সিডনী শুক্রবার, ২০শে সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ই আশ্বিন ১৪৩১

বিষাদের সাথে একটি দিন : তাপস বড়ুয়া


প্রকাশিত:
৭ জুলাই ২০২০ ২৩:১৮

আপডেট:
১৮ জুলাই ২০২০ ২৩:২২

তাপস বড়ুয়া

 

আজ ফেব্রুয়ারীর এক তারিখ। চাকরি না থাকার একমাস পূর্ণ হয়েছে গতকাল। সারা মাস অফিসে যাই নি। বাসার কাজের লোক, বাড়ীর দারোয়ান কে কী ভাবছে কে জানে। গত রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আজ থেকে অফিস যাওয়ার মতো বেরোবো সকালে; আসবো বিকেলে। সেই মত সকালে সেভ করে, ¯œান সেরে, নাস্তা করে ফিটফাট হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য শাহবাগ। পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে বই পড়ে কাটিয়ে দেবো একটা কর্ম-দিবসের সবটুকু সময়।
শাহবাগে বাস থেকে নেমে দেখি জাতীয় কবিতা উৎসবের ব্যানার। ভাবলাম আগে ওখানেই যাবো। ত্রিশতম জাতীয় কবিতা উৎসবের আজ উদ্বোধন। আমি যখন উৎসব প্রাঙ্গণে পৌঁছালাম তখন উদ্বাধনী ভাষণ দিচ্ছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক।
এবারের প্রতিপাদ্য, “কবিতা শান্তির, কবিতা মৈত্রীর”। এই বিষয়েই আলোচনা শুরু হলো উদ্বোধনের পরপর। তখন আলোচনা করছেন কলকাতার শঙ্করলাল ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার নিয়ে অডিটোরিয়াম থেকে বেরোনোর মুহুর্তে একজন মা তার হাতে একটি কাগজ দিয়ে বলেছিলেন, আমার ছেলে যুদ্ধে যাওয়ার সময় তার পকেটে এই কাগজটা নিয়ে গিয়েছিলো। তাতে তোমার কবিতা লেখা। সে আর ফিরে আসে নি। মৃতদেহের পকেটে কাগজটা পাওয়া গেছে। কাগজে ইংরেজী অনুবাদে লেখা ছিলো, “যাবার দিনে...”
শুনছিলাম। পাশের ফাঁকা চেয়ারে কেউ একজন এসে বসলেন। তাকিয়ে দেখি, বসেছেন বিশ বছর ধরে অনেকবার দেখা কিন্তু পরিচয় না থাকা একজন মানুষ। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, এখান থেকে বিশ বছর আগে, তখন থেকেই তাকে দেখে আসছি। বগলে রেক্সিনের ফাইল, সামনে একটু ঝুঁকে হাটছেন তিনি। সাধারণত বাম বগলে ফাইলটি থাকতো। আর ঘাড়টা সামান্য বাঁকানো থাকতো বাম দিকে। আমি জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র ছিলাম। তিনি জগন্নাথ হলে কোন ছাত্রের কাছে থাকতেন ‘গেস্ট’ হয়ে। ঢাকা শহরে বিনা খরচে ভাল পরিবেশে থাকার জন্য অনেকে এরকম আসেন। দু’চারদিন থাকেন; কাজ সেরে চলে যান। তখন ওনাকে অনেকবার দেখেছি। ফাইল বগলে ঘাড় কাৎ করে সামনে ঝুঁকে হাঁটছেন সামান্য দুলুনি দিয়ে দিয়ে। আমি ভাবতাম তার হয়তো হাইকোর্টে কোন কাজ আছে। মামলা মোকদ্দামা চালানোর জন্য আসতে হয়। অথবা তিনি হয়তো বেসরকারী স্কুল বা কলেজের শিক্ষক। শিক্ষাভবনে বা নায়েমে কাজ থাকে। আসলে তিনি কে, কেন এখানে থাকেন, ফাইল বগলে করে কোথায় যান, জানা হয় নি কখনোই। চুপচাপ, কখনো আপন মনে ঠোঁট নাড়তে নাড়তে নি:শব্দে কথা বলতে বলতে তিনি হাঁটতেন জগন্নাথ হলের দক্ষিণ পাশের পাঁচিলের গা-ঘেষা ফুটপাথ দিয়ে। ঢাকার অফিসে কাজবাজ সংক্রান্ত ধারণা ছাড়াও লোকটি সম্পর্কে আমার দু’টি ধারণা জন্মেছিলো। এক. তিনি টাকা পয়সার সমস্যায় থাকেন, তার কোন চাকরি বাকরি নেই; দুই. তিনি তার মত থাকতে ভালবাসেন, তার যাবার কোন জায়গাও নেই; তাই পথে পথে হেঁটেই সময় কাটান।
এক ধরনের মনখারাপ হতো তাকে দেখলে। আশির দশকে গ্রামে কিছুটা লেখাপড়া জানা কিন্তু কাজ না থাকা কৃষ্ণ মামাকে দেখেছি। জমিজমা তেমন ছিলো না, চাকরি বাকরিও ছিলো না। গরীব মানুষের গ্রামে টিউশনিও ছিলো না। খেয়ে না খেয়ে থাকতেন পরিবার নিয়ে। তারপর একদিন পৈত্রিক ভিটেটুকু বেঁচে দেশ ছাড়েন। শুনেছি, ওখানে গিয়ে কয়লা ফেরি করতেন বাড়ি বাড়ি। এখানে ওটা করা তার জন্য একটু কঠিন ছিলো। যদিও শেষ দিকে অন্যের জমিতে দিনচুক্তি শ্রমিক বা কিষেণ হিসেবে তাকে কাজ করতে দেখেছি।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরোনোর পাঁচ-ছয় বছর পরে জগন্নাথ হলের পাঁচিল ঘেঁষা ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা সেই লোকটির সাথে আবার দেখা। আমি তখন একটি এনজিও-তে কাজ করি। আমরা সেমিনার আয়োজন করেছি প্রেসক্লাব অডিটোরিয়ামে। সেখানে তাকে দেখলাম এক কোনায় বসে লাঞ্চ করছেন। আমি নিশ্চিত ছিলাম, তিনি অনাহুত। সেমিনারের মতো অনুষ্ঠানে এরকম অযাচিত কিছু লোক কখনো কখনো ঢুকে পড়েন। সেমিনার ব্যাগ আর খাবার থাকে তাদের লক্ষ্য; সাথে যাতায়াত ভাতা। এখন আমার মনে হচ্ছে, সময় কাটানোও হয়তো একটা উদ্দেশ্য থাকে কারো কারো। আমাদের এক সহকর্মী তাকে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলেন কিছু একটা, আমি তাকে ডেকে সরিয়ে নিয়ে আসি। কিন্তু ওনার দিকে খেযাল রাখি। অত্যন্ত যতœ করে তিনি খেয়েছিলেন। শেষে প্যাকেটের একেবারে নিচে থেকে যাওয়া দু একটি ভাতও তিনি বুড়ো আঙুল আর তর্জনীর চিমটিতে ধরে খেয়েছিলেন সেই দৃশ্য আমার মনে আছে। এসব অনুষ্ঠানে প্রায় প্রতিটি প্যাকেট থেকেই খাবার নষ্ট হয়; আধখাওয়া ফেলে দেয়া হয়। সেখানে তার যতœ করে শেষ ভাতটি খুঁটে খাওয়া আমার মনে গেঁথে আছে।
আজ তিনি আমার পাশে এসে বসেছেন। সময়ের ব্যাবধানে চুলগুলো পাকা। সদ্য ছাটিয়েছেন। ক্লিন শেভড। আজ হাতে সেই ফোল্ডারটি নেই; একটা চটের ব্যাগ। কোন সেমিনার বা ওয়ার্কসপের স্টিকার সাঁটা তার উপরে। কাঁধে ঝুলানো। বাম হাতে ধরা বাদামের ঠোঙা। টুক টুক করে বাদাম খাচ্ছেন। চাইলে কথা বলতে পারি। জেনে নিতে পারি এতদিন তিনি কী করছেন এখানে, কে তিনি। জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয় না। তাকে নিয়ে এতদিন আমার যে ধারণা, যে ছবি, সেটাকে নিজের মনেই রাখতে চাই। আজ তো আরো বেশি। আজ তারও কাজ নেই; আমারও নেই। কবিতা উৎসবে যেখানে আয়োজকরাই আছে কম সংখ্যায়, সেখানে আমরা দুজন সকাল থেকেই আছি বসে। “আমার আজ কোথাও যাবার নেই; কিচ্ছু করার নেই।” তিনি কথা বলেন না আমার সাথে। কিন্তু আমার দিকে একটা বাদাম এগিয়ে দেন। অন্যদিন হলে হয়তো নিতাম না; ভদ্রতা করে শুধু বলতাম ‘থ্যাংক ইউ’। আজ বাদামটা নিলাম।
কোন কথা নেই দু’জনের মধ্যে। কিছুক্ষণ পরে তিনি উঠলেন; আমিও উঠলাম। তিনি, দেখলাম, একটু সামনের সারির দিকে এগোচ্ছেন। এখানে গায়ে রোদ পড়ছিলো বলে হয়তো। আমি পেছন দিয়ে বেরিয়ে এলাম। প্রায় একটা বাজে। কিছু খাবো এতদিনের অভ্যাস সময় ধরে লাঞ্চ করা। ক্যাম্পাসের হাকিম চত্বর বা লাইব্রেরির সামনের দোকানগুলো দেখে ঠিক খাবার ইচ্ছে জাগে না। ভাবলাম, তাহলে পাবলিক লাইব্রেরিতে যাই। ওখানকার ক্যান্টিনে খাবার খেয়ে বাকী সময়টা ওখানে বসে কিছু পড়বো টড়বো। বিকেল হলে বাসায় যাবো।
পাবলিক লাইব্রেরিতে এসে ক্যান্টিনে খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না। গত অনেক বছর যাবৎ অভিজাত দোকান ছাড়া বাইরে থেকে চা-ও খাই নি। মূলত বাসা থেকে নিয়ে যাওয়া লাঞ্চ খেয়েছি দুপুরে। এসব খাবার জায়গাগুলো অপরিচিত লাগে। একটা স্যান্ডউইচ আর একটা পেপসি নিই। দাম দিতে গিয়ে অবাক -- মাত্র একচল্লিশ টাকা। আবার সেই উল্টো ভাবনা মনে আসে, এত কম দাম, নিশ্চয়ই খাবার খারাপ, অপরিচ্ছন্ন জায়গায় বানানো। এসব ভাবতে ভাবতে পাবলিক লাইব্রেরির দোতলায় উঠি। পাঠকক্ষে যাওয়ার আগে একটা ফ্রি ইন্টারনেট ক্যাফে। সেখানে মেইল চেক করি। সকালে বাসা থেকে বেরোনোর সময় মেইল চেক করে এসেছি। তবু আশা, এরপরে কোন অফিস থেকে কোন মেইল এলো কিনা। দরখাস্ত করা আছে বেশ কয়েকটা। দ’ুটোতে ভাইভাও দিয়েছি।
না কোন মেইল নেই। আমি পাঠকক্ষের দিকে পা বাড়াই। ঘুরে ঘুরে প্রত্যেকটা ‘আইল’ ধরে হাঁটি। বসার যায়গা নেই কেথাও। একটা চেয়ারও খালি পাই না। তবু দুটো বই নামাই। আবার হাঁটি বিভিন্ন টেবিলের পাশ দিয়ে। কোথাও খালি নেই। সম্ভবত বিসিএস বা এরকম প্রতিযোগিতামূলক কোন পরীক্ষা আছে সামনে। তার প্রস্তুতি নিচ্ছে প্রায় সবাই। সবাই চাকরি খুঁজছে। বই পড়ে সময় কাটাবো সেই জায়গাও নেই। যেন বনফুলের লেখা সেই গল্পের মত অবস্থা যেখানে দু’জন বেকার মানুষের মধ্যে প্রতিযোগীতা চলে কে আগে এসে পার্কের বেঞ্চিটা দখল করবে।
আবার কবিতা উৎসবের যাবো বলে হাঁটতে শুরু করি। পাবলিক লাইব্রেরির গেট দিয়ে রেরোনোর মুখে সামনা সামনি পড়ে যায় সুমন আর অনিক। ছাত্রজীবনের বন্ধু। বছর পনেরো কোন দেখা নেই। ফেসবুকের কল্যানে সুমনের চেহারাটা ভুলিনি। সুমন আর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বিভাগে পড়তাম। অনিক ওর ছোটবেলার বন্ধু, পড়তো জগন্নাথ কলেজে। কিন্তু যোগাযোগ তার আড্ডা ছিলো আমাদের সাথে। তার চুল পেকেছে। শরীর ভেঙ্গেচুরে গেছে। সুমন সাথে না থাকলে অনিককে চেনা কঠিন হতো। প্রাথমিক উচ্ছাসের পর অনিক জিজ্ঞেস করে, ‘তুই কোথায় আছিস।’ আমার হয়ে সুমনই বলে দেয়, ‘ও তো বিগ শট, ইউএনডিপিতে’। আমিও বলি, ‘ইউএনডিপির একটা প্রজেক্টে আছি।’ তাদের কথা বলার ধরনে আমি বলতে পারি না যে এখন আমার কোন চাকরি নেই। যে প্রজেক্টে আমি কাজ করছিলাম, সেটা শেষ হয়ে গেছে একমাস আগে। অনিককে জিজ্ঞেস করি, ‘তুই কি দেশ টিভিতে?’ ও বলে, ‘না গাজী টিভিতে ছিলাম। দু’মাস ধরে কোথাও নেই রে।’ কথাশেষের ‘রে’ শব্দটি আমাকে ভীষণভাবে ছুঁয়ে যায়। এতবছর এতবড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করার পরেও বেকারত্বের সামাজিক ও আর্থিক চাপ যে কতটা মারাত্মক তা আমি গত একমাসেই বুঝেছি। ‘ভিতরে যাবি?’ আমি জিজ্ঞেস করি। ‘না তেমন ঠিক নেই কিছু। তুই যাচ্ছিস কোথায়?’ আমি বলি, ‘ভেতরে বসার জায়গা নেই তাই বেরিয়ে এলাম; চল কবিতা উৎসবে যাই।’ ‘চল।’
আমি ওদের সাথে আবার এসে অনুষ্ঠানস্থলে বসি। একথা সেকথা বলি। আমাদের ছাত্রজীবনের কবিতা উৎসবে রাত পর্যন্ত বসে থাকার গল্প হয়। এরই এক ফাঁকে ভাবলাম সুমনকে জিজ্ঞেস করি তার পত্রিকার সাহিত্য পাতায় গল্প প্রকাশের কোন সুযোগ আছে কি না। আজকাল গল্প লিখছি। একটিও কোথাও ছাপানোর জন্য নির্বাচিত হচ্ছে না। ইংরেজিতে লেখক কম এদেশে। অনুবাদ করে ইংরেজী কাগজে দিলে যদি প্রতিযোগিতা কমে। জিজ্ঞেস করি, ‘তুই তো ইন্ডিপেন্ডেন্ট-এ?’ ‘-ছিলাম।’ ‘এখন?’ ‘কোথাও নেইরে।’ একটু থেমে বলে, ‘দু’এক জায়গায় কথা হচ্ছে; দেখা যাক।’ আমি কথা বাড়াই না।
##

 

এই লেখকের অন্যান্য লেখা



আপনার মূল্যবান মতামত দিন:


Developed with by
Top