সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ২০শে বৈশাখ ১৪৩১

সাহিত্যে আড্ডার সংস্কৃতি ও লেখালেখি : প্রণব মজুমদার


প্রকাশিত:
২৩ জুন ২০২০ ২৩:১৪

আপডেট:
৮ জুলাই ২০২০ ২০:৪২

 

সাহিত্যের ক্ষেত্রে পারস্পরিক মত বিনিময় মানে আড্ডা খুবই জরুরি। শুদ্ধতা হচ্ছে সাহিত্যেরও প্রধান অনুষঙ্গ ! বস্তুনিষ্ঠ আড্ডা থেকে একজন লেখক শিক্ষার সঠিক পাঠ নেন ! কেউ কেউ আড্ডা থেকে লেখার বিষয় নির্বাচন ও পরিকল্পনা করেন। মৌলিক ধারণা, রচনাশৈলীর কাঠামোগত প্রকৃতি এবং ব্যাকরণ রীতি জেনে লেখক ঋদ্ধ হয়। আর তা হন প-িত বা প্রজ্ঞাবানদের সঙ্গে কথপোকথন বা আড্ডা কিংবা গল্পের মধ্য দিয়ে। একসময় পরিবার ও সমাজে আড্ডা শব্দটি নেতিবাচক হিসেবে বিবেচিত হতো ! লেখার মানোন্নয়নেও আড্ডা বা আলোচনা অপরিহার্য বিষয়। আমিও আড্ডা বা আলোচনার সূত্র ধরে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লেখালেখিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি।
মহানগরে আশির দশক থেকে লেখালেখির সুবাদে আমি আড্ডাবাজ ! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) থেকে সে পরিভ্রমণ শুরু। বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাবশাস্ত্রের মতো কঠিন বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি বিখ্যাত লেখকদের সঙ্গে আড্ডা আমার দিন কার্যক্রমের প্রধান অংশ ছিলো। মনে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি চত্বর, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বায়তুল মোকাররমের পাশে অবস্থিত জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর (ডিএফপি), প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআইবি) বাংলাদেশ টেলিভিশন, রেডিও বাংলাদেশ, ইন্দিরা রোডের বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র, ব্যাংক, বীমা ও বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা, জনসংযোগ কর্মকর্তা, শিল্পী এবং সাহিত্যকেন্দ্রিক পত্রিকাগুলোতে নিয়োজিত লেখকগণ ছিলেন আমার আড্ডার প্রাণ। সেই সময় বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রাণবন্ত শিক্ষণীয় আড্ডা হতো। আলোচনায় পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহশীল সম্পর্ক ছিলো। খুব একটা স্বার্থ তখন চোখে পড়তো না। চা, সিগারেট, সিংগারা, পুরি বা লোনতা বিস্কুট আহারে আড্ডা প্রাণময় হয়ে উঠতো। আলোচক ও শ্রোতার মধ্যে কোন তাড়াহুড়োর ভাব ছিলো না। সময়ের রেলগাড়ির যাত্রায় জমে উঠতো শিক্ষাগ্রহণ, আড্ডা বা আলোচনা। আমার সেই আড্ডার প্রথিতযশা জ্ঞানবান লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীদের অনেকেই বেঁচে নেই। জীবিত যাঁরা রয়েছেন মহানগরের কঠিন ও দুর্বিসহ জীবনে অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই আমার। শিল্প সাহিত্য, সাংবাদিকতা ও সংস্কৃতির সেই আড্ডা বা আলোচনা থেকে যা শিখেছি যাঁদের নাম না বললেই অতৃপ্তি থেকে যাবে তাঁরা হলেন কবি আহসান হাবীব, কবি আল মাহমুদ, কবি তালিম হোসেন, ড. আহমেদ শরীফ, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, হুমায়ুন আজাদ, বি. চৌধুরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, রাজিয়া আমিন খান, কাজী জাওয়াদুর রহমান, সাঈদ আহমেদ, মমতাজউদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, নরেন বিশ্বাস, কথাশিল্পী মাফরুহা চৌধুরী, আহমেদ হুমায়ূন, হেদায়েত হোসাইন মোরশেদ, সাযযাদ কাদির, শাহরিয়ার কবির, শাহাদাত চৌধুরী, আহমেদ নূরে আলম, জহিরুল হক, নাসির আহমেদ, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কবি ফজলে রাব্বী, কবি কায়সুল হক, কবি মোহাম্মদ রফিক, কথাশিল্পী মঞ্জু সরকার, কথাশিল্পী ও অনুবাদক জাফর তালুকদার, আতোয়ার রহমান, কবি আবদুস সাত্তার, খালেদা এদিব চৌধুরী, রোকনুজ্জামান দাদাভাই, বজলুর রহমান, আফলাতুন, আখতার হুসেন, কথাশিল্পী বিপ্রদাশ বড়ুয়া, কবি আসাদ চৌধুরী, কবি হেলাল হাফিজ, কবি মাহবুব হাসান, কবি মাহমুদ আল জামান (আবুল হাসনাত), কথাশিল্পী হরিপদ দত্ত, সুশান্ত মজুমদার, তাপস মজুমদার, কবি শামসুল ইসলাম, জাহিদুল হক, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন, শামসুল হক দিশারী, আনোয়ারুল কবীব বুলু, শরাফুল ইসলাম, আমান সাঈদ, রথীন্দ্র রথীজিৎ, বরুণ গোস্বামী, শম্ভুনাথ পাইন, সিরাজুল ফরিদ, নীতিশ সাহা, অমিতাভ দাশ হিমুন, ফারুক হোসেন, মাহবুবা হক কুমকুম, তাহমিনা আজিজ বেবী, প্রণয় সাহা, বাপী শাহরিয়ার, দেবাশীষ সরকার, কবি ত্রিদিব দস্তিদার, আরেফিন বাদল, জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ, আতিকুল হক চৌধুরী, আবদুল্লাহ আল মামুন, কেরামত মাওলা, সমীর কুশারী, মানিক দে, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী, বরকতউল্লাহ, জিয়া আনসারী, আলাউদ্দিন আহমেদ, আহসান হাবীব, মোহাম্মদ আবু তাহের, ফখরুল আবেদিন দুলাল, জীবন চৌধুরী, গীতিকার মনিরুজ্জামান মনির, মাসুদ করিম, অমল বোস, হুমায়ূন ফরীদী, ফারুক মেহেদী, তাজুল ইসলাম ফিরোজী, আলী যাকের, ড. ইনামুল হক, খালেদ খান, এস. এম. সোলায়মান, কাজী রফিক, আজিজুল হাকিম, বাবুল বিশ্বাস, শান্তিবালা সিং, রাহিজা খানম ঝুনু, শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায়, লুবনা মরিয়ম, শুক্লা সরকার, তহুরা আলী, বেলায়েত হোসেন, সুলতানা হায়দার, ইউসুফ আলী খান খোকা, আলমগীর কবীর, শিবলি সাদিক, আমজাদ হোসেন, বেবী ইসলাম, শিল্পী নিতুন কুন্ডু, আবদুর রাজ্জাক, মনিরুল ইসলাম, কাইয়ুম চৌধুরী, আমিনুল ইসলাম, সাদেক খান, মাহফুজউল্লাহ, সুবীর চৌধুরী, সারা মাহমুদ, জিনাত বরকতউল্লাহ, ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কারার মাহমুদুল হাসান, লতিফুর রহমান, অরিজিৎ চৌধুরী প্রমুখ। লেখালেখি এবং শিল্প ও সংস্কৃতির শিক্ষা জীবনে এদের কাছে আমি কম বেশি ঋণী। সাহিত্য আড্ডায় বেশি সময় ব্যয় করেছি আশির দশকে। সাহিত্য, সাংবাদিকতা, সংস্কৃতি ও শিল্পের যা একটু শিখেছি বেশির ভাগ উল্লেখিত গুণীজনদের আড্ডার সংস্পর্শ থেকেই।
লেখকদের সঙ্গে আড্ডা ছাড়াও সংগঠনকেন্দ্রিক আড্ডায় ছিলাম কখনো সঞ্চালক কিংবা মধ্যমণি। কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, অবজারভার ভবনে অবস্থিত কিশোর বাংলার চাঁদের হাট এবং অনুশীলন সংধের সাহিত্য আড্ডা আজও চোখে ভাসছে। মনে পড়ে রাজধানীর নয়াপল্টনে খেলাঘরের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকাকালে আমি ১২৩টি সাহিত্য বাসর পরিচালনা করেছি। সেই সাহিত্য বাসর বা আড্ডায় অংশগ্রহণকারি অনেক লেখকই আজ দেশের স্বনামখ্যাত সাহিত্যিক।
মফঃস্বল শহরে বিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৭৮ সালের ২৭ জুন সেই সময়ের রুচিশীল ও জনপ্রিয় কাগজ দৈনিক সংবাদ এর খেলাঘর পাতায় প্রকাশিত চার চরণের ছড়া আমাকে লেখালেখির ভূবন নিয়ে আসে। তারপর পর্যায়ক্রমে শিশু কিশোর উপযোগী কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ছাড়াও ছিলো সকল শ্রেণির পাঠযোগ্য সাহিত্যের সমালোচনা এবং গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা ও নাটক লেখায় গভীর মনোসংযোগে নিমগ্ন। সে লেখা ছাপা হয় সংবাদ, ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা, দৈনিক বাংলার বাণী, গণকণ্ঠ, দৈনিক দেশ, কিশোর বাংলা, শিশু, নবারুণ, ধান শালিকের দেশ, সচিত্র বাংলাদেশ, বই, উত্তরাাধিকার, বিচিত্রা, সচিত্র সন্ধানী এবং রোববারসহ লিটল ম্যাগাজিনে ! মতিঝিল ভারতীয় গ্রন্থাগার, দিলকুশায় ইউসিস লাইব্রেরি, ফুলার রোডের ব্রিটিশ কাউন্সিল ও শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে সাহিত্যের ওপরও পড়াশোনা চলতো। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আড্ডাতো ছিলোই !
হল জীবন শেষ করে ঢাকা শহরের যন্ত্রণাময় মেস যাপন ! প্রকাশিত লেখাগুলো পরে একসময় গ্রন্থিত হতে পারে এ চিন্তা আমার কখনই ছিলো না ! আজ এখানে তো কাল ওখানে। এভাবে আমার সেসব প্রকাশিত লেখার প্রামাণ্য কাগজ ও পত্রিকা কোথায় যে হারিয়ে যায় সে মূলধনের খবর রাখিনি তখন। আজ সে দুঃখ আমাকে কুরে কুরে খায় !
নানা দৈনিক কাগজে প্রকাশিত পেপারের সূত্র দলিলের সাহায্য নিয়ে উদ্ধারকৃত ১০টি গল্প নিয়ে বই হুলুস্থুল বের হয় ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের অমর একুশে গ্রন্থ মেলায়। দেশের বৃহত্তম সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান মুক্তধারা। ১৯৮৮ সালে এর কর্ণধার এবং বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অমর একুশে গ্রন্থ মেলার প্রবর্তক নমস্য শ্রী চিত্তরঞ্জন সাহা (প্রয়াত) আমার একাধিক বই বের করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ! কিন্তু সে বছর ভয়াবহ বন্যায় মুক্তধারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে নির্বাচনী বোর্ড অনুমোদিত গল্প, ছড়া এবং নাটকের পা-ুলিপিগুলো বই আকারে আলোর মুখ দেখতে পায়নি । ২০১৭ সালের শেষদিক। বিশ্ববিদ্যালয় হলমেট অনুজপ্রতিম যিনি বর্তমানে বাংলা একাডেমি এর উপ পরিচালক (ফোকলোর) ড. তপন বাগচী সহযোগিতার হাত বাড়ালেন ! দৈনিক আজকের কাগজ এ তপন ছিলেন আমার অন্তরঙ্গ সহকর্মী। কর্মস্থল বাংলা একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে আড্ডার পরে সে তাঁদের পুরাতন ভবনে অবস্থিত লাইব্রেরিতে অধীনস্থদের বলে দিলেন আমাকে সহযোগিতা দেয়ার কথা। ১৯৮০ সাল থেকে দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত গল্গগুলো উদ্ধারে লাইব্রেরি ওয়ার্ক শুরু হলো ! পুরোনো পত্রিকাগুলো এখানে খুব একটা নেইও ! ২১ দিন পরিশ্রমের পর ১০টি গল্প সংগ্রহ করতে সমর্থ হই। বাংলা একাডেমি এর লাইব্রেরি থেকে গল্প উদ্ধার শুধু তপন বাগচীর আন্তরিক সহযোগিতার কারণেই সম্ভব হয়। সেজন্য আমি গ্রন্থ লেখক হতে পেরেছি ! বাকী কৃতিত্বের দাবীদার নন্দিতা প্রকাশ এর কর্ণধার ভবোরঞ্জন বেপারী মানে বিভি রঞ্জন ! যদিও তিনি শেষ মুহূর্তে বাণিজ্যিক দর কষাকষিতে প্রথম বই প্রকাশে কৃতকার্য হয়ে আমায় ধন্য করেছেন। আফসোস তাহলে এ প্রক্রিয়ায় ৩০ বছর আগে কেন বই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলাম না ? তখন তো টাকার পরিমাণ কম লাগতো ! সৃজনশীল বইয়ের বাজার সে সময় এতটা বাণিজ্যিকও ছিলো না।
শিক্ষা জীবন শেষে সাংবাদিকতা পেশায় যাবো ঠিক করে রেখেছিলাম ! যদিও অর্থনৈতিকভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় এমন নিশ্চিত সরকারি বেসরকারি ভালো ভালো চাকরির সুযোগকে অবহেলায় দূরে ঠেলে দিয়েছি। যাই হোক, জীবিকার টানে জাতীয় দৈনিকে মূলধারার বিশেষ করে অর্থনীতি প্রতিবেদন সাংবাদিকতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি একুশটি বছর। এ সময় অনেকটা নীরব থাকে আমার মৌলিক সাহিত্য কর্ম। ককর্ট রোগে দীর্ঘ চিকিৎসার পর স্ত্রীকে হারাই ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে! নিজেকে সামলে নিলেও জীবনের সবচেয়ে সংকটময় দিনগুলোর অভিজ্ঞতা এবং কাছের মানুষগুলোর বঞ্চনা আমাকে দুঃখের সমুদ্রে নিমজ্জিত করে প্রবলভাবে। জীবনবোধের এই ট্র্যাজেডি আমাকে কবিতা নির্মাণের পথ দেখায়।
বড়দের কবিতা লেখা নিয়ে বেশি ভাবতে শুরু করি। সাহিত্য আড্ডায় যোগ দেই আবার। সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠন জিগীষা এর সঙ্গে যুক্ত হই ! চাঁদপুরে ছেলেবেলায় লিটল ম্যাগাজিনে যাঁর কবিতা পড়ে নিজেকে মনে মনে কবি ভাবতাম সেই অগ্রজ কবি ও গল্পকার ইলিয়াস ফারুকীর অনুরোধে সংপৃক্ত হই এখানে। মহানগর নয়াপল্টনে জিগীষা এর অস্থায়ী কার্যালয়। গল্পকার মনিরা আক্তার সম্পাদিত এর ত্রৈমাসিক সাহিত্য প্রকাশনা বৈঠা সংকলনে লেখার মাধ্যমে কবিতার পুনারম্ভ। কবিতা আমার কাছে কঠিন মাধ্যম মনে হয় যতটা কথাসাহিত্য নয়। কবিরা যেন চিত্রশিল্পীর বিমূর্ত রূপে কবিতা লিখেন ! অচেনা কঠিন শব্দের মননশীল কারুকাজে কবিতার ভাবার্থ আমাকে এখনও বেশ ধাঁধায় ফেলে ! কবিতা পড়া এবং এর রচনাশৈলী নিয়ে আমি বেশ তৎপর।
সামাজিক যোগাযোগের অত্যন্ত জনপ্রিয় মাধ্যম ফেসবুকে কবিবন্ধুদের খুঁজে বেড়াই ! কবিতা শেখার প্রত্যয়ে বন্ধুত্বের আহবান জানাই ! অন্যদের বাদ দিয়ে তার স্থলে কবিদের অন্তর্ভুক্ত করি !
কবি নাহিদা আশরাফীকে বন্ধু অনুরোধ পাঠাই। ৪ সহ¯্রাধিক বন্ধু তালিকায় তিনি যুক্ত হন। বন্ধুত্ব গ্রহণের কিছুদিন পর ম্যাসেঞ্জারে আমার লেখা একটি প্রেমের কবিতা পাঠিয়ে জানতে চাই -
- কেমন হয়েছে কবিতাটি ? ইলেকট্রনিকস ডিভাইসে বাটন টিপে তার সপ্রতিভ উত্তর !
- খুব ভালো হয়েছে তা বলবো না !
মেধাবী নাহিদার ওপর তাৎক্ষণিক অভিমান হলো আমার ! কবিতা নিয়ে আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন মহানগরীর সাহিত্য প্রাঙ্গণ শাহবাগস্থ কাঁটাবনে ! তিনি যে কবিতা ক্যাফে এর পরিচালক তা জানা ছিলো না ! কাঁটাবনের কনকর্ড এম্পোরিয়ামে বলাকা প্রকাশনীরর প্রকাশক লেখিকা সাংবাদিক শরীফা বুলবুলের সঙ্গে কাজ সেরেই কবি ও সম্পাদক নাহিদা আশরাফীকে ফোন দেই। শুরু হলো তাঁর সঙ্গে আড্ডার পর্ব । কাব্যপ্রেমী পরিপাটি সুশ্রী এই ভদ্রমহিলা দু’টি অনুষ্ঠানে আমাকে নিমন্ত্রণ করেন ! সেখানে পেলাম আমার চেনা কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি ও গবেষক তপন বাগচী ও কবি তিথি আফরোজসহ অনেককে !
ফেসবুকে আলাপ হয় কবি নাহিদার সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই ! একদিন প্রস্তাব দিলেন স্বল্পসংখ্যক লেখককে নিয়ে কবিতা ক্যাফে চত্বরে ধারাবাহিক সাহিত্য আড্ডা শুরু করবেন ! কবিতা ও কবির রচনা নিয়ে ঘরোয়া আলোচনা ! বললাম মন্দ নয়, আমিও আছি আপনার সঙ্গে !
একদিন রাতে ম্যাসেঞ্জারে ঢুকে দেখি মনকাড়া অঙ্গসজ্জার নিমন্ত্রণ পত্রের সফট কপি ! আড্ডার নাম বহতা ! আলোচক ড. তপন বাগচী। কয়েকদিন পর দেখি এক বিকেল সোয়া তিনটায় কবিতা ক্যাফে এর মধ্যখানে কবিদের সমাগম। একে একে ভরে গেলো আড্ডার স্থল। দুই ঘন্টা ধরে চললো কবিতার প্রাণবন্ত আড্ডা। অংশগ্রহণকারীদের তাৎক্ষণিক চাঁদায় সিঙ্গারা ও চা পানে অনুষ্ঠান চলছে। পঠিত লেখার ওপর আলোচনার অতিথি তপন বাগচী। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা, আলোচনা, রচনার কাঠামোগত ইতি ও নেতিবাচক দিক এবং লেখালেখির নেপথ্য কথায় প্রায় সকলেই বিমুগ্ধ এবং সন্তুষ্ট হলেন ! সাহিত্য আড্ডার মধ্যমনি ও সাহিত্য সংকলন জলধি এর সম্পাদক কবি নাহিদা আশরাফীসহ দেশের নবীন প্রবীণ লেখকদের সঙ্গে কবিতা ও সাহিত্য আড্ডা প্রায় সময়ই চলে। কবিতা লেখার অনুশীলন বৃদ্ধি পেলো । জাতীয় দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী এবং স্বনামখ্যাত সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশ হচ্ছে বড় ও ছোটদের উপযোগী গল্প, ছড়া, কবিতা প্রবন্ধ, নাটক এবং কলাম নিবন্ধ। পাঠ্যাভাস এবং পারস্পরিক সাহিত্য বিষয়ক আড্ডা এখনও অব্যাহত রেখেছি লেখার প্রয়োজনে। তবে অসন্তুষ্টি রয়েছে আমার এখনও । কষ্ট হয় ! ভালো লেখা লিখতে না পারার হতাশা আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সারাক্ষণ।
সারা বিশ্বে কঠিন ভাইরাস করোনা জীবনের গতিপথকে বেশ স্লথ করে দিয়েছে। সংক্রমণের ভয়ে আমরাও বেশির ভাগ মানুষ গৃহকোনে বদ্ধ রয়েছি। সবার একটাই জিজ্ঞাসা -কবে যাবে করোনা ? বিষন্নতা এবং একঘেয়েমি গৃহযাপন থেকে প্রশান্তির জন্য মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের আড্ডায় প্রতিদিন মিলিত হচ্ছি আমরা। অধিকাংশ আড্ডা সেটা সাহিত্য কিংবা স্বাস্থ্য বা সমাজ সচেতনতামূলক হোক না কেন তাতে শুদ্ধ বা সঠিক তথ্য জ্ঞান বা ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। বাণিজ্য চিন্তায় ব্যক্তির আত্মপ্রচারের আধিক্যে মূল কার্যক্রম আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। বস্তুনিষ্ঠ আড্ডা হচ্ছে না। আলোচকের জ্ঞানের গভীরতা নেই । অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উত্তর, লাগামহীন অপ্রয়োজনীয় আলোচনা আড্ডার প্রাণকে নির্জীব করে দিচ্ছে। অংশগ্রগণকারিগণ শোনতে চান কম, বলতে চান বেশি!
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় দুই যুগেরও আগ থেকে দেশের সাহিত্যেও দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেছে! হয়েছে সাহিত্য বাণিজ্যিক । মননশীলতা তাতে ব্যাহত করেছে । লেখক এখন আপন মনে সৃজনশীল কাজে যুক্ত হন না। পত্র পত্রিকার পৃষ্ঠপোষক এবং সম্পাদকগণ প্রবহমান কালকে বেশি প্রাধান্য দেন। তাছাড়া তাদের কাছে মানের চেয়ে পরিচয়ের সূত্রটাই যেন অগ্রগণ্য। লেখা প্রকাশের মাধ্যমে রাতারাতি পরিচিতি পাবার অভিপ্রায়ে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটকে গুরুত্ব দিয়ে লেখকরাও সে পথে পরিভ্রমণ করেন। ফলে ফরমায়েশী লেখার কারণে মান ও সাহিত্য রীতি তেমন বজায় থাকে না। আশির দশকে লেখক, শিল্পীসহ সাহিত্য ও সংস্কৃতির নিয়োজিতদের মধ্যে তেমন কর্মধারা দেখা যেতো না। চেতনার গভীর থেকে আসা মন দিয়ে সময় নিয়ে শিল্পের সাধনা করতেন তাঁরা।
একজন লেখক হিসেবে সমৃদ্ধ সাহিত্যের কল্যাণে বস্তুনিষ্ঠ এবং প্রজ্ঞাময় আড্ডার গুরুত্ব রয়েছে বলে আমি মনে করি। সুন্দরভাবে বিকশিত হোক সাহিত্য। জয় হোক মানবতার।

 

প্রণব মজুমদার
লেখক গল্পকারকবিপ্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক
শান্তিনগরঢাকা

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top