সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

বাংলা গল্পের বরপুত্র সোমেন চন্দ : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
১১ জুন ২০২০ ২১:৩৯

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২০:৪১

ছবিঃ সোমেন চন্দ

 

মহাবিদ্যালয় শিক্ষা জীবনেই তাঁর নাম প্রথম শুনি। আশির দশকের শুরুতে। অবিভক্ত বাংলার প্রখ্যাত প্রগতিশীল নেত্রী বরিশালের মনোরমা বসু মাসিমার কাছে। ছেলেবেলা থেকেই গল্প লেখায় আমার ঝোঁক। তা জেনে তিনি বাংলা গল্পের বরপুত্র সোমেন চন্দের গল্প পাঠের জন্য পরামর্শ দেন আমায়।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র জীবন শেষ করে যুক্ত হই ঢাকায় মূলধারার অর্থনীতি প্রতিবেদন সাংবাদিকতায়। আমার সাহিত্য চর্চা অনেকটা কমে আসলো। কিন্তু পাঠাভ্যাস বেড়ে গেলো পেশার কারণে। সাহিত্য নিয়ে তেমন লেখালেখি এ সময় না হলেও বিশেষ করে গল্প উপন্যাস পড়া থেকে বিচ্যুত হয়নি। পরিণত বেলায় সন্ধান করে বেড়াই সোমেন চন্দের গল্পসমগ্র। বইমেলায়  ১৯৯৬ সালে পেয়ে যাই ১৭টি গল্পের দুর্লভ সংকলন সোমেন চন্দের গল্পগুচ্ছ। পড়ে ফেলি মাত্র ৫ বছর আয়ুকালে লেখা বাস্তববাদী ও বক্তব্যধর্মী ২৮ গল্প, ২টি উপন্যাস, ২টি নাটক এবং কিছু কবিতার মননশীল লেখক সোমেন চন্দের কিছু গল্প। যা অবিভক্ত বাংলার সেরা সৃষ্টি হিসেবে অভিহিত। সোমেনের গল্পগুলোর কাহিনী ও দর্শন যেন মর্তলোকে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার যাপিত জীবনের চিরসত্য দৃশ্যমান বাস্তবতা। তাঁর গল্প বলার ভঙ্গি সহজ সরল এবং প্রতীকী। গল্পে কোনো ঘোরপ্যাঁচ যেমন নেই, তেমনি নেই ভাষাগত বা আঙ্গিকাশ্রয়ী কোনো জটিলতা। সংসার, সমাজ এবং রাষ্ট্রকে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন তিনি গভীর অর্থবোধক বর্ণনা এবং সংলাপে। ইঁদুর, দাঙ্গা ও প্রত্যাবর্তন গল্প শ্রবণ আমাকেও ভাবিয়ে তোলে।
'দাঙ্গা' গল্পে দাঙ্গার বেশ ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে সাবলীলভাবে। পুরোপুরি অন্য রকম গল্প। দুটো ছেলে। একজন কোমর থেকে ছোরা বের করে একটা লোকের পেছনে বসিয়ে দেয়, তারপর বোঝা গেল দাঙ্গার সূত্রপাত। অজ্ঞাত এক ব্যক্তির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে গল্প এগোয়। দাঙ্গা শুধু ক্ষয়ক্ষতিই করে না, সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে বিভেদ সৃষ্টি হয় না, গভীর একটা ক্ষত তৈরি করে, যা শুধুই অশান্তি! যে ক্ষত হয়তো জীবনে আর পূরণ হয় না। দাঙ্গার অভিজ্ঞতা নিয়ে বাংলা সাহিত্যে খ্যাতিমানদের অনেক গল্প রয়েছে। কিন্তু সোমেনের দাঙ্গা গল্পের বিষয়টি ভিন্ন, অভিনব ও বৈচিত্র্য। গল্পে অজু যখন কর্কশ কণ্ঠে বলে- তোমরা তো বলবেই ... তারপর মৃদুস্বরে..., আমরা হিন্দুও নও, মুসলমানও নও ..., আমরা ইহুদির বাচ্চা না রে? অশোক হা-হা করে হেসে বলে, সার্চ হোক বা না হোক, তাতে উল্লাস করারই বা কী আছে, দুঃখিত হবারই বা কী আছে, আসল ব্যাপার হলো অন্য রকম, দেখতে হবে এতে কার কতখানি স্বার্থ সংপৃক্ত। দাঙ্গায় যে কার লাভ হয় তা তো কেউ বুঝতে পারে না কিন্তু ক্ষতি যাদের হয় তারা আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। অশোকের বাবা আর ফিরে আসেনি, মায়ের মলিন মুখটা আরো করুণ হয়ে ওঠে, ফিসফিসিয়ে মা বলে, ‘তাছাড়া আজ আবার মাইনে পাবার দিন’। গল্পে দাঙ্গার পাশাপাশি অর্থনৈতিক সংকট এবং তা থেকে উদ্বেগের একটা চিত্র উঠে এসেছে। অশোকের মতে, বিশ্বে যত দেশে দাঙ্গা হচ্ছে, তা সবই ফ্যাসিস্টদের কাজ, বড়লোকদের দালাল সবাই, শুধু বলি হয় সাধারণ মানুষ এবং তারা তাদের হাতের পুতুল হয়। মানুষ শুধু অন্যের প্ররোচণায় দাঙ্গায় জড়ায়, কিন্তু ফলাফল শূন্য, মাঝখানে মুনাফা লুটে নেয় মহাজন।
প্রত্যাবর্তন গল্পে দুই বন্ধুর দীর্ঘকাল পরে প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ দিয়ে গল্পটির সূচনা। ২৫ বছর পরে নিজ গ্রামে ফিরে আসে প্রশান্ত। অনেক পরিবর্তন চোখে পড়ে যায় তার, তাদের বাড়ির ভগ্নদশা দেখে মন তার খারাপ হলেও কালু মিয়ার সঙ্গে এক রাতে দেখা হলে সবই যেন ভুলে যায় সে। বাল্যকালের বন্ধু, অনেক স্মৃতি লেপ্টে আছে ওর সঙ্গে, পুরনো হলে বন্ধু সে তো বন্ধু, কালু মিয়া দরিদ্র কিন্তু এতটাই গরীব যা প্রশান্ত তা ভাবতে পারেনি কখনো, ওর ছেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে, কালুও তো একটা দুর্ভিক্ষের কঙ্কালসার অস্থি নিয়ে দাঁড়িয়ে। গল্পে যে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, তা উপমার মধ্য দিয়েই স্পষ্ট। মানুষের খাদ্য হরণ করছে পুঁজিপতিরা, ওরা কেড়ে খাচ্ছে দরিদ্রের খাদ্য। এভাবে বুর্জোয়া সমাজ প্রতিনিয়ত সাধারণ মানুষের রক্ত-মাংস খেয়ে ফুলে ফেঁপে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে, আর নিম্নবিত্ত বা বিত্তহীন মানুষ হচ্ছে নিঃস্ব। মানুষে মানুষে বিরাজমান এ বৈষম্য সদ্য যুবক সোমেন চন্দের চিন্তনে গভীর ছায়া ফেলে। তাই তিনি তাঁর গল্পগুলোতে শ্রেণি প্রভেদের সে বক্তব্য গদ্যের কারুকাজে স্পষ্ট করেছেন পাঠকের কাছে।
প্রত্যাবর্তন গল্পের মতো 'ইঁদুর' গল্পটিও প্রতীকধর্মী। এখানেও দরিদ্র মানুষের কথাটি বেশ উচ্চঃস্বরেই উঠে এসেছে, বুর্জোয়া শ্রেণী দিন দিন কিভাবে ইঁদুরের মতো কুরে কুরে আমাদের সমাজ-সংস্কার আর সভ্যতাকে নিঃশেষ করছে, তারই ইঙ্গিত সোমেন প্রতীকের মতো গল্পে তুলে ধরেছেন। অভাব-অভিযোগ মানুষের লালিত স্বপ্নকে বিবর্ণ করে ফেলে, নিম্নমধ্যবিত্ত-নিম্নবিত্ত অথবা বিত্তহীনকে বুর্জোয়া বা পুঁজিবাদ দমিয়ে রাখে, তার রোষানলে দলিত-মথিত হতে হতে একদিন সে ইঁদুরের খাবারে পরিণত হয়। গল্পে সুকুমার এমন একটি চরিত্র, যার মা-বাবা, ভাইবোন সবই আছে, আছে অভাব, স্বপ্ন হারানো এক হতাশা! তাকে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, দিন দিন সংকুচিত করে, সে বাঁচার মতো বাঁচতে চায়। কিন্তু নিয়মিত এই পরিবারের মানুষদের ওই একটা বুর্জোয়া ইঁদুর তাড়া করে বেড়ায়, সুকুমার আড়ষ্ট থাকে, মা ভয়ে তটস্থ সবসময়, একটা শঙ্কা একটা অপরাধবোধ তাদের তাড়িয়ে বেড়ায়, অভাবী পরিবারটি বাড়তি খরচা হিসেবে একটা ইঁদুর ধরার কল কেনার কল্পনাও করতে পারে না। তারপরও তারা ইঁদুরের সঙ্গে যুদ্ধ করে, সাম্রাজ্যবাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত ইঁদুরের যে উৎপাত, তা হয়তো কখনো নিবৃত্ত হবে না। অভাবে মানুষ পুষ্টিহীন হচ্ছে, অনাহারে দিন দিন তার শরীরের মাংস ঝরে যাচ্ছে, জীবন থেকে স্বপ্ন-বাসনা একটু-একটু দূরে সরে যাচ্ছে, ইঁদুর গল্পে এই বোধ সোমেনের ভাবনাকে সুদূর প্রসারিত করেছে। ইঁদুর যখন লেখা হয় তখন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন চলছে, সে সময় নানা পর্বে দেশজুড়ে স্বাধীনতার জন্য চলছিল সক্রিয় আন্দোলন। গল্পে সংসারে অভাব-অনটনের চিত্র শিল্পরূপ পেয়েছে শ্রেণি চরিত্রহীন মধ্যবিত্তদের সার্বিক অবস্থা লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে- ‘এরা কে জানো? এরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান বটে, কিন্তু এরা না খেয়ে মরে! যে ফুল অনাদরে শুকিয়ে ঝরে পড়ে মাটিতে এরা তাই। এরা তৈরী করেছে বাগান, অথচ তারা ফুলের শোভা দেখে না। পেটের ভিতরে সুঁচ বিঁধেছে প্রচুর, কিন্তু এদের ভিক্ষাপাত্রও নেই। পরিহাস! পরিহাস!...।’ ইঁদুর গল্পে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার বৈষম্যমূলক এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত সংসারের অনটনের দিকগুলো এসেছে সরাসরি বেশ সাবলীলভাবে চরিত্রের প্রয়োজনে। আমাদের এই স্বপ্নহীন বন্ধ্যা সময়ে সোমেন চন্দের গল্পের নায়ক সুকুমার দৃপ্ত প্রত্যয়ে আলোর পথ দেখায়। হতাশার বদলে সে শোনাতে পারে আলোর গান। সুকুমার বলে- ‘ইতিহাস যেমন আমাদের দিকে মোড় নেয়, আমিও ইতিহাসের দিকে মোড় নিলুম। আমি হাত প্রসারিত করে দিলুম জনতার দিকে, তাদের উষ্ণ অভিবাদনে ধন্য হলুম। তাদেরও ধন্যবাদ যারা আমাকে আমার এই অসহায়তার বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে গেছে। ধন্যবাদ, ধন্যবাদ! গল্পের শেষের দিকে সুকুমারের ক’জন বন্ধুর পরিচয় ঘটে পাঠকের সঙ্গে। যারা শ্রেণি সংগ্রামি। মানুষের মুক্তির সংগ্রামে যারা আত্মোৎসর্গ করছে। কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা বলতে চায় ‘একদিন এ সংগ্রাম সফল হবেই, মানুষে-মানুষে বৈষম্য থাকবে না। গল্পের পরিণতিতে- ‘ব্যাপার আর কিছুই নয়, কয়েকটা ইঁদুর ধরা পড়েছে।’ বাক্যটি দিয়ে সঞ্চিত ক্ষোভের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই ধরণের হাজারো ক্ষোভ বর্তমান বিশ্বে ৯৯ শতাংশ মানুষের। বন্ধুদের মতে, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সফল হতে পারে শোষিতের সংগ্রাম।
সাহিত্য বোদ্ধারা বলেন, ইঁদুর বাংলা সাহিত্য তথা বিশ্বসাহিত্যে একটি সার্থক ছোট গল্প। জনপ্রিয় কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন, সোমেন চন্দের ইঁদুর গল্প তাঁকে বেশ উদ্বুদ্ধ করেছিলো সাহিত্য অঙ্গনে আসতে। গল্প ইঁদুর পাঠের ব্যাপক প্রভাব পড়ে তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার সৃষ্টিতে।
১৯৩৭-১৯৪২ মোট পাঁচ বছর ছিলো তাঁর সৃষ্টির ব্যপ্তিকাল। প্রথম দু’বছর তিনি রোমান্টিক ধারায় লিখলেও পরের বছরেই তিনি নিজেকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিলেন। রোমান্টিক ভাবধারার বদলে তাঁর সাহিত্যকে তিনি করেছিলেন জীবনমুখী। রচনা, চরিত্র এবং উপমার দিক থেকেও প্রতিনিয়তই তিনি নিজেকে অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। সোমেন সাহিত্যের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট হলো নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা।
বাংলার বরেণ্য প্রগতিশীল কথা সাহিত্যিক সোমেন চন্দের মৃত্যুটা ছিলো অপ্রত্যাশিত নিরোগে, দাঙ্গায় ঢাকার রাজপথে। কমিউনিষ্ট পার্টি নেতা ও ক্ষণজন্মা এ সুসাহিত্যিকের কালজয়ী সৃষ্টি গল্প দাঙ্গার কাহিনীর মতোই তিনি বলিদান হন স্বদেশী রেভুলেশনরী সোশ্যালিষ্ট পার্টি (আরএসপি) নামের উগ্রবাদী দলের সন্ত্রাসীদের হাতে। মাত্র ২২ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয় তাঁকে। মৃত্যু ১৯৪২ খৃষ্টাব্দের ৮ মার্চ। জন্ম তাঁর ঢাকা জেলার নরসিংদীতে ১৯২০ সালের ২৪ মে। বেঁচে থাকলে তিনি তাঁর বলিষ্ঠ লেখনির মাধ্যমে বাংলার কথা সাহিত্যের পরিমন্ডল ছাড়িয়ে বিশ্ব সাহিত্যে জায়গা করতে নিতেন তা সাহিত্য পন্ডিত অনেকেই বলেছেন এবং এখনও বলেন।
অনেকের মতো বাংলা কথা সাহিত্যের বরপুত্র ও রাজকুমার এবং আমার সাহিত্য জীবনের সূচনালগ্নের স্বপ্নপূরুষ সোমেন চন্দ। করোনা ক্রান্তিকালে জন্মের শততম বার্ষিকী উদযাপন হলো না। দেরিতে হলেও প্রাণভরে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই।

প্রণব মজুমদার
লেখক গল্পকারকবিপ্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শান্তিনগরঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top