ক্যাপ্টেন সায়গল: এক বিরম্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা : মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
প্রকাশিত:
২২ মার্চ ২০২২ ২৩:৫১
আপডেট:
৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৯:১১
স্বাভাবিকভাবে জন্মপরিচয়ের ধারায় সামাজিক অবয়বে সাধারণত কাউকে রাতারাতি উত্থান-পতনের মুখোমুখি হতে হয় না। কিন্তু তা যে হয়ইনা তাও সঠিক নয়। ভাগ্য মানুষকে কখন কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা কেউ কখনো জানতে পারে না। আজ যে নিন্দিত বা হতদরিদ্র- কাল সে হয়তো সিংহাসনে বসে সকলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে পারেন। কিংবা আজ যিনি সিংহাসনে বসে ক্রোড় হাসি হাসছেন কালই হয়তো আচমকা এক ঝড়ে শুষ্ক পত্র-পল্লবের ন্যায় পথে-প্রান্থরে গড়াগড়ি খাবেন। সমাজের প্রতিটি স্তরে স্তরে, জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে এর প্রমাণ দৃষ্ট হয়। এর একটি জ্বলন্ত প্রমাণ ক্যাপ্টেন সায়গল- এক বিরম্বিত মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি। যিনি পৈত্রিক আদর্শ পরিত্যাগ করে মাতৃ আদর্শে জীবনকে প্রত্যক্ষ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মাতৃসমাজ কি তাঁর এই আশা-আকাঙ্খার মাহাত্ম অনুধাবন করতে পেরেছিল?
তাঁর পুরো নাম ক্যাপ্টেন ইকরামুল মজিদ সায়গল- যিনি পিতার দিক থেকে পাঞ্জাবি আর মায়ের দিক থেকে বাঙালি। মানুষের প্রাথমিক শিক্ষা, চেতনা ও বিশ্বাসের বুনিয়াদ গাঠত শৈশবে মাতৃতান্ত্রিক পাঠশালায়। ক্রমোন্নত শিক্ষাস্তরে জ্ঞানের ভাণ্ডার উত্তরোত্তর পূর্ণতা পেলেও মাতৃশিক্ষার আদর্শিক দিকনির্দেশনা কখনও পথ হারায় না। ক্যাপ্টেন সায়গল পাঞ্জাবির ঔরসজাত হলেও বাঙালি গর্ভের দায় এবং মাতৃশিক্ষার প্রেরণায় ঋদ্ধ ছিলেন। তাই পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যক্ষ করে তিনি ব্যথিত হয়েছিলেন। এক দেশ এক ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতার অযুহাতে ইসলামের নীতি বিষর্জন দিয়ে বৈষম্যের নগ্ন চর্চায় তিনি পীড়াবোধ করতেন।
মায়ের আদর্শ লালন করে শৈশব, কৈশোর পাড়ি দিয়ে যৌবনে এসে কর্মজীবনের স্বচ্ছ সলিলে অবগাহন করতে চেয়ে ছিলেন। তাই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন প্রাপ্তির পর চরম রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ প্রত্যক্ষ করে ন্যায়সঙ্গত এবং অধিকার বঞ্চিত মানুষের আবেগকে অলক্ষ্যেই নিজের অন্তরে ধারণ করেন। সত্তরের নির্বাচনে গণতান্ত্রিক রায়ের বিপরীতে যখন তাঁর পৈত্রিক জাতীয়তা হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় তখনই তিনি তাঁর লক্ষ্য স্থির করে সার্বিক পরিস্থিতি গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে শুরু করেন।
ক্যাপ্টেন সায়গল ঢাকায় জয়দেবপুরে অবস্থিত ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যটালিয়নে কোর কমান্ডের একজন হেলিকপ্টার পাইলট ছিলেন। সেখান থেকে তিনি একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ গ্রহণের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা সেনানিবাসে অবস্থিত ‘স্কুল অব ইনফেন্ট্রি অ্যান্ড ট্যাকটিক্স’-এ যোগদান করেন। একাত্তরে মার্চের সেই উত্তাল দিনগুলির সংবাদ তিনি সেখানে থেকেই প্রাপ্ত হন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় রেডিওতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের ভাষণে উদ্বিঘœ হয়ে তিনি পূর্ব পাকিস্তান চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে করাচি বিমান বন্দরে আসেন। সেখানে এক বাঙালি সেনা কর্মকর্তা লে. এস আই এম নূরুন্নবী খানের (মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বীরবিক্রম খেতাবে ভূষিত হন) সাথে তাঁর দেখা হয়। তখন তারা পরষ্পরের সাথে পরিচিত হন এবং ক্যাপ্টেন সায়গলের কাছ থেকে লে. নবী জানতে পারেন যে, ‘ঢাকার পরিস্থিতি ভয়াবহ। আর্মি ক্র্যাকডাউন হয়েছে। হাজার হাজার সিভিলিয়ান মারা যাচ্ছে।’
যাহোক তাঁরা ২৮ মার্চ তারা তেজগাঁও বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। ক্যাপ্টেন সায়গলের সাথে ছিলেন লে. নবীসহ আরও একজন। বিমান থেকে অবতরণের পর পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ক্যাপ্টেন সায়গল একটি গাড়ির ব্যবস্থা করলে তাতে তারা ঢাকা সেনানিবাসে ঢুকে পড়েন। এখানে তখন ইএমই, এএমসি, এএসসি, ইঞ্জিনিয়ার্স এবং সিগন্যাল ইউনিটে শতকরা ৭০ জনই ছিলেন বাঙালি সেনা সদস্য। তাদেরকে নিয়ে তাঁরা বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন তখনই। সন্ধ্যার পরপরই সম্ভাব্য বিদ্রোহের সময় নির্ধারণ করে গোপনে সকলকে জানিয়ে দেয়া হয়। পাশাপাশি বাঙালি মেজর মাওলার বাসায় গিয়ে পরামর্শ করলে মাওলা এবং তার স্ত্রী তাতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। সেখানে উপস্থিত অনেক কর্মকর্তাকেই তখন উদ্বিঘœ দেখাচ্ছিল।
এদিকে ক্যাপ্টেন সায়গলকে বিশেষ কিছু কাজের দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছিল। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন মা বাঙালি হওয়ার কারণে পাকিস্তানিরা তাঁকে বিশ্বাস করছে না। এমতবস্থায় ২৮ মার্চের পরিবর্তে একদিন পিছিয়ে ২৯ মার্চ তাঁদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ২৯ মার্চ সকাল ১০টায়ই ১৪৯ ইএমই ওয়ার্কশপ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেনারা ঘিরে ফেলে। অগত্যা গোয়েন্দারা তাদের পরিকল্পনার বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছে মনে করে তাঁরা দ্রুত পালানোর সিদ্ধান্ত নেন এবং দুপুরের মধ্যেই সেনানিবাস থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হন।
এদিকে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সহ-অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহ বিদ্রোহ করে জয়দেবপুর থেকে তাঁর বিভিন্ন কোম্পানিকে ময়মনসিংহে গিয়ে তাঁর সাথে যোগ দেবার জন্য গোপন নির্দেশ দিয়ে ২৮ মার্চ সকাল ১০ টায় ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। টাঙ্গাইল গিয়ে তিনি জানতে পারেন চট্টগ্রামে মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেছেন। ২৯ মার্চ তিনি মুক্তাগাছা পৌঁছেন। ভোরবেলা জয়দেবপুর, গাজীপুর এবং টাঙ্গাইলের সৈন্যরা মুক্তাগাছা পৌঁছে যায়। অপরাহ্নে মেজর সফিউল্লাহ তাঁর ব্যাটালিয়ন সমাবেশের কাজ সম্পন্ন করে বিকাল ৪টায় সিটি হলে সকল অফিসার ও সেনাদের সমাবেশের মাধ্যমে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। ৩০ মার্চ তিনি তাঁর পুরো রেজিমেন্ট নিয়ে পাকবাহিনীর সাথে মোকাবেলার উদ্দেশ্যে ঢাকার পথে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নেন। সেদিনই তিনি তাঁর সদর দপ্তর কিশোরগঞ্জে স্থানান্তর করেন। সেখানে আসার পর মেজর কাজী নুরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন আব্দুল মতিন, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তাঁর সাথে যোগ দেন। তখন ক্যাপ্টেন সায়গলও ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে গিয়ে ভৈরব বাজারের নিকট মেজর সফিউল্লাহ কাছে রিপোর্ট করে তাঁর বাহিনীতে যোগদান করেন। অতঃপর মেজর সফিউল্লাহ ১ এপ্রিল ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ক্যাপ্টেন সায়গলের যোগদান বিষয়ে মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ বলেন, ‘আমার সৈন্যরা যখন ভৈরব বাজার থেকে ঢাকার পথে অগ্রসর হয়, ক্যাপ্টেন সায়গল, ব্যাটালিয়নের একজন অফিসার, যিনি কোর কমান্ডারের হেলিকপ্টার পাইলট ছিলেন, দলত্যাগ করে ব্যাটালিয়নের যোগ দেন। আমি তাকে আমার ব্যাটালিয়নের আলফা কোম্পানির নেতৃত্ব প্রদান করি।’
মনেপ্রাণে বাঙালি হয়েও পিতৃপরিচয়ের কারণে ক্যাপ্টেন সায়গলকে বাঙালি হতে দেয়া হয়নি। মেজর সফিউল্লাহ তাঁকে বিশ্বাস করে তাঁর বাহিনীতে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করলেও ভাগ্য তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের মঞ্চ থেকে ছুড়ে ফেলে দেয়। তখন মুক্তিবাহিনী কর্তৃক মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হলেও বিএসএফ ছিল খবরদারীত্বে। তারা এই পিতৃ পরিচয়ের কারণে সায়গলকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং এপ্রিলের শেষ দিকেই পাকিস্তানের গুপ্তচর সন্দেহে আটক করে। কয়েকদিন আগরতলার কারাগারে বন্দী রেখে পাঠিয়ে দেয়া হয় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কারাগারে। সেখানে ১০০ দিন কারাভোগের পর এক সুযোগে তিনি পালিয়ে নেপালে চলে যান। সংবাদ পেয়ে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা নেপাল থেকে তাঁকে বন্দী করে ঢাকায় নিয়ে আসে। সেখানে ৮৪ দিন তাঁকে জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপরের ইতিহাস কুয়াশাচ্ছন্ন।
[লেখক: এশিয়াটিক সোসাইটির অধীন ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন’ প্রকল্পের গবেষক ও হবিগঞ্জ জেলা সমন্বয়ক। বাংলা একাডেমির হাওর গবেষক]
মুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার
হবিগঞ্জ জেলার ইতিহাস, হাওরের ইতিবৃত্ত, প্রসঙ্গ: মুক্তিযুদ্ধে হবিগঞ্জ, মুক্তিযুদ্ধে মাধবপুর প্রভৃতি গ্রন্থ প্রণেতা। সমন্বয়ক (হবিগঞ্জ জেলা): এনসাইক্লোপিডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশন, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি।
আপনার মূল্যবান মতামত দিন: