সিডনী শুক্রবার, ১৯শে এপ্রিল ২০২৪, ৬ই বৈশাখ ১৪৩১


এক যে আছে বৃক্ষ : নবনীতা চট্টোপাধ্যায়


প্রকাশিত:
১ এপ্রিল ২০২১ ২০:৪১

আপডেট:
১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৯:৪৭

ছবিঃ নিম গাছ

 

কেউ ছালটা ছাড়িয়ে নিয়ে সেদ্ধ করছে।
পাতাগুলো শিলে পিষছে কেউ
কেউ বা ভাজছে গরম তেলে
খোস, দাদ, হাজা চুলকানিতে লাগবে।
চর্মরোগের অব্যর্থ মহা ঔষধ
কচি পাতাগুলো খায় ও অনেকে
এমনি কাঁচাই, কিংবা তেলে ভেজে
যকৃৎতের পক্ষে ভারী উপকার।
কচি ডালগুলো ভেঙে চিবোয় কতলোক
দাঁত ভাল থাকে, কবিরাজেরা প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাড়ীর পাশে গজালে বিজ্ঞরা খুশীই হন, বলেন
নিমের হাওয়া ভাল, থাক কেটো না।
কাটে না, কিন্তু যত্ন ও করে না।
আবর্জনা জমে এসে চারিদিকে।
সান দিয়ে বাঁধিয়েও দেয় কেউ
সে আর এক আবর্জনা।
হঠাৎ একদিন একটা নতুন ধরণের লোক এলো।
মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে রইল শুধু
বলে উঠল "বা: কি সুন্দর পাতাগুলি
কি রূপ, থোকা থোকা ফুলেরই বা কি বাহার
এক ঝাঁক নক্ষত্র নেমে এসেছে যেন
নীল আকাশ থেকে সবুজ সায়রে।"
খানিকক্ষণ চেয়ে দেখে চলে গেল।
কবিরাজ নয়, কবি
নিমগাছটার ইচ্ছা করতে লাগল লোকটার  সাথে চলে যায়, কিন্তু পারলে না।
মাটির ভিতরে শিকড় অনেক দূর চলে গেছে।
বাড়ীর পিছনে আবর্জনার স্তুপের
মধ্যেই দাঁড়িয়ে রইল সে।
ওদের বাড়ীর গৃহকর্মনিপুণা লক্ষী বৌটার ও ঠিক একই দশা।"       

(নিমগাছ/বনফুল)
              

বৈজ্ঞানিক নাম আজাদিরাচটা ইন্ডিকা। শব্দটি পার্সী শব্দ থেকে এসেছে। পার্সী ভাষায় আজাদ কথাটির অর্থ হল স্বাধীন আর দিরাচটা  মানে বৃক্ষ বোঝায় এবং ইন্ডিকা কথাটির অর্থ ভারতীয়। এককথায় ভারতীয় উপমহাদেশের একটি স্বাধীন বৃক্ষ। সংস্কৃত ভাষায় নিম্ব শব্দটি থেকে নিম শব্দ এসেছে। এছাড়া অনেক দেশে একে মার্গোসা বলেও অভিহিতা করা হয়। মূলত মেহগনি  প্রজাতির বৃক্ষ। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলিতে যেমন ভারতীয় উপমহাদেশ, বাংলাদেশ, মায়ানামার, শ্রীলংকা আফ্রিকা, দক্ষিণ এশিয়ায়, দক্ষিণ ও মধ্য আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চলে এই গাছ পর্যাপ্ত পরিমাণে দেখা যায়। সাধারণত: ৫০ থেকে ৭০ ফুট লম্বা হয়। পাতাগুলি আড়াই ইঞ্চি থেকে চার ইঞ্চি লম্বা হয়। ২১ থেকে ৩২ ডিগ্রী তাপমাত্রায় নিমগাছ ভাল থাকে। এমনকি গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির ৪০ বা ৪৫ ডিগ্রী তাপমাত্রাতেও এরা দিব্যি টিকে থাকতে পারে কিন্তু তাপমাত্রা ৪ডিগ্রীর নিচে নেমে গেলে আর বেঁচে থাকতে পারে না। খুব তাড়াতাড়ি ডালপালা বিস্তার করে একরাশ সবুজ পাতা নিয়ে নিম গাছ বৃদ্ধি পায়।  নিমফুলের সুগন্ধ অতি মনোরম এবংনিমফল বহু পাখিদের প্রিয় খাদ্য। নিমগাছের বিস্তার প্রধানত: নিমফলের বীজ থেকেই হয়।
পুরানে কথিত আছে সে সমুদ্র মন্থন থেকে উত্থিত অমৃত কলসে করে নিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র যখন যাচ্ছিলেন তখন কয়েক ফোঁটা অমৃত পৃথিবীতে পড়ে যায়।  সেই পড়ে যাওয়া অমৃতকণা থেকে নিম গাছের জন্ম।  নিম তাই সর্বরোগহারিণী প্রাণদায়ক অমৃত বৃক্ষ। হিন্দুরা বিশ্বাস করেন যে  দেবীর কৃপায় বসন্ত রোগ বা স্মল পক্স সেরে যায় সেই শীতলা দেবীর অধিস্থান নিম বৃক্ষে। উত্তর ও পূর্ব ভারতে যেমন দেবী শীতলা, দক্ষিণ ভারতে  তেমনি মারিম্মান দেবী বা নিমারী দেবীর প্রতীক হিসাবে ধরা হয় নিম গাছকে। দক্ষিণ ভারতে বহু মন্দিরে বা গৃহে পূজার সময়, বছরের প্রথম দিনে নিমপাতা ও ফুল দিয়ে তৈরী মালা বিগ্রহকে পরানো হয়হয়। পৌরাণিক গাথা অনুসারে সূর্যদেব মহাপরাক্রমশালী অসুরদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিমবৃক্ষে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সূর্যের উপাসকদের কাছে নিমগাছ তাই পবিত্র ও পূজনীয় বৃক্ষ।

এবার ফেরা যাক ইতিহাসের পাতায়। ভারতীয় উপমহাদেশে নিমগাছের ব্যবহার প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ঔষধি হিসাবে নিমগাছের পাতা ও ফুলের ব্যবহার ৪৫০০ হাজার বছর আগের পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতা হরপ্পার ঐতিহাসিক খননকার্যে বহু জায়গায় নিদর্শন পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ প্রত্নতত্ববিদরা এইসব ধ্বংসাবশেষের মাঝে  কিছু পাত্র আবিস্কার করেছেন। সেইসব পাত্রে ঔষধ হিসাবে নিমগাছের মূল ও পাতার নিদর্শন পাওয়া গেছে| চরক-সংহিতা, শুশ্রুত-সংহিতা ও বৃহৎ সংহিতায় চরক তদানীন্তন ভারতীয় চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিম গাছের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। আয়ূর্বেদ শাস্ত্রের জনক চরক  নিমগাছকে সর্বরোগহারিণী নামে ভূষিত করেছেন। আজ থেকে পাঁচ হাজারবছর আগেও নিম গাছের ছাল, পাতা, ফল ও ফুল দিয়ে নানান ধরণের ঔষধি তৈরী হত যা মানুষের নানাবিধ রোগ বিশেষত:চর্ম রোগের মহৌষধ ছিল। ৩৫০বছর আগের একটি তালপাতার পুঁথিতে  (চেন্নাইয়ের ট্রাডিশনাল মেডিসিন ও রিসার্চ সেন্টারে সংরক্ষিত)  বর্ণিত আছে  নিমগাছের  থেকে তৈরী ঔষধে নানাবিধ ক্ষত নিরাময়, মস্তিস্কের যাবতীয় রোগ মানসিক অসুখ, প্যারালাইসিস রোগের উপশম সম্ভব ছিল।
বহু যুগ ধরে ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির চিকিৎসা ব্যবস্থায় নিম এক জাদুকরী ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে।  কোনোরকম যত্ন ছাড়াই প্রধানত:আপন মনে গজিয়ে ওঠা এই বৃক্ষের ছাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিটি অংশই মানবসেবায় নিয়োজিত। এই গাছের পাতা নানা ধরনের চর্মরোগ, দৃষ্টিশক্তিজনিত সমস্যা, কৃমিনাশ, পাকস্থলির রোগ, ক্ষুধামান্দ্য, রক্তশিরাজনিত সমস্যা, দাঁত ও মাড়ির রোগে  উপকারী। এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ ও আবরশনের ক্ষেত্রেও নিমপাতার কার্যকারিতা প্রমাণিত।  নিমগাছের ছাল ম্যালেরিয়ায়, পাকস্থলি ওবৃহদান্ত্রের সমস্যায় কাজ দেয়। কৃমিনাশ, মূত্রনালির সমস্যায়, নামান ধরণের ক্ষত, লেপ্রসি, ডায়াবেটিসে নিমফল এক মহার্ঘ ঔষধ। নিমডাল সর্দিকাশি, দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য, ডায়াবেটিসে ব্যবহৃত হয়। ভারত ও বাংলাদেশের গ্রামগুলিতে নিমডাল স্বাস্থ্যকর দাঁতন হিসাবে বহু গ্রামবাসী এখনো ব্যবহার করে থাকেন। নিমগাছের বীজ থেকে উৎপন্ন তেল লেপ্রসি ও কৃমিনাশে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও বিভিন্ন চর্মরোগ, মাথার উকুননাশ, ক্ষতে নিমতেল উপকারী।
