সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথ ও গল্পগুচ্ছ : শাহান আরা জাকির পারুল


প্রকাশিত:
১৩ মে ২০২০ ২২:০৬

আপডেট:
২ মে ২০২৪ ০৬:৩৯

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বকবি। তার সম্পর্কে বিশদ আলোচনার ধৃস্টাতা আমার নেই। তবুও যাঁকে ভালবাসি শ্রদ্ধা করি, তাঁর কথা যেমন শুনতে ভাল লাগে বলতেও তেমনি ভাল লাগে। আমি তাঁর ছোট গল্প সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করবো।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাসাহিত্যের প্রথম সার্থক গল্পকার। বলতে গেলে গল্পগুচ্ছ দিয়েই বাংলা ছোট গল্পের যাত্রাশুরু। এ কারণে গল্পকার রবীন্দ্রনাথকে অনুধাবন করতে হলে ছোট গল্প সম্পর্কিত আমাদের উপলব্ধিকে উজ্জীবিত রাখা বাঞ্চনীয়। ছোট গল্প একটি অতি আধুনিক শিল্পরূপ।

আজ পৃথিবী অনেক ছোট হয়ে আসছে। জীবনকাল সীমিত অথচ কাজ অনেক বেশি, জীবন সংগ্রাম খরতর। অবকাশ অনেক কম। মহাকব্যের দিন শেষ হয়ে গেছে। এমনকি উপন্যাসের জন্যও চাই বিশেষ আয়োজন। কাজেই ছোট গল্প একালের জন্য ভারী উপযোগী। গ্রাম বাংলা বেদ হচ্ছে গল্পগুচ্ছ। গ্রাম বাংলার প্রকৃতির কল্পনা তারই পটভূমি। তারই পটভূমিতে গ্রামের মানুষগুলি যেন জীবন্ত।

জনপদকে প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না বলেই গল্পের মধ্যেও যেমন পড়েছে প্রকৃতির আলোছায়া, তেমনি কবিতায় পাই মানবপ্রীতির স্পর্শস্বাদ। এই দুই সত্তার মিলনেই পূর্ণাঙ্গ রবীন্দ্রনাথ অনেক কম।

বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প নিয়ে আলোচনার সময় রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের ‘বর্ষযাপন’ কবিতাটির উদৃতি প্রায়ই দেখা যায়। কবিতাটি রচনাকালে কবি পূর্ণোদ্যমে গল্প লিখে চলেছেন।

সুতরাং ছোট গল্প সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত উপলদ্ধি আন্তরিক ভাবে ধরা পড়েছে। ছোট প্রান ছোট ব্যাথা ছোট ছোট দুঃখ কথা, নিতান্তই সহজ সরল।

সহস্র বিসৃত রাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি
তারি দু’চারিটি অশ্রুজল
নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা
নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ
অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে
শেষ হয়ে হইল না শেষ
জগতের শত শত  অসমাপ্ত কথা যত
অকালের বিছিন্ন মুকুল।
অজ্ঞাত জীবন চলা কত অখ্যাত কীর্তির ধুলা
ভাব কত ভয় ভুল”।

মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। তবুও বলতে হয়, ছোট গল্পের ফলশ্রুতি অতৃপ্তিতেই তৃপ্ত। ছোট গল্প রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় প্রধান ধারক। কাব্য সঙ্গীতের পরেই তার স্থান।

১৮৯১ খৃষ্টাব্দে ভাবজগতে সমাহিত কবি যখন বৈষয়িক তাগিদে গ্রাম বাংলার বৈচিত্রের সম্মান পান, তখন থেকেই তাঁর স্বার্থক ছোট গল্প শতধারায় উৎসারি  হয়। ১৮৯১ সাল থেকে ১৮৯৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত চাহিদানুযায়ী তাঁর চুয়াল্লিশটি গল্প প্রকাশিত হয়।পরিমানের দিক থেকে এগুলি সমগ্র গল্পগুচ্ছের অধিক এর ও কিছু বেশি।

গল্পগুচ্ছ বিষয়বস্তর দিক থেকে প্রেমের প্রাধান্য স্বীকৃত। কিন্তু সে প্রেম সহজ প্রবনতার স্বাক্ষরে অবসিত নয়। রবীন্দ্রনাথের প্রেম- প্রধান প্রায় গল্পেই, আমরা দেখি দাম্পত্য প্রেমের বৈচিত্র।

রবীন্দ্রনাথের এমন অনেকগুলো গল্প আছে যেগুলিতে সামাজিক জীবনের সম্পর্ক বৈচিত্র শিল্পরূপ লাভ করেছে। যেমন- পোষ্টমাষ্টার, রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা, উলুঘরের বিপদ, রাসমনির ছেলে, দিদি, হালদার গোষ্ঠী, মকুরদা, দেনাপাওনা, যঊেশ্বরের যজ্ঞ, হৈমন্তী ও শাস্তি উল্লেখযোগ্য।

আমাদের সমাজে অধিকারের দিক থেকে দুস্তর বৈষম্য সর্বজনবিদিত। পুরুষশাসিত, সামন্ত প্রভাবিত সমাজে নানাবিধ অসাম্যের মধ্যে নারী- নির্যাতন অন্যতম। সামন্ত সংস্কারের নিগুঢ়ে বাঁধা সমাজে নারীর স্থান কোথায়? তার জবাব পাই আমরা শাস্তি গল্পে কৃষাণ বধু চন্দরা জানতো বড় বউকে কে খুন করেছে। কিন্তু বড় ভাইকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাবার জন্য গ্রাম প্রধান রামলোচনকে ছোট ভাই ছিদাম রূই রুদ্ধকন্ঠে উঠিয়া বলিল “ঠাকুর বউ গেলে বউ পাইব কিন্তু আমার ভাই ফাঁসি গেলে আর তো ভাই পাইব না”।

সহজ সরল নিষ্পাপ চন্দরা ডাগর ডাগর চোখ দুটি অশ্রুসিক্ত করে পরম প্রিয় স্বামীর দিকে ক্রদ্ধ বাঘিনীর মত চেয়ে রইল। সব ঘটনা জেনেও সবাই যুক্তি করে তাকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিল। আশা ছিল কৌশলে তাকে মুক্ত করে আনবে। কিন্তু অভিমান ক্ষুদ্ধ চন্দরা নিজেই সে আশার মুখে ছাই দিয়েছে।

আত্মমর্যাদার যে পরকাষ্ঠা সে সংসারের কাছ থেকে পেয়েছে, তাতে সংসারের মায়া ছিন্ন করে যেতে সে মুহূর্তের জন্য বিচলিত হয়নি। সমগ্র নারী নির্যাতনের প্রতীক এই চন্দরা। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জজ সাহেবের সংঙ্গে চন্দরার কিছু সংলাপ প্রান ছুয়ে যায় ওগো সাহেব, আমি খুন করিয়াছি এককথা আর কতবার বলিব।

জজ:তুমি যে অপরাধ স্বীকার করিতেছ তাহার শাস্তি কি জান?

চন্দরা: না

জজ:  তাহার শাস্তি ফাঁসি।

চন্দরা: ওগো তোমার পায়ে পড়ি, তাই দাও না সাহেব। তোমাদের যাহা খুশি করো, আমার তো আর সহ্য হয় না।

জজ: (ছিদামকে) সাক্ষীর দিকে চাহিয়া বল, এ তোমার কে হয়?

চন্দরা: দুই হাতে মুখ ঢেকে ও আমার স্বামী হয়।

জজ: ও তোমাকে ভালবাসে না?

চন্দরা: হুঁ ...ভা...রি... ভালবাসে।

জজ: তুমি উহাকে ভালবাস না?

চন্দরা: খু...উ...ব... ভালবাসি।

ছিদাম: সাহেব, আমি খুন করিয়াছি।

জজ: কেন?

ছিদাম: ভাত চাহিয়া ছিলাম বড় বউ ভাত দেয় নাই

দুঃখীরাম: সাহেব আমি খুনি করিয়াছি।

অবশেষে চন্দরাকে বাঁচার জন্য দুই ভাই অপরাধ স্বীকার করছে প্রমাণ হওয়ায় চন্দরার ফাঁসীর আদেশ হোল। ফাঁসীর দয়ালু জজ সাহেব চন্দরাকে জিজ্ঞেস করলেন কাহাকেও দেখিবার ইচ্ছা কর?

চন্দরা: একবার আমার মাকে দেখিতে চাই।

জজ: তোমার স্বামী তোমাকে দেখিতে চায়, তাহাকে কি ডাকিয়া আনিব?

চন্দরা (ঘৃনায়), বলিল “মরণ”।

এভাবেই রবিঠাকুর তার শাস্তি গল্পে চন্দরার মধ্যে দিয়ে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর নির্যাতনের প্রতিটি চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এখানেই তার ছোট গল্পের স্বার্থকতা।.

 

শাহান আরা জাকির পারুল
নাট্যকারলেখক  গবেষক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top