সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

নববর্ষ ও বৈশাখী মেলা: শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
২৭ এপ্রিল ২০২০ ২৩:১৬

আপডেট:
২৮ এপ্রিল ২০২০ ০২:১২

 

চলে যাওয়া বছরের সমাপ্তি। আর নতুন বছরের আগমন;-এই হলো নববর্ষ। ব্যর্থপ্রাণের আর্বজনা সরিয়ে দিয়ে ভোরের রাঙা রবি জানিয়ে দেয় এসেছে নতুন সকাল, নতুন দিন। নুতন বছর সেই নতুন বছরকে বরণ করে নিতে কত না আয়োজন।

বাংলার প্রধীন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় ছয় ঋঁতু আর ১২ মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পহেলা বৈশাখ ও নববর্ষ বাঙ্গালীর বিজয় পতাকা আকাশে তুলে ধরে। বাঙ্গালীর এই বিজয় হচ্ছে সংস্কৃতির। বাংলা সনের প্রথম দিনটি হলো পহেলা বৈশাখ। অধিকাংশ অভিধানে বৈশাখ শব্দের পরিচয় দেয়া হয়েছে বাংলা বছরের প্রথম মাস হিসেবে। কিন্তু প্রখ্যাত বাংলা অভিধান প্রণেতা হরিচরণ বন্দেপাধ্যায়। তার বঙ্গীয় শব্দকোষ এ বলেছেন, যে মাস বৈশাখী অর্থাৎ বিশাখানক্ষত্রযুক্ত পৌর্নমাসী; বৎসরের প্রথম মাস মাধব। অথচ গ্রামীণ সাধারন মানুষের ভাষা হলো বয়শাখ হচ্ছে বয়শাখ, মানে শাখে কিছু বয়, শাখে মানে গাছের ডালে, ডালের ভাল নাম হলো শাখা। তাঁরা বৈশাখ শব্দটির অর্থ সম্পর্কে আরো বিস্তৃত করে বলেন, বৈশাখে গাছের শাখায় যেমন বাতাস বয়, তেমনি বাতাসের সাথে রসও বয়। আসলে বৈশাখে শাখায় শাখায় রস বয় বলেই তো বৈশাখ হয়। বৈশাখ মাসে গাছে গাছে ফলের কত না সমারাহ দেখা যায়। ঝোপা ঝোপা আম,  জাম, লিচু কাঁঠালের লোভনীয় আমন্ত্রণ, প্রকৃতিকে এক নতুন রূপে সাজিয়ে দেয়। বিশ্বাসী হিন্দু ধর্মাবলম্বি হিন্দুরা পূজা-অর্চনার সুবিধার  জন্য পঞ্জিকা ব্যবহার করেন। তারা পঞ্জিকানুসারে চৈত্রের শেষ দিনকে চৈত্র সংক্রান্তি ও চড়ক পূজা হিসেবে পালন করে।

এই চড়ক পূজা উৎসবের সুন্দর প্রক্রিয়া আছে। কোন এক সন্ন্যাসীকে উদাম শরীরে মাটিতে শুইয়ে তার পিঠে ফোটানো হলো লোহার মোটা বরশি। এরপর তাকে গামছা আর দড়ির সাহায্যে ঝোলানো হলে চড়ক গাছে। সন্যাসী শূন্যে ঝুলতে থাকেন। এই হচ্ছে চড়কপূজা। শতশত বছর ধরে চৈত্র সংক্রান্তিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এমন অমানবিক চড়কপূজা নিষিদ্ধ হলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মপ্রাণ মানুষ আজও চড়ক পূজায় প্রার্থনায় সমবেত হয়। ১৮৬৫ সালে আইন করে নৃশংস এই বরশীবিদ্ধ চড়ক পূজা নিষিদ্ধ করা হয়। চড়ক একটি ব্রত। চৈত্রমাসের শেষ দিন শিবভক্ত বান রাজা তার সঙ্গীদের নিয়ে নাচগানে আত্মহারা হয়ে শরীরের রক্ত বের করে তার ছেলের উদ্দেশ্যে নিবেদন করেন। বান রাজার রক্ত উপহার পেয়ে শিব খুশি হয়েছিলেন। এ কাহিনী অনেক আগের।

