সিডনী শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল ২০২৪, ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১

আমার সৎভাই : দীলতাজ রহমান


প্রকাশিত:
১৭ মে ২০২০ ২১:০৩

আপডেট:
১৮ মে ২০২০ ২২:৪৭

 

আমার লেখার যারা পাঠক, তারা প্রায়ই আমার বিভিন্ন লেখাতে আমার এক সৎভাইয়ের উপস্থিতি দেখতে পান। এই সেই সৎভাই। বয়সে সে আমার থেকে তিন বছরের মতো বড় ছিল। কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়ে আমার সবকিছু আগে আগে শেখা হয়ে গিয়েছিল। ভাই আমার তিন বছরের বড় অথচ আমরা সাঁতারও শিখেছি একসাথে। তার মানে আমি বছর চারেক বয়সের ভেতর সাঁতার শিখেছি!
আমরা তখন খুলনার দৌলতপুরে। আগে ওখানে প্রায় সব বাড়িতে একটা করে পুকুর ছিল। মহিলাদের পর্দা রক্ষার জন্য ঘাটে তিনদিক থেকে গোলপাতার বেড়া দেয়া থাকতো। শিশুরা তো নারী-পুরুষ সবার সাথেই গোসল করতে পারতো। আমরা দু’জন তাই সারাদিন সুযোগ পেলেই পানিতে নেমে বেড়া ধরে দাপাদাপি করতাম। তারপর একদিন একসাথে দু’জন সাহস করে ডুব দিয়ে বেড়া ছেড়ে বাইরে বের হলাম! যেদিন প্রথম বেড়ার বাইরে বের হয়ে আমরা দাপাদাপি করে ভেসে থাকতে পারছিলাম, সে কি আনন্দ হচ্ছিল আমাদের। এখনো মনে হয়, হাত বাড়ালে সে ক্ষণ ছুঁতে পারি!
আমার থেকে দুই ক্লাস ওপরে পড়তো ভাইটি। কিন্তু আরবি প্রতিটি অক্ষর শেখা থেকে প্রতিটি সুরা, কোরান শরীফ আমরা একসাথে পড়েছি! তাই প্রতিটি আয়াত প্রতিটি সুরা যখন আমি পড়ি, মনে হয় এখনো দুজনে একসাথে দুলে দুলে ঝুলে ঝুলে পড়ছি ! বিশেষ করে নামাজ পড়তে বসলে তো মনেই হয়, ও পাশে আছে। তাতে বুঝতে পারি, আমার কিছু পুণ্য অর্জন হলে সে তাতে ভাগ পায়।
ভাত খেতে বসে যার যার প্লেটে খেতে খেতে হঠাৎ কখনো একজন আরেকজনকে বলতাম, আয়, দুজনের ভাত এক প্লেটে ঢেলে একসাথে খাই! খাওয়ার আগে মাখাতে মাখাতে সে ভাতে আঁশটে গন্ধ হয়ে যেত। আর তাই খেতে খেতে আমাদের কত কত গল্প হতো।
তাকে টেক্কা দিতে আমি নৌকা বাওয়া শিখেছিলাম । শুধু এমনি বাওয়া নয়, বহু ঝড়-ঝাপটার ভেতরও বর্ষার টইটুম্বর জলের উত্তাল ঢেউ ঠেলে নৌকা বেয়ে উঠোনের কোনায় আসতে পেরেছি। ভাই আমার আজন্মের প্রতিদ্বন্দ্বি তাই তার মতো করে মাছও মারতে শিখেছি। না হয় চারটে কমই পেতাম। তবু যেন ও যা করবে, তা আমাকে পারতেই হবে !
সেই শিশু বয়সে আমি তার শার্ট-প্যান্ট পরে তার সাথে বাজারে যেতাম। আর সে, মানে ভাইটি আমাকে ওভাবে ছেলে সাজিয়ে নিতো, যেন অর্ধেক বোঝা আমি বয়ে আনি। ওর মনে মনে এই শত্রুতা, বৈরী টান, ভালবাসা বা কাছাকাছি থাকার নেশা আমাকে যে মিশ্র শক্তি ও অনুভূতির জন্ম দিয়েছে, তার জন্য আমার জীবনের বড় কৃতজ্ঞতা সেই বৈরীজনের উদ্দেশ্যেই অর্পণ করি। তবু সেই কৃতজ্ঞতা তাকে যখন আমি পৌঁছাতে পারি না, তখন নিজেকে খুব ভারাক্রান্ত লাগে!
সৎভাই-বোন, দু’জন যতই একজনের কাঁধের ওপর আরেকজন হাত রেখে পায়ে পা পেঁচিয়ে চলতাম, ভেতরের সাপ-নেউল বুঝি ঠিকই স্বরূপে আবির্ভূত হতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। একসময় সে একাই আমার ঘোর বিরোধী হয়ে উঠলো। যখন সে লেখাপড়া শেষ করে বড় চাকরিতে ঢুকলো। তখন সে আমার পুরোই ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ!
আর আমার তাতে কিই বা করার ছিল! কীই বা এসে যেত তাতে আমার ! বয়স কম হলেও ভরা সংসারের দাপুটে গিন্নী আমি তখন । চার চারটে ছেলেমেয়ের সব ক‘টি তখন স্কুলে যায়। পদস্থ কর্মকর্তা স্বামী। বাপের পক্ষের যে আত্মীয়-স্বজনকে বাপের বাড়ির দুয়ার পর্যন্ত আসতে দেখিনি। সে আত্মীয়-স্বজন আমার বাড়ির ভেতরে গড়ায়। কারণ তখন ঢাকাতে মানুষের ওঠার জায়গা ছিল কম। কারো ছিলই না। অনেকে অনেক বাড়িতে পাত্তা পেত না। আর ও ভাই তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটি থেকে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স করেছিল । তার পাশের সময়টা ১৯৮৫ সালে। শত্রুতা অবশ্য আরো দু ক্লাস আগে থেকে শুরু হয়েছিল। তখন খালি এর ওর কাছে শুনি, ‘তোর ভাই ঢাকাতে এসেছিল...।’ আমি চাতকের মতো তাদেরকে বলতাম, আমার কথা বললো কিছু? সবাই বলতো ‘না তো!’

আমার বড় ছেলেটি তখন সম্ভবত এইটে পড়ে। নব্বই/ একানব্বই সালে সম্ভবত, একদিন আমি পাশের বাড়িতে গিয়েছিলাম হাজবেন্ডকে ফোন করতে। তার সম্ভবত যশোরে পোস্টিং ছিল। ছেলে গিয়ে আমাকে বললো, আম্মা, খায়রুল মামা একটা মাইক্রোবাসে অনেকগুলো বন্ধু নিয়ে আসছে। মামা মাইক্রোবাসে বসে আছে। বন্ধুদের একজন নেমে খবর দিয়ে গেলেন।তোমাকে ডাকে। গেলাম ভয়ে ভয়ে। কারণ তার মাথা ভরা অহেতুক ক্রোধ। ভাবলাম কোমর বেঁধে আমার সাথে ঝগড়া করতে আসছে কিনা। এ ছাড়া এভাবে আসার আর কি কারণ!
কিন্তু আমাকে দেখার সাথে সাথে ভাইটি বললো, আমার খুব কোমর ব্যথা। গাংনি থেকে ঢাকাতে কজন কলিগ একসাথে আসছি ট্রেনিংয়ে। আমার সেবা করতে করতে ওরা বিরক্ত হয়ে গেছে। ওরা বলছে, তোর কে আছে বল্, তার কাছে রেখে আসি। আমি ক’দিন ধরে বলেছি, ঢাকাতে আমার কেউ নেই! কিন্তু আজ ওদেরকে বললাম, চল্, একজন আছে। কিন্তু ঢাকার রূপ যেভাবে পরিবর্তন হচ্ছে, তাতে দেখি তার বাড়িটা খুঁজে পাই কিনা ...। তার কাছেই যাই!’
দেখলাম, ভাইটি মরিচ খেয়ে খুব ঝাললাগা মানুষের মতো সিরিসর করে কথা বলছে।

তখন তো আমাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল না। নিজের বাড়ি ঢাকার মেরাদিয়াতে তখন বসবাস করি। আমি ভাইয়ের সে বন্ধুদেরকে বললাম, আমি ভ্যানিটি ব্যাগটা নিয়ে আসি। আমাদেরকে ঢাকা মেডিকেলে একটু নামিয়ে দেন ....। তারা ঢাকা মেডিকেলে আমাদের নামিয়েই গাড়িসহ ওধাও হয়ে গেল। কিন্তু ওখানে ডাক্তাররা চেষ্টা করেও তার এক্সরে করতে পারলেন না। ভর্তিও করে নিলেন না! তারপর সেখান থেকে নিয়ে মৌচাক মার্কেটের সামনে আরোগ্য নিকেতনে ভর্তি করলাম। একাই কদিন টানা-হেঁচড়া করলাম। পরে বাড়ি থেকে তার নিজের মা ছোটভাই লিটনসহ এলো। সৎমাকে আম্মা বলতাম। আমার মা’কে আবার তারা আম্মা ডাকতো ।
ভাইটির সমস্যা ছিল, সে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। কিন্তু মনে কোনো সংশয় ছিল না যে আর ভাল হবে না। যে ক’দিন বাড়িতে আমার কাছে ছিল, সেই তার পুরনো ছেলেমানুষি। বললো, এই দীল, তোর গলার চেইনটা আমার গলায় দে তো ! জানিস, ইট দেখলে আমার মন কেমন করে। বাড়ি বানাতে ইচ্ছে করে। ইশ, তোর সাথে শত্রুতা না করে যদি সম্পর্কটা রাখতাম, আমার তাহলে ঢাকাতে বাড়ি করা হতো। যা টাকা জমছে স-ব গ্রামে জমি কিনেছি। ও জমি আমার কোন কাজে লাগবে !’ আবার কখনো বলতো, তুই আমার ছোটবোন, তোর ছেলে এইটে পড়ে আর আমি বিয়েই করতে পারলাম না! তুই আমার জন্য মেয়ে দেখ!’
আমার বাড়ির বনেদি এক ভাড়াটিয়াকে তক্ষুণি ডেকে বললাম, আমার ভাইয়ের জন্য মেয়ে দেখেন...।’ আমি কথা শেষ করার আগেই ভাড়াটিয়া বললো, উনি তো খোড়া। উঠে দাঁড়াতে পারেন না!’ ভাইটি তখন হেসে বাঁচে না । আমিও হেসেছিলাম। কারণ ওই উঠে না দাঁড়াতে পারাটা স্থায়ী হবে ডাক্তাররা তার কোনো কারণ খুঁজে পাননি। তবে লেখাপড়া শেষ হলে, চাকরিতে ঢোকার আগে জামাত শিবিরের মিছিলের লোক তাকে হকিস্টিক দিয়ে, তাদের চেনা শত্রু মনে করে খুব পিটিয়েছিল এবং তারা মনে করেছিল সে মরে গেছে। হয়ত সেই মারের কারণেই সে খুব জটিল অবস্থায় পিজি হাসপাতালের চিকিৎসকদের হার মানিয়ে বাড়িতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করে ।
কিন্তু আমার রক্তের ভেতর যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সে রেখে গেছে, যেন আমার ভেতরে সে-ই প্রবলভাবে বেঁচে আছে । সে আমাকে ঋণী করেনি, তবু আমি তার কাছে অনবরত ঋণ স্বীকার করে যাই। সাপের মাথার কাছে লজ্জাবতী গাছের শেকড় ধরলে সাপ নাকি আর মাথা তুলতে পারে না! আমার লড়াকুসত্তাটিও কেবল এই সৎ ভাইটির কাছে মাথা নোয়ায়, কারণ এবিদ্যা যে তারই শেখানো !

 

দীলতাজ রহমান
লেখক ও সংগঠক

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top