সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

মে দিবসে শ্রমিকদের ন্যায় অধিকার এবং নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য অবসান বাস্তবায়ন : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১ মে ২০২০ ১৯:২৬

আপডেট:
১ মে ২০২০ ১৯:৫০

 

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস যা সচরাচর মে দিবস নামে অভিহিত।  প্রতিবছর ১মে তারিখ বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হয়। এটি আর্ন্তজাতিক শ্রমিক আন্দোলন ও বামপন্থী আন্দোলনের উদ্যাপন দিবস। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শ্রমজীবী মানুষ এবং শ্রমিক সংগঠনসমূহ রাজপথে সংগঠিতভাবে মিছিল ও শোভাযাত্রার মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে।

১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে হে মার্কেটে দৈনিক আটঘণ্টা কাজের দাবীতে শ্রমিকরা জমায়েত হয়েছিল। তাদেরকে ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি এক অজ্ঞাতনামার বোমা নিক্ষেপের পর পুলিশ শ্রমিকদের উপর গুলীবর্ষণ শুরু করে। ফলে প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। এই শহীদদের আত্মত্যাগকে স্মরন করে মে দিবস পালিত হয়।

১৮৮৯ সালে ফরাসী বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক-এর প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্নদেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালের আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে এই প্রস্তাব অনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এরপরপরই ১৮৯৪ সালের মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে।

পরে ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এই উপলক্ষে কাজের সময় নির্ধারনের দাবী আদায়ের জন্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বজুড়ে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজনের সকল সমাজবাদী গণতান্ত্রিকদল এবং শ্রমিক সংঘের (ট্রেড ইউনিয়ন) প্রতি আহ্বান জানানো হয়। সেই সম্মেলনে শ্রমিকদের হতাহতের সম্ভাবনা না থাকলে বিশ্বজুড়ে সকল শ্রমিক সংগঠন ১তারিখে বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১তারিখকে সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালনের দাবী জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকরী হয়। দীর্ঘদিন ধরে সমাজতান্ত্রিক কমিউনিস্ট এবং কিছু উগ্রবাদী সংগঠন তাদের দাবী জানানোর জন্য মে দিবসকে মূখ্য দিন হিসেবে বেছে নেয়। পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চীন, কিউবা সহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। বাংলাদেশেও দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে।

১ মে সকল শ্রমিকের আর্ন্তজাতিক সংহতি ও সংগ্রামের এক প্রতিকী দিন। এ দিনটি বিশ্বের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষের সংহতির দিন। একটা নির্দিষ্ট শ্রমের সাথে বেতন বৈষম্য নূনতম মজুরী নির্ধারন চাকরির নিশ্চয়তা সহ বিভিন্ন বিষয় আজ শ্রমিকদের জোরালো দাবীতে পরিনত হয়েছে।

বিশ্বের উন্নত দেশসমূহের মত বাংলাদেশের শ্রমিকরাও অতীতের লোমহর্ষক স্মৃতি ধারন করে, আর বর্তমান বঞ্চনা থেকে মুক্তির আশা ও দাবী নিয়ে দিনটি পালন করে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের দারিদ্রপীড়িত শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির দাবী আদায়ে এখনো রাজপথে নামতে হয়। এখনো তারা মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত।

বাংলাদেশে ৪৫ লক্ষ গার্মেন্টস শ্রমিকের মধ্যে অধিকাংশই নারী শ্রমিক। ২০১৩ সালে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩ হাজার টাকা থেকে ৭৭ ভাগ বাড়িয়ে ৫ হাজার ৩ শত টাকা নির্ধারন  করা হয় (সূত্র: জাতীয় সংসদ অধিবেশন ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪)

ন্যূনতম মজুরি অধিকাংশ গার্মেন্টস মালিক মানেন না। কাজ করতে গিয়ে অনেক শ্রমিক মৃত্যু বরণ করলেও তারা কোন ক্ষতিপূরণ পায় না। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের রানাপ্লাজা ধসে যাওয়ার ঘটনা আমরা সবাই জানি। অনেক শ্রমিক পঙ্গুত্ব বরণ করে ধুকে ধুকে মরছে।

আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর থেকেই জেনেভা কনভেনশনে স্বাক্ষর করে শ্রর্মজীবী মানুষের অধিকারকে স্বিকৃতি দেয়া হলেও শ্রমিক শ্রেণির মানুষ তাদের ন্যায্য মজুরিও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছে। অনেক বেসরকারী শিল্প কারখানায়, আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা। নির্ধারিত শ্রমের সময় মানা হয় না এবং শ্রমিকদের বাধ্য করা হয় ওভারটাইম করার জন্য।

বিভিন্ন অভিনব কায়দায় শ্রমিকদের নির্যাতন করা হয়। বেতন বাড়ানোর কথা বললেই মালিক পক্ষ চাকুরিচ্যুত করার হুমকি দেখায়। নানা ওজুহাতে গার্মেন্টস বন্ধ রেখে বিনাবেতনে শ্রমিকদের মানসিক অস্থিরতায় রাখার চেষ্টা করে। নানা ভাবে বিভিন্ন শ্রমজীবী মানুষকে কাজ দেয়ার নাম করে ঠকানো হয়।[ বিশ্বায়নের উন্নতির ফলে আমাদের দেশেও অর্থনৈতিক গতিশীলতা বাড়লেও শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নতি সেভাবে ঘটেনি।

বিভিন্ন পেশায় খেটে খাওয়া নিম্নবিত্ত শ্রমিকদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিরাপত্তা ও মৌলিক চাহিদা পূরণ করে তাদেরকে বেঁচে থাকার অধিকার প্রয়োজন। বিভিন্ন পেশায় খেটে খাওয়া অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের শ্রমের স্বীকৃতি প্রকৃতপক্ষে আজো মেলেনি।

নারী ও শিশুশ্রমিক এর অবস্থা একেবারেই নাজুক। নারী শ্রমিক কখনোই তাদের পুরুষ সহকর্মীর সমান মজুরি পান না। এই শ্রেণী বৈষম্য দূর করা দরকার। দেশের অধিকাংশ শিল্পখাতে মজুরির ব্যবস্থা নেই। সেসব শিল্পের শ্রমিকদের জন্য নির্ধারিত মজুরি কাঠামে ঘোষণা করা হয়নি, সেগুলোতে মজুরিকাঠামো ঘোষনা করা হয়নি। সেগুলোতে মজুরিকাঠামো ঘোষনা করা এবং তা বাস্তবায়নের উদ্যাগ এখন সময়ের দাবী। বিষয়টির প্রতি বর্তমান সরকার সুদৃষ্টি রাখবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

শ্রমের ন্যায্যমূল্য প্রদান সহ নারী পুরুষের মজুরি বৈষম্যের অবসান হোক মহান মে দিবসে। এই হোক সকলের অঙ্গিকার।

সূত্র: উইকিপিডিয়া, কালেরকন্ঠ, বাংলাদেশ প্রতিদিন ও দৈনিক যুগান্তর।

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকার, লেখক গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top