এরপর থেকে শৈব সম্প্রদায়ের ভক্তরা চৈত্র সাংক্রান্তির দিন শিবকে পাওয়ার জন্য চড়ক উৎসবে আত্নহারা হয়। চড়কপূজা ঘিরে আয়োজন করা হয় শিবের  গীত বাজনা ও হরগৌরী নৃত। বরিশালের জুসখোলা সুনামগঞ্জেজর বিশ্বরম্ভপুর, পাবনার পূর্ণানন্দ যোগাশ্রম, গাজীপুরের কালিয়াকৈর, মৌলভীবাজার, গোপালগঞ্জ, বাগেরহাট, ঝিনাইদাহের মহেশপুরে এখানো চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখন তা ভিন্ন প্রক্রিয়ার সম্পন্ন হয়। একটি লাইফ পোস্টের মত পাইপ হচ্ছে চড়ক গাছ। এই গাছটি পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয় চৈত্রসংক্তান্তির দিন ঢাকঢোল বাজিয়ে শিবের গান গেয়ে পানির ভেতর থেকে তুলে আনা হয় চড়ক গাছ। এরপর চড়ক গাছটি মাটিতে পুঁতে তার সঙ্গে দড়ি ও কাঠ বাঁধা হয়। এরপর সন্যাসীর পিঠে বড়শী ফুটিয়ে চড়ক গাছে ঝুলিয়ে পাক ঘোরানো হয়।

ঝিনাইদহের ফতেপুর গ্রামে চড়ক পূজা উপলক্ষে এখনো চড়ক মেলা বসে। এই চড়ক উৎসবের ২০০ বছরের ইতিহাস রয়েছে। অতীতে কলকাতা আদলতের জজ অমূল্যকুমার চট্টপাধ্যায় ইঞ্জিনিয়ার নাগেন্দ্রনাথ মুখার্জী, ফটিক মুখার্জী, দাসু মুখার্জী চড়ক উৎসবের মূল আয়োজক ছিলেন। বর্তমানে এলাকায় অবস্থাপন্ন হিন্দু সম্প্রদায় চড়কপূজার আয়োজন করে। সন্যাসী অবনিশ কালা, নিতাই মিস্ত্রি, দোলে মিস্ত্রি, মেঘা সন্যাসী এরাই দীর্ঘদিন চড়কে পাক খেয়েছেন। এখন নতুন প্রজন্মেও সন্যাসীরা চড়কে উঠে শিবকে খুঁজে পান। চড়কপূজার হাজার হাজার মানুষ উৎসবে  মেতে ওঠেন। জেগে ওঠে ভক্তরা,¬ জেগে ওঠে বাংলার অতীত ঐতিহ্য।

উপনিবেশিক শাসনামলে, কৃষিনির্ভর পল্লীসদৃশ পূর্ব বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বিকাশ খুব কম ছিল। যেটুকু ছিল তা হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের হাত ধরেই বাঙালী সংস্কৃতি এবং সাংস্কৃতিক ধারা বিকাশ লাভ করেছিল। মুসলমানদের অংশগ্রহণ ক্ষীণ হওয়ার কারণেই বাঙ্গালী সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী প্রচারণার সুযোগটি নিয়েছিল পাকিস্তানী রাষ্ট্র।

পাকিস্তানী আমলে, ঢাকায় খুবই সংক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে এ উৎসব পালিত হতো। এত আড়ম্বরও ছিল না। তবে চেতনার স্থানটি ছিল যথেষ্ট দৃঢ়। প্রতি চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা বসতো। লালবাগ শ্মশানঘাটের দক্ষিণের বিশাল জায়গাজুড়ে মেলা বসতো। স্থানীয় ভাষায় একে চৈত্র পূজার মেলা বলা হতো। এই চৈত্র সংক্রান্তির পড়ন্ত বিকেলে বৃষ্টি ছিল অনিবার্য। মুসলধারে বৃষ্টি হতো। এখন সেই মেলাও নেই বৃষ্টিও নেই। কালের গর্ভে সবই যেন হারিয়ে যাচ্ছে।

