেবি আত্মীয়া।
সামনে রাখা খাবার দেখে আজ সে কথাই মনে পড়ে গেল। চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ালাম। মুবিনও অনুসরণ করলো আমাকে। রাজু হাত গুটিয়ে বসে রইলো।
পরদিন ঘুম থেকে কেউ জেগে উঠবার আগেই রেল স্টেশনে এসে পৌঁছলাম আমরা।
কোচবিহারের সবিস্তার বর্ণণা শুনে খানিকক্ষণ চুপ করে থাকলেন কমল গুহ। তারপর বললেন, ‘খবর পেয়েছি ভুরুঙ্গামারীতে ট্রেনিং এর ব্যবস্থা হয়েছে, বিলম্ব না করে আপনারা ফিরে যান সেখানে।'
এই সুযোগে মেহেরনিগার খালার সঙ্গে দেখা করার লোভটা সামলাতে পাড়লাম না কিছুতেই। নাজিরহাট হয়ে মশালডাঙ্গা সিটমহল দিয়ে ঢুকলাম পাথরডুবিতে। খালাবাড়িতে দুপুরের ভোজন সেরে একরকম পালিয়ে চলে এলাম ভুরুঙ্গামারীতে।
ভুরুঙ্গামারী কলেজ মাঠে পুলিশের জনৈক সাব-ইন্সপেক্টরের তত্ত্বাবধানে ট্রেনিং নিচ্ছিলো বেশ কিছু ছেলে। আমরাও এসে যোগ দিলাম তাদের সঙ্গে। লেফ-রাইট করতে করতেই কেটে গেল দিন দুই। তৃতীয় দিনে এলো আরো বেশ কিছু ছাত্র কুড়িগ্রাম কলেজের, তারাও যোগ দিল আমাদের সঙ্গে ফলে সমস্যা দেখা দিলো একজন প্রশিক্ষকের পক্ষে এত ছেলেকে সামলানো। ঠিক হলো পঁচিশ জনের আলাদা আলাদা গ্রুপ করে ফিজিক্যাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করা। মুকুল ফৌজের সক্রিয় সদস্য হওয়ার কারণে একটি গ্রুপের শারীরিক কসরৎ শেখানোর দায়িত্ব পড়লো আমার ওপর। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরৎ শেখাতেই সপ্তাহ কেটে গেল। শুক্রবার ছিলো সেদিন। রাতের খাবারের পর বিচ্ছিন্ন ভাবে হাঁটাহাঁটি, গল্প গুজব করছিলাম কেউ কেউ। এমন সময় নির্দেশ এলো কলেজের সবচেয়ে বড় ক্লাস রুমে একত্রিত হওয়ার। হুড়োহুড়ি করে এসে সমবেত হলাম সবাই। কারণ বুঝতে না পেরে একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম। এমন সময় আমাদের মাঝে এসে পৌঁছলেন মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয়কারীর দায়িত্বপ্রাপ্ত ছাত্রলীগ নেতা আখতারুজ্জামান মণ্ডল। উৎসুক দৃষ্টি সবার তার দিকে। আখতারুজ্জামান কোনরকম ভূমিকা না রেখে সরাসরি বললেন, ‘আগামীকাল ভোরে তোমাদেরকে লংমার্চের জন্য তৈরি থাকতে হবে।'
এক'শ দশজনের বিরাট দল। মোরগ ডাকা ভোরে সবাই ফলিন হলাম সামরিক নিয়মে। সূর্য ওঠার আগেই অজানার উদ্দেশ্যে রওয়া হলাম জোর কদমে কুচকাওয়াজ করতে করতে। অত সকালেও রাস্তার দু'ধারে দাঁড়িয়ে শত শত জনতা হাত নেড়ে উৎসাহ দিতে লাগলেন আমাদের। অসুস্থ্যতার কারণে লংমার্চ থেকে বাদ পড়ে গেল মুবিনসহ জনাচারেক উৎসাহী তরুণ। সকাল সাতটার কিছু পরে পৌঁছলাম এসে বাংলাদেশ সীমান্তের বাগভান্ডারে। নো ম্যানস ল্যান্ডে একটি কংক্রিটের ব্রীজের তলায় আমাদের বিদায় জানাতে দাঁড়িয়েছিলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেস। এক এক করে এগিয়ে গেলাম তার সামনে। ক্যাপ্টেন আমাদের প্রত্যেকের বুক চাপড়ে পরীক্ষা করতে লাগলেন ফিজিক্যাল ফিটনেস। এখানেও বাদ পড়ে গেল জনা দশেক। হ্যান্ডশেক করে বাকিদেরকে বিদায় জানালেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেস। সীমান্তের ওপারে অপেক্ষমান শিখ মেজর ও বিএসএফ জোয়ানরা স্বাগত জানালেন আমাদের। সকাল দশটার কিছু পরে সাহেবগঞ্জ এসে পৌঁছলাম আমরা। সেখানে একটি মাইনর স্কুলের মাঠে বসতে দেয়া হলো আমাদের। একসঙ্গে এত মানুষ দেখে স্থানীয় কৌতুহলী মানুষের ভীড় জমে উঠলো। যুদ্ধে যাওয়ার আগেই উপস্থিত মানুষের মুখে মুখে যুদ্ধ জয়ের স্তুতি আর বীরত্বের মহিমায় অভিসিক্ত হতে লাগলাম আমরা। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে মেজাজটা খিটখিটে হয়ে উঠলো ক্ষুধার যন্ত্রণায়। নিয়ন্ত্রণহীন শরীরটা আপনা-আপনি ঢলে পড়তে লাগলো ঘাসের ওপরে। এই যখন অবস্থা ঠিক তখনই জনতার ভিড়ে একটা পরিচিত মুখ চোখে পড়লো। দেখি জ্বলজ্বল চোখে সেও তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। চার চোখের মিলন। উঠে দাঁড়িয়ে কোন রকমে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এসে দাঁড়ালাম তার মুখোমুখি। জড়িয়ে ধরলাম দু'জন দু'জনাকে। এ ক্ষণ যেন মহামিলনের। থাকলাম কিছুক্ষণ এইভাবে। তারপর ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুই এখানে'?