শুধুমাত্র ঔষধ ও সর্বরোগবিনাশ নয়, দূষিত এই পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষায় নিমগাছ এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আমরা সবাই জানি যে কোনো গাছ অক্সিজেন ত্যাগ করে ও কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে। এর ফলে আমাদের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় অক্সিজেন আমরা চারপাশের পরিবেশ থেকে সহজেই পেয়ে যাই। নিমগাছ সেই প্রজাতির বৃক্ষ যারা সবচেয়ে বেশি কার্বনডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে পৃথিবীকে দূষণমুক্ত রাখে। এছাড়াও মশা ও বিভিন্ন প্রজাতির বিষাক্ত পোকামাকড়ের উপদ্রব কমাতে নিমতেল থেকে তৈরী স্প্রে খুবই উপযোগী। মাথার খুসকি নিবারনে, ত্বকের স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য নানা ধরণের সাবান, কসমেটিকসে, নিমের নির্যাস ব্যবহার হয়।  চিকেন পক্স বা স্মল পক্সের আরোগ্য সাধনে নিমপাতা ও নিমের নির্যাস খুব কার্যকারী। গ্রীষ্মপ্রধান দেশগুলির খাদ্যতালিকায় ও নিম জায়গা করে নিয়েছে। বিশেষত: শীতের শেষে বা বসন্তের শুরুতে আমাদের ভাতের পাতে নিমবেগুন ভাজা, মরশুমী সবজি দিয়ে নিমপাতার পাতলা ঝোল শুধুমাত্র  সুস্বাদু নয়, শরীরের পক্ষে উপকারী, জিভের স্বাদ বাড়ায়। দক্ষিণ ভারতের খাদ্যতালিকায় নিমফুলের একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। শুকনো নিমফুল পাউডার দিয়ে ফ্লাওয়ার রাইস, রসম ইত্যাদি বিভিন্ন পদ রান্না হয়ে থাকে। এমন কি কখনো কখনো ডিশের উপর গার্নিশিং করার জন্য সুগন্ধি টাটকা নিমফুল ব্যবহার করা হয়। নিমফুলের নির্যাস আরোমাথেরাপিতে ব্যবহার হয় নার্ভ শীতল রাখার জন্য। জামাকাপড়, বিভিন্ন ধরণের সংরক্ষণের কাজে ছত্রাক নিবারণের জন্য শুকনো নিমপাতা ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
নিমগাছের কার্যকারিতা ও গুণাগুণের কথা লিখতে গেলে পাতার পর পাতা শেষ হয়ে যাবে তবু একটি অসমাপ্ত অধ্যায় রয়ে যাবে। প্রশ্ন হলো যুগের পর যুগ ধরে এই ম্যাজিক বৃক্ষটি সমগ্র পৃথিবী ও মানব জাতির এতো হিতসাধন করে আসছে, পরিবর্তে  আমরা এই বৃক্ষটির যথাযথ সংরক্ষণের জন্য কি উপায় নিয়েছি? আবর্জনার মাঝে, নীচু জলাজমিতে, কখনো মানুষের আগ্রাসী অতাচারে বহু নিম গাছ মৃতপ্রায়। যে বৃক্ষটির সংরক্ষণ ও বহুমাত্রায় প্রজনন ও বিস্তার পৃথিবীর আয়ূ বাড়িয়ে দেয়, তার বিষয়ে আমরা যুগ যুগ ধরে উদাসীন ও নির্বিকার। সম্প্রতি ব্যাংগালোরের কনকপুরায় একদল পরিবেশবিদ সমস্ত শহরের নিমগাছগুলির রক্ষণাবেক্ষনে উদ্যোগী হয়ে বহু মৃতপ্রায় নিমগাছকে পুনর্জীবন দিয়েছেন। তারা নাগরিকদের মাঝে নিমগাছের সংরক্ষনশীলতার চেতনা বিকাশের জন্য ব্রতী ও হয়েছেন। আমাদের সবার মধ্যে এই চেতনা বিস্তার লাভ করুক তা না হলে সুদূর ভবিষ্যতে এই জাদুকরী বৃক্ষটি বিলুপ্ত হয়ে গেলে বিষন্ন নিমফলের মত ছায়াপথে  পরপড়ে  থাকবে পৃথিবী নামক এক মৃতপ্রায় নীলগ্রহ।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top