চৈত্র সংক্রান্তি গড়িয়ে আসে নববর্ষ। আমাদের দেশে নববর্ষের  দিনটি হলো পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ এসে বছরের যাত্রা শুরু করে। কাল বৈশাখী নতুন করে কিছু সৃষ্টির আগে ভাঙ্গারও যে প্রয়োজন হয়। দামাডোল পিটিয়ে কালবৈলাখী যেন তা দেখিয়ে দেয়। তাই নববর্ষ যেন জানান দেয় সগৌরবে আপন মহিমায়।

বাংলা সনের সাথে বাংলা নববর্ষ সংশ্লিষ্ট। মুঘল সম্রাট আকবরের সময় বাংলাবর্ষের উদ্ভব। এর আগে এ দেশে চন্দ্র বছর হিসেবে হিজরী সন চালু ছিল। কিন্তু হিজরী সন সৌর বছরের প্রেক্ষিতে বছরে দশ বারো দিন কম হলে ফসলের মৌসুম ও খাজনাদি আদায়ে ঝামেলা দেখা দেয়। আকবরের ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি ছিল যথেষ্ট উদার। তিনি  যেমন মুসলমান হিন্দু খ্রীষ্ঠান, প্রভৃতি ধর্মের নানা উপাদান নিয়ে দিন ই ইলাহী নামে নতুন ধর্মের অবতারনা করেছিলেন, তেমনি প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকার উপর ভিত্তি করেই তার সভাসদ আমীর ফতেহউল্লাহ সিরাজী নামক এক বিজ্ঞ জ্যোতিষীকে দিয়ে সৌর বছরের হিসেবে বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তখন ছিল ৯৯২ হিজরী। খাজনা আদায় ও শাসনকাজ পরিচালনার সুবিধার্থে সারা ভারত বর্ষের জন্য তিনি একটি অভিন্ন সন প্রথার প্রবর্তন করেন। বঙ্গাব্দ প্রচলনের প্রারম্ভিক মাস বৈশাখকে নির্বাচন করার প্রকৃত কারন হলো খাজনা আদায়ের সুবিধা। কারণ ফাল্গুন ও চৈত্রমাসে নদী-নালা শুকিয়ে নাব্যতা হারাতে থাকে। ফলে বৈশাখে ঝড়বৃষ্টি বাদল হওয়াতে প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থার সুবিধাহয় এবং চাষী ও বর্গাদারের প্রধান ফসল আমন বাজারহাত করণে বেগ পেতে হয় না। ফলে কর আদায় ও ঋন পরিশোধেও জমিদার ও প্রজাদের মধ্যে বিরাট সুবিধা হতো।

পূর্বে যখন জমিদার প্রথা চালু ছিল তখন নববর্ষের দিনে পূন্যাহ নামে অনুষ্ঠান হতো। এ অনুষ্ঠানে রায়ত প্রজারা এসে জমিদার বাড়িতে জড়ো হতো। প্রজাদের  কাছ থেকে পুরাতন বছরের খাজনা আদায় করে, জামিদারের পক্ষ থেকে প্রত্যেক প্রজাকে মিষ্টি মুখ করানো হতো। রাতে বসতো যাত্রা সারি জারী বা কবিগানের আসর। রাজস্ব আদায় অনুষ্ঠানে প্রত্যেন্ত অঞ্চল থেকে আগত হিন্দু মুসলমান প্রজারা লেনদেন চুকিয়ে রাজন্যবর্গকে তৃপ্ত করে স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলতো। সবাই একাত্রিত হয়ে এই অনুষ্ঠানে নিজেরদের মধ্যে মেলাবন্ধন এর বিষয়টি ছিল আনন্দের ও পরস্পরের মধ্যে ভাবের অদান প্রাদন। এই মিলন মেলা বা সমাগম উপলক্ষে যে বিশেষ বেচাকেনা ঘটতো, বৈশাখী মেলা বা ধুমের সুত্রপাত ঘটে এখান থেকেই। ষাটের দশকে ছায়ানটের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ড: সানজিদা খাতুন বৈশাখীকে নব আলোকে ও চেতনায় জাগ্রত করেন। বাঙ্গালী সংস্কৃতির মিলনমেলা হলো বৈশাখী মেলা।

মেলা শব্দ মানে মিলনের স্থান। শিল্পের সাথে জীবনের মিলন, পুরনো ঐতিহ্যের সাথে নবীনদের উচ্ছসিত উল্লাস। বাঁশের বাঁশী, তালপাতার পাখা, ঝুনঝুনি, বেলুন, চুড়ি মালা, বাতাসা, সাজ, নকুলদানা, খৈ, ঝুরি, বাদাম, ডাব, ডালা, কুলা, হাওয়াই মিঠাই লোকজানের প্রচন্ড ভীড়, চেচাঁমেচি, হাসি তামাশা, পান্তা-ইলিশ, পিঠা পুলির ফুচকা, চটপটি, এই হলো মেলার সার্বজনীন ছবি।

মনে পড়ে ছেলে বেলার কথা।

পহেলা বৈশাখ কি তা জানতাম না। এখন বুঝি আসলে ঐ দিনটিই ছিল পহেলা বৈশাখ। ভোর বেলাতেই সেদিন আম্মা গোসল করিয়ে নতুন জামা পরিয়ে দিতেন। বাসায় নানারকম পিঠা-পুলী খেতাম। বিকেল হলে বাবা সাইকেলে করে মেলায় নিয়ে যেতেন। লাল-নীল কাগজে বিভিন্ন দোকন সাজানো থাকতো। বাঁশীর ভেপুর সুর আর মিষ্টির গন্ধে বিমোহিত হতাম। দোকানীদের হালখাতায় রসগোল্লা অনেক খেয়েছি। ঘুরে ঘুরে নাচতে নাচতে মেলা থেকে ঝুির, বাতাসা, নানা সাজের হাতী ঘোড়া নক্সা করা মিষ্টি খাবার নিয়ে বাসায় ফিরতাম। হাতে থাকতো অবশ্যই বেলুনের ফুলঝুরি।

রাতে আম্মা ক্ষীর-পায়েশ, পোলাও, কোর্মা রান্না করতেন। দিনে সপ্তপদী। শাক, মাছ, মাংস সহ সাতপদের তরকারী।

সবাই বিশ্বাস করতো নববর্ষে ভালভাবে খাওয়া দাওয়া বা কাজকর্ম ভাল হলে বছরটিও ভাল যাবে। এ বিশ্বাস এখনো আমাদের বাঙ্গালীর সংস্কৃতির ধারক হিসেবে কাজ করে আসছে। তবে এখন ইলিশ পান্তা একটি বর্ষবরণের প্রধান খাবার হিসেবে স্থান পেয়েছে। রীতিমত উৎসব মুখর দিন পালিত হয় পহেলা বৈশাখ।

শিশুবেলার কথা মনে পড়ে।

বাবা তখন সিলেট জেলার ফুলতলা চা বাগানে কর্তব্যরত মেডিক্যাল অফিসার ছিলেন। অনেক হিন্দু পরিবার ছিল সেখানে। উপজাতীয় লেবারতো ছিলই। বিরাট মেলা বসতো সেখানে, সারা রাত লাঠিখেলা ও ষাঁড়ের লড়াই চলতো। গানবাজনা নাচ ও মেলার বেচাকেনা। বড় হয়ো জেনেছি আম্মার কাছে, আসলে ওটা চৈত্র সংক্রান্তি ও বৈশাখী মেলা ছিল। খাসিয়া, মুড়ং উপজাতিরা সারারাত ভাং-গাঁজা টেনে গান বাজনা করতো। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত দেখা যেত বৈশাখী ধুম বা হালখাতা। বেশীরভাগ স্বর্ণকারিগরের মধ্যে বেশী প্রচলিত ছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের পর বেনিয়া ইংরেজ সরকারের আমলে এই বৈশাখী ধুম স্তিমিত হয়ে শুধুমাত্র ব্যবসায়ী সমাজে সীমাবদ্ধ হয়।

স্বাধীনতার পর নববর্ষের দিনটি আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে আনন্দ ও উৎসবের দিনে পরিণত হয়েছে। বিগত ১০-১৫ বছরে উৎসবের আধিক্য সীমাহীন।

প্রসঙ্গত একটি বিষয় না বললেই নয়।

তা হলো পূর্বে নববর্ষ উদযাপন ছিল বাংলার সবচেয়ে বড় অসম্প্রদায়িক উৎসব। কিন্তু বর্তমানে এ দিনটি পালন নিয়ে অনাকাঙ্খিত এক বির্তক বিভাজন সৃষ্টি হয়েছে। যা দিনটির আসম্প্রদায়িক চেতনাকে খর্ব করেছে সব সম্প্রদায়ের প্রাণের উৎসব নববর্ষ। অনভিপ্রেত এই বির্তক চলছে বিগত ২০ বছর ধরে। সামরিক রাষ্ট্রপতি এরশাদ সাহেবের নির্দেশ বলে বাংলাদেশে নতুন বাংলা সন চালু হয়েছিল। এখানে বাংলা মাসের ৩০ ও ৩১ দিনে ভাগ করে খীষ্ট্র  সালের ১৪ এপ্রিল কে বাংলা নববর্ষ নির্ধারণ করা হয়। বাঙ্গালী মুসলমানের জীবনে বিশেষ করে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে বাংলা সনের কোন প্রয়োজন নেই। তাই আমরা সানন্দচিত্তে তা মেনে  নিয়েছি। কিন্তু অনেক হিন্দু সম্প্রদায় এই পঞ্জিকা মানেন না। তারা বলেছেন, চাঁদের মাসের তারিখ পরিবর্তন যেমন অসম্ভব, তেমনি তিথি, ক্ষণ, লগ্ন এসবের পরিবর্তনও অসম্ভব। পূর্ণিমার তিথিতেই পূর্ণিমা অনিবার্য যা দ্বিতীয় বা তৃতীয় সম্ভব নয়। তাই লক্ষ্য করা যায়, কোন কোন স্থানে বাঙ্গালী মুসলমানরা নববর্ষ পালন করেছে ১৪ এপ্রিল। আর বাঙ্গালী হিন্দু, অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী এমন কি অনেক মুসলমান ও নববর্ষ উদ্যাপন করছে ১৫ এপ্রিল।

বলা বাহুল্য ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্মতিথি  হলো পূর্বের ১৫ এপ্রিল ১ বৈশাখ ছিল তখন। এখন তাহলে ১ বৈশাখ? নাকি ৩০ চৈত্র ধরবো? উত্তরটি জানতে পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট লেখক, গোলাম মুরশীদ আশ´া করেছেন এভাবে “কেবল একটি মাত্র সংকেত দেখা দিয়েছে, বাংলা নববর্ষের দিগন্তের একতরফা ভাবে, বাংলাদেশ যেভাবে বাংলা পঞ্জিকায় সংস্কার করেছে তা সম্ভবত বাংলা সনকে আর হিন্দু মুসলমানের অভিন্ন উৎসব থাকতে দেবে না।  বিভেদেও অশনি’ যেদিন এসব দুই বাংলায় দুই দিনে পালন হবে, সেদিনই এই সানের অখন্ড বাঙ্গালী খন্ডিত হবে”।

আবার অন্য দিকে বিভিন্ন পন্ডিত, গবেষক ও ঐতিহাসিক এর যুক্তি হলো সম্রাট আকবর যখন ১৫৫৬ খীঃ সিংহাসনে আরোহন করেন তখন হিজরী সন ৯৬৩ সাল ছিল। আবুল ফজলের আইন- ই- আকবরিতে ইলাহি সন বা তারিখ- ই- ইলাহি সম্পর্কে তথ্য আছে। সবকিছু মেনে নিয়ে আমরা যদি বর্তমান ২০১২ খীষ্টাব্দ থেকে আকবরের সিংহাসন আরোহনের ১৫৫৬ খীষ্টাব্দ বাদ দিই এবং অবশিষ্টের সঙ্গে ৯৬৩ হিজরী সন যোগ করি তাহলেই আমরা বর্তমান বঙ্গাঁব্দ ১৪১৯ পেয়ে যাবো। অর্থাৎ ২০১২ খীষ্টাব্দ বর্তমান খীষ্টাব্দ, ১৫৫৬ খীষ্ট্রাব্দ অতীতের খীষ্ট্রাব্দে = ৪৫৬ (অবশিষ্ট)+৯৬৩ হিজরী সন = ১৪১৯ বঙ্গাব্দ।

কলকাতার সংসদ বাঙ্গলা অভিধান এ লেখা আছে ৫৯৩ খ্রীষ্টাব্দে বঙ্গাব্দ শুরু হয়। যথাযথ সাক্ষী প্রমাণ না পেলেও পহেলা বৈশাখ যে নববর্ষ পেয়েছি আমরা, তা আমাদের বাঙ্গালী জীবনে অনেক অনেক পাওয়া।

আবার লোকনাথ পঞ্জিকামতে হালখাতা এবং নববর্ষ ১৫ এপ্রিল।

বাংলা একাডেমি পঞ্জিকা মতে বাংলাদেশে হালখাতা ও নববর্ষ ১৪ এপ্রিল।

সবশেষে নববর্ষ নিয়ে আমরা কোন অশনি সংকেত দেখতে চাই না। কারো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত  করে মুখে অসাম্প্রদায়িক হতে চাই না। বাঙ্গালী সংস্কৃতিতে আমরা কোন বিভাজন চাই না।

যারা বাঙালী মুসলমানের আনন্দ করার আয়োজনের মধ্যে হিন্দুয়ানীর গন্ধ পান তারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন। বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের নবর্বষ পালন বা পহেলা বৈশাখ একান্তই নির্মল আনন্দ ছাড়া আর কিছু নয় ।

এই দিনটির সাথে পুজা অর্চনা বা মসজিদে প্রার্থনার কোন সম্পর্ক নেই। এইদিন পালন শুধুমাত্রই একটু নির্মল আনন্দের জন্য। এই নবর্বষ পালন আমাদের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে।

সেই ষাটের দশক থেকে ছায়ানটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সঙ্গীতের মাধ্যমে নতুন দিন, নতুন বছরকে আহবান করা হয়। রমনার বটমূলে চলে সারাদিন ব্যাপী নববর্ষের উৎসব। গ্রামগঞ্জের বৈশাখী মেলা এখন রাজধানীসহ অন্য শহরে মহা ধুমধামে পালিত হয়। দেশব্যাপী চলে নববর্ষের মিছিল। বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্নভাবে পুরনো সংস্কৃতিকে নতুন করে তুলে ধরে। ষাঁড়ের লড়াই, হলিখেলা গম্ভীরা, লাঠিখেলা, সাপখেলা, পথঘাটে বায়োষ্কোপ দেখানো, এসব এখনো গ্রাম গঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় ।

হাজার বছরের চর্চিত সংস্কৃতিকে আমরা নববর্ষে নতুন নতুন আঙ্গিকে বিকশিত করতে চাই। দলমত নির্বিশেষে আমরা চাই পহেলা বৈশাখ সমগ্র বাঙ্গালীর জন্য অটুট থাকুক।

স্বাগতম নববর্ষ। সুস্বাগতম-।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক ও গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top