: দিদির বাড়িতে এসে উঠেছি।
নিপুন সরকার। আমাদের নিপুদা। একই গ্রামে বাড়ি। দু'জন আমরা দু'পাড়ার। বয়সে বছর তিনিকের বড় হলেও বন্ধুত্বের গভীরতা একসঙ্গে নাটক করার সুবাদে। আমাদের গ্রামে মঞ্চস্থ প্রথম নাটকের নায়িকা ছিলো সে। অদ্ভূত সুন্দর ফর্সা। কণ্ঠস্বরটা অনেকটা মেয়েলী। সাজলে চেহারাটা দেখাতো অনেকটা গিরীশ যুগের নায়িকা কুসুমকুমারীর মত।
নিপুদার চোখ ছলছল করে উঠলো। হাত ধরে টানতে লাগলো আমাকে, ‘তুই চল আমার সঙ্গে। দেখা যখন পেয়েছি কোথাও যেতে দেবনা তোকে। কুলিগিরি করে খাব দু'জনে।
: কুলিগিরি সবাইকে মানায় না নিপুনদা। আমি মরে যাব ফিরবো না তবুও।
আমার ধনুক ভাঙ্গা পণ দেখে দমে গেল নিপুদা।
: তুই যে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছিস কাকা জানেন সে কথা?
অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকলাম।
: বেশ, কিছু বলবো না তোকে, শুধু একটিবার আয় আমার সঙ্গে কিছু মুখে দিয়ে আসবি দিদির ওখান থেকে। দিনি খুশি হবেন তোকে দেখলে।
: এদের ছেড়ে একা আমি যেতে পারি না নিপুদা।
: সবাইকে খাওয়ানোর সামর্থ কি আমার দিদির আছেরে।
আশাহত নিপুদা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে মিলিয়ে গেল আবার ভীড়ের মধ্যে।
উপবাসে প্রায় সারাদিন কেটে যাবার পর সামরিক বাহিনীর পাঁচখানা ট্রাক এসে দাঁড়ালো স্কুল মাঠে। ত্রিপল ঢাকা এই ট্রাকে উঠে রওয়ানা হলাম আমরা আবার এক অজানা পথে।
সন্ধ্যার কিছু আগে ট্রাকগুলো এসে দাঁড়ালো যে জায়গায় চারদিকটা তার ঘেরা ঘনজঙ্গলে। বিক্ষিপ্ত সামরিক তাঁবুগুলো ঢাকা পড়ে আছে মানুষ সমান লম্বা কাঁশবনের আড়ালে। এই কাঁশবনেই বসতে দেয়া হলো আমাদের। একে সারাদিনউপবাস তার উপর পথের ক্লান্তি। অবসন্ন শরীরটাকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। ঢলে পড়লাম কাঁশবনের ওপরই। পাশেই আরেকটি গ্রুপ দাঁড়িয়ে আছে সারিবদ্ধ লাইন দিয়ে। ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করে জানলাম জায়গাটা টাপুরহাট। মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিতে নাম লেখাতে হবে এখানেই। দীর্ঘ সময়ে তালিকার কাজ শেষ হতেই খেতে দেয়া হলো আমাদের। কলাপাতায় প্লাস্টিকের মত মোটা মোটা ভাত আর বুটের ডাল। ভেসে আছে তাতে মরা বড় বড় নাটাপোকা। ঘেন্নায় সব উল্টে এলো ভেতর থেকে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি এই খাবারই গো-গ্রাসে গিলছে সবাই।
কলাপাতা ফেলে হাত ধুতে যাচ্ছিলাম পুকুরের পানিতে। হঠাৎ কমান্ড ভেসে এলো পেছন থেকে, ‘গেট রেডি, এক্ষুণি আমাদের রওয়ানা দিতে হবে'। ফিরে এলাম সবাই হুড়োহুড়ি করে। যে যে অবস্থায় ছিলাম সেভাবেই উঠে বসলাম ত্রিপল ঢাকা ট্রাকে।
রাত নটার দিকে ট্রাকগুলো বেরিয়ে যেতে লাগলো টাপুরহাট সামরিক ক্যাম্প থেকে। দু'শ জনের এই দলে সবাই ছিলাম আমরা লালমনিরহাট এবং ভুরুঙ্গামারী থেকে আসা।
বিরতিহীন ছুটে চলেছে ট্রাকগুলো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে। শহর-বনাঞ্চল, সুদীর্ঘ সবুজ চা বাগান চোখে পড়ছে মাঝে মাঝে রাস্তার লাইট পোস্টের আলো এসে চোখে পড়ছে যখন। কখনো কোলাহল মানুষের। পাথর নিস্তব্ধতা কখনো। জনশূন্য পাথার। কখনো গভীর বনাঞ্চলের সর্পিল পথ। এরই মধ্যে জেগে-কখনো বা তন্দ্রা জড়ানো চোখে চলেছি গন্তব্য পথে।
কেটে গেছে কতক্ষণ বলতে পারবো না। ট্রাকের ঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল হঠাৎ। কিছু বুঝে উঠবার আগেই নির্দেশ এলো, ‘নেমে পড় সবাই।'
বিশাল এক হল রুমে এনে জড়ো করা হলো আমাদের। রাত্রি কত জানার উপায় ছিলো না কোন। চিমনী বাতির আলোয় শব্দহীন সামরিক বাহিনীর জোয়ানদের তৎপরতাই চোখে পড়লো কেবল।
পরদিন সকালে নাস্তার পর্ব শেষ হতেই খাকি হাফপ্যান্ট ও নতুন বাংলা হাফসার্ট পড়তে দেয়া হলো আমাদের। বলা হলো সেই সাথে সকাল আটটার মধ্যে মেডিকেল সেন্টারে উপস্থিত থাকতে শারীরিক চেকআপের জন্য। সামরিক নিয়মে মুক্তিযোদ্ধা বাছাই প্রক্রিয়াতে শংকিত ও হতাশ হয়ে পড়লাম স্বাধীনতা যুদ্ধে জীবন উৎসর্গ করতে আসা জনা বিশেক তরুণ (তাদের অবশ্য পরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল শরণার্থী ক্যাম্পে)। উত্তীর্ণরা দাঁড়ালাম এসে ক্যামেরার সামনে একে একে প্লেটে লেখা বডি নম্বর বুকে লাগিয়ে।
এবার গ্রুপ ভাগ। ছাত্র, অছাত্র, সামরিক ও আধা সামরিক পৃথকিকরণ। কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা সামরিক এলাকার ভিতর টিনের ছাউনী দেয়া বৃহদাকারের কয়েকটি ঘরে এ্যারো মার্ক চোখে পড়লো। হার্ডবোর্ডে লালকালিতে লেখা রয়েছে তাতে চার্লি উইং, ডেল্টা উইং ও ভাসানী উইং। অছাত্রদের থাকার ব্যবস্থা ভাসানী ও চার্লি উইংএ। সামরিক ও আধাসামরিক ব্যক্তিদের জন্য ডেল্টা উইং [যা সেখানকার কমান্ডিং অফিসারের (সি.ও) অফিস সংলগ্ন]। আর আমরা জনাপঞ্চাশেক ছাত্রের থাকার ব্যবস্থা হলো এই দুই উইং থেকে প্রায় হাজার গজ দূরে চা বাগান ও গভীর বনাঞ্চল পরিবেষ্টিত ওসমানী উইং-এ।
দুপুরে খাবার পর সেদিনের মত বিশ্রাম নিতে ছুটি দেয়া হলো আমাদের। এমন পরিবেশে শুয়ে বসে না থেকে ক্যাম্পের চারদিকে ঘুরে দেখার ইচ্ছে জাগলো মনে। কাউকে কিছু না জানিয়ে সুযোগ বুঝে চুপি চুপি বেরিয়ে পড়লাম উইং থেকে। গত রাত্রে অন্ধকারে এবং আজকে সারাদিনের ব্যবস্ততায় যা চোখে পড়েনি ঘুরতে বেরিয়ে এখন তা স্পষ্ট হলো চোখের সামনে। ক্যাম্পে প্রবেশ পথে টিনের বড় একটি সাইন বোর্ডে কালো রংয়ের ওপর লাল কালিতে লেখা রয়েছে ‘মুরতি ক্যাম্প' (পরবর্তীতে ‘মুজিব ক্যাম্প' নামকরণ করা হয়)। সমতল ভ‚মি থেকে প্রায় হাজার ফুট ওপরে এই ক্যাম্পের অবস্থান। দুই মাইলের মত বৃত্তকায় ক্যাম্পটাকে ঘিরে প্রাকৃতি সৌন্দর্য্যে ঢাকা পাথরের সু-উচ্চ পাহাড় আর চা বাগান। র্কাটাতারের বেড়া দিয়ে চারদিকে ঘেরা ক্যাম্পের উত্তর-পূর্ব দিকে পাহাড়ের গা বেয়ে ঝমঝম শব্দ করে নামছে ঝরণার পানি। আ—হারা হয়ে গেলাম আনন্দে। সন্তর্পনে এগুতে লাগলাম সামনে। ঝর্ণার কুয়াশা ভেদ করে চোকে পড়লো একটা পিচের পাকা রাস্তা। গভীর অরণ্যের ভিতর দিয়ে মিশে গেছে তা দূরে কোথাও। চা বাগান পেরিয়ে টিলার মত একটি পাথরের চূড়ায় এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের কোলে ঝুলে আছে ঝুপড়ির মত ছোট ছোট ঘর। ভুটানী মহিলা-পুরুষদের চলাফেরা চোখে পড়লো। দুর্বার এক আকর্ষণ টানতে লাগলো আমাকে। কি হবে সে সবের তোয়াক্কা না করে কাঁটাতারের বেষ্টনী পার হয়ে নেমে এলাম নিচে পাহাড়ের গা বেয়ে। পাথরের ওপর দিয়ে সাবধানে হেঁটে এসে দাঁড়ালাম আরেকটি পাথরের ওপর। ফার্ণ গাছের ফাঁক দিয়ে তাকালাম পশ্চিম কোণে। যা চোখে পড়লো তাতে কলম্বাসের আমেরিকা আবিস্কারের মত উল্লাসে ফেটে পড়লাম। সঙ্গীহীন এই নির্জনতায় পশ্চিম দিকে তাকিয়ে বড় ভাল লাগলো বসে থাকতে আমার। দূরে অগুনতি পর্বত শ্রেণি। গাছ, লতাপাতা, গুল্ম বুকে করে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্থীরভাবে। কোন কোন পাহাড় কুয়াশায় ঢাকা। কোনটা মুক্ত। সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘা। দূরে লিংবয়ের রেস গ্রাউন্ড দেখাচ্ছে ঠিক খেলাঘরের উঠোনের মত। নিচে কার্টরোডের রাস্তা দেখা যাচ্ছে।
এসব দেখে মনে হচ্ছে, আমি যেন টেলিস্কোপ চোখে ‘অবজারভেটরী হিলে' বসে রয়েছি।
পালিয়ে এসেছিলাম একবার বছর দু'য়েক আগে আম্মার সঙ্গে ঝগড়া করে। আব্বার মামাতো ভাই ধুবড়ীর শহুদুজ্জামান চাচার সঙ্গে সেই সময় মনের সুখে চষে বেরিয়েছিলাম দার্জিলিংয়ের সর্বত্র। মুগ্ধ করা সেই সব জায়গা চোখের সামনে দেখতে পেয়ে বিমোহিত হয়ে গেলাম আরেকবার। এইভাবে দেখতে দেখতে সূর্য যে কখন পশ্চিম দিকে ঢলে পড়েছে টেরই পাইনি। হঠাৎ মনে হলো ক্যাম্প থেকে অনেক দূরে এসে পড়েছি। ফেরা জরুরি। নইলে পৌঁছতে পৌঁছতে রাত হয়ে যাবে।
ফিরতে গিয়ে ভানায় বিচলিত হয়ে পড়লাম। যদি কেউ দেখে ফেলে, উত্তর দেব কি? এমনি নানা কথা ভাবতে ভাবতে এক সময় চা বাগানের কাছাকাছি পাহাড়ের ধারে এসে পৌঁছলাম। ফিরে তাকালাম আরেকবার পেছনের দিকে। ফার্ণ গাছ আর লতাগুল্মের ফাঁক দিয়ে অসংখ্য বাঘের চোখের মত তখন দার্জিলিংয়ের সমস্ত বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেছে।
সামরিক ট্রেনিং শুরু হলো পরদিন থেকেই। সময়ের প্রতিটি সেকেন্ড এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিলো তখন যে পূর্ণাঙ্গ একজন সৈনিকের যা যা প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার সবই প্রায় শেখানো হয়েছে আমাদের সংক্ষিপ্ত কোর্সের মধ্যে দিয়ে। থিওরিটিক্যাল ক্লাস, প্রাকটিক্যাল প্রতিটি বিষয়ে প্রতিদিন বিশ ঘণ্টা করে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো আমাদের। প্রাকটিক্যাল প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন নায়েক তুলশী কুমার বিন্দ্রা, সুবেদার যোগেন্দ্র রাউত, সুবেদার মেজর অশ্বিনী কুমার ভার্মা। থিওরিটিক্যাল ক্লাস নিতেন মেজর বলবীর সিং এবং মেজর রণজিৎ কিদওয়ানী। থিওরিটিক্যাল ক্লাসগুলোর মধ্যে এক্সপ্লোসিবের ব্যবহার, ডামির মাধ্যমে গ্রেনেড থ্রো, গেরিলাযুদ্ধের কৌশল ও ব্যবহারিক প্রয়োগ সম্পর্কিত নানা বিষয়ে নিয়মিত ক্লাস নিতেন মেজর রণজিৎ কিদওয়ানী। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী কর্ণাটকের এই ভদ্রলোক ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী ও বন্ধুবৎসল। তাঁর ক্লাসের স্থিতি সময়ের গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকতো না কখনো। বাচনভঙ্গি ও সু-মিষ্ট কণ্ঠে বিষয় ভিত্তিক আলোচনা করতে গিয়ে যখন বুঝতেন তার আলোচিত বিষয়ের ওপর তেমন মনোযোগ নেই কারো তখন আচমকা বাঘের গর্জন, পাখির ডাক দিয়ে উঠতেন হববলার কণ্ঠে। মেতে উঠতেন কৌতুক আর সরস গল্পে। শুনতে চাইতেন গল্প আমাদের কাছ থেকেও। এভাবেই ক্লাসের দিকে মন ফেরাতেন তিনি আমাদের। রণজিৎ কিদওয়ানীকে আমরা ডাকতাম ‘রঙ্গিলা' বলে। তাঁর কৌতুক ও কথা বলার ঢংয়ে খুঁজে পেতাম অনেকটাই পাকিস্তানের কৌতুকাভিনেতা রঙ্গিলাকে।
দিন এভাবেই গড়াতে লাগলো ঠাঁসা এ্যাসাইমেন্টে।
একদিনের ঘটনা। রাতের ট্রেনিং শেষ করে ঘুমোবার আয়োজন করছি কেবল, এমন সময় টিনের চালে শব্দ করে পড়তে লাগলো গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি। সঙ্গে শির শিরে হিমেল হাওয়া। পাহাড়ি এলাকায় একবার বৃষ্টি শুরু হলে চলে তা টানা কয়েকদিন, মাসও পেরিয়ে যায় কখনো কখনো। এমনি বাতাবরণে জাগলো মনে অদ্ভূত এক খেয়াল। মাথায় মাফলার, গায়ে কম্বল জড়িয়ে দাঁড়ালাম এসে বারান্দায়। ঘরটা আমাদের অন্যান্য উইং থেকে বারো ফুট উঁচুতে। আস্ত গাছের একেকটা বীম ছাদ পর্যন্ত লম্বা। মেঝে কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরি সম্পূর্ণ। বেড়াও তাই। জানালাগুলো সাড়ে তিন ইঞ্চি বেড়ের রড দিয়ে তৈরি। মজবুত দুর্গের মত। ঘরে ওঠা নামা করতে হয় মই বেয়ে। হিংস্র জীবজন্তু থেকে নিরাপদ থাকতে কাছ শেষে মই তুলে রাখতে হতো ওপরে। বারান্দার এককোণে বসে তাণ্ডব দেখছিলাম প্রকৃতির। বয়ে যাওয়া জোর হিমেল বাতাসের সঙ্গে বৃষ্টিও পড়তে লাগলো ঝমঝম শব্দ করে। বিদ্যুতের চমক প্রচণ্ড। ভেসে আসছে অরণ্য থেকে বাঘ সঙ্গীতের মাতম। সব কিছু মিলিয়ে একটা অনাসৃষ্টি হানতে লাগলো শরীরে। অবস্থা বেগতিক বুঝে উঠে দাঁড়ালাম। ঘরে ঢোকার মুহুর্তে হঠাৎ ভেজা কাঠে পা পিছলে পড়ে গেলাম নিচে কম্বল জড়িয়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় বুঝে উঠতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। বুঝতে পারলাম যখন দেরি হয়ে গেছে ততক্ষণে। কিছুটা দূরত্বে অদ্ভূত একটা আওয়াজ ভেসে এলো কানে। ভয় পেয়ে গেলাম। ডাকবো যে কাউকে চিৎকার করে সে শক্তিও নেই। ব্যাথায় টন টন করে উঠলো মাথা। রইলাম পড়ে চুপচাপ তেমনি ভাবে। কাছে এসে থেমে গেল আওয়াজটা। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো আমার কানের ওপর। সাহস করে তাকালাম চোখ মেলে। পাশে হাঁটু গেরে বসে রয়েছেন সুবেদার মেজর ভার্মা। কিছু বললেন না। কোলে তুলে নিয়ে আমাকে উঠে এলেন মই বেয়ে ওপরে। ঘরে ঢুকে টর্চের আলোয় দেখে নিলেন চারদিকটা। অঘোরে ঘুমোচ্ছে সবাই। বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে নিরবে ভর্ৎসনা করলেন আমাকে। তারপর বর্ষাতিটা গায়ে চাপিয়ে নেমে গেলেন দ্রুত মই বেয়ে।
সপ্তাহ তিনেক পেরিয়ে গেল বিভিন্ন ট্রেনিং এর মধ্য দিয়ে। শুরু হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং।
যুদ্ধ মহড়া। সেদিনও বৃষ্টি হচ্ছিল টিপটিপ করে। সাড়ে পাঁচটা ভোর। যুদ্ধাবস্থায় তৈরি আমরা পঁচিশজনের একটি দল। সঙ্গে আটজন জোয়ান। কমান্ডিং এর দায়িত্বে সুবেদার মেজর ভার্মা। যুদ্ধাবস্থায় খাবার বরাদ্দ মাত্র চারখানা পাতলা পুরি। সারাদিনের জন্য এক লিটারের চেয়ে কম পানি। দরকারি সরঞ্জাম ভর্তি ব্যাগ পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ক্যাম্প থেকে।
বিপত্তি দেখা দিল শুরুতেই, সমতলে নেমে ঝরণা পাড় হতে গিয়ে। কোমর সমান গভীরতা। কিন্তু খড়স্রোতা। পানির ওপর শত শত মণ ওজনের এক একটি পাথর বিপদজ্জনক পিচ্ছিল। ওপারে যেতে পা ফেলতে হবে এই পাথরেরই খাঁজে খাঁজে। সামান্য অসতর্কতা মানেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। অনভিজ্ঞ আমাদের নিয়ে কোনরকম ঝুঁকি নিলেন না সুবেদার মেজর ভার্মা। আট জোয়ানকে দু'ভাগে দাঁড় করালেন ঝরণার এপার-ওপারে মোটা দড়ি টেনে ধরে। সতর্কভাবে এই দড়ি ধরেই পার হলাম ঝরণা একে একে। ছুঁচালো নুড়ি পাথর মাড়িয়ে, পাহাড়ের কোল বেয়ে, বিপদ সংকুল টিলার মতো পাথরের এক একটি চাড় ডিঙ্গিয়ে এসে ঢুকলাম গভীর অরণ্যের মধ্য দিয়ে যাওয়া পিচের রাস্তায়। প্রায় পঞ্চাশ ফুট চওড়া মসৃণ রাস্তাটা জনমানব শূন্য। দৃষ্টি যায় যতদূর মনে হয় দেখে সরু কালিরেখা একটা ঢাকা পরে আছে গাছের লতায় পাতায়। রোমাঞ্চকর পরিবেশে চলতে ভালোই লাগছে। রাস্তার দু'ধারে ফার্ণ, শাল, সেগুন, সুন্দরীসহ নানা গাছ। ফাঁকে ফাঁকে বিশাল বেত ঝাড়। পেকে ঝুলে রয়েছে নাসপাতি, কালজাম, গোলাপজাম ডালে ডালে। বেদানা, ডালিম ফেটে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে গাছের তলায়। পাকা টসটসে ফল গাছে ঝুলে থাকতে দেখে বড় লোভ হলো। কৌশল করে মূলদল থেকে পিছিয়ে পড়লাম আকবর, অপিল, চাঁদমিয়া আর আমি। রাস্তায় দাঁড়িয়েই অপিল ছিঁড়তে লাগলো বেদানা, ডালিম। কাঁধের ব্যাগ রাস্তার ওপর খুলে রেখে উঠতে লাগলাম জামগাছ বেয়ে। হাত দশেক মাত্র উঠেছি, ফোঁস শব্দ কানে বাজলো এসে বাতাসের মত। উপরে চোখ তুলে তাকিয়েই গা ছেড়ে দিলাম নিচে। মাটিতে পড়েই চিৎকার দিয়ে সোজা দৌড়ে এসে দাঁড়ালাম রাস্তায়। সর্বাঙ্গ কাঁপছে থরথর করে। আমার আচরণে হতভম্ব সঙ্গীরা কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলাম সোজা জামগাছের দিকে। অগুনতি সাপ কুন্ডলী পাকিয়ে জড়িয়ে আছে জামগাছ। তালুতে গিয়ে ঠেকলো ফল খাওয়ার সাধ। সরে এলাম সবাই দ্রুত। বুঝতে পারলাম এতক্ষণে ডামি যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার পূর্বে কেন বিশাক্ত ঘ্রাণের তরল ঔষধি মাখতে দেয়া হয়েছিল আমাদের গোটা শরীরে। হাঁটতে হাঁটতে ফরেস্ট ক্যাম্প চোখে পড়লো একটা। উঁকি মেরে দেখলাম চোখে পড়লো না কাউকে। বিশাল বনভ‚মির নির্জন রাস্তায় শেষ হয় না পথচলা। পিঠের ভারও বাড়তে লাগলো সময়ের সাথে সাথে। অসহনীয়। তেষ্টায় বুক ফেটে যাওয়ার উপক্রম। উপায় নেই তবুও একফোঁটা পানি পান করার। জানার উপায় নেই কোন কখন শেষ হবে এই যুদ্ধ মহড়া। প্রায় দশ মাইল হেঁটে আসার পর অরণ্যের গভীরে বয়ে যাওয়া সরু একটি নালার পাশে তাঁবু পড়লো আমাদের। সঙ্গে আসা গাইড সাবধান করে দিলেন আমাদের একা চলা ফেরা এবং এখানকার কোন পানি ব্যবহার না করার জন্য। এ পানিতে মিশে আছে বিষাক্ত সরীসৃপের লালা।
বেয়নেট দিয়ে পরিষ্কার করা হলো তাঁবুর আশপাশ। যুদ্ধ পরিকল্পনা সাজানোর জন্য জায়গা পরিষ্কার করা হলো কমান্ডারের তাঁবুর সামনে। উঁচু করা হলো জায়গাটা আলগা মাটি দিয়ে।
শরীর আর চলে না। নাস্তা খাওয়া হয়নি তখনও সকালের। বিরাম নেই তবুও হুকুম তামিলের। সময় কত? তাও জানার উপায় নেই। অরণ্যের অন্ধকার ভেদ করে সূর্যের দেখা পাওয়া দুষ্কর।
হুকুম এলো অবশেষে নাস্তা খাওয়ার। তবে কাজ বন্ধ করে নয়। কাজের ফাঁকে ফাঁকে। পুরি একখানা, পানি দুই ঢোক গিলে গলা ভিজিয়ে নিলাম কোন রকমে। ঝরণা পার হয়ে বনাঞ্চলে ঢোকার মুখে আমাদের দু'জন সঙ্গীকে রেখে আসা হয়েছে অন্যদলের যুদ্ধাবস্থান রেকি করতে। ওরা ফিরে এলেই তবে বসতে হবে যুদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে। প্রতিটি কাজ সারতে হচ্ছে আমাদেরকে দ্রুত বয়ে যাওয়া সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে।
নৈসর্গীক সৌন্দর্যের লীলাভ‚মিতে অবাধ বিচরণ যাদের তারা মানবে কেন আমাদের মত বেরসিক মানুষের উপস্থিতি। তাইতো স্ব-গর্ব উপস্থিতি বুঝাতে একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লো পিঠে শ্যাওলা জমা পাহাড়ি সাপ, চ্যাপটা শরীরের লম্বা লম্বা জোক, হনুমান আর বন্য হাতির দল। এ অবস্থায় গুটিগুটি মেরে বসে রইলাম তাঁবুর ভেতরে সবাই। কৌশলী গাইডরা পরিস্থিতি সামলে নিলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। ফিরে এসেছে ইতোমধ্যে রেকি দল। সাজানো হলো যুদ্ধ পরিকল্পনা তাদের সাহায্যে।
ভাঙলো খেলাঘর। তাঁবু গুটিয়ে নিয়ে রওয়ানা হলাম আবার পরিচিত সেই পথ ধরে। টিপটিপে বৃষ্টি নেমে গেছে একেবারে। বাতাসের উন্মাদনা নেই আগের মত। তবে আকাশ মেঘলা রয়েছে। শান্ত এবং সহায়ক পরিবেশ যুদ্ধ প্রাকটিসের জন্য। ঝরণার পাড়ে আসতে পথ পরিবর্তন করতে হলো বারকয়েক। ভুটিয়া বস্তির ভেতর দিয়ে পাহাড়ের আড়ালে গা ঢেকে উজানে এসে জড়ো হলাম। এমনিতে মেঘলা আকাশ। সেই সঙ্গে নেমে এসেছে সন্ধ্যার অন্ধকারও। আক্রমণ পরিকল্পনা সু-নির্দিষ্ট করতে এগিয়ে গেলেন মেজর ভার্মা টেলিস্কোপ চোখে। কিন্তু বিভ্রান্ত হতে হলো তাকে বর্তমান অবস্থার সঙ্গে রেকি পরিকল্পনায় অমিল দেখে। প্রতিপক্ষ সম্ভবত পরিবর্তন এনেছে তাদের পরিকল্পনায়। পূর্বের স্পট থেকে সরে এসে ছাউনী ফেলেছে তারা তুলনামূলক বিপদসংকুল স্থানে ফায়ারিং স্পট বরাবর ওপরে চা বাগানের ভেতর। ঝরণার পানির গভীরতা একটু বেশি এ জায়গাটায়। প্রায় পাঁচশ ফুট খাড়া পাহাড়। ওপরে ওঠার একমাত্র পথ তারা অবরোধ করে আছে। সবদিক বিবেচনা করে আমাদের পরিকল্পনাতেও তাৎক্ষণিক কিছু পরিবর্তন আনতে হলো। পাহাড়ের ঢালু বেয়ে সরাসরি ঝরণার পানিতে নেমে এলাম আমরা। গলা সমান পানি। তবে স্রোত নেই আগের মত। দু'হাতে রাইফেল মাথার ওপর তুলে ধরে শব্দহীন সন্তপর্ণে এগুতে লাগলাম পানি ভেঙ্গে ভেঙ্গে।
পাহাড়ের নিচে জড়ো হলাম সবাই। জয়-পরাজয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ব্যতিক্রম কিছু একটা করার এই তো সুযোগ। একমাত্র পথে এ্যাম্বুস করে বসে আছে তারা।
ওপরে ওঠার বিকল্প একমাত্র পাহাড়ের গা বেয়ে ঝুলে পরা লতাগুল্ম। তুচ্ছ করে মৃত্যু ভয় বেছে নিলাম এই পথই। উঠে এলাম লতাগুল্ম বেয়ে। জয় হলো সাহসের। আক্রমণ করলাম একযোগে। পরাজিত হলো প্রতিপক্ষ। জয়ের তৃপ্তি মুখে নিয়ে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। পথে আসতে আসতে মন্তব্য করলেন কমান্ডার, ‘ডামি নয়, আসল যুদ্ধই আজ করেছ তোমরা'।
এই ধারাবাহিকতায় ওসমানী, ভাসানী, চার্লি ও ডেল্টা উইং থেকে বাছাই করা পঁয়ত্রিশ জনের একটি দলকে পাঠানো হলো মেটেলির (জলপাইগুড়ি) ধূ ধূ বালুচরে এক্সপোলসিব ডেমনস্টেশন, মর্টার ফায়ার ও গ্রেনেড থ্রো'র প্রশিক্ষণের জন্য।
প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এলাম যখন সন্ধ্যারাত্রি উতরে গেছে। মিড আওয়ার। নিজেদের দেয়া কোড ল্যাংগুয়েজ। এটা বিশ্রামের সময় আমাদের। অর্থাৎ ট্রেনিংয়ের প্রথম পর্ব শেষ, দ্বিতীয় পর্ব শুরুর মধ্যবর্তী এই সময়টাতে আমরা সাধারণত হাঁটা-চলা, গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিই। কিন্তু আজ উইংয়ের কাছাকাছি হতেই কেমন যেন সব ফাঁকা ফাঁকা মনে হলো। দ্রুত মই বেয়ে ঢুকলাম ঘরে। চিন্তে পারলাম না কাউকে। সম্পূর্ণ অপরিচিত সব ছেলে বসে রয়েছে। বন্ধুদের কাউকে দেখতে পেলাম না সেখানে। বিছানাপত্রও কিছু নেই। ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলাম। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি সুবেদার মেজর ভার্মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন আমার পেছনে। ছেলের যত্নে এতদিন এই ভদ্রলোকটি আগলে রেখেছেন আমাকে। কিছু জিজ্ঞেস করবার পূর্বেই বললেন, ‘বর্ডারে পাঠানো হচ্ছে তোমাদের। থিয়েটার হলে সবাই অপেক্ষা করছে'। কানে কিছু গেলনা আর। ছুটলাম উর্দ্ধশ্বাসে থিয়েটার হলের দিকে। সি.ও. সাহেবের ব্রিফিং শেষ তখন। গ্র“প নির্বাচন চলছে। পঞ্চগড় সেক্টরে আকবর, হিলিতে অপিল, চাঁদ মিয়া ভুরুঙ্গামারীতে আর গিতালদহে আমাকে কোম্পানি কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হচ্ছে। চাপা কান্না উথলে উঠলো ভেতর থেকে। গাড়িতে উঠবার আগে বাঁধ ভেঙ্গে এলো চোখে। বন্ধুরা গলা জড়াজড়ি করে কাঁদলাম হাপুস নয়নে অনেকক্ষণ।
‘আর যদি দেখা না হয় কখনো' কাঁদতে কাঁদতে মঞ্জুরুল বলল, ‘মাফ করে দিস ভাই'।
সপ্তাহ কয়েকের নানা ঘটনা, ট্রেনিং ক্যাম্প, পাহাড়, অরণ্যের স্মৃতি বুকে পুরে রওয়ানা হলাম যে যার পথে সৈনিক জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় যুদ্ধের ময়দানে।
(চলবে)
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ১
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ২
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৩
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৫
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : শেষ পর্ব
কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত
বিষয়: কাজী জাকির হাসান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: