সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

চৈত্র সংক্রান্তি মেলা: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৭ এপ্রিল ২০২০ ২৩:০৪

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ১২:০৮

 

মাসের শেষদিনটিকে বলা হয় সংক্রান্তি। বিভিন্ন মাসে রয়েছে বিভিন্ন সংক্রান্তি। বাংলা বছরের সমাপনী মাস চৈত্র। চৈত্রের শেষ দিনটিকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি। এদিনটিকে বিভিন্ন উৎসবের মধ্যে দিয়ে পালন করে থাকে বাঙ্গালী সমাজের নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ। বিশেষ করে সনাতন হিন্দু সমাজের লোকেরা তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও লোকাচারের মধ্য দিয়ে পালন করে এ দিনটি। আর বছরের শেষ দিনের চৈত্র সংক্রান্তি সূর্যাস্তের মধ্যে দিয়ে কালের গর্ভে হারিয়ে যায় বাংলা পুঞ্জিকার একটি বিদায়ী বছর।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে বাঙ্গালী সামাজে লোকেরা নীলপূজা, চড়কপূজা, গাজন, মেলাসহ বেশকিছু লোকাচারমূলক অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। চৈত্র সংক্রান্তির এ মেলা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের উৎসব। শাস্ত্র অনুসারে এইদিনে স্নান, দান, ব্রত, উপবাস প্রভৃতি ক্রিয়াকর্মকে পূন্যজনক বলে মনে করা হয়।

চৈত্র সংক্রান্তির উৎসবের অন্যতম প্রধান উৎসব গাজন। এ উৎসব চৈত্র সংক্রান্তির দিন থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত মাসের শেষ দিন কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে উদ্যাপিত হয়। এর মূল লক্ষ্য সূর্য এবং তার পত্নীরূপে কল্পিত পৃথিবীর বিয়ে দেয়া। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্যের যখন প্রচণ্ড উত্তাপ থাকে তখন সূর্যের তেজ প্রশমণ ও বৃষ্টি লাভের আশায় কৃষিজীবী সমাজ এ উৎসব পালন করে থাকে বহুকাল আগে থেকেই।

গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ চড়ক। এ উৎসবে গ্রামের কোন এক শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা শুরু হয়ে অন্য শিবতলায় গিয়ে শেষ করা হয়। শোভাযাত্রায় একজন শিব আর একজন গৌরী সেজে নৃত্য করে। অন্যান্য ভক্তরা তখন নন্দি, ভৃঙ্গী, ভুত-প্রেত, দৈত্যদানব প্রভৃতি সেজে শিব-গৌরীর সঙ্গে নাচতে থাকে। এ সময় শিবকে নিয়ে নানারকম লৌকিক ছড়াও আবৃত্তি করে তারা। এ ছড়াতে শিবের নিদ্রাভঙ্গ থেকে শুরু করে তার বিয়ে, কৃষিকর্ম ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে। গাজনের মেলাতে সাধারণত শুলফোঁড়া, বানফোঁড়া ও বড়শিগাঁথা অবস্থায় চড়কগাছে ঘোরা, আগুনে হাঁটা প্রভৃতি সব ভয়ঙ্কর ও কষ্টসাধ্য কলাকৌশল দেখানো হয়।

এছাড়াও চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় বাঁশ, বেত, প্লাস্টিক, মাটি ও ধাতুর তৈরি বিভিন্ন ধরনের তৈজসপত্র যেমন তালপাতর পাখা, লোহার দা-বটি, খুন্তি-কুড়াল, বাঁশ-বেতের ডোল, কুলা, চালনি, মাটির হাঁড়ি, সরা, মাটির ব্যাংক, শৌখিন সামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য যেমন লাড্ডু, তিলা, গজা, জিলাপী, বাতাসা সহ বাংলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য বেচা কেনা হয়। বায়স্কোপ, সার্কাস, পুতুলনাচ, ঘুড়ি ওড়ানো ইত্যাদি চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থা থাকে সেখানে। অঞ্চলভেদে এই মেলা তিন থেকে চারদিন চলে। চৈত্র সংক্রান্তির খাদ্য তালিকায় কোন মাছ-মাংস থাকে না। চৌদ্দ প্রকার শাক হেলেঞ্চা, ঢেকি, সেন্টি, কচু, থানকুনি, তেলাকুচা, নটেশাক, গিমা, খারকোন, বতুয়া, নুনিয়া, হাগড়া, পাট, সাজনা প্রভৃতি মিশালে রান্না করে গ্রামের নারীরা। এই শাকগুলো বাড়ির আশে-পাশে এমন কি খাল, পুকুর ডোবর ধার থেকে সংগ্রহ করা হয়।

চৈত্রের শেষদিন নিরামিষ খাওয়ার রেওয়াজ বাঙ্গালির। একসময় কেবল হিন্দু পরিবারগুলোতে এ নিরামিষ বা পাচন রান্নার প্রচল ছিল। এখন মুসলিম পরিবারগুলোতেও বছরের শেষদিনে পাচন রান্না হয়। পাচন রান্নায় প্রচলিত সবজির মধ্যে পেঁপে, মিষ্টি আলু, চালকুমড়া, মটরশুটি, কাঁচা শিমের বিচি, শসা, পটল, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, লাউ, মিষ্টি কুমাড়া, ঢ্যাঁড়স, বেগুন, বরবটি, গাজর, লাউ ও মিষ্টি কুমড়ার শাক, কচুরলতি, টমেটো, কাঁকরোল, তিতা করলা, মারিশ শাক, পুঁই শাক, কলমি শাক, ঢেকি শাক উল্লেখযোগ্য।

এসব সবজির পাশাপাশি ব্যবহার করা হয় ডালের বড়া, মটরশুটি, শুকনো ফেলন ডাল, শিমের বিচি। অন্যন্য সংক্রান্তির মধ্যে চৈত্র মাসের সংক্রান্তির ভাব বেশ আলাদা। আমাদের দেশের হিন্দুপ্রধান অঞ্চলগুলোতে যুগ যুগ ধরে চৈত্র সংক্রান্তির নানা উৎসবের আয়োজন করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম বারোয়ারি মেলা। নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, বরিশাল, দিনাজপুরের ফুলছড়িঘাট এলাকায়, কুমিল্লার লাঙ্গলকোট ও ঢাকার সাভার ধামরাইয়ে চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top