সিডনী শুক্রবার, ৩রা মে ২০২৪, ১৯শে বৈশাখ ১৪৩১

সাদা বক : সায়মা আরজু


প্রকাশিত:
২৪ জুন ২০২০ ২১:২৩

আপডেট:
২৪ জুন ২০২০ ২১:২৫

ছবিঃ সায়মা আরজু

 

আশ্বিন মাসের ধান ক্ষেতের নব্য ধানের শিষ গুলোর দিকে তাকিয়ে কেমন এক শিহরন জাগে সালমার সারা শরীরে। ক্ষেতের কিনারা দিয়ে ছুটে গিয়ে হাত বুলিয়ে দিতে ইচছা করে ক্ষেতের সারা গায়ে পরম মমতায়। নিজের ঈষৎ স্ফিত পেটের দিকে তাকিয়ে খানিক লজ্জা ও পায় সে। মনে মনে হাসে।নিজের পেটে হাত বুলায়। একটু কি নড়ে উঠলো! বাড়িতে এক জোড়া ছাগলের বাচ্চা এনেছিল এক বছর আগে বাপের বাড়ি থেকে। সেগুলোর একটা তার মত একটু একটু করে ভরছে। মনে হয় সে আর ছাগলটা একই সময় বিয়োবে। ফিক করে হেসে ফেলে সালমা।
-বৌ কই গেলা?
শ্বাশুড়ির ডাকে তাড়াতাড়ি আসতে গিয়ে উঠোনে রাখা খড়ির জন্য কাঠের স্তুপে পা আটকে পড়ে যেতে যেতে উঠে দাঁড়ায়। শ্বাশুড়ি হায় হায় করে এগিয়ে আসেন।
- কতবার কইছি সাবধানে চলবা। একটা অঘটন না ঘটাইলেই তোমার হইব না। ব্যাতা পাওনাই তো?
-না আম্মা।
-যাও পুকুর থন কয়ডা চিংঙর মাছ আনছি কুইট্টা শষা আনাজ দিয়া চড়াইয়া দাও।
সালমা পাকের ঘরের দিকে যায়।

খানিক বাদে মালেক বাড়ি ফেরে। আজ হাটবার দুপুরে খেয়েই হাটের দিকে যাবে। আনোয়ারা বেগম একটা ঝুড়িতে সবজি আর অন্য একটা ঝুড়িত তিন কুড়ি হাসের ডিম গুছিয়ে দেয় হাটে বিক্রির জন্য। সালমা ভাত বাড়ে।
মালেকের সংসারে অভাব না থাকলেও প্রাচুর্য নাই সালমার বাপের বাড়ির মত। তার বাপের বাড়িতে পাকা ঘর, ধানের গোলা, সুপুরি, নারকেলের বাগান, কাজের লোক। আর মালেকের বেড়ার ঘরে টিনের ছাউনি। আব্বা মারা যাওয়ার পর ভাইরা আলাদা আলাদা সংসার করতে চাইল। মা'র বয়স হয়েছে। মেয়ের বোঝা বেশীদিন মাথায় রাখতে চাইল না কেউ। স্কুলের ক্লাস এইট থেকে ছাড়িয়ে এনে বিয়ে দিয়ে দিল।

সপ্তাহ ঘুরে মাস শেষ হয়। আস্তে আস্তে ক্ষেতের ধানে সোনালী রং লাগে। সালমার শরীরের ভিতরের ছোট্ট শরীরটা বেশ দুরন্ত হয়েছে। সালমা পেটে হাত বুলিয়ে আদর দেয়। শরীরটাও আর ভালো যাচ্ছেনা আজকাল। মাকে খবর দেয়া হয়েছে। ধান কাটা শেষ হলেই আসবে। আজ আকাশটা বেশ মেঘলা। এমন মেঘ থাকলে ধান শুকাতে সময় লাগবে, ভাবে সালমা।
সামনের দাওয়ায় বসে রেডিও শুনছিলো মালেক। অস্থির পায়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায় সে। ফিরে আসে বেশ অনেক সময় পর। এসেই মাকে বলে, 'আম্মা বইন্যা হইতে পারে। কাইল থিকা ধান কাটা লাগব। আপনে একটু গোছ গাছ কইরা রাইখেন কহন কি হয়?'
সপ্তাহ খানেক পরের এক সকালে  আবহাওয়া বেশ উতলা হয়ে উঠলো। থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। বাঁধ ভেঙ্গে পানি উঠেছে বড় রাস্তায়। বাড়ির উঠোনেও পানি। গ্রামের অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে চলে গেছে। কি করবে বুঝতে পারছেনা মালেক। সালমাকে নিয়ে এ অবস্থায় নড়ার উপায় নাই। পানি বাড়ছে, বৃষ্টিও। ঘরে পানি ছুঁই ছুঁই করছে। আনোয়ারা বেগম হাস মুরগির খাঁচা খুলে দিলেন। হাঁস গুলো উঠোনে সাঁতার কাটতে লাগলো আর মুরগী কয়টা পাকের ঘরের আড়ার উপরে আশ্রয় নিল। সালমার অনুরোধে তার ছাগল দুটোকে বারান্দায় মাঁচা করে রাখা হয়েছে।
দুপুরে ছাগলটার প্রসবের সময় হয়ে এল। আনোয়ারা বেগম দক্ষ হাতে সামলাচ্ছেন। সালমার দিকে ছাগলটা প্রসব বেদনায় করুন চোখে তাকায়। বুকের ভেতর মোচর দিয়ে ওঠে তার। একে একে দুটো বাচ্চা দেয় ছাগলটা। শ্বাশুড়ির কথা মত চটের বস্তার উপর শুকনা খড় বিছিয়ে দিয়ে মা ছাগলের পাশে বাচ্চা দুটোকে রাখে সালমা।
চারদিক মেঘে ঢাকা। বোঝার উপায় নাই বিকেল না সন্ধ্যা। আনোয়ারা বেগমের মন কেমন করে। বউটা পোয়াতি, শেষ সময়, রাতে যদি কিছু হয়। মনে কু ডাকে।কেরোসিনের চুলাটা অনেকদিন ব্যবহার হয়না। কখন না কখন লেগে যায়। পানি ডিঙিয়ে বার বার পাকের ঘরে যাওয়া যাবেনা। হঠাৎ খেয়াল হয় তার ঘরে কেরোসিন নাই। মালেককে বলে, 'দেখতো বাবা কেরোসিন আনা যায় কিনা'। মালেক হাটু পানি ভেঙে বেরিয়ে যায়।
আনোয়ারা বেগমের আশঙ্কাই ঠিক হয়। সালমার ব্যাথা উঠেছে। এদিকে ছেলটাও আসছেনা। আনোয়ারা বেগম সালমাকে জিজ্ঞেস করেন-
- ব্যাথা কেমন মা।
-বেশি না।

আনোয়ারা বেগম ভাবেন পাশের বাড়ির দুলালের মাকে ডেকে আনতে পারলে ভাল হয়। ছেলের দেরি দেখে সালমাকে বলেন,
-আমি যাই দেখি দুলালের মারে পাই কিনা। তুমি ডরাইও না।
-আচ্ছা।

আনোয়ারা বেগম বেড়িয়ে গেছেন সেই কখন, এখনও ফেরেন নাই। এদিকে সালমার ব্যাথা বেড়ে গেছে। কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। আম্মা আম্মা বলে কয়েকবার ডাক দেয়। চারদিক অন্ধকার। কুপি জ্বালানো দরকার। এদিক ওদিক হাতরে সে দিয়াশলাই বা কুপি কোনোটাই পেলোনা। ভাবলো, হয়তো পাকের ঘরে, যাই নিয়ে আসি। কোনরকম দাওয়া থেকে নীচে নেমেই সালমার মনে হল প্রবল স্রোতের মধ্যে সে। এক ধাক্কায় কোথায় এসে পড়ল ঠাহর করতে পারলো না। একটা শক্ত গাছের সাথে আটকে গেলে সেটার ডাল ধরে গতি আটকালো সে। মনে মনে ভাবলো বাড়ির পাশের খালটা এত কাছে চলে এল কেমনে?
কতক্ষন এভাবে গেল কে জানে! পানি খেতে ইচ্ছা করছে,ব্যাথাটা আসছে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে ভেঙে চুড়ে সব নীচে নামছে। হঠাৎই  মানুষের কন্ঠ আর ঝপ ঝপ দাড়ের শব্দ কানে এল। কিছুক্ষন পরে একটা নৌকা এসে পাশে দাড়াল। সালমা শুনতে পেল কেউ বলছে
-বাইচ্চা আছে। নৌকায় উঠাও।
- ওমা পোয়াতি। রক্ত।এর তো টাইম হইয়া আইছে।

একজন মহিলার গলা সালমাকে জিজ্ঞেস করল,'তোমার নাম কি? স্বামীর নাম কি? বাড়ি কই?' সালমা হুঁশ রাখতে পারছেনা। কি বলল মনেও করতে পারছনা। সালমার চোখে ছাগলটার করুন মুখটা, চোখটা ভাসছে। হঠাৎই মনে হল কান্নার শব্দ শুনতে পেল। মহিলা কন্ঠ কয়েকবার নাড়া দিল তার শরীর। ডাক দিল, 'ও মাইয়া, ও মাইয়া'। সালমার চোখ খোলার শক্তি নাই। মহিলা বলল,
- মইরা গেছে নাকি? যে রক্ত ভাঙ্গতাছে। আমাগো লগে তো অত কাঁথা -কাপড় নাই। আর দাই ই বা কই পামু?
-কি করবা? এইহানে নৌকা রাখা নিরাপদ না। উঁচা জায়গায় যাওন দরকার।
-আল্লাহর হাতে ছাইড়া দেন। দেহেনতো ঐডা কি? ঐ বাঁশের লগে বান্ধা? তালের ডোঙা নাহি ? তারে ঐডায় শোয়াইয়া দেই তাইলে।
-বাচ্চা?
- এতো বকের লাহান সাদা। হেরে ফালাই রাখলে কাউয়ায় খাইব। আমি লইয়া যাই, আমি পালমু।

তালের ডোঙা আসল। সালমা টের পেল তাকে তালের ডোঙায় শোয়ানো হচ্ছে। প্রানপনে সে কথা বলতে চাইল। কোনও আওয়াজ করতে পারলো কি? ঝপ ঝপ দাড়ের আওয়াজ মিলিয়ে গেল। তার চোখের উপরে যেন দেখতে পেল একটা সাদা বক উড়তে উড়তে দূরের কোনো মেঘে মিলিয়ে যাচ্ছে।

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top