সিডনী বৃহঃস্পতিবার, ২রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

"চির সবুজ কবি নির্মলেন্দু গুণ" : সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান


প্রকাশিত:
২২ জুন ২০২০ ২০:৩৬

আপডেট:
২২ জুন ২০২০ ২১:২৮

ছবিঃ কবি নির্মলেন্দু গুণ

 

বর্তমান সময়ে বাংলা কাব্য সাহিত্যে অন্যতম প্রধান কবি নির্মলেন্দু গুণ। কবি বলতে সাধারণ মানুষের ধারণা, কবি মানেই খুব গুরু গম্ভীর একজন মানুষ। তবে যে কেউ কবি নির্মলেন্দু গুণকে কাছ থেকে দেখলে এই ধারণাটা বদলে যাবে। তিনি সদা হাস্যোজ্জল, প্রাণ চঞ্চল ও শিশু সুলভ কোমল হৃদয়ের অধিকারী। তিনি নিজেও যেমন হাসিখুশি থাকতে পছন্দ করেন, তেমনি উনার আশেপাশে থাকা সবাইকে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রাখতে পারেন। কবির ভাষ্য মতে, 'গুমরা মুখে থাকা আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমি প্রাণবন্ত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি'। সাহিত্য অঙ্গনে সুবক্তা হিসেবে উনার আছে যথেষ্ট খ্যাতি। বিশ্ব বিখ্যাত মার্কিন রম্য লেখক ও জনপ্রিয় বক্তা মার্ক টোয়েনের সাথে উনার একটি বিষয়ে দারুণ মিল আছে। তিনি মার্ক টোয়েনের মতোই অতি  সাধারণ কোন বিষয় খুব অসাধারণ ভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। খুব সাধারণ কথায় মানুষকে তিনি হাসাতে পারেন। বিভিন্ন সাহিত্য সভায় বক্তব্য রাখার সময় তিনি শ্রোতাদের জন্য রাখেন অনেক নির্মল হাসির খোরাক। কবি-সাহিত্যিকদের আড্ডায় তিনি থাকেন সবার মধ্যমণি। যতক্ষণ সময় তিনি উপস্থিত থাকেন, আড্ডা প্রাণবন্ত করে রাখেন। বয়সের ভারে শরীর দূর্বল হয়ে আসলেও মনের দিকে তিনি চির সবুজ ও তারুণ্যে ভরপুর। উনার মাঝে বেশ  রসবোধ থাকায় হাসি ঠাট্টায় নেই কোন জুড়ি। তিনি বলেন, 'আমার শরীরের বয়স বাড়ছে ঠিকই কিন্তুু মনের বয়সে আমি এখনও তরুণ। মনের বয়স সর্বোচ্চ আঠারো থেকে কুড়ি হবে'। তিনি অত্যন্ত মিশুক  প্রকৃতির, সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন। এটা উনার একটা বিশেষ গুণ। তাই তিনি অন্য কবিদের চেয়ে একটু আলাদা। এমন বিশেষ কিছু গুণাবলীর জন্যে বলা হয়, বাংলা কাব্য সাহিত্যে কবি নির্মলেন্দু গুণ একজনই। তাঁর নামের সাথে সঙ্গতি রেখে তিনি বহুমুখী গুণের অধিকারী। তিনি একাধারে কবি, কথা-সাহিত্যিক, সাংবাদিক এবং একজন দক্ষ চিত্রশিল্পী। তিনি ছিলেন স্বাধীনতার সপক্ষে অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনায় বিশ্বাসী একজন সংগ্রামী কবি।

১৯৪৫ সালের ২১ জুন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা থানার কাশবন গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম সুখেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী ও মা বিনাপানি। পরিবার প্রদত্ত তাঁর নাম হচ্ছে নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরী। তাঁর বাবা ছিলেন একজন চিত্রশিল্পী। বাবার প্রবল ইচ্ছা ছিল তাঁর কোনো এক সন্তান চিত্রশিল্পী হোক। কেননা তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলের পাঠ শেষ করতে পারেননি। সন্তানদের দিয়ে সে কষ্ট হয়তো দূর করতে চেয়েছিলেন। হয়তো বাবার এই গুণটা তাঁর কাব্য জগতের বাইরে নিজের অজান্তেই এসে বাসা বেঁধেছে। মাত্র চার বছর বয়সে তাঁর মাকে হারানোর পরে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলে নতুন মায়ের কাছে হাতেখড়ি হয় তাঁর পড়াশোনার। তৃতীয় শ্রেণীতে প্রথম বারহাট্টা স্কুলে ভর্তি হন। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবি প্রতিভার বিকাশ শুরু হয় নির্মলেন্দু গুণের। তবে তিনি লেখাপড়ায় একজন মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬২ সালে দুই বিষয়ে লেটারসহ মেট্রিক পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাশ করেন। এরপর কবি আইএসসি পড়তে চলে আসেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। সেখান থেকে চলে আসার পর বাবার অনুরোধে তিনি ভর্তি হন নেত্রকোনা কলেজে। ১৯৬৪ সালে আইএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডের ১১৯ জন প্রথম বিভাগ অর্জনকারীর মধ্যে নেত্রকোনা কলেজের একমাত্র তিনিই ছিলেন। উনার বাবা চাইতেন তিনি ডাক্তারী পড়বেন। কিন্তু তিনি চান্স পান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগে৷ ভর্তির প্রস্তুতি নেন নির্মলেন্দু গুণ ৷ হঠাত্‍ হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা শুরু হয় ঢাকায়৷ দাঙ্গার কারণে তিনি ফিরে আসেন গ্রামে৷ ঢাকার অবস্থার উন্নতি হলে ফিরে গিয়ে দেখেন তাঁর নাম ভর্তি লিষ্ট থেকে লাল কালি দিয়ে কেটে দেওয়া৷ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে আর্কিটেকচারে রিটেনে পাস করা সত্ত্বেও ভাইবাতে উনাকে ফেল করানো হয়ে ছিল। পরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসেন গ্রামে। মানসিকভাবে অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন আর লেখাপড়া করবেন না। কিন্তু স্কলারশিপ পাচ্ছেন মাসে ৪৫ টাকা। বছর শেষে আরও ২৫০ টাকা। ভর্তি না হলে স্কলারশিপ বাতিল হবে। তাই আবার সেই নিরানন্দ নিয়ে ফিরে আসা আনন্দ মোহন কলেজে পাসকোর্সে বিএসসিতে ভর্তি হলেন। কিন্তু  তা আর শেষ করা হলো না। শেষ পর্যন্ত প্রাইভেটে বিএ পাস করেন। সে সার্টিফিকেটও আর তোলা হয়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলেও ঢাকায় উনার নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তখন তিনি নিয়মিত ভাবে একের পর এক কাব্য রচনা করে যাচ্ছেন আর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। তখনকার সময়ে ঢাকার বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। তবে মেট্রিক পরীক্ষার আগেই নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত ‘উত্তর আকাশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণের প্রথম কবিতা ‘নতুন কান্ডারী’৷ মূলত এখান থেকেই পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার 'সাপ্তাহিক জনতা' পত্রিকায় প্রকাশিত হয় 'কোন এক সংগ্রামীর দৃষ্টিতে' নামক কবিতা। ঢাকা থেকে প্রকাশিত এটাই তাঁর প্রথম কবিতা। এরপর নিজের সম্পাদনায় বের করেন 'সূর্য ফসল' সংকলন। কবি সিকান্দার আবু জাফর এই সংকলনের জন্য আশীর্বাণী লিখে দেন। ঐ সংকলনে কবিতার মাধ্যমে শোষক শ্রেণীর শোষণের বিরুদ্ধে মেহনতী মানুষকে ডাক দেন কবি। সংকলনের বিভিন্ন কবিতায় ফুটে ওঠে বিদ্রোহ। যা শাসক শ্রেণীর পছন্দের বাইরে চলে যায়। শাসক শ্রেণীর রক্ত চক্ষু পড়ে কবির ওপর। ফলে কবির নামে মামলা হলো। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো।  পরে অবশ্য মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা খুরশেদ চৌধুরী ও মৌলানা ফজলুর রহমানের মধ্যস্থতায় মামলা প্রত্যাহার হলো। এরপরও মামলা তাঁর পিছু ছাড়েনি। ডাকাতির মামলায় আসামি করা হলো। আবারও গ্রেফতারি পরোয়ানা। শুরু হলো ফেরারী জীবন। কখনও গৌরীপুর, শ্যামপুর, কখনও জারিয়া-ঝাঞ্ছাইল। এরপর তিনি চলে আসেন ঢাকায়। উঠলেন বন্ধু নাট্যকার মামুনুর রশীদের সাথে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট-এর হোস্টেলে। তখন বসে না থেকে কাজ শুরু করলেন আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদের ‘কণ্ঠস্বর’ পত্রিকায়। এ সময় কবি বন্ধু আবুল হাসান তাঁর সর্বক্ষণ সঙ্গী হয়ে ওঠেন। এখন ভালই কাটছে সময়।

কবির মন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারার আক্ষেপ তখনও দূর হয়নি। তাই সেই বেদনা দূর করতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হলেন। সেখানে তিনি শেখ মুজিব কন্যা শেখ হাসিনাকে সহপাঠী হিসেবে পান। স্বাধীনতার পূর্বে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন কবির হৃদয় আন্দোলিত করে। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি বেশ আকৃষ্ট হন। ৬ দফা আন্দোলন শুরু হলে কবি বঙ্গবন্ধুকে একটি কবিতা উৎসর্গ করেন। পরে সেটি ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর ‘সংবাদ’ পত্রিকায় ছাপা হয়। কবিতাটির শিরোনাম ছিল 'প্রচ্ছদের জন্য'। বঙ্গবন্ধু তখন জেলখানায় থাকা অবস্থায় কবিতাটি পাঠ করে মুগ্ধ হয়ে ছিলেন। কবির ভাষ্য মতে, 'উনিশ সাতষট্টির বারই নভেম্বরে, তখন বঙ্গবন্ধু জেলখানায় ছিলেন। লতিফ সিদ্দীকি তাকে (শেখ মুজিব) এই কবিতাটা পড়তে দিছিলেন। রনেশ দাশগুপ্তের মাধ্যমে তিনি (বঙ্গবন্ধু) কবিতার অর্থ উদ্ধার করেছিলেন। "দেখেন তো আপনার কবি আমাকে নিয়া কবিতা লিখছে, কী বলতে চাচ্ছে কবিতার মধ্যে।" যখন কবিতাটা পড়ে শুনালেন, তখন বঙ্গবন্ধু উচ্চকন্ঠে হেসে বললেন, 'আপনারা আমাকে চিনতে পারেন নাই, কবি আমাকে চিনতে পারছে।' বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে রচিত ওটাই ছিল প্রথম কবিতা। তার পূর্বে বাংলাদেশের কোন কবি বঙ্গবন্ধুকে সচেতন বিবেচনায় নিয়ে কোনো কবিতা লেখেননি। পরবর্তীতে তিনি কবিতার শিরোনাম পরিবর্তন করে রাখেন 'স্বদেশের মুখ শেফালী পাতায়'। এই কবিতাটি উনার 'নির্বাচিতা' কাব্যগ্রন্থে যুক্ত করেন। ১৯৬৮ সালের ২৯ জুলাই হোটেল পূর্বাণীতে তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে সুযোগ পান তিনি। পত্রিকা ও টেলিভিশনের মাধ্যমে প্রচার পায় এ কবিতা পাঠের আসর। এ সুযোগ তাকে পাঠক ও কবি মহলে পরিচিতি এনে দেয়। তখন তাঁর লেখা কবিতা ও কলাম ঢাকার পত্রিকা গুলোতে নিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়। তখনকার সময়ে তিনি লিখছেন সংবাদ, আজাদ, পাক জমহুরিয়াত, জোনাকী প্রভৃতিতে।

১৯৭০ সালের ২১ জুলাই তরুণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে তিনি পাঠ করেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা 'হুলিয়া'। এ 'হুলিয়া' কবিতাটি তাঁকে কবি খ্যাতি এনে দেয়। বড় বড় লেখকরা তাঁর কবিতার প্রশংসা করেন। পশ্চিম বঙ্গের শক্তিমান লেখক শক্তি চট্টোপাধ্যায় 'পূর্ব বাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা' গ্রন্থে  'হুলিয়া' কবিতাটি ছাপেন। তখন তিনি বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। এ কবিতা নিয়ে প্রখ্যাত কলামিস্ট আবদুল গাফফার চৌধুরী 'তৃতীয় মত' শিরোনামে একটি কলাম লিখেন। এ কলাম বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি গোচরে আসে এবং তিনি কবির সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। এই প্রসঙ্গে কবির ভাষ্য মতে, 'আমার 'হুলিয়া' নিয়া যখন গাফফার চৌধুরী 'তৃতীয় মতে' লিখলেন, তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, "এই কবি তো আমাকে নিয়ে কবিতা লিখছিল সেই সিক্সটি সেভেনে, আমি তখন জেলে ছিলাম। এই কবি আমার সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলো কেন? কোথায় থাকে এই কবি। আমার সঙ্গে একবার কথা বলাতে পার কিনা এই কবির। কোথায় থাকে জান?" গাফফার ভাই বললেন, এই কবি তো বোহেমিয়ান, কোথায় থাকে কেউ জানে না। তখন আবিদুর রহমান (সম্পাদক, দি পিপল) বললেন, আমি জানি। আমার কাগজে চাকরী করে। উনি (শেখ মুুুুজিব) বললেন, "তাহলে তাকে আসতে বল। তুমি তাকে নিয়ে আস আমার কাছে, আমি কথা বলবো তার সাথে।" তারপর আবিদুর রহমান সাহেব আমাকে বললেন, "শেখ সাহেব আপনার সাথে দেখা করতে চান"। কবি হিসেবে এটা ছিল আমার জন্য খুবই সম্মানজনক।' তিনি পরের দিন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে যাবেন বললেও বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে যাওয়া হয়নি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি সৈয়দ আহমদ ফারুক ও জিএস আনোয়ারুল আলম শহীদ উনাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়িতে। সেদিন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা ভেস্তে যাওয়ার কারণে সন্ধ্যার পর ধানমন্ডির বাসায় ঘনিষ্ঠদের নিয়ে তিনি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। সেদিন রাত দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা না করেই কবি ফিরে আসেন আজিমপুরে। রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার দিকে পাক আর্মি ঢাকার ঘুমন্ত মানুষের উপর অপারেশন সার্চলাইট নামক এক নারকীয় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে। এ হত্যাযজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল গুলোতেও পরিচালিত হয়। তখন নেত্রকোনার আরেক কবি হেলাল হাফিজ থাকতেন ইকবাল হলে। যদিও সেদিন কবি হেলাল হাফিজ বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ায় জহুরুল হক হলে রাত্রি যাপনের কারণে অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। ২৭ মার্চ সকালে কবি বন্ধু হেলাল হাফিজ কেমন আছেন জানতে কবি নির্মলেন্দু গুণ আজিমপুর থেকে সেখানে যান। ইকবাল হলে গিয়ে দেখেন চারদিকে ধ্বংসস্তূপ, লাশ আর লাশ। জহুরুল হক গেটের সামনে কবি হেলাল হাফিজের সাথে দেখা। তাকে জীবিত দেখে উচ্ছ্বসিত আবেগে বুকে জড়িয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকলেন নির্মলেন্দু গুণ। পরে নদীর ওপারে কেরানীগঞ্জের দিকে আশ্রয়ের জন্য দুজনে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দেন। পরবর্তী সময়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান।

সেখানে তিনি কলকাতায় আকাশবাণী ভবনে 'বেতার জগত' পত্রিকার সম্পাদক ডাঃ গাঙ্গুলীর সহযোগী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কবিতা ছিল তার হাতিয়ার। কবিতাকে তিনি মূলত অস্ত্রে পরিণত করেন। তাঁর নিজের ভাষায় 'কবিতা আমার নেশা, পেশা, প্রতিশোধ গ্রহণের হিরন্ময় হাতিয়ার'। তাই তাঁর কবিতার মাঝে ছিল দেশপ্রেম, সংগ্রাম, রাজনীতি। যা মানুষকে উজ্জীবিত করেছে। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে সমাজ জীবনের উজ্জীবন ও সাধারণ জীবনযাত্রাকে আবদ্ধ করে রেখেছেন কবিতার ফ্রেমে। স্বাধীনতার পূর্বপর্যন্ত চাকরি করেছেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সম্পাদিত 'কণ্ঠস্বর', আহমদ রফিক সম্পাদিত 'নাগরিক', 'পরিক্রম' ও 'জোনাকী' পত্রিকায়। এরপর আবিদুর রহমান সম্পাদিত ইংরেজি পত্রিকা 'দি পিপল' এ কাজ নেন সাব-এডিটর হিসেবে। স্বাধীনতার পর কাজ করেছেন কবি আল মাহমুদ সম্পাদিত 'গণকণ্ঠ' পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। তখন তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন দূর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সমালোচনা করে কলাম লিখতেন। কবির কথায়, 'দেশে ফিরে "গণকন্ঠে" জযেন করলাম কবি আল মাহমুদের সঙ্গে। সেখানে তো আওয়ামী লীগের অপকর্ম, দুর্নীতি ইত্যাদি সমালোচনা লেখাটাই ছিল আমাদের কাজ। তবে ব্যক্তি মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা সব সময় ছিল।' এরপর সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন 'সংবাদ' ও 'দৈনিক বাংলার বাণী' পত্রিকায়। এখান থেকে চাকরি নেন ‘বাংলাবাজার’ পত্রিকায় সাহিত্য ও সহকারী সম্পাদক হিসেবে। এরপর ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি কাজ করেছেন ‘দৈনিক আজকের আওয়াজ’ নামে একটি পত্রিকায়। সেটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর কোথাও চাকরি করেননি। অসুস্থতা কবিকে শারীরিকভাবে দুর্বল করে দিয়েছে। তাই এখন কবিতাকে নিয়েই তার ঘর সংসার। সময় কাটাচ্ছেন কবিতার সঙ্গেই। কবি নেত্রকোনায় তাঁর গ্রাম কাশতলায় 'কাশবন বিদ্যা নিকেতন' নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন। কবির ঠাকুরদা রামসুন্দর এর নামে প্রতিষ্ঠা করেছেন 'রামসুন্দর পাঠাগার'। এছাড়াও নেত্রকোনার মালিনীর কুঞ্জঘাটে কাব্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান 'কবিতাকুঞ্জ' পড়ে তুলেছেন। সেখানে এ পর্যন্ত বাংলাদেশসহ মোট ৮০টি দেশের প্রায় ষোলোশো কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করা হয়েছে। ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের কবিদের কাব্যগ্রন্থ সংগ্রহ করে কাব্যকুঞ্জ সমৃদ্ধ করা হচ্ছে।

অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় কবির কাব্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। তাঁর প্রথম কবিতাটি ছিল-

আমি এখন পড়ি যে ভাই বারহাট্টা হাই স্কুলে,
একে অন্যে থাকি হেথায় ভাই বন্ধু বলে।
এই স্কুলটি অবস্থিত কংশ নদীর তীরে,
আমাদের বাড়ি হইতে দেড় মাইল উত্তরে।

এ কবিতার কোন শিরোনাম ছিল না, তবে এ কবিতা লিখেই তিনি কাব্য জগতে হাতেখড়ি নেন। তিনি প্রধানত একজন আধুনিক কবি। শ্রেণীসংগ্রাম, স্বৈরাচার-বিরোধিতা, প্রেম ও নারী তার কবিতার মূল-বিষয় হিসেবে বার বার এসেছে। কবিতার পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, আত্মজীবনী ও ভ্রমণ কাহিনী লিখেছেন। নিজের লেখা কবিতা এবং গদ্য সম্পর্কে তার নিজের বক্তব্য হলো - "অনেক সময় কবিতা লেখার চেয়ে আমি গদ্যরচনায় বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি। বিশেষ করে আমার আত্মজৈবনিক রচনা বা ভ্রমণকথা লেখার সময় আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি যে আমি যে গদ্যটি রচনা করতে চলেছি, তা আমার কাব্য-রচনার চেয়ে কোনো অর্থেই ঊনকর্ম নয়। কাব্যকে যদি আমি আমার কন্যা বলে ভাবি, তবে গদ্যকে পুত্রবৎ। ওরা দুজন তো আমারই সন্তান। কাব্যলক্ষ্মী কন্যা যদি, গদ্যপ্রবর পুত্রবৎ।" কবির মোট গ্রন্থের সংখ্যা ৯০টি। ১৯৭০ সালে কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'প্রেমাংশুর রক্ত চাই' প্রকাশিত হয়। কবি যেমন কবিতাকে ভালোবেসে সব ছেড়ে জীবন যৌবন সব কবিতার পেছনেই উৎসর্গ করেছেন। কবিতাও তাকে এনে দিয়েছে যশ-খ্যাতি। কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ কবি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, কবি আহসান হাবীব সাহিত্য পুরস্কার প্রভৃতি। কবির ৭৬-তম জন্মদিনে উনার প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তিনি সুস্থ শরীরে দীর্ঘ কাল আমাদের মাঝে বেঁচে থাকুক। তাঁর হাতে আরও কালজয়ী কবিতার জন্ম হউক।

 

সৈয়দ আসাদুজ্জামান সুহান
কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top