সিডনী রবিবার, ৮ই ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪শে অগ্রহায়ণ ১৪৩১

দিন যত যাবে মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তত বুঝবে : সালেক খোকন


প্রকাশিত:
৮ এপ্রিল ২০২১ ২০:১৯

আপডেট:
৮ ডিসেম্বর ২০২৪ ১৪:৫৩

ছবিঃ সালেক খোকন এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম নূর ইসলাম

 

আমগো বাল্যকালডা ছিল অন্য রকম। বন্ধুরাই তহন প্রাণ। টুটুল, মাশরাফি, বাদল, আতিয়ার আরও অনেকেই। সবাই মিলে বল খেলতাম। আমি খেলতাম রাইট আউটে। গ্রামের পাশেই ছিল দুইডা বিল। পাটাকাটার বিল ও চওড়ার বিল। পানি যহন টান দিত তহন হাটে হাটে ঢোল পড়ত। দল বাইন্ধা একদিন সবাই বিলে নামত। ওইডা ছিল উৎসবের লাহান। শত শত লোক। ঝোকা (পল) দিয়া বিলের এক সাইড থাইকা মাছ মাইরা অন্য সাইডে যাইত। যার ভাইগ্যে যেইডা পড়ত। শোল, বোয়াল, শিং, বড় বড় মাগুর, টাকি, বড় সরপুঁটি। সোল, বোয়ালই উঠত বেশি।

বাবা গ্রামের এমএলএফ ডাক্তার। রুগি দেখতেন ডোমার বাজারে। তহন তো চেম্বার বইলা কিছু ছিল না। টেবিলে ওষুধ সাজাইয়া বইতেন। মাঝে মইধ্যে অনেক রাইতে ডাক পড়ত। কিন্তু মানুষের চিকিৎসায় তারে কহনও বিরক্ত হইতে দেহি নাই।’’

‘‘সমাজ নিয়া তিনি ভাবতেন। প্রথম কমিউনিস্ট পার্টি করলেও পরে ভাসানী ন্যাপে জয়েন করেন। রাজনীতিতে তহন লাভ-ক্ষতি বইলা কিছু ছিল না। মূল বিষয় ছিল মাইনসের সেবা। বাবারে দেখছি, নিজের টাকা দিয়া মাইনসের চিকিৎসা করতে, গরিব ঘরের মেয়েদের বিয়ের খরচ দিতে। এইসব কাজ তার রক্তে মিশা ছিল। জমি ছিল তাঁর সত্তর বিঘা। রাজনীতির জইন্যে সেইটা বিক্রি করতে করতে বিশ বিঘায় নাইমা আসে। সম্পদ গেলেও বাবারে মানুষ সম্মান করত। খালেক ডাক্তার, বললেই দশগ্রামের লোক এক নামে চিনত। এহন তো রাজনীতিবিদদের সম্পদ খালি বাড়েই!’
নিজের জবানিতে শৈশব ও কৈশোরের কথা বলছিলেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা এস এম নূর ইসলাম। চার ভাই ও তিন বোনের সংসারে তিনি সবার বড়। বাবার নাম আবদুল খালেক আর মা নূর জাহান বেগম। বাড়ি নীলফামারী জেলার ডোমার উপজেলার পশ্চিম সোনা রায় গ্রামে।

লেখাপড়ায় নূরের হাতেখড়ি নাউয়াপাড়া (বর্তমানে ডাঙ্গাপাড়া) প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। পঞ্চম শ্রেণি পাশের পর তিনি ভর্তি হন ডোমার মাল্টি লিটারেল হাই স্কুলে। ১৯৭০ সালে তিনি এই স্কুল থেকেই মেট্রিক পাশ করেন। পরে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন নীলফামারী সরকারি কলেজে। একাত্তরে তিনি ছিলেন কলেজের ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্র।

বড়দের আলোচনা ও ছাত্রনেতাদের বক্তব্য থেকেই নূর ইসলামরা জেনে যেতেন নানা বৈষম্য ও শোষণের কথা। তখন নেতা ছিলেন আবদুর রউফ, অ্যাডভোকেট রফিকুল ইসলাম, বজলুর রহমান, আবদুল জব্বারসহ অনেকে। সত্তরের নির্বাচনে ডোমারে মুসলিম লীগ থেকে দাঁড়ন টোকরা এমপি আর আওয়ামী লীগের আবদুর রউফ। নির্বাচনে রউফ জয়ী হন। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আরোহণে বাধা দিতে নানা ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ফলে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ওই সময় ডোমারে জনসভা করতে আসেন মতিয়া চৌধুরী। বাকি ঘটনা শুনি নূর ইসলামের মুখে।
‘‘উনি ছিলেন অগ্নিকন্যা। দলবেঁধে আমরা তাঁর বক্তব্য শুনতে যাই। পাকিস্তানিদের অবিচারের কথা, শোষণের কথা বললেন তিনি। সবার কাছে তহন সবকিছু পরিষ্কার হইয়া যায়। তিনি রুইখা দাঁড়াইতে বললেন। রউফ সাহেব সবাইরে ঐক্যবদ্ধ করতে থাকলেন।’’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নূর ইসলামরা শোনেন রেডিওতে। তিনি বলেন:
‘‘বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি… রক্ত আরও দেব.. এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব..।’ এই কথার পর স্বাধীনতার ঘোষণার আর বাকি কী থাকে? এরপর সৈয়দপুরে পাকিস্তানি সেনা ও বিহারিদের লগে বাঙালিদের সংঘর্ষ বাঁধে। হাজার হাজার লোক লাঠিসোটা নিয়া সৈয়দপুর অ্যাটাক করে। ২৫ মার্চে ঢাকায় আর্মি নামার খবর আমরা পাই পরের দিন বিকালে। গ্রামের সবাই তহন ভয়ে অস্থির। মুখে মুখে খবর ছড়াইল, ‘পেলেইন আসবে, বোম ফালাবে’। তাই বাড়ি বাড়ি সবাই বাঙ্কার খোঁড়া শুরু করল।’’
ডোমারে আর্মি গেল কোন সময়টায়?
মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলামের উত্তর:
‘‘মার্চের শেষে। ওরা থানায় ক্যাম্প করে। খানরা গিয়াই প্রথম রউফ সাহেবের বাড়ি জ্বালাইয়া দেয়। হিন্দু বাড়িগুলো ছিল টার্গেটে। ভয়ে বহু লোক তহন চিলাহাটি বর্ডার দিয়া ভারতে চইলা যায়। বাড়ি ছাইড়া আমরাও আশ্রয় লই বর্ডারের কাছাকাছি।’’
মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন কবে এবং কেন?
তিনি বলেন:
‘‘সময়টা এপ্রিলের মাঝামাঝি। পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচার দিন দিন বাড়ছিল। ওগো সাহায্য করত মুসলিম লীগাররা। আমগো দেড় বিঘা জমিতে বড় বাঁশবাগান ছিল। ওরা সব কাইট্টা নিয়া ডোমারে বাঁশের কেল্লা বানাইল। দেশে থাকলে তো এমনি মরমু। তয় মারি মরমু। মা-বোনদের রক্ষা করমু। এইডাই ছিল চিন্তা। বাবাই ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা কইরা দেন।’’
আবদুর রউফ ববিন, ধীরাজ, জুলফিকারসহ নূর ইসলামরা জলঢাকা ও পাটগ্রাম হয়ে ইন্ডিয়ার ধাপরা ক্যাম্পে গিয়ে ওঠে। সেখান থেকে যান বাকডোকরা ক্যাম্পে। ৫-৭ দিন থাকার পর ট্রেনিংয়ের জন্য তাদের পাঠিয়ে দেওয়া হয় শিলিগুড়ির মূর্তি ক্যাম্পে। সে সব দিনের কথা জানালেন নূর ইসলাম:
‘‘প্রথম ব্যাচের আমগো উইংস ছিল ৪টা। ডালডা, ব্রেবো, আলফা ও চার্লি। আমি ছিলাম ৪নং চার্লি উইংসে। এফএফ নম্বর- ৪/২৮। গুরখা রেজিমেন্টের মেজর বিবি সারকি পুরা উইনংসের চার্জে ছিলেন। ট্রেনিং হয় এক মাস। ১০ হাজারের মধ্যে আমরা ৮৫ জন ছিলাম ইন্টেলিজেন্সে। রাতে সবাই শুইয়া গেলে আমাদের আরও ৩ ঘণ্টা কইরা ট্রেনিং চলত। হাউট-আউট করা, ডিনামাইট, হাই এক্সপ্লোসিভ চার্জ, ককটেল তৈরি, ব্রিজ-কালবার্ট ডেমোনেশন এইসব শিখানো হইত।’’
কোথায় কোথায় অপারেশন করলেন?

 ‘‘আমগো পাঠানো হয় পঞ্চগড়ের পূর্ব দিকে, কোটগজে। মিরগর বিওপি থেকে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে আক্রমণ করে আবার ফিরা আসতাম। গেরিলা ছিলাম। সহজ ভাষায়, ‘মার না ঔর ভাগনা’। দিনে রেকি চলত। সন্ধ্যার পর মেজর সাহেব ম্যাপ আঁইকা বুঝাইয়া দিতেন। রাতেই আমরা হিট কইরা চইলা আসতাম। এইভাবে অপারেশন করি টাঙ্গি ব্রিজ, পুটিকিমারি ব্রিজ, আটোয়ারিসহ ৬নং সেক্টরের অনেক স্থানে। ইন্ডিয়ান আর্মি মেজর বিবি সারকি সরাসরি আমাদের কমান্ড করতেন।’’
বিশেষ কোন দায়িত্বে ছিলেন?
‘‘ইন্টিলিজেন্সের আমরা ছিলাম ২ জন। রাস্তা-ঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ওড়াইতেই ডাক পড়ত। এক্সপ্লোসিভ ও ডেমুনেশনের সময় আমাদের পাহারা দিত মুক্তিযোদ্ধাদের একটা দল। ঠাণ্ডা মাথায় আমরা কাজ সাইরা চইলা আসতাম। আমার কাছে থাকত একটা স্টেনগান, ২টা গ্রেনেড ও ১টা ভেরি লাইট পিস্তল। লাল ও সবুজ সিগনাল হইত ভেরি লাইট পিস্তলে। খুব বিপদে পড়লে আমরা সেইটা দিয়া সংকেত পাঠাইতাম।’’

ছবিঃ পাকিস্তানি সেনাদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় নূর ইসলামের বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ

ভারত যখন ঘোষণা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নামে, তখনই নূর ইসলামরা পঞ্চগড় থেকে সামনে অ্যাডভান্স হতে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে। পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও মুক্ত করে তারা চলে আসেন দিনাজপুরের খানসামায়। ওখানেই ঘটে রক্তাক্ত সেই ঘটনা। পাকিস্তানিদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে উড়ে যায় নূর ইসলামের বাঁ পায়ের হাঁটুর নিচের অংশ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ওইদিনের কথা নূর আমাদের জানালেন:
‘‘১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। খুব ভোরের ঘটনা। ঠাকুরগাঁও ও বীরগঞ্জ হয়ে আমরা খানসামায় ঢুকছি। এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) সাড়ে তিনশর মতো। সঙ্গে ভারতীয় গুরখা ও মারাঠা রেজিমেন্ট। আমরা এক সাইডে ওরা অন্য সাইড দিয়া অ্যাডভান্স হইতেছিল।’’
‘‘খুব গোলাগুলি চলতেছে। পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে পজিশন নেয় ডাঙ্গারহাটে। আমরা তখন আত্রাই নদী ক্রস করছি। ও পাড়েই খানসামা থানা। সাথীরা সমানে এগিয়ে যায়। আমি খানিকটা পেছনে। এক্সপার্ট হইলেও ওরা যে নদীর পাড়ের বালিতে অ্যান্টি-পারসোনাল মাইন পুঁইতা রাখছে, টেরই পাই নাই। পানি থেইকা উইঠা বালিতে পা রাখতেই ধুম কইরা বিকট শব্দ হইল। আমি ছিটকা পড়ি। নিজেরে সামলাইয়া নিয়া দাঁড়াইতে চাইলাম। কিন্তু না, কাত হইয়া পইড়া গেলাম। সারা শরীর কাঁপতেছিল। বাম পায়ের দিকে চোখ পড়তেই স্থির হইয়া যাই।’’
হাঁটুর নিচ থেকে বাকি পা উড়ে গেছে তখন নূর ইসলামের। রগ ও মাংসগুলো ঝুলছে আর কাঁপছে। তাঁর মনে হচ্ছিল, প্রথমে পায়ের রক্তগুলো শরীরের উপরে উঠে আসে। কিছুক্ষণ পরই ঝুপ করে অনেক রক্ত একসঙ্গে পা দিয়ে বেরিয়ে যায়। নদীর পানির খানিক অংশ লাল হয়ে স্রোতে মিলিয়ে যায়। সব দেখছেন, গোঙ্গাচ্ছেন তিনি। ছোট ছোট দারকানা মাছগুলো পানিতে পাউডার হয়ে যাওয়া নূর ইসলামের শরীরের মাংস আনন্দ নিয়ে খাচ্ছে।

নূর যেভাবে বিবরণ দিলেন:
‘‘আই সি ইট মাই ঔন আইস… তখনও ভয় পাই নাই। ভয় পাইলে হয়তো ওইখানেই মইরা যাইতাম। ওই অবস্থার মধ্যেই বালির মধ্যে থাকা আরও কয়েকটা মাইন আমি নিষ্ক্রিয় করি। এরপর সঙ্গে থাকা সেল ড্রেসিং দিয়া পায়ের কিছু অংশ বাইন্ধা লই।’’
‘‘এরপর ক্রলিং করে নদীর কাচারে উইঠা আসি। ছোট ছোট স্প্লিন্টার আমার সারা শরীরে। ব্লিডিং হইতে হইতে চোখ অন্ধকার হইয়া আসছিল। মাথাও ঘুরতেছে। হাতের এসএলআরটা মাটিতে রাইখা তার ওপর মাথা দিয়া আমি শুইয়া থাকি…’’
এভা্বেই অনেক ক্ষণ পড়ে থাকেন নূর ইসলাম। এরপর কাছাকাছি আসে ভারতীয় মাইন ডিটেকটিভের একটি দল। তারা মেশিন দিয়ে রাস্তায় মাইন ডিটেক্ট করছিল। তাঁকে দেখে প্রথমে হাত উপরে তুলতে বলে। ক্রমশ নিঃসাড় হয়ে আসা শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াতে না পেরে হামাগুড়ি দিয়ে মাথাটা তুললেন তিনি। ওরা প্রশ্ন করে: ‘‘কোন হ্যায় তুম?’’
‘‘হাম মুক্তি হ্যায়।’’
ওরা বলে: ‘‘পাস ওয়ার্ড বাতাও।’’
ওই দিন তাদের পাস ওয়ার্ড ছিল, ‘চাঁদ সুরুজ’। পাস ওয়ার্ড বলতেই, ‘আইয়ে মেরা দোস্ত’ বলেই তারা সামনে এগিয়ে গিয়ে তুলে নেয় নূর ইসলামকে।
প্রথমে ঠাকুরগাঁও ও পরে হেলিকপ্টারে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতের বাকডোকরা হাসপাতালে। জ্ঞান ফিরলে চোখ মেলতেই এক নার্স এসে হাসিমুখে বললেন: ‘‘আপ কা দেশ তো আজাদ হো গ্যায়া।’’
শুনে চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না নূর। কলকাতা কম্বাইড হাসপাতালের হয়ে আমাকে নেওয়া হয় কিরকি হাসাপাতালে। সেখান থেকে পুনাতে। পরে কাঠের পা লাগিয়ে ফিরে আসেন তিনি বাংলাদেশে।
দেশে ফিরে মায়ের অনুভূতির কথা জানাতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হন এই বীর:
‘‘কৃত্রিম পা লাগানো থাকায় প্রথম কয়দিন মা বুঝতে পারেননি আমার পঙ্গুত্ব। কষ্ট পাইবেন বইলা তাঁরে বলাও হয় নাই। ঘরের দরজা বন্ধ করে রাতে পা খুইলা ঘুমাইতাম। মনের ভুলে একদিন দরজা খোলা রাইখাই শুইয়া পড়ছি। খুব ভোরে মা আইসা হঠাৎ দেখেন, আমার এক পা নাই। জড়িয়ে ধরে হাউমাউ কইরা মার সে কী কান্না।’’

ছবিঃ নূর ইসলামের অনুকুলে বঙ্গবন্ধুর আর্থিক সহযোগিতার পত্র

যে দেশের জন্য ত্যাগ স্বীকার করলেন, সে দেশ কি পেয়েছেন?
‘‘স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, কিন্তু স্বপ্নের সে দেশ পাইনি! পাঙ্খরাজ নামে এক সাঁওতাল, মসজিদের হুজুর, ছাত্র , শিক্ষক, জেলে, কৃষক একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি। আমরা ধর্মনিরেপেক্ষ দেশ চেয়েছি। এখন তো ধর্মান্ধতার দেশ চলছে।’’
রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকদের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে একাত্তরের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন এই বীর যোদ্ধা। তাঁর ভাষায়:
‘‘আটোয়ারি থানায় কিসমত রশেয়া নামক স্থানে একটি বাড়ি ছিল হাফিজ চেয়ারম্যানের। তিনি ছিলেন ওখানকার পিস কমিটির প্রধান। এক সন্ধ্যায় তার বাড়িতে আমরা অ্যাটাক করি। ভেতরে বড় একটা গোডাউন ছিল। সত্তর জন মেয়েকে সেখান থেকে আমরা বিবস্ত্র অবস্থায় উদ্ধার করি। প্রতি রাতেই খানরা ওই বাড়িতে এসে ফুর্তি করত। মেয়েগুলোর সারা শরীর ছিল ক্ষতবিক্ষত। ওদের দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। মেয়েদের ওরা কাপড় দিত না। সম্ভ্রম হারানোর কষ্টে কাপড় পেলেই ওখানকার মেয়েরা ফাঁস লটকে মরত। পরে হাফিজকে আমরা মেরে ফেলেছিলাম।’’
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড নিয়ে এই সূর্যসন্তান অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামত। তিনি বলেন:
‘‘বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরেছে তারা পশুর চেয়ে খারাপ। বঙ্গবন্ধুকে সম্মান দেখিয়েই মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দিয়েছিলেন। উনি এক ভুল করছেন সাধারণ ক্ষমা করে। আমরাও ভুল করেছিলাম হাতিয়ার জমা দিয়ে। যদি মুক্তিযোদ্ধাদের হাতিয়ার থাকতো তবে বঙ্গবন্ধু আজও বেঁচে থাকতেন। আর এই দেশে একটি রাজাকারও থাকত না। দিন যত যাবে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুকে তত বুঝবে। তাঁর মতো মানুষ পৃথিবীতে একবারই জম্মায়।’’

নানা সমস্যা থাকলেও বুকভরা আশা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নূর ইসলাম বলেন, ‘‘তোমরা লেখাপড়া শিখে নিজেদের যোগ্য কইরা তোল। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশটা স্বাধীন করছি। মনে রাখবা, মানবতা, সততা ও দেশপ্রেম থাকলেই সামনে আগাইতে পারবা।’’

ছবি: সালেক খোকন

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top