সিডনী মঙ্গলবার, ১৬ই এপ্রিল ২০২৪, ৩রা বৈশাখ ১৪৩১

আহমদ ছফাঃ বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচায়ক : মাসুদ পারভেজ 


প্রকাশিত:
১ জুলাই ২০২০ ২২:৫৬

আপডেট:
১ জুলাই ২০২০ ২৩:১৬

ছবিঃ আহমদ ছফা

 

‘আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যখন আমাদেরকে রক্ত দিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে' বা 'বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, এখন যা বলছেন শুনলে বাংলাদেশের সামাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না'। 

স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে এই কথাগুলো এখনো পর্যন্ত কতটুকু প্রাসঙ্গিক এবং যৌক্তিক তা সহজেই অনুমেয়। অনেকের মতে ক্ষমতার সামনে সত্য উচ্চারণ করা মত সাহিত্যিক একজনই ছিলেন, তিনি লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ, গণবুদ্ধিজীবী ও বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচায়ক আহমদ ছফা। যার কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পড়তে হয়েছে তাকে। সামাজিক অগ্রগতি, মানুষের গহনের ক্ষতি, সম্ভবনা ও মুক্তির উপায় আহমদ ছফার চেয়ে বেশি কেউ চিন্তা করেনি। তার প্রতিটি লেখায়, চিন্তা চেতনা ও বক্তব্যে বাংলাদেশকে একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন। সবসময় ধর্মান্ধতা, সুশীল সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতা, রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের বিরুদ্ধে গলা উঁচিয়ে কথা বলেছেন। প্রাণ প্রকৃতির সংমিশ্রণে উপস্থাপন কৌশলে নিজস্বতা বজায় রেখেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের এই প্রথম গ্রন্থ রচয়িতা।
আহমদ ছফা মনে করতেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও পাঠ্যপুস্তক এই তিন অপরিহার্য জিনিসের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বিচারশীল ও চিন্তাশীল করে তুলতে না পারলে শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ভণ্ডুল হয়ে যায়। দেশের কোন শিশুই যেন তার শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয় সেজন্য তার উদ্যোগ ও নির্দেশনা আজও অনুকরণীয়।
ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষার প্রতি প্রেম দেখিয়েই চলছে তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ বা ইংরেজিতে সিভিল সোসাইটি। জাতির সঙ্গে এমন বেইমানি আচরণে ক্ষুব্ধ আহমদ ছফা তাই বলতেন, ‘আজ এই দাস্য মনোভাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। তা নইলে আমাদের স্বাধীনতা মিথ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু এই মানসিক দাসত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কাজটা হৈ হৈ করে হওয়ার কথা নয়। এতে প্রয়োজন সুন্দরতম ধৈর্য, মহত্তম সাহস, তীক্ষষ্টতম মেধা এবং প্রচণ্ড কূলছাপানো ভালোবাসা, যার স্পর্শে আমাদের জনগণের কুঁকড়ে যাওয়া মানসিক প্রত্যঙ্গে আশা-আকাঙ্ক্ষা জাগবে এবং সাহস ফণা মেলবে।’

বিখ্যাত এই মহান মানুষটির জন্ম ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা মরহুম হেদায়েত আলী ওরফে ধন মিয়া। মা মরহুমা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ১৯৬০খ্রিস্টাব্দে নিজের গ্রামের নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ছাত্রাবস্থায় সুধাংশু বিমল দত্তের মাধ্যমে কৃষক সমিতি-ন্যাপ বা তৎকালীন গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। মাস্টারদা সূর্যসেনেরবিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁরা কয়েকজন বন্ধু মিলে চট্টগ্রাম-দোহাজারী রেললাইন উপড়ে ফেলেন। পরে গ্রেপ্তার এড়াতে কিছুকাল পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মগোপন করেন। ১৯৬২খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন ; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েবাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমীর পিএইচডিগবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৫৭খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্তশ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
পরে ১৯৮৬-তে জার্মানভাষার ওপর গ্যোটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যে জ্ঞান তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সাহস জুগিয়েছিল।
১৯৬৭ সালে মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে চট্টগ্রামের গ্রামীণ সমাজের পটভূমি, বিষয়বস্তু ও সংলাপে "সূর্য তুমি সাথী" উপন্যাস দিয়ে পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। যেখানে ধর্মান্ধতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ও জাতিগত বিভেদের তুমুল প্রতিবাদ রয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম গ্রন্থ "জাগ্রত বাংলাদেশ" প্রকাশিত হয়। ১৯৭২ সালে দৈনিক গণকণ্ঠ-এ ধারাবাহিকভাবে "বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস " প্রকাশ করা হলে । বইয়ে আহমদ ছফা বাঙালি চিন্তকদের সম্পর্কে যুক্তিসহ রূঢ় সব মন্তব্য করেছেন। আহমদ ছফার সর্বাধিক আলোচিত সাতচল্লিশের দেশভাগ থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—দীর্ঘ এ কালখণ্ডে বুদ্ধিজীবীরা কীভাবে আত্মবিক্রির প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন, কীভাবে পুরস্কার, পদক-পদবির জন্য মরিয়া ছিলেন, তা তথ্য উপাত্তসহ উপস্থাপন করেছেন। বিতর্ক বা আলোড়ন সৃষ্টিকারী এই প্রবন্ধের কারণে তৎকালীন সরকারের রোষে পড়তে হয় তাকে। তবুও একটি বাংলা সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থ হিসেবে পাঠক পরিচিতি লাভ করে। এছাড়া তার অন্যান্য গ্রন্থ সমূহের মধ্যে অন্যতম প্রবন্ধ- জাগ্রত বাংলাদেশ (১৯৭১), বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাংলা ভাষা: রাজনীতির আলোকে (১৯৭৫), বাংলাদেশের রাজনৈতিক জটিলতা (১৯৭৭), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য প্রবন্ধ (১৯৮৯), রাজনীতির লেখা (১৯৯৩), আনুপূর্বিক তসলিমা ও অন্যান্য স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ (১৯৯৪), নিকট ও দূরের প্রসঙ্গ (১৯৯৫), সঙ্কটের নানা চেহারা (১৯৯৬), সাম্প্রতিক বিবেচনা: বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৯৭), শতবর্ষের ফেরারী: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়(১৯৯৭), শান্তিচুক্তি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ (১৯৯৮), বাঙালি জাতি এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র (২০০১), উপলক্ষের লেখা (২০০১), আমার কথা ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০২), সেইসব লেখা (২০০৮), সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস (১৯৭৯),
উপন্যাস- সূর্য তুমি সাথী (১৯৬৭), ওঙ্কার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), মরণবিলাস (১৯৮৯), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (আত্মজৈবনিক প্রেমের উপন্যাস,১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), সৃজনশীল জীবনী- যদ্যপি আমার গুরু (১৯৯৮),
অনুবাদ- তানিয়া (মূল: পি. লিডভ) (১৯৬৭), সংশয়ী রচনা: বার্টাণ্ড রাসেল (১৯৮২), ফাউস্ট (মূল: ইয়োহান ভোলফ্‌ গাঙ ফন গ্যোতে) (১৯৮৬), কবিতা- জল্লাদ সময় (১৯৭৫), দুঃখের দিনের দোহা (১৯৭৫), একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা (১৯৭৭), লেনিন ঘুমোবে এবার (১৯৯৯), আহিতাগ্নি (২০০১) গল্পসংগ্রহ- নিহত নক্ষত্র (১৯৬৯), কিশোর গল্পসমগ্র-দোলো আমার কনকচাঁপা (১৯৬৮), শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ- গো-হাকিম (১৯৭৭)।
আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আহমদ শরীফের নেতৃত্বে বাংলাদেশ লেখক শিবির গড়ার মুখ্য ভূমিকাও পালন করেন তিনি। মুক্ত-স্বাধীন স্বদেশভূমিতে প্রগতির তরুণ সৈনিকদের অভ্যুদয় ছফার কাঙ্ক্ষিত ছিল। এজন্য বিভিন্ন সময়ে তিনি নিজে আরও মানববাদী সংগঠন গড়ে তোলেন কিংবা প্রতিবাদী ও প্রগতিশীল সংগঠকের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। তার জীবদ্দশায় দেশের সুপ্রতিষ্ঠিত নবীন প্রবীণ বেশিরভাগ লেখকেই তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে সহযোগিতা পেয়েছেন । তার অবদানে বাংলা সাহিত্যে অনেক কবি লেখক নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল হয়েছেন।  শুধুমাত্র তিনিই চিরকাল অবহেলিত রয়ে গেল ।
মহাত্মা আহমদ ছফা সম্পর্কে বাংলাদেশের প্রায় জ্ঞানসাধকগণ অনেক উঁচু মন্তব্য করেছেন তার মধ্যে গণবুদ্ধিজীবী ড. সলিমুল্লাহ খাঁনের মতে, “মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা”। আবুল ফজলের মতে, “ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫ সালে প্রকাশিত) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ।” আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের মতে, “ছফা গল্প বলার কলা অল্পবয়সেই রপ্ত করেছিলেন। তাই পাঠকরা তাঁর ডাকে সাড়া দেয়।” জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, “ছফার রচনাবলী গুপ্তধনের খনি এবং তাঁর সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে যে জগতে যে কোন পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।” 

আহমদ শরীফ ছফাকে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে, “সুবিধাবাদীর ‘Life is a compromise’ তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমন স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।”

এই কীর্তিমান ২০০১ সালের ২৮ জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেওয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়। পদ পদবী বিমুখ, প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ‘লেখক শিবির পুরস্কার’ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ সালে ‘ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার’ ও ২০০২ সালে ‘মরণোত্তর একুশে পদক’ এ ভূষিত হন আহমদ ছফা।

 

মাসুদ পারভেজ 
আগ্রাবাদ  চট্টগ্রাম

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top