মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি (শেষ পর্ব) : কাজী জাকির হাসান
প্রকাশিত:
৩ আগস্ট ২০২০ ২২:৫০
আপডেট:
৫ আগস্ট ২০২০ ০২:০৫
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সেদিন কি ঘটেছিল বাংলাদেশে? কি হয়েছিলো ঢাকার অবস্থা দেখতে পারেনি। দেখেছি পুনায়। নাসিক, খান্ডালা সহ পুনার পার্শ্ববর্তী সব শহরে বসবাসকারী বাঙালীদের ঢল নেমেছিলো কিরকী সামরিক হাসপাতালে আমাদের দেখতে, অভিনন্দন জানাতে। আমাদের বিজয় আনন্দে আত্মহারা প্রতিটি বাঙালি পরিবারকে আবেগে চিৎকার করে বার বার বলতে শুনেছি একটি কথাই, বাঙালি হিসেবে গর্বিত আজ আমরা তোমাদের জন্য। বিশ্বের দরবারে বাঙালি জাতীর যে পরিচিতি সে শুধু তোমাদের আত্মত্যাগের জন্যই সম্ভব হয়েছে।
১৬ তারিখের পর সামরিক নিয়ম কানুন কিছুটা শিথিল হলো আমাদের জন্য। হাসপাতালের স্টাফ সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর অনুমতি পেলাম পুনা শহর পর্যন্ত। কিন্তু ঘুরবো কোথায়? নিজে কিছু চিনিনা, জানিও না এখনকার পথ-ঘাট। সিস্টার ক্যাপ্টেন হেলেন ডি সোজাই তার পছন্দের কিছু জায়গা ঘুরে দেখিয়েছেন আমাদের। যেমন অন্দর গার্ডেন, বাহার গার্ডেন, পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউট, শিবাজী জাদুঘর, গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের বাড়ি। বাড়িটা কিরকী থেকে পুনা শহরে ঢুকার মুখে হাতের বাঁ দিকে পড়ে। ডান দিকে বহমান পাহাড়ি খাদ। সমতল থেকে উঁচু পাহাড়ের মত বৃহদাকারের একটি পাথরের ওপর বাড়িটা। নিচ থেকে দেখা যায় যতদূর একটা সাইন বোর্ড ঝুলানো বাড়ির সম্মুখে সিস্টার হেলেন ঘৃণার সঙ্গে সেদিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এই বাড়ি জাতীয় বিশ্বাসঘাতকের। যতবার আসি এখানে আর্তনাদ শুনতে পাই মহাত্মার’।
পুনার প্রবাসী বাঙালি সমাজ বিশেষ করে কমলা নেহেরু পার্কের বাসিন্দারা প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে যেতেন আমাদের। সুপ্ত বাসনার বহির্প্রকাশ ঘটিয়ে তারা এটাই বুঝতে চাইতেন সকলকে এই বীর বাঙালির জাত আমরাও (যতই নিয়ম শিথিল হোক না কেন পাবলিক ফাংশনে এভাবে অংশ নেয়া ঠিক নয়। মেজর তাহেরের কথায় পরে নিরুৎসাহিতই আমরা)। তবে পুনা ডেকান কলেজ এন্ড ভাষা ইনস্টিটিউট কর্তৃপক্ষ আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যে সম্মান আমাদের দেয়া হয়েছিলো, গোত্রহীন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এর চেয়ে বড় সম্মান পাইনি দেশেও কখনো। বাঙালির সাফল্যে গর্বিত সেই বাঙালির দু'টো মুখ স্মৃতিপটে জেগে আছে আজও জ্বলজ্বল করে। ভুলতে পারিনি আজও সেই অনুষ্ঠানের মুখ্য উদ্যোক্তা ইংরেজির অধ্যাপক কবি ও সাহিত্যিক রাজলক্ষী দেবী ও বাংলার অধ্যাপক ডাঃ সেনকে।
তারিখটা সঠিক মনে নেই আমার। ডিসেম্বরেরই কোন দিন হবে হয়তো। নিয়মিত রাউন্ড শেষ করে মেজর চ্যাটার্জী জানালেন আজ সকাল দশটায় বাংলাদেশের কিছু নেতা আসবেন আমাদের দেখতে। কথাটা শুনে বারুদে আগুন দেয়ার মত জ্বলে উঠলো মুক্তিযোদ্ধা যত। মেজর তাহের ছুটে এলেন হুইল চেয়ারে করে, বললেন সাইকে, ‘একজনও তোমরা কথা বলবেনা ওদের সঙ্গে। দেশ স্বাধীন হয়েছে তাই দরদ উপচে পড়ছে। এতদিন কোথায় ছিলেন তেনারা? আজ আসছে পাবলিসিটি মারাতে... ইত্যাদি ইত্যাদি।' এ ধরনের ক্ষোভ একা যে মেজর তাহেরের তা নয়, যুদ্ধাহত প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার ভেতরেই জ্বলছিলো ক্ষোভের আগুন এমনি করে।
এগারটা বেজে গেলো। অধৈর্য্যরে সঙ্গে একজন সিস্টার মন্তব্য করলেন, ‘বাঙালির সময় জ্ঞান নেই'।
বারোটা ছুঁই ছুঁই ঘড়িতে। দুপুরের খাবার পরিবেশনের নির্দেশ দিয়ে মেজর চ্যাটার্জী অন্যান্য কর্মকর্তাদের নিয়ে ওয়ার্ড ত্যাগ করবেন এই মুহুর্তে প্রবেশ করলেন চার পাঁচজনের একটি প্রতিনিধি দল। নেতৃত্বে কোরবান আলী। কুশল জিজ্ঞেস করবার সঙ্গে সঙ্গে পচা ডিম ছুড়ে মারার মত অশালীন গালি গালাজ তীরের মত গিয়ে বিঁধতে লাগলো প্রতিনিধিদলকে। অসহায় কোরবান আলী সুযোগই পেলেন না কিছু বলার। তাঁকে ধরতে উদ্যত হলো দু'একজন। বিদেশের মাটিতে অপ্রীতিকর কিছু ঘটার আগেই মেজর চ্যাটার্জী, ক্যাপ্টেন ব্যানার্জী, ওয়ার্ড মাস্টারদের সহায়তায় প্রতিনিধিদলকে নিয়ে গেলাম ওয়ার্ড থেকে বের করে।
কোরবান আলী দুঃখ করে বললেন, ‘বাস্তব কারণেই সম্ভব হয়নি আমাদের খোঁজ খবর নেয়ার। এখন তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছি দেখা করতে।'
৩০ ডিসেম্বর ১৯৭১
বোম্বে চিত্র জগতের খ্যাতিমান অভিনেতা সুনীল দত্ত ও কবির বেদী এবং বিশিষ্ট গজল গায়ক অমৃত সিং অরোরা এলেন আমাদের দেখতে। তাঁদের সঙ্গে মেজর চ্যাটার্জী।
টায় টায় পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি সমান মেজর চ্যাটার্জী বরাবরই একটু বেশি স্নেহ করতেন আমাকে সেটা টের পেয়েছি অনেকবার তাঁর ব্যবহারে। কিন্তু আজ তিনি যেভাবে আমার পরিচয় তুলে ধরলেন সুনীল দত্তের কাছে তাতে আমার মত পুঁচকে ছোঁড়ার মাটির সঙ্গে মিশে যাবার যোগাড়।
সুনীল দত্তের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ওয়ার্ডে ঢুকে সোজা আমার বেডের সামনে এসে দাঁড়ালেন মেজর চ্যাটার্জী, বললেন, ‘এর কথাই বলছিলাম আপনাকে। চেহারাটা দেখতে মায়া মায়া বটে আসলে দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা একজন। এগারজন পাকিস্তান আর্মিকে একাই খতম করেছে সম্মুখ যুদ্ধে। তার চেয়েও বড় কথা এ একজন ভাল শিল্পী। বড় লেখকও। এর বাবা ঢাকা রেডিওতে আছেন।'
কি বুঝলেন সুনীল দত্ত জানিনা, একটা টুল টেনে নিয়ে বসলেন আমার কাছে। মৃদু হেসে বললেন, ‘বোম্বে থেকে আমরা দেখতে এসেছি তোমাদের। দেখার মত মানুষ যে তোমরা!'
আমি তাকিয়ে রয়েছি তাঁর দিকে অবাক দৃষ্টিতে। এবার একটু শব্দ করে হাসলেন, বললেন, ‘তুমি কি চেন আমাকে?
: আপনাকে, নার্গিস, রাজকাপুর, দেব আনন্দ, দিলীপ কুমার, মধুবালা সবাইকে চিনি।
: কি ভাবে!
বিস্মিত কণ্ঠ সুনীল দত্তের।
: মাদার ইন্ডিয়া দেখেছি আপনার। নার্গিসের ভীষণ ভক্ত আমি!
টুল ছেড়ে একেবারে বিছানায় আমার কাছে এসে বসলেন সুনীল দত্ত। নিজের কানকে হয়তো বিশ্বাস করতে পারছিলেন না তিনি। পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘হিন্দি সিনেমা দেখানো হয় তোমাদের দেশে?
: দেখে দেখেই তো চিনেছি আপনাদের।
খুবই মার্জিত, রুচিশীল, সু-পুরুষ সুনীল দত্ত চোখের সানগ্লাস খুলে রাখলেন কোলের ওপর। হাতের ছড়িটা-যা তিনি এতক্ষণ নাড়াছাড়া করছিলেন কথা বলার তালে তালে, বিছানার এক পার্শ্বে সরিয়ে রেখে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এবার বলতো তোমার পরিচয়টা?
বললাম, ‘আমার নিজের কোন পরিচয় নেই। তবে আমার আব্বা আটচল্লিশ সাল পর্যন্ত স্টাফ আর্টিষ্ট ছিলেন অল ইন্ডিয়া রেডিও, কলকাতায়। ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা ও চলচ্চিত্রকার প্রমথেশ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ সহকারী। ‘দেবদাস' এ কাজ করেছেন।'
হাসপাতালে যতক্ষণ ছিলেন সুনীল দত্ত আর যাননি উঠে কোথাও। বরং কবির বেদী এবং অমৃত সিং অরোরার সঙ্গে সুনীল দত্তই পরিচয় করিয়ে দেন আমাকে। যাবার সময় বলে যান, ‘আমরা আসছি খুব শীঘ্রই তোমাদের এখানে অনুষ্ঠান করতে।'
১৬ জানুয়ারি ১৯৭২
পায়ের যন্ত্রণা চরমে গিয়ে পৌঁছলো। অবস্থা এমন যে, কিছু একটা না করলে ঘা শুকনো তো দূরের কথা স্বাভাবিক চলফেরা করা পর্যন্ত কঠিন হয়ে যাচ্ছে। গত রাত্রে রাউন্ডে এসে এ অবস্থা দেখে অপারেশন থিয়েটারে আজ উপস্থিত থাকতে বলেছে কর্ণেল মজিদ।
এ্যাডভাইস মত সকল প্রস্তুতি নিয়ে বসে রয়েছি সকাল থেকে অপারেশন থিয়েটারের লবিতে। ভেতরে আরেকটি অপারেশন চলছিলো তখন। হঠাৎ মেজর চ্যাটার্জী হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির আমার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন কোন রকমে, ‘তুমি এখানে?'
: পায়ের ব্যাথাটা স্যার....
কথা শেষ করতে দিলেন না আমাকে, বললেন, ‘আরে রাখো তোমার পায়ের ব্যাথা। গিয়ে দেখো কারা এসেছেন। সুনীল দত্ত খুঁজছেন তোমাকে।' আর পায়ের অপারেশন। মুহুর্তে উরে গেল কোথায় পায়ের ব্যাথা-বেদনা। বেরিয়ে এলাম মেজর চ্যাটার্জীর সঙ্গে।
ক'দিন ধরেই গুঞ্জন চলছিলো একটি সাংস্কৃতিক দল আসছে বোম্বে থেকে অনুষ্ঠান করতে আমাদের এখানে। সেইভাবে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও প্রায় সম্পন্ন। সার্জিক্যাল ওয়ার্ড চার এবং দুই এর মাঝখানে খোলা জায়গায় স্টেজও তৈরি করে রাখা হয়েছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট দিন ও সময় নির্ধারণ না থাকার কারণে প্রবল আগ্রহ সত্ত্বেও একটা গা ছাড়া ভাব ছিলো সবার মধ্যেই।
মঞ্চের কাছাকাছি আসতেই দেখি বসার মত জায়গা খালি নেই কোথাও। ঘাসের ওপর বসে অনুষ্ঠান দেখছে সবাই। মঞ্চে তখন আসরানি। ইয়াহিয়া, ভুট্টোর কণ্ঠ নকল করে কৌতুক পরিবেশন করছেন।
মঞ্চের পেছনে এসে দাঁড়ালাম ক্র্যাচে ভর দিয়ে। আর মুহুর্তেই একরকম লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন সুনীল দত্ত। বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলেন ভেতরে। শিল্পীরা সবাই তখন বসে আছেন সেখানে। একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন কিশোর কুমার, আশা ভোঁসলে, মালা সিনহা, মহেন্দ্র কাপুর, লতা মুঙ্গেশকর, অভিনেতা মনোহর দীপক, বিশিষ্ট নৃত্যশিল্পী মধুমতি (মনোহর দীপকের স্ত্রী), মধুমতির ছোট বোন (নাম মনে নেই) এবং সিলোন ব্রডকাষ্টিং করপোরেশনের খ্যাতিমান ব্রডকাষ্টার আমিন সাহানীর সঙ্গে। কিশোর কুমার তো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে, বললেন, ‘আমিও জলপাইগুড়ির বাঙালি।'
সুনীল দত্ত এবার ঘুরে দাঁড়ালেন নার্গিসের দিকে, বললেন' এর গল্পই করেছিলাম তোমার কাছে।'
হাত ধরে কাছের চেয়ারটায় টেনে বসালেন নার্গিস। দু'হাতে মুখটা টেনে নিয়ে একটা চুমু দিলেন কপালে। বিস্ময়ের ঘোর তখন আমার দু'চোখে। এ কার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি? বাবা-মা'র মুখে গল্প শুনেছি যে নার্গিসের, ইনি কি সেই নার্গিস? মানুষ এত সুন্দর হতে পারে? বয়স তাঁর পঁয়তাল্লিশ কি পঁচিশ ঠাওর করতে পারলাম না।
: তুমি কি অনুষ্ঠান দেখবে?
ঘোর কেটে গেল নাগিসের কথায়, বললাম, ‘আপনার এখানে বসেই সময় কাটাতে চাই।'
: বেশ তো গল্প করো তাহলে।
আমি আবার কি গল্প করবো। তাঁকে বললাম, ‘আপনিই বলুন আমি শুনছি।'
নার্গিস বললেন অনেক কথা। জানি না এসব কথা তিনি বলেছেন কিনা অন্য কোথাও কিংবা বলে থাকলেও তা যে সব জানা থাকবে আমার এমনও নয়। তিনি শোনালেন আমাকে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের কথা। বললেন, বরাবরের উচ্চাভিলাসী ও প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের অধিকারী ভুট্টোর সঙ্গে তাঁর মধুর সম্পর্কের কথা। কতবার ভুট্টো অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে পাকিস্তানে গিয়ে বসবাসের জন্য। আরও... আরও অনেক কথা... অভিনয় জীবনের কথা, সহ অভিনেতাদের কথা, পরিবারের কথা, মা জিদ্দন বাঈ, ভাই আনোয়ার হোসেনের কথা।
আজ ভাবি কি ভেবে এত কথা নার্গিস শুনিয়েছিলেন আমাকে? পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাবও তিনি দিয়েছিলেন আমাকে। লোভনীয় এ প্রস্তাব আমি গ্রহণ করতে পারিনি। তখন দেশে ফিরে আসাটাই জরুরী মনে হয়েছিলো আমার কাছে।
অনুষ্ঠান শেষে বোম্বে ফিরে যাওয়ার আগে বাসার টেলিফোন নম্বর দিয়ে নার্গিস বললেন, ‘কিছু দিনের মধ্যে সুনীল দত্তের নেতৃত্বে একটি সাংস্কৃতিক দল ঢাকায় যাচ্ছে। এই দলে আমি ছাড়াও লতা মুঙ্গেশকর, মহেন্দ্র কাপুর, আশা ভোঁসলে, মালা সিনহা থাকছে। তুমিও যেতে পারো আমাদের সঙ্গে। গেলে যোগাযোগ করো।
মধুমতি, মনোহর দীপকও তাঁদের ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, ‘কিছু দরকার হলে লজ্জা কোরনা, জানিও আমাদের। খুশি হবো।'
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের কারণে পায়ের ব্যাথা চেপে রাখলেও আর পারলাম না। এমন অসহনীয় যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল যে, পেইন কিলার পর্যন্ত কাজে আসছে না। ঠিক হলো, কর্ণেল মজিদ অপারেশন করবেন। সকাল আটটায় একা একাই গিয়ে হাজির হলাম অপারেশন থিয়েটারে। সব তৈরি। এক্সরে ফিল্মটা সাঁটানো লাইট বক্সে। অপারেশন বেডে শোয়ানোর আগে জিজ্ঞেস করলেন কর্ণেল মজিদ, ‘তাকাও এক্সরে বক্সের দিকে, স্প্রিংটা দেখছো যে জায়গায়, ব্যাথাটা কি সেখানেই অনুভব করছো এখন?'
: না।
: ঠিক কোন জায়গায় মনে হচ্ছে, দেখাও তো আঙ্গুলে চাপ দিয়ে।
ঠিক ব্যাথার জায়গাটা চেপে ধরলাম আঙ্গুল দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা গোল মার্ক করলেন কর্ণের মজিদ এবং শুয়ে পড়তে বললেন অপারেশন বেডে।
তীব্র আলোর ঝলকানিতে আলোকিত হলো গোটা শরীর। একটা ইনজেকশন পুশ করলেন সিস্টার। কয়েক সেকেন্ড মাত্র। এরপর আর কিছু জানি না।
জ্ঞান ফিরলে চেয়ে দেখি ওয়ার্ডে শুয়ে আছি নিজের বিছানায়। পাশে দাঁড়িয়ে আছেন সিস্টার লেঃ দীপ্তি রাঠোর। হাসছেন মুচকি মুচকি। বাঁ হাতের কব্জিতে গজের কাপড় দিয়ে বাঁধা গিট্টু দেখিয়ে বললেন, ‘তোমার দেখার জন্য স্প্রিংটা বেঁধে দিয়েছেন কর্ণেল স্যার।'
দু'দিনে শুকিয়ে গেল ঘা। হাঁটা-চলা শুরু করলাম নতুন করে আর্টিফিশিয়াল পা পরে।
কমান্ডেন্ট ব্রিগেডিয়ার যোশী থেকে শুরু করে কিরকী হাসপাতালের নার্স, ডাক্তার, বয়, ব্রাদাররা কেন যে এত ভালবাসতেন ঠিক জানি না। সবার মধ্যেই একটা প্রভাব বলয়, তৈরি হয়ে গিয়েছিলো আমি বুঝতাম সেটা যখন সহযোদ্ধা বা ভারতীয় সৈন্য বা মেজর তাহের কোন কাজ করাতে চাইতো আমাকে দিয়ে। একদিন কর্ণেল মজিদ তো বলেই ফেললেন, ‘যত আহত মুক্তিযোদ্ধা আছে এখানে, সুস্থ হলেও তোমাকে পাঠানো হবে সবার শেষে।'
১৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২
হাসপাতাল থেকে আকস্মিক ডিসচার্জ করা হলো আমাকে। মেজর চ্যাটার্জীর স্বাক্ষর ডিসচার্জ পত্রে। ছুটে গেলাম তাঁর কেবিনে। কারণ জানতে চাইলে তিনি জানালেন ফিটনেস বোর্ডের সিদ্ধান্তের কথা। ঘটনা জেনে রাজি হয়ে গেলাম শেষ পর্যন্ত, ব্যাকুল প্রতিক্ষায় থাকা আত্মীয়-পরিজনের কথা ভেবে।
আসলে ঘটনাটা ছিলো অন্যরকম।
চারজন সুস্থ মুক্তিযোদ্ধার যে দলটি ফিরে যাওয়ার কথা বাংলাদেশে, সেই দলেরই একজন ঢাকার বক্সনগরের মাকসুদুর রহমান চিনু হঠাৎ পড়ে গিয়ে বাথরুমে ফ্রাকচার হয়ে যায় তার অপারেশনের জায়গা। চারজনের সেই রিজার্ভেশনে অগত্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয় আমাকেই।
এর আগে এমোন করে তো মিশিনি মানুষের সঙ্গে। তাই বিচ্ছেদ বেদনা খুব গভীরে নাড়া দিয়েছে আমার। সবার চোখে পানি দেখে নিজেও কেঁদে ফেলেছি জোরে শব্দ করে।
যা যা ঘটে একটি পরিবারে, এখানেও ঘটেছিলো তাই। রাগ-অনুরাগ, ক্ষোভ-অভিযান, শাসন-আদর সবই ছিলো এই ক'মাসের একান্নবর্তী পরিবারে।
বিদায় দিতে এসে যে যা পেরেছে দিয়েছে উপহার। দিয়েছে কেউ কেউ নিজের নামাঙ্কিত সামগ্রী।
দেখেছি পেছনের গ্লাসে চোখ রেখে আমাদের বহনকারী এ্যাম্বুলেন্স চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত দাঁড়িয়ে ছিলেন সবাই ফেলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু দু'টো চোখ এত ভিড়ের মধ্যেও খুঁজে ফিরছিলো যাদের হা-পিত্তিস করে সেই মেজর চ্যাটার্জী আর কর্ণেল মজিদকে পাইনি কোথাও খুঁজে।
১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২
সকাল আটটা কি দশটা হবে ঠিক মনে নেই এখন। শিয়ালদহ স্টেশনে এসে পৌছলাম আমরা। বোচকা-গাট্টি নামিয়ে নিয়ে বসলাম এসে ওয়েটিং রুমে। দূতাবাস থেকে প্রটোকল অফিসার এসে নিয়ে যাবেন এমনই বলা হয়েছে আমাদের।
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু আশে-পাশে কাউকে দেখছি না কোথাও। এই অবস্থা দেখে সহযাত্রী মনিন্দ্রনাথ ঘোষ বললেন, ‘মহারাজ নন্দ কুমার রোডে আমার বাড়ি। আপত্তি না থাকলে চলুন না একবার ঘুরে আসবেন।'
বিক্রমপুরে পৈত্রিক নিবাস মনিন্দ্রনাথের। কলকাতার বাসিন্দা এখন। ঠিকাদারী ব্যবসা করেন নেপালে। বোম্বে থেকে এক সঙ্গে আসছি। আলাপি ভদ্রলোক। মনটা এখনও বাংলাদেশেরই রয়ে গেছে।
তিনজন রাজীও হয়ে গেল তাঁর কথায়।
যদি ফিরে যায় দূতাবাসের লোক আমাদের না দেখে...
এই ভাবনা থেকে আমি পারলাম না রাজি হতে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর। ভড়কে গেলাম রীতিমত। এখানকার পথ ঘাট চিনি না। পরিচয় ছিলো যার সঙ্গে কিছুটা তিনিও চলে গেলেন। দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেল ভেতরটা।
: কিছু মনে করাবেন না দাদা, আমি কি আপনাদের কোন সাহায্যে আসতে পারি? এতক্ষণ যুবকটি দাঁড়িয়েছিলো একটি বুক স্টলের সামনে। দেখছিলো আমাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। লক্ষ করছি অনেকক্ষণ ধরে। আপনারা বোধহয় অপেক্ষা করছেন কারো জন্য। বিশ্বাস করে সব খুলে বলতে পারেন আমাকে। কথা বার্তা শুনে জয় বাংলার লোক বলেই তো মনে হচ্ছে আপনাদের।
সময়টা অনুকূলে নয় আমাদের জন্য। কি করতে গিয়ে কি হয়ে যাবে ঠিক নেই। সে কারণে দ্বিধার সঙ্গে একটা শংকাও কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। অযথা ঝুট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার চেয়ে চুপচাপ বসে থাকাই ভাল। যুবক এগিয়ে এলো আরো। ঘনিষ্ঠ ভাবে দাঁড়ালো কাছে এসে।
: ভয় পাচ্ছেন তো? ভয়ের কিছু নেই। আমি বাবুল কান্তি রায়। যাদবপুর রামকৃষ্ণ উপনিবেশে থাকি। আপনারা একটা অসুবিধায় পড়েছেন বুঝতে পেরেই এগিয়ে এসেছি, কোন কু-মতলব নেই আমার।
বিপদে আমরা পড়েছি এটা তো ঠিক। এ সময় কাউকে না কাউকে তো আমাদের বিশ্বাস করতেই হবে। বিশ্বাসটা না হয় বাবুলকেই করি।
ঘটনা খুলে বললাম সব।
শুনে বাবুল বললো, ‘ভাববেন না দাদা, সব ব্যবস্থা আমি করে দিচ্ছি।' টেক্সি ডেকে বেডিং পত্তর নিজেই তুললো তাতে। চারজন পেছনে বসলাম কোনরকম চাপাচাপি করে। বাবুল ড্রাইভারের পাশে।
পার্ক সার্কাস পৌঁছলাম যখন, তখন বেলা দু'টো প্রায়। মেইন গেইট বন্ধ। পাশে খোলা রয়েছে পকেট গেইট। রাস্তার পাশে ওয়াল ঘেঁষে টেক্সি পার্ক করতে বলে নায়েক সাইদুর রহমান, বাবুল আর আমি ঢুকলাম ভিতরে। রিসিপশন টেবিলে লোক নেই কেউ। ভেতরের একটি কামরায় জনা চারেক লোক পাশাপাশি দু'টো টেবিল জোড়া লাগিয়ে তাস খেলছে বসে। ঢুকতে দেখে কেউ জিজ্ঞেস করলোনা আমাদের। ফিরেও তাকালো না একবার। বাবুল কিছু বলার জন্য এগিয়েছে কেবল, কে যেন একজন বললো, ‘আজ রোববার, কাল আসুন।' বাবুল বলতে যাচ্ছিলো এরপরও কিছু। থামিয়ে দিলো সাইদুর রহমান। হাতের লাঠিটা খেলার টেবিলে সজোরে মেরে চিৎকার করে উঠলো, ‘তগোর বাপেরা যে খাড়ায় রইছে, দেহস না রে বান্দির পুতেরা? কয় দিনেই লাটসাব বইনা গেছস সব? মনে কয়, পাছায় লাঠি ঢুকায় দেই রাজাকারগরে।'
দু'হাতে লাঠি তুলেছে এমন ভাবে, তড়িৎ বাবুল ধরে না ফেললে, রক্তের স্রোত বয়ে যেত তাস খেলিয়েদের। আর্টিফিসিয়াল পা-তবুও কি ধরে রাখা যায় সাইদুরকে, বার বার লাঠি তোলে মারতে। না পেরে উচ্চস্বরে গালাগাল করতে থাকে অশ্রাব্য ভাষায়।
চিৎকার চেঁচামেচিতে লোকজন এসে ভীড় করে ভিতরে। এই যখন অবস্থা চলছে ঠিক সেই সময়ে কালো রংয়ের একটি মার্সিডিস প্রাইভেট গাড়ি ঢুকে দূতাবাসের ভিতরে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে ভদ্রলোক দাঁড়ান এসে জনারণ্যের মাঝখানে। জিজ্ঞেস করেন, ‘হচ্ছেটা কি এখানে?'
সাদা কাগজের মত হয়ে যায় মুখ তাস খেলিয়ে চারজনের। লম্বা সালাম ঠুকে তোতলাতে থেকে ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়িয়ে। বাবুল কান্তি রায় এগিয়ে গিয়ে তখন বৃত্তান্ত খুলে বলে ভদ্রলোককে স্টেশন থেকে দূতাবাস পর্যন্ত ঘটে যাওয়া সব ঘটনা। কথা শুনে প্রচণ্ড ক্ষোভে ফুঁসতে লাগলেন ভদ্রলোক। আমাদেরকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসালেন ওঁর অফিস ঘরে। ঐ চারজনও গিয়ে ঢুকলো পিছু পিছু। ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করলেন কোথায় যেন। কথা শেষ করে তাকালেন ওদের দিকে। তিরস্কার করে বললেন, ‘একটু আগে ম্যাসেজ এসেছে ঢাকা থেকে এয়ারপোর্টে মারা গেছে চারজন মাইন বিস্ফোরনে। রক্ত ঝরছে এখনও বাংলাদেশে। আর এরই মধ্যে ভুলে গেলেন তাদের কথা যাদের রক্তে এই স্বাধীনতা। এতই অকৃতজ্ঞ আপনারা, ছিঃ জাতির মাথা বিদেশের মাটিতে হেঁট করে দিয়েছেন আপনারা।'
বাবুল উঠে দাঁড়ালো, বললো, ‘আমি তাহলে আসি স্যার।'
: আই এ্যাম ভেরী মাচ গ্রেটফুল টু ইউ। আপনি না থাকলে জানিনা আরো কতটা লজ্জায় পড়তে হতো আমাকে।
চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে হাই কমিশনার মোস্তাফিজুর রহমান করমর্দন করলেন বাবুল কান্তি রায়ের সঙ্গে। বাবুল যাবার সময় আমার ঠিকানাটা লিখে নিয়ে বেরিয়ে গেল রহস্যময় হাসি হেসে।
মাস কয়েক পর বাবুলের লেখা চিঠিতে বুঝতে পেরেছিলাম রহস্যের কারণটা। ঐ চিঠিটাই ছিলো আমার কাছে লেখা বাবুলের প্রথম এবং শেষ চিঠি। সে লিখেছিলো, পার্টির কাজে শিলিগুড়ি যাচিছ। কবে ফিরবো... আদৌ ফিরবো কিনা জানি না। সত্যি বলতে কি, শিয়ালদহ স্টেশনে সেদিন তোমাদের দেখে খুব মায়া হয়েছিলো। জীবনে ভাল কাজ যদি কিছু করে থাকি, সেই ভালোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ ভাল ছিলো প্রকৃত ঠিকানায় তোমাদের পৌঁছে দেয়া।'
স্টাফদের অনাকাক্সিক্ষত ব্যবহারে দুঃখ প্রকাশ করে মোস্তাফিজুর রহমান তাঁর ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, ‘এদের পৌঁছে দিয়ে আস সূর্যসেন স্ট্রীটে, ইন্ডিয়া হোটেলে। তারপর শান্ত্বনা দিয়ে বললেন, ‘যে পর্যন্ত না দেশে ফিরে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা করতে পারছি— আপনারা এই হোটেলেই থাকবেন।'
প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগলে তার তাপ লাগে গিয়ে নিজের ঘরেও। সঙ্গত কারণে পশ্চিম বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশে একটা অস্থির অবস্থা তখন। বিশেষ করে গুপ্ত নকশাল তৎপরতায় কলকাতা নিরাপদ ছিলো না কারো কারো জন্যে। ইন্ডিয়া হোটেলে আমাদেরকে রাখার পেছনে এটাও একটা কারণ।
বাইরে চলা-ফেলায় কড়া নজর ছিলো হোটেল মালিকের। বাইরে থেকে কাউকে হুট করে হোটেলে আনার ব্যাপারেও সতর্ক পরামর্শ ছিলো তাঁর। বাইরে বেরুনোর খুব একটা প্রয়োজন হতো না। বেশি খারাপ লাগলে তিন তলার বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে তাকিয়ে থাকতাম ব্যস্ত মহানগরীর জনপথে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইন্ডিয়া হোটেল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বিশেষ কিছু নেতা, ছাত্র নেতার আবাসস্থল ছিলো এখানেই।
বাড়ি বিক্রমপুর এ কারণেই হোটেল মালিকের বিশেষ একটা দূর্বলতা ছিলো মুক্তিযোদ্ধা তথা বাংলার মানুষের প্রতি এবং সে দায়িত্ব তিনি পালন করার চেষ্টা করেছেন আন্তরিকভাবেই। ন'মাসের মুক্তিযুদ্ধে অনেক নেতা দেখেছেন তিনি-কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা দেখেন নি।
এসব কথা হোটেল মালিকের মুখ থেকে শোনা। প্রথম যেদিন হোটেলে এসে উঠলাম আমরা, আবেগ আপ্লুত মালিককে ফোনে বলতে শুনেছি হাই কমিশনারকে, ‘যতদিন প্রয়োজন মুক্তিযোদ্ধারা থাকবে আমার হোটেলেই। এজন্য একটি টাকাও খরচ করতে হবে না বাংলাদেশ সরকারকে।'
চারজন থাকতাম পাশাপাশি দু'টো রুমে। রুম বয় থাকার পরও একটি দশ-বার বছরের ছেলে ফায়-ফরমায়েস খাটতো আমাদের। ফুটফুটে মিষ্টি চেহারার ছেলেটি ছিলো ভীষণ চটপটে আর মিশুক স্বভাবের। অতটুকুন বয়সে বাবড়ী চুলে ঝাকি মারতো যখন দারুন লাগতো দেখতে। কাজের কথা অর্ধেক মুখে থাকতেই ব্যস্ত হয়ে পড়তো তা তামিল করার জন্য।
মাংস খেতাম না হোটেলে। সবজী আর ছোট মাছ পছন্দ করতাম বেশী। খাবার পর লক্ষ করতাম প্রতিদিন একটি পরিষ্কার বাটিতে জড়ো করে রাখা মাছের এঁটোকাঁটাগুলো তিন তলার ছাদে বসে খাচ্ছে ছেলেটি আপন মনে চিবিয়ে চিবিয়ে। সহানুভূতি জাগলো ছেলেটির প্রতি। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম কাছে, জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এগুলো খাচ্ছো কেন?
উত্তরে ছেলেটি বললো, ‘আমি রাতে দেখতে পাই না বাবু। মা বলেছেন, ছোট মাছের কাঁটা খেলে চোখের জ্যোতি বাড়ে। তাইতো...
২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৭২
হোটেল মালিককে জানিয়ে রেখেছিলাম সকালের দিকে ব্যারাকপুর ঘুরে আসবো একবার। দূতাবাসের সঙ্গে কথা বলে হোটেলেরই কর্মচারী একজন ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি আমার সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু কি কারণে জানি না সময়টা পরিবর্তন করে দুপুরের খাওয়ার পর নিজেই তিনি সঙ্গে যাবেন বলে গেলেন আমাকে।
দুপুরের খাবার খেয়ে অপেক্ষা করে আছি। অন্য তিনজন খাচ্ছে তখনও। এমোন সময় ঝড়ের বেগে রুমে ঢুকলেন হোটেল ম্যানেজার, বললেন, ‘দূতাবাস থেকে ফোন করেছে, কিছুক্ষণের মধ্যে লোক আসছে আপনাদের নিতে, তৈরি হয়ে নিন শীঘ্রই।'
: ব্যাপার কি বলুন তো?
কথাটা আপনা থেকে বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
: সে কথা তো দাদা আমাকে বলেনি।
যে বেগে এসেছিলো ম্যানেজার সেই গতিতে বেরিয়ে গেল আবার।
নিশ্চয়ই দেশে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয়েছে। ভাবতেই বুকটা নেচে উঠলো আনন্দে। খাওয়া অসম্পূর্ণ রেখে উঠে দাঁড়ালো ওরা। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় জামা গুছিয়ে নিলাম ব্যাগে। বইপত্র যা কিনেছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনে ভরিয়ে ফেললাম তা কাঠের বাক্সে। তৈরি হয়ে নিজেরা পায়চারি করতে লাগলাম রুম আর বারান্দায়। প্রায় আধা ঘণ্টা পর গাড়ির হর্ণ বেজে উঠলো নিচে। দু'জন কর্মচারী সহ ম্যানেজার নিজেই নামলেন মালপত্তর নিয়ে। পেছনে পেছনে আমরাও। দু'জন দু'জন করে বসলাম দু'টেক্সিতে। দূতাবাস কর্মচারী বসলো একটিতে ড্রাইভারের পাশের সিটে।
মোস্তাফিজুর রহমান প্রটোকল অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য। রুমে ঢুকতেই দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন হাত বাড়িয়ে, বললেন, ‘যুগোশ্লাভিয়ার একটি কার্গো বিমান ঢাকা যাচ্ছে রিলিফ নিয়ে। ওতেই ব্যবস্থা করেছি আপনাদের চারজনের। একটু কষ্ট হবে এই যা। তবে স্বাধীন দেশে ফিরে যাওয়ার আনন্দে এ কষ্ট মনে হবে না দেখবেন।'
কথা শেষ করে দূতাবাসের প্যাডে টাইপ করা একটি করে চিঠি ধরিয়ে দিলেন আমাদের হাতে। চিঠিতে ঠিকানাসহ কে কোত্থেকে এসেছি, পরিচয় কি আমাদের এই লেখা ছিলো।
: এক কাপ চা দিয়েও আপ্যায়ন করতে পারলাম না আপনাদের। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে, চলুন—
ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম আবার। সঙ্গে বসলেন প্রটোকল অফিসার। দমদম এয়ারপোর্টের পথে হাত নেড়ে বিদায় জানালেন মোস্তাফিজুর রহমান।
স্বাধীন বাংলাদেশে
উড়ে চলেছে প্লেন আকাশে ডানা মেলে। মুক্তিযোদ্ধা চারজন প্লেনের ক্রু আটজন। কেউ নেই আর। পাইলট ও কো-পাইলট ছাড়া একেক সিটে চারজন করে মুখোমুখি বসে রয়েছি পাশাপাশি। শব্দ নেই কথার। ভাষা দু'চোখে শুধু। শ্রদ্ধাবনত ক্রুরা তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। এক সময় ঘোষণা করলেন পাইলট, প্রবেশ করেছি আমরা বাংলাদেশের আকাশ সীমায়।
তোলপাড় শুরু হয়ে গেল গোটা শরীর উদ্বেল আবেগে। ভাবছি শুধু কি দেখবো বিমান থেকে নেমে? আমরা যে আসছি আজ সে কথাতো জানেনা আমাদের আত্মীয়-স্বজনেরা কেউ।
ভাবনা আর প্রত্যাশার দোলাচলে প্লেন স্পর্শ করলো তেজগাঁও বিমানবন্দর। ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো নির্ধারিত জায়গায়। তাকিয়ে রয়েছি তখনও জানালার গ্লাস দিয়ে— দেখছি মানুষের হাঁটা-চলা, ছুটো-ছুটি করছে সগর্বে স্বাধীন বাংলার মাটিতে। উড়ছে পত পত করে বিমান ভবনের সু-উচ্চ চূড়ায় অর্জিত লক্ষ শহীদের রক্তের জাতীয় পতাকা।
নেমে এলাম ক্রুদের সাহায্যে। উবু হয়ে বসে চুমু খেলাম কোন রকমে স্বাধীন বাংলার মাটি। প্রত্যাশিত সুখের আনন্দে দু'চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়তে লাগলো পানি। ক্রুরা পাশে এসে দাঁড়ালো আমাদের হাত ধরে।
ছুটে ভাসছে কিছু লোক ফুলের মালা হাতে।
গর্বিত জাতির-গর্ব মুক্তিযোদ্ধা।
সংবাদ পেয়েছে নিশ্চয়ই এই প্লেনেই আসছি আমরা। বিজয়ের আনন্দ ধারায় দু'গাল বেয়ে ঝরে পড়া চোখের পানি মুছলামনা, ভাবলাম মিশে যাক এ পানি একাকার হয়ে ওদের সঙ্গে, ছুটে আসছে যারা মালা হাতে আমাদের বরণ করতে।
নিকটে এলো...
সদস্য রেডক্রসের, সঙ্গে কর্মকর্তা বিমান বন্দরের। গদ গদ হয়ে ফুলের মালা পরিয়ে দিলো তারা যুগোশ্লাভ ক্রুদের গলায়।
হতচকিত ক্রুরা বিব্রত।
বলতে চাইলো কি যেন দেখিয়ে আমাদের।
কে শোনে সে কথা—
ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কর্মকর্তারা ততক্ষণে রিলিফের মালামাল নিয়ে।
মালা গলায় স্তম্ভিত ক্রুরা তেমনি দাঁড়িয়ে রইলো স্থির।
দাঁড়িয়ে আমরাও...
রক্ত ভেজা মাটিতে...
তাকিয়ে ঝাপসা চোখে সেদিকে....
(সমাপ্ত)
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ১
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ২
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৩
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৪
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : পর্ব - ৫
মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলো : শেষ পর্ব
কাজী জাকির হাসান
কথা সাহিত্যিক, নাট্য ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় ও স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত
বিষয়: কাজী জাকির হাসান
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: