সিডনী শনিবার, ২০শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশের বিজয়ের দীর্ঘপথে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ভূমিকা : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৫ আগস্ট ২০২০ ২৩:১৫

আপডেট:
২৬ আগস্ট ২০২০ ০০:১৭

ছবিঃ বিবিসি

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ বাংলাদেশী শহীদ হোন, অসংখ্য মানুষ হয়ে পড়েন গৃহহীন, অনেক মা-বোন হারান তাঁদের সম্ভ্রম। এই যুদ্ধে ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতীয় বাহিনীর ভূমিকা এবং ত্যাগ অনস্বীকার্য। আজ আমি সেই বিষয়ে কিছু আলোকপাত করব।

১৯৭১-এর ২৫ মার্চের কালোরাতের পর থেকে আত্মরক্ষার জন্য এদেশের অনেক নিরীহ ও নিরস্ত্র মানুষ নিজের ঘরবাড়ি ও দেশ ত্যাগ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে গমন করতে থাকেন।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্মম অত্যাচারের ফলে ১৯৭১-এর নভেম্বর মাসের শেষ নাগাদ ভারতে আশ্রিত বাংলাদেশী শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ কোটি। ভারতের ৭টি রাজ্যের ৮২৫ টি শরণার্থী শিখিবর ১৯৭১-এর এপ্রিল থেকে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৯৮,৯৯,৩০৫ জন। ভারত সরকার ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে সাহায্য প্রদান করে।

ভারত, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত খুলে দিয়ে ভীত সন্ত্রস্ত বাঙালিদের নিরাপদ আশ্রয় প্রদান করে। পশ্চিম বঙ্গ, বিহার, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার রাজ্যসরকার সীমান্তে উদ্বাস্তু আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে। এ যুদ্ধ বিশ্বব্যাপী বাঙলা ভাষাভাষীদের ঐক্যের আগুন নজীরবিহীনভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৭ই মার্চ ১৯৭১ সালে তার সরকারের পূণ্য সমর্থন ব্যক্ত করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। এই সরকার তার সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করে প্রবাসের কলকাতায়। বাঙালিরা খুবই আধুনিক ও দুঃসাহসী গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এক সময় ভারতও যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ভারত তার অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে সহায়তা করে। তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করে। যেভাবে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়তা করেছে পৃথিবীতে তার ইতিহাস বিরল। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৭ হাজার কোটি রূপি শুধু খরচ করেনি, বরং তার সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈন্যদে ৩৬৩০ জনের জীবন উৎসর্গ করেছে আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধে। প্রায় ৯৮৫৬ কর্মকর্তা ও জোয়ানরা আহত হয় এবং এখন পর্যন্ত ২১৩ কর্মকর্তা ও জোয়ান নিখোঁজ রয়েছে। ভারতীয় সেনাদের রক্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাথে মিশে আছে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের ভারতীয় সেনাবাহিনী বড় ধরনের প্রশিক্ষণ প্রদান করে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা ভারতের বিহার, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলে। এই ক্যাম্পগুলো মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের জন্য প্রস্তুতির ক্ষেত্র হয় হিসেবে গেরিলা ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য।

মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনার যৌথকমান্ড গঠিত হয় ১৯৭১ সালের নভেম্বরে। লেফেটনেন্ট জেনারেল জগৎসিং আরোরা, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কর্মান্ডের যৌথবাহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব পান। কিন্তু যৌথবাহিনীর অপারেশন শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানের বিমান বাহিনী অমৃতসর, শ্রীনগর ও কাশ্মির উপত্যাকায় বোম্বিং করে। তৎক্ষণাত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আদেশ দেয়া হয় প্রতিউত্তর দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে। আর এভাবেই ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়, যার একদিকে ছিল পাকিস্তানি সেনা, আর অন্যদিকে ভারতীয় সেনা আর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে শুরু করে। আর তখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পরাজয় ও আত্মসমর্পণ সময়ের ব্যাপারে হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্বে যুদ্ধে বন্ধে আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোতে বন্ধ হয়ে যায়।

ভারতীয় সেনাবাহিনী ধীরে ধীরে সেপ্টেম্বরের দিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর অভিযান শুরু হয় প্রকৃতভাবে ডিসেম্বরে আর তা মাত্র ১০ দিন বলবৎ থাকে। এটা ছিল সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবস্থান সরানো, যাতে করে ডিসেম্বরে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়। ২৩ নভেম্বর ইয়াইয়া খান জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেন পাকিস্তানের সর্বত্র এবং তার জনগণকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ডিসেম্বরের শেষযুদ্ধ প্রাথমিকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীই করেছে। মূল যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের সন্ধ্যা ৫.৪০ যখন পাকিস্তানি বিমান বাহিনী যখন বোম্বিং শুরু করল ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের ৯টি বিমানবাহিনীর ক্যাম্পে। এ যুদ্ধের জবাবে পাকিস্তান ও ভারত নিয়মতান্ত্রিকভাবে স্বীকার করে নিলো দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান। এইভাবে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার শেষযুদ্ধ শুরু হয়।

লেফেটেন্টে জেনারেল জগৎ সিং আরোরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অষ্টম, তেইশত ও সাতান্নতম ডিভিশন পরিচালনা করেছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বপাকিস্তান আক্রমণে। এই বাহিনীগুলো যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উপর আক্রমণ করছিল, ঠিক তখন ভারতীয় বিমানবাহিনী পূর্বপাকিস্তানের বিমানঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ করে উড্ডয়নক্ষেত্রগুলো ধ্বংস করে দেয়। একই সময় ভারতীয় নৌবাহিনী পূর্বপাকিস্তানের সামুদ্রিক অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয়। ভারতীয় বিমান বাহিনী পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর বোম্বিংয়ের কঠিন জবাব দেয়। একরাতের যুদ্ধ পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনয়ন ও মিত্রবাহিনীর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন স্থবস্থান স্থলে চারহাজার অতর্কিত আক্রমণ পাকিস্তানিদের জন্য ভয়াবহ ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনে। সদ্য গড়ে উঠা বাংলাদেশের বিমানবাহিনীর তিনটি মিশিনগান সজ্জিত ডিএইচ অটার বিমান ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের জন্য রক্তাক্ত দুঃস্বপ্ন ডেকে আনে।

প্রথম যে দিন বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলঃ

৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির ফলে এই উপ-মহাদেশে একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের অভ্যুদয় আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হয়।

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আজ সকালে সংসদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাটি করেন এবং উভয় সভায় সদস্যগণই দাঁড়িয়ে এই ঘোষণাকে স্বাগত জানান। সেই সঙ্গে সংসদ কক্ষে প্রবল হর্ষধ্বনি উত্থিত হয় এবং সদস্যবর্গ উৎসাহ আবেগে মিলিত ধ্বনি তুলেন ‘জয় বাংলা' বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের নতুন সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে অভিহিত হবে। এই সভা নিশ্চয়ই চান যে, আমি বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁদের অন্যান্য সহকর্মীদের কাছে আমাদের ঐকান্তিক সম্বর্ধনা ও আন্তরিক অভিনন্দন পৌঁছে দিই।

সংসদের অধিবেশন আরম্ভ হওয়ার অব্যবহতি পরেই শ্রীমতী গান্ধী একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, বাংরাদেশের জনগণ বিরাট বাধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের' সূচনা করেছেন।

শ্রীমতী গান্ধী বলেন যে, বাংলাদেশ ও ভারতের সরকার ও জনগণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য যে একসাথে কাজ করছেন, তা ভাল প্রতিবেশীর দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

শ্রীমতী গান্ধী বলেন, একমাত্র এরূপ একটি নীতিই এই অঞ্চলে শান্তি, স্থায়িত্ব ও প্রগতির দৃঢ়ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ সরকার ভারতে আগত শরণার্থীদের দ্রুত প্রত্যাবর্তনের এবং তাঁদের জমিজমা ও জিনিসপত্র ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করার জন্য পুনরায় উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। ভারত স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রচেষ্টা কার্যকরী করার ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিবে।

বেলা সাড়ে দশটায় সময় শ্রীমতি গান্ধী এই কাংখিত বিবৃতি প্রদানের জন্য উঠে দাঁড়ান এবং বিবৃতি পাঠের সঙ্গে সঙ্গে হর্ষধ্বনি ওঠে।

শ্রীমতি গান্ধী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের প্রসঙ্গে এলে লোকসভায় অভূতপূর্ব উৎসাহ পরিলক্ষিত হয়েছিল; সদস্যগণ দাঁড়িয়ে উঠে বিপুল হর্ষধ্বনি সহকারে ঐতিহাসিক ঘোষণাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভূটান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। ঐদিন বেলা ১১টার সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও মারফত ভারত বাংলাদেশের স্বীকৃতি ঘোষণা করে। তবে ভারতের কয়েক ঘন্টা আগে তার বার্তার মাধ্যমে ভূটানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর থেকে জাতিসংঘের অন্তর্ভূক্ত প্রায় সকল দেশ স্বাধীনতার মাসে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত শতাধিক রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

 

তথ্যসূত্র : সিতাংশু কুমার সুর চৌধুরী, ম্যাগাজিন বাঙালী

(শাহান আরা জাকির পারুলের ‘মহাকাব্যের অমরগাঁথা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’ বইয়ের অংশ বিশেষ)

 

শাহান আরা জাকির পারুল 
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top