সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্র কাব্যের বৈচিত্র্য : ড. মীনা মুখার্জী


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২০ ২০:২৬

আপডেট:
১৩ মে ২০২০ ২১:২৬

 

 রবীন্দ্রনাথ অতি বাল্য কালেই স্বগৃহের সাহিত্যিক ও স্বাদেশিকতার আবহাওয়ার মধ্যে বড় হয়ে বাংলা সাহিত্যের সাথে ঘনিষ্ঠ পরিচয় লাভ করেছিলেন৷কবির বাল্যকালে তাঁদের বাড়ীতে সাহিত্যের হাওয়া বইত৷ তাঁর সহোদর দাদারা ও তাঁর খুড়তুতো দাদারা সর্বদা সাহিত্য চর্চা ও সাহিত্য রচনা করতেন৷সেকালের বিখ্যাত নাট্যকার রামনারায়ণ তর্করত্নকে দিয়ে নাটক রচনা করিয়ে তাঁরা ঠাকুরবাড়ীতে অভিনয় করতেন৷ তাঁর দাদাদের বন্ধু অক্ষয় মজুমদার ও অক্ষয় চৌধুরী মহাশয়েরা ঠাকুর বাড়ীতে সাহিত্য, নাটক ও গানের আসরে যোগ দিয়ে সেই সব আসর মাতিয়ে তুলতেন৷ এই সময়কার পরিচয় আমরা জীবনস্মৃতিতেই পেয়েছি৷জীবনস্মৃতিতে আরও কয়েক জায়গায় আমরা কবিকে বলতে শুনেছি যে —এইরূপ সাহিত্য আবেষ্টনের মধ্যে থেকেও বয়োজেষ্ঠদের কাছে উৎসাহ পেয়ে কবির সাহিত্য বোধশক্তি সচেতন হয়ে উঠবার সুযোগ লাভ করেছিল৷ কবিতা,গান,নাটক,গল্প,উপন্যাস,প্রহসন,প্রবন্ধ,সমালোচনা—যে দিকেই তিনি তাঁর ভাস্বর প্রতিভা জ্যোতি বিকীর্ণ করেছেন,সেই দিকটিই সমুদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে৷এমনটি এদেশে আর কারোর দ্বারাই সম্ভব হয়নি৷

রবীন্দ্রনাথ মূলতঃ কবি৷ স্বার্থক কবির সকল লক্ষণই রবীন্দ্রনাথের কাব্যসৃষ্টিতে বিদ্যমান৷ কবি কবিতাকে নব রূপ দান করেছেন৷ রবীন্দ্রনাথ একদিকে সংস্কৃত সাহিত্যের সৌন্দর্য্য রাশি, অপরদিকে ইউরোপীয় সাহিত্যের  ভাবৈশ্চর্য্য একত্র সমাহৃত করে নিজের প্রতিভার অপূর্ব ছাঁচে ফেলে যে ললিত-ললাম-শায়িত-শায়িনী তিলোত্তমা সৃষ্টি করেছেন, তাতে জগৎ মুগ্ধ হয়েছে৷ রবীন্দ্রনাথের পরবর্ত্তী বিদেশী কবির কাব্যেও তা প্রতিফলিত দেখতে পাওয়া যায়৷প্রকাশ-ভঙ্গিমার নবীনতায় রবীন্দ্রনাথ অপ্রতিদ্বন্দ্বী৷ সৌন্দর্য্যের ভিতর দিয়ে সত্যের ও প্রেমের সাধনা করা রবীন্দ্রনাথের সমগ্র কাব্যজীবনের ইতিহাস, এইজন্য তিনি বলেছেন —"জীবের মধ্যে অনন্তকে অনুভব করারই নাম ভালবাসা, প্রকৃতির মধ্যে অনুভব করার নাম সৌন্দর্য্য-সম্ভোগ৷"

কবিগুরুর কবিতার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে সর্বানুভূতি,জল-স্থল-আকাশে,লোক-লোকান্তরে সর্ব দেশ-কালে ও সর্ব মানব সমাজে নিজেকে পরিব্যাপ্ত করে মেলে দিতে তিনি নিরন্তর উৎসুক৷ দেশ-কাল অতিক্রম করে কবি নিয়ত শাশ্বত বিপুল প্রকাশ করেছেন, তাই তিনি নিরন্তর উৎসুক৷ দেশ-কাল অতিক্রম করে কবি নিয়ত শাশ্বত সত্যকে বিপুল প্রকাশ করেছেন, তাই তিনি কবীন্দ্র, শাশ্বত সত্যের একজন শ্রেষ্ঠ পুরোহিত৷ জগতের সঙ্গে মিলিত হয়ে 'জগতস্রোতে ভেসে চলার কবি-জীবনের একমাত্র কামনা৷ বিশ্বের সঙ্গে আত্মীয়তা স্থাপনে কবির প্রবল সাধ৷

"ইচ্ছা করে বারবার মিটাইতে সাধ—
পান করি বিশ্বের সকল গাত্র হতে
 আনন্দ মদিরাধারা নব নব স্রোতে৷"

 তাঁর জীবনের মন্ত্র -'আনন্দই উপাসনা আনন্দময়ের৷ "কবির দেশানুরাগ তাঁর বাল্যকাল থেকেই প্রবল৷দেশের অতি সামান্য লোকের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁদের আত্মীয় হতে চান—'ওদের সাথে মেলাও ,যারা চরায় তোমার ধেনু'(গীতিমাল্য) কবির কাছে ধরণী তীর্থ দেবতার মন্দির প্রাঙ্গণ,স্বদেশ' মহামানবের সাগরতীর, ভারততীর্থ'কবি তাঁর স্বদেশকে বিশ্বদেবের প্রতিমূর্ত্তি বলে মনে করেন৷ প্রকৃতি কবির কাছে সৌন্দর্য্যলক্ষী, বিশ্বসোহাগিনী লক্ষী, বিশ্বব্যাপিনী লক্ষী (চিত্রা)৷

"বিশ্ব সোহাগিনী লক্ষি জ্যোর্তিময়ী বালা,
আমি কবি তারি তরে আনিয়াছি মালা৷"—

  (চিত্রা—জ্যোৎ্সনারাতে)৷

কবি সুন্দরের পিয়াসী৷ তিনি প্রকৃতির রূপমুগ্ধ প্রেমিক৷প্রকৃতিকে সুন্দর বলে কবি তাঁর কবিতাকে সার্থক করেছেন৷ তাঁর কাছে —

 "প্রসন্ন আকাশ হাসিছে বন্ধুর মত৷
  সন্ধ্যা অন্ধকার মায়ের অন্চল সম৷"

তিনি বলেছেন—" আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে৷"

রুদ্র ও শান্ত কবিকে প্রকৃতির এই দুই রূপই মুগ্ধ করেছে৷ তাছাড়া শরৎ 'বসন্ত, বর্ষা ঋতুর শান্ত সৌন্দর্য্যেও কবি মোহিত৷বিধাতার সৃষ্টি নারীকে কবি তার

মনের ঐশ্বর্য্যে নতুন করে গড়েছেন নিজস্ব ছাঁচে৷ তাঁর কাব্যে নারী স্বপ্ন-সঙ্গিনী মর্মের গেহিনী হয়েছে—একদিকে রাত্রির নর্মসখী ঊর্বশী হয়েছে—অন্যদিকে মামসী হয়েছে—বিজয়িনী হয়েছে—তীর্থবারি বহন করে প্রভাতের চন্ডী  কল্যাণী হয়েছে৷এই কল্যাণী নারী মূর্তিকেই বন্দনা করে কবি বলেছেন —"সর্বশেষের গানটি আমার আছে তোমার তরে৷"(ক্ষণিকা,কল্যাণী) কবির কাব্যে পতিতাও মহীয়সী,নারী হয়েছে অর্ধেক কল্পনা আর অর্ধেক মানবী৷

রবীন্দ্রকাব্যে অনাবিল প্রেমের মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে৷নারী দেবী হয়েছে;কামের ভোগের উপকরণগুলিও পবিত্র মহিমা লাভ করেছে৷কবির কথায় —"যারে বলে ভালবাসা তারে বলে পূজা"৷কবি নারীত্বের দেব মন্দির গড়ে স্বপ্নময় যৌবনকেও নূতন করে গড়েছেন তার পূজারী রূপে৷ কবি মিলনকে সংযত রাজশ্রী দান করেছেন, বিরহকে তপস্যায় পরিণত করেছেন, নর নারীর প্রেমকে আধ্যাত্মিক সাধনা মনে করেন, দুই জীবনের ভোগেই এ প্রেমের পরিসমাপ্তি নয়,কবির কথায়—এ জন্ম-জন্মান্তরের সাধনার ধন৷

কবির কাছে দাম্পত্য প্রেমের আদর্শ যে কি তা তিনি দেখিয়েছেন—'মহুয়া'র নির্ভয় কবিতায়ঃ

 "আমরা দুজনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে,
  মুগ্ধ ললিত অশ্রু-গলিত গীতে৷
  পন্চশরের বেদনা-মাধুরী দিয়ে
   বাসর-রাত্রি রচিবনা মোরা,প্রিয়ে৷
   ভোগের পায়ে দুর্বল -প্রাণে ভিক্ষা না যেন যাচি৷
   কিছু নাহি ভয়,জানি নিশ্চয় তুমি আছ আমি আছি৷"

পতিতা নারীর মধ্যেও তার হদয়ের মাধুর্য্য ঐ মাহাত্ম্যকে দেখে তাকে কবি সম্মান দেখাতে কুন্ঠিত হননি৷পতিতা নারীকে তিনি বলেছেন—

 "নাহিক করম,লজ্জা শরম,
  জানিনে জনমে সতীর প্রথা,
 তা বলে নারীত্বটুকু
 ভুলে যাওয়া সে কি কথার কথা?" (কাহিনী পতিতা)  
পতিতার হদয় মাহাত্ম্য দেখে কবি দুটো সনেট লিখেছেন, একটি 'করুণা' অপরটি 'সতী '৷(চৈতালী )৷

কবি জীবনকে নব নব রূপ দিয়েই ক্ষান্ত হননি,মরণকেও তিনি নতুন রূপ এবং মাধুর্য্য দান করেছেন৷ আনন্দবাদী কবি মৃত্যুভয় জয় করেছেন,মরণকে বরণীয় মনে করে তিনি লিখেছেন—"মরণরে,তুঁহু মম শ্যাম সমান! "মরণ কবির কাছে 'এই জীবনের শ্রেষ্ঠ পরিপূর্ণতা৷'

রবীন্দ্রনাথের ভগবানও কোনও বিশেষ নামে  চিহ্নিত হননি বলেই তাঁর "গীতান্জলি" প্রভৃতি ভক্তি রসাত্মক কাব্য সর্ব ধর্মের সমাদরের সামগ্রী হতে পেরেছে৷কবির আধ্যাত্মিকতা ও ভক্তি কেবলমাত্র হৃদয়ের আবেগ বা ইমোশন নয়, তা যুক্তির ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত, অপ্রমত্ত, বলিষ্ঠ, আত্মনির্ভর৷ এই জন্য কবির প্রার্থনা—

"যে ভক্তি তোমারে লয়ে ধৈর্য্য নাহি মানে,
মুহূর্ত্তে বিহ্বল হয় নৃত্য গীত গানে
ভাবোন্মাদ -মত্ততায়, সেই জ্ঞান হারা
উদ্ভ্রান্ত-উজ্ব্বল যেন ভক্তি-মদধারা
নাহি চাহি নাথ৷ (নৈবেদ্য, অপ্রমত্ত)

ভগবান তো মানুষের এই জীবনেই জন্ম-জন্মান্তর ঘটিয়েছেন৷অতএব যে মৃত্যু জন্মান্তরের সূচনা করেছে তাতে ভয় কি? এই জন্যই কবি নিজেকে বলেছেন মৃত্যুন্জয়—

"আমি মৃত্যুর চেয়ে বড় এই কথা বলে 
যাব আমি চলে৷" (পরিশেষ, মৃত্যুন্জয়)

জীবনের গভীরতম প্রদেশের শ্রেষ্ঠ সাধনার অর্ঘ্য প্রয়োগের জন্য কবি কল্প মহিমায় আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনদেবতা রচনা করেছেন৷জীবনের বৈচিত্র্যের সুরটি তার হাতে সমপর্ণ করেছেন,জীবনের নৈবেদ্য তার চরণে উৎসর্গ করেছেন৷

বিশ্বের সঙ্গেও কবির সহস্র যোগসূত্র৷কবির প্রতিভাধারা মহাসাগরে মিশে শেষ হয়ে যায়নি,শেষের মধ্যেও যে অশেষ আছে-কবি প্রতিভা সেই অশেষে মিলে চিরদিনের জন্য অশেষে মিলে চিরদিনের জন্য অশেষ হয়ে আছে৷

রবীন্দ্রনাথ রোম্যান্টিক কবি, কবি যে একান্তভাবেই রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন ছিলেন,সেকথা তিনি নিজেই স্বীকির করেছেন—তাঁর 'নবজাতক' কাব্যগ্রন্থে৷

"আমারে বলে যে ওরা রোম্যান্টিক
সেকথা মানিয়া লই 
রসতীর্থ পথের পথিক
মোর উত্তরীয়ে,
রং লাগায়েছি প্রিয়ে৷"

একটি মাত্র সংজ্ঞা দ্বারা রোম্যান্টিসিজমের স্বরূপ দ্বারা নির্ণয় করা সম্ভব নয়৷ রোম্যান্টিসিজমের সকল লক্ষণই চোখে পড়ে থাকে; শেলীর স্বাধীন চিত্তবৃত্তি ও অতীন্দ্রিয়তা, কীটসের ভোগ সর্বস্ব সৌন্দর্য্যচেতনা, ওয়ার্ডসওয়ার্থ অতি সাধারণ বস্তুগুলোর সুক্ষ আনন্দোপলব্ধি এদের কোনওটিরই অভাব নাই রবীন্দ্রনাথের কবিতায়৷ একটা সমাধানহীন রহস্যের মধ্যে জানা অজানার মিশ্রণে যে আনন্দের উৎপত্তি রোম্যান্টিক কবিতার বিশেষত্ব —রবীন্দ্রনাথে তাও আছে৷অর্ন্তদৃষ্টির আলোকে রবীন্দ্রনাথ জগৎ ও জীবনকে সত্য করে দেখেছেন, খন্ডের মধ্যে তিনি দেখেছেন পূর্ণকে, সীমার মধ্যে অসীমকে৷

সুদূরের প্রতি আকাঙ্খা জনিত বেদনাই কবিকে দূরে থেকে দূরে আহ্বান করেছে৷ রবীন্দ্রনাথ তন্ময়, ভাবুক৷ পৃথিবীকে কবি মর্মচক্ষু দিয়ে দেখেছেন৷ কবি রোম্যান্টিক—তাই—বিশ্বের সকল প্রকাশের মধ্যে একটি ঐক্যবন্ধনী দেখতে পেয়েছেন৷ কবি পৃথিবীর কবি৷

"আমি পৃথিবীর কবি ,যেথা তার যত উঠে ধ্বনি,
আমার বাঁশির সুরে সাড়া তার জাগিবে তখনি৷"

রবীন্দ্রনাথ মানুষকে, ধরণীকে ভালবেসেছেন৷ তাঁর রোম্যান্টিসিজম বাস্তব সর্ম্পকশূণ্য নয়৷ ধরণীর ধূলি মাটিকে ভালবাসেন বলেই তিনি স্বর্গ থেকে বিদায় প্রার্থনা করেছেন৷

"চেয়ে তোর স্নিগ্ধশ্যাম মাতৃ দুগ্ধপানে,
ভালবাসিয়াছি আমি ধূলিমাটি তোর,
জন্মেছি যে মর্ত্তলোকে ঘৃণা করি তারে,  
ছুটির না স্বর্গ আর মুক্তি খুঁজিবারে৷" (আত্ম সমপর্ণ, সোনার তরী)

বিশ্ব-প্রকৃতির সঙ্গে এই নিগূঢ় পরিচয়, এই নিবিড় আত্মীয়তা রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিসিজমের এক বিশিষ্ট স্বতন্ত্রতার রূপ দিয়েছে৷ প্রকৃতির সঙ্গে আপন অন্তরের অখন্ড যোগসূত্রের অস্তিত্বজ্ঞানের মধ্যে এক সুক্ষ আনন্দরস আছে—সেই আনন্দের সন্ধানেই রবীন্দ্রনাথের কবিপ্রাণ এক অতীন্দ্রিয় লোকে প্রয়াণ করেছে৷

এই ভাবে কবির কাব্যে এক আশ্চর্য্য কাব্যিক ও নান্দনিক প্রকাশ, অসীমকে সীমার বন্ধনে ধরাকে কবি "অধরার প্রতিবিম্ব ' বলেছেন৷ সমুজ্ব্বল গৌরবের প্রণতসুন্দর অবসানই কবির কাম্য৷ কবি জীবন -সন্ধ্যার ধূসরবর্ণ আবরণ অপসারণ করে কবি জীবনের সীমা অতিক্রমী চিরন্তন গৃহে নবজন্মের প্রত্যাশী৷ কবির অনেক কবিতায় দার্শনিক প্রত্যয়ের পরিচয় ও পরিস্ফুট৷ তাঁর বৈচিত্র্যময় অমরকাব্য-প্রতিভা দেশ-বিদেশ ও সর্বজন বিদিত আজ৷ অমর স্রষ্টা কবিকে শত কোটি নমন!!

 

ড. মীনা মুখার্জী